সংবাদমাধ্যম শুধু জনগণের প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, তার বর্তমান ও ভবিষ্যতের জীবনেরও অনেক কিছু তার ওপর নির্ভর করে। গণমাধ্যম বা সংবাদমাধ্যম বা মিডিয়া যার মধ্যে সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও অন্তর্ভুক্ত সেগুলোর প্রতি তাই একটি দেশের নাগরিকদের বড় ধরনের প্রত্যাশা থাকে। মানুষ প্রত্যাশা করে গণমাধ্যম প্রকৃত খবর প্রকাশ করবে, দেশ ও মানুষের সমস্যা বিশ্লেষণ করবে, সমাজ অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট বিষয় অনুসন্ধান করবে এবং প্রকৃত সত্য তুলে আনবে।
সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতির স্বরূপ অন্বেষার পাশাপাশি মানুষের অধিকার হরণ, বৈষম্য নিপীড়নের খবর তুলে ধরবে এবং গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য যে ধরনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ব্যবস্থা থাকা দরকার, তার পক্ষে মত তৈরি করবে। নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও বাংলাদেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যম জনগণের এসব প্রত্যাশা পূরণ করার অবস্থায় নেই বরং অনেক ক্ষেত্রে তার বিপরীত ভূমিকাই দেখা যায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বাধীন সাংবাদিকতা বা স্বাধীন সংবাদপত্র কথাগুলো তাই খুব কৃত্রিম শোনায়। সংবাদমাধ্যমের পরিচালনা বা কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সংবাদমাধ্যম বা টেলিভিশনের মালিকানা এখন কতিপয় বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত। বাংলাদেশের এই বৃহৎ করপোরেট গোষ্ঠীর ইচ্ছা, পরিকল্পনা, প্রয়োজন, অগ্রাধিকার, সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ইত্যাদির ওপর সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা নির্ভর করে। তাদের পাশাপাশি সরকার যখন স্বৈরতন্ত্রী তখন তাদের বেআইনি চাপ, হস্তক্ষেপ এবং আইনি প্রতিবন্ধকতাও গণমাধ্যমের ভূমিকা নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করে।
এর বাইরে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সংবাদমাধ্যমের সম্পাদক ও সাংবাদিকদের অবস্থান। তারা সংবাদমাধ্যমকে কীভাবে দেখতে চায়, নিজেদের কী ভূমিকা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, শুধু চাকরি না সাংবাদিক হিসেবে সম্মানজনক অবস্থান এগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই ভূমিকার পার্থক্যের কারণে, মানে শুধু মালিক বা সরকারের কারণেই নয়, সাংবাদিক বা সম্পাদকের কারণেও সংবাদমাধ্যমের পার্থক্য তৈরি হতে পারে। আমরা জানি মিডিয়ার মধ্যেও লড়াই থাকে, সেখানে যেমন দাসানুদাস থাকতে পারে, তেমনি থাকতে পারে দায়িত্বশীল মানুষ। যেমন থাকতে পারে লোভী সুবিধাবাদী লোক, তেমনি থাকতে পারে আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন প্রকৃত সাংবাদিক।
সংবাদপত্র বা টেলিভিশন বা সংবাদ চ্যানেল এখন যেসব বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতে তাদের অনেকেই প্রত্যক্ষভাবে ঋণখেলাপি, ব্যাংক লুটের কারিগর, ভূমিদস্যু হিসেবে পরিচিত। তারা বিভিন্ন স্থানে বন, নদী, জমি দখল করছে; তারা দুর্নীতিযুক্ত বিভিন্ন প্রকল্পের অংশীদার, দেশে লুণ্ঠন ও সম্পদ পাচারের সুবিধাভোগী।
এ ধরনের গোষ্ঠীগুলো যখন সংবাদমাধ্যমের মালিক হয় তখন আমাদের বুঝতে কষ্ট হয় না যে, এসব মাধ্যম কী ধরনের কাজে ব্যবহৃত হয়। তবে কখনো কখনো দুই বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত দেখা দিলে তাদের ঝগড়াঝাটির কারণে দুই গোষ্ঠীর অপতৎপরতার কিছু খবরাখবর প্রকাশিত হয়। কিন্তু তা খুব স্বল্পস্থায়ী হয়, কেননা তাদের মধ্যে বিরোধের চেয়ে স্বার্থের ঐক্যই বেশি। সেজন্য বিরোধের সময় জনগণ কিছু সত্য তথ্য পায়, কিন্তু দিন শেষে তারা আবার এক হয়ে জনবিরোধী অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়।
সাধারণভাবে দেখা যায়, এ ধরনের সংবাদমাধ্যম কিছু গোষ্ঠীর ক্ষমতা বিস্তারে কিংবা সম্পদ অধিকতর আহরণের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ওই সংবাদমাধ্যমে যারা কাজ করেন তারা যদি আত্মসমর্পণের লাইন গ্রহণ করে, তারাও তখন এ অংশের একটা সক্রিয় বাহিনীতে পরিণত হয়। আর তাদের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক থাকে পারস্পরিক সহযোগীর।
এখন দেশে যারা চোরাই সম্পদ বানাচ্ছে, যারা ক্ষমতার চর্চা করছে কিংবা বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠী, তারা সরকার-ঘনিষ্ঠ বটেই। সরকারের আশীর্বাদ এবং পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এরকম দ্রুত চোরাই টাকা সংগ্রহ করা বা ক্ষমতার অংশীদার হওয়া সম্ভব নয়। নিজেদের স্বার্থেই তাদের রক্ষা করা সরকার তার দায়িত্ব হিসেবে মনে করে। এমন অবস্থায় সরকারের সহযোগী এসব গোষ্ঠী এবং সরকারের এমপি, মন্ত্রী, আমলাদের এরকম কোনো সংবাদ যাতে প্রকাশ করা না যায়, সেজন্য গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা, হামলা হুমকি ছাড়াও ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামে আইনি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়।
এ আইনগুলো মতপ্রকাশের ন্যূনতম স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে প্রত্যক্ষ ক্ষমতার ব্যবহারের নমুনা। এর বাইরে সম্পাদককে হুমকি দেওয়া, কিংবা সাংবাদিকদের হয়রানি করা, এমনকি সরাসরি তাদের ওপর আক্রমণ করা তো অব্যাহত আছেই। গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে সব প্রতিষ্ঠান বৃহৎ ব্যবসায়ী আর সরকারের পকেটস্থ হলে সংবাদপত্রের শ্বাস নেওয়া কঠিন হয়।
আমরা জানি, বিশ্বজুড়েই সংবাদমাধ্যমের একটি সংকট চলছে। আমরা যদি ফিলিস্তিনের ঘটনা বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব সেখানে অবিরাম গণহত্যা চললেও বিশ্ব মিডিয়া যেমন নিউইয়র্ক টাইমস, সিএনএন সেখানকার ঘটনা ভয়াবহ বিকৃত করে প্রচার করছে। বিশ্বে যত গণহত্যা হয়েছে সেখানে এসব মিডিয়া সহযোগী হয়েই কাজ করেছে। দেখা যায়, প্রতিষ্ঠিত মিডিয়া যেমন নিউইয়র্ক টাইমস, সিএনএন, বিবিসি যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী করপোরেটের পক্ষেই অবস্থান গ্রহণ করেছে। গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা একটি, ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এমন হাজারও উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রেও দেখতে পাচ্ছি, যখন দেশে অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটা ধারাবাহিকতা চলছে, দেশে বৈষম্য বাড়ছে, অর্থনৈতিক সংকট মাত্রাতিরিক্ত তখন কারা এর জন্য সুনির্দিষ্টভাবে দায়ী; যেমন—মন্ত্রী, নেতা, বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যাংক, মন্ত্রণালয় হোক কিংবা ব্যবসায়ী গোষ্ঠী হোক, তাদের ব্যাপারে সংবাদ যথাযথভাবে প্রকাশও করা হয় না। করলে তার জন্য বহুরকম হয়রানির শিকার হতে হয়। টেলিভিশনগুলো তো সরকারের সম্প্রসারিত একটি অঙ্গ হিসেবেই কাজ করছে।
এরকম কঠিন বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে মানুষ বিকল্প সংবাদমাধ্যমের ওপর নির্ভর করছে বেশি। ফিলিস্তিনের ঘটনা আমরা সিএনএন বা নিউইয়র্ক টাইমসের ওপর ভিত্তি করে বসে থাকছি না। বিকল্প সংবাদমাধ্যমের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা আমাদের সামনে সত্য-মিথ্যা বিষয়গুলো আরও বিস্তৃতভাবে তুলে ধরছে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমের শক্তিশালী জায়গা তৈরি হচ্ছে।
মূলধারার মাধ্যমে সত্যি খবর গায়েব করে দেওয়ার পাশাপাশি মিথ্যা খবর আর সরকারের বিজ্ঞাপনী প্রচারই প্রধান তৎপরতা। এ ক্ষেত্রে সত্যি-মিথ্যা খবর পর্যালোচনা করার শক্তি অর্জন না করে আমাদের কোনো পথ নেই। কোন সংবাদ সঠিক, কোন সংবাদ সঠিক নয়, কোনটি ব্যবসায়িক, সরকার বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রোপাগান্ডা, কোনটি বাস্তবভিত্তিক তা আমাদেরই বুঝতে হবে। মিথ্যা প্রচারণার শিকার হতে না চাইলে বিকল্প প্রচারমাধ্যমকে শক্তিশালী করতে হবে। এর জন্য নাগরিকদের সচেতন সজাগ ভূমিকার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ: শিক্ষক, লেখক এবং ত্রৈমাসিক জার্নাল সর্বজনকথার সম্পাদক