বয়স পঁয়ষট্টি পেরুলে সঞ্চয় হয়ে ওঠে মূল সম্বল। তাই তার মূল্যমান রক্ষা করা একান্তই জরুরি হয়ে ওঠে। সেই বয়সের বাংলাদেশিদের স্বার্থে এই নিবন্ধটি, যদিও অনেক তরুণ সঞ্চয়কারীদের জন্য বিষয়টি প্রাসঙ্গিক হতে পারে। একইসঙ্গে তিনটি ক্ষেত্র বা বিভাগের কর্মকাণ্ডে সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যেও নিবন্ধ শেষে কিছু পরামর্শ রয়েছে। যে ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এই নিবন্ধটি রচিত, তার বর্ণনা শুরুতেই করছি।
প্রেক্ষাপট
১. জনৈক ব্যক্তি ও তার স্ত্রীর নামে যৌথ মালিকানায় একটি বসবাসযোগ্য ফ্ল্যাট রয়েছে। সেখান থেকে ভাড়া বাবদ প্রাপ্ত আয় বছর শেষে প্রতিজনের আয়কর হিসাব জমায় (রিটার্ন্স-এ) অর্ধেক করে দেখানো হয়। অতীতে পরিবারের সম্পত্তিতে কে কত টাকা দিল, তা রিটার্ন্সে উল্লেখ থাকলেই যথেষ্ট ছিল, তার ভিত্তিতে সম্পত্তির অংশ নিরূপিত হতো না। সম্পত্তি রেজিস্ট্রিকালে যৌথ মালিকানা দেখানো হলে (৫০:৫০) সেই সম্পত্তি থেকে আয়ের বণ্টনে একই রীতি প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে পর্যাপ্ত প্রজ্ঞা না থাকায়, আমরা ব্যক্তি ও পরিবারকে দুই স্তরে সম্পৃক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছি। সম্ভবত সে কারণেই আমরা যান্ত্রিকভাবে চিরচরিত সামাজিক সংগঠন (পরিবার)-এর অস্তিত্ব খর্ব করে ব্যক্তিকে সরাসরি বাজার ও সরকারী কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করার প্রয়াসে লিপ্ত। তাই, দেশের কৃষ্টি ধর্তব্যে না এনে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মতো আমরা একই পরিবারের সদস্যদের যৌথ-মালিকানাধীন সম্পত্তির স্বত্ব প্রতিজনের প্রাথমিক অর্থদানের ভিত্তিতে বিভাজনের চেষ্টা করি। তবে অনস্বীকার্য, নমিনিব্যবস্থা অথবা যৌথ-মালিকানাধীন আর্থিক সম্পদের (যেমন : যৌথ ব্যাংক অ্যাকাউন্টে গচ্ছিত অর্থ) উত্তরাধিকার নির্ণয়ের ব্যাংক আইনকেন্দ্রিক রীতি, ওয়ারিশভিত্তিক উত্তরাধিকার নীতির সঙ্গে সর্বক্ষেত্রে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
২. যে দেশে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানে ‘সামাজিক নিরাপত্তা’ কর্মসূচিতে অঢেল সম্পদ বিতরণ করতে সক্ষম নয়, অথবা আর্থিকভাবে সক্ষমদের নিরাপত্তা বিধানে উপযুক্ত (বাজারনির্ভর) বিমা প্রবর্তন ও তার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারছে না বা সমাজ ও পরিবার পর্যায়ে পরস্পরকে দেখবার কৃষ্টির অধঃপতন রোধ করতে ব্যর্থ হয়, সেসব দেশে ভাগ্যবানরা অতিরিক্ত সম্পত্তি সঞ্চয় করে তার আয়ের মাধ্যমে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হন। একাধিক কারণে স্থাবর অথবা অস্থাবর সম্পত্তির মালিকানা ব্যক্তির সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার ক্ষেত্রে ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে। অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির ফলে সমাজে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, যা অনেক সময় আইনি মালিকানা স্বত্বকে ভঙ্গুর করে। এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি সরকারের অর্থপ্রাপ্তি যতখানি নিশ্চিত করতে সক্ষম, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে, সমমাত্রায় সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে পারে না। দক্ষ ও সৎ কর্মীর অভাবে ব্যক্তির তথ্য নিরাপত্তা হুমকিতে থাকে, যা সব প্রকারের সম্পদের মালিকানা স্বত্বকে ভঙ্গুর করে তোলে। তথ্যপ্রযুক্তি থেকে উপযোগিতা নিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি প্রয়োজন, যা রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৃঢ়তার ওপর নির্ভরশীল।
৩. তথাকথিত আধুনিক সমাজে সম্ভবত সর্বাধিক ঝুঁকিতে থাকে আর্থিক সম্পদ। শেয়ারবাজার পুঁজি তৈরি থেকে বহু দিন অব্যাহতি নিয়েছে এবং দুঃখজনক হলেও সত্য যে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে জুয়ার তাড়না দিয়ে আকৃষ্ট করতে হয়, যা ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীর (বিনিয়োগকারীর) ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। আর্থিক খাতে সহজপ্রাপ্য বিকল্প হলো ব্যাংকে সঞ্চয়ী আমানত (ডিপোজিট) এবং নানা প্রকারের দীর্ঘ-মেয়াদি সঞ্চয়। শেষোক্তটির মাঝে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের বিবিধ সঞ্চয়পত্র অন্তর্ভুক্ত। দুটো খাতের সঙ্গে যুক্ত ঝুঁকির প্রকৃতি ভিন্ন, যা নিম্নে পৃথকভাবে উল্লেখ করা হলো।
৩(ক) ব্যাংকে আমানত রাখার জন্য গ্রাহককে সুদ অথবা ভিন্ন কোনো নামে অর্থ প্রদান না করে আজকাল আমানত রক্ষা ও অন্যান্য সেবার নামে (ব্যাংক কর্তৃক) নিয়মিত কর্তন স্থায়ী চর্চায় পরিণত হয়েছে। সেইসঙ্গে আছে সরকারের (কর ও রাজস্ব বিভাগের) নানা অজুহাতের কর্তন। এসবের সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতি যোগ করলে ব্যাংকে রাখা আমানত থেকে প্রাপ্তি ঋণাত্মক—অর্থাৎ, ব্যাংক আমানত হিসেবে সঞ্চিত অর্থের পরিমাণ ও তার মূল্যমান প্রতিনিয়ত কমছে।
৩(খ) ব্যাংক দেউলিয়ার ফলে আমানতকারীর কী ধরনের বিপর্যয় আসতে পারে, সে আলোচনা করব না। তবে, অ্যাকাউন্টধারীর মৃত্যুর পর সমুদয় অর্থ পেতে পরিবারের সদস্যদের অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বিশেষত, আমানতকারীর মৃত্যুর পর ব্যাংকে গচ্ছিত সমুদয় অর্থ পেতে ওয়ারিশদের পাওনা এবং নমিনির অধিকার নিয়ে মাঝে মধ্যে বিচারকদের সংশয় জাগে (৮ জানুয়ারি ২০২৩ সালের বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে প্রকাশিত আরিফুর রহমানের ‘Nominee or heir: Who is entitled to receive the money of the deceased?’ এবং ২৯ এপ্রিল ২০১৭ তারিখের ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসে নিরঞ্জন রায়ের নিবন্ধটি দ্রষ্টব্য)। তদুপরি, অনেক ক্ষেত্রে নমিনির তথ্য পূর্ণাঙ্গভাবে রক্ষণাবেক্ষণে অবহেলা থাকে এবং আমার জানামতে, কোনো ব্যাংকই অ্যাকাউন্টসংক্রান্ত তথ্য-সংবলিত কোনো সনদ গ্রাহককে দেয় না। যেভাবে আমরা বিশ্বাসের বশে কাগজের টুকরোকে বিনিময়যোগ্য অর্থ হিসেবে গণ্য করি, একইভাবে ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেনে বিশ্বাসের উপস্থিতি মুখ্য ভূমিকা রাখে। তবে সেই বিশ্বাসের ফলে কাগজপত্রে অসম্পূর্ণতা থাকে যা আমানতকারী ও তার নমিনি বা উত্তরাধিকারদের জন্য ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। এসব বিষয়ে তথ্যভিত্তিক গবেষণা, লেখকের জানামতে, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে অনুপস্থিত। যেসব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বিগত দশ বছরে দাবিবিহীন অবস্থায় রয়েছে সেসবে গচ্ছিত অর্থের ব্যাংক-ওয়ারি হিসাব ইন্টারনেটে পাওয়া যায় (ব্যাংক প্রতি দুই থেকে ১৫ কোটি টাকা), যদিও দুএকটি ব্যাংকের সাইটে সংযোগ স্থাপন সম্ভব হয়নি। তবে প্রাপ্ত তথ্য থেকে বুঝা সম্ভব নয়—‘দাবিকৃত’ বন্ধ হওয়া অ্যাকাউন্টগুলোর দাবি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা হয়েছিল কিনা। সম্ভবত এটা বললে অত্যুক্তি হবে না, আইনের অস্পষ্টতা এবং অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা অথবা ব্যাংক কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতা না থাকায় আমানতকারীর ইচ্ছাপূরণের ঝুঁকি রয়ে যায়। তাই ব্যক্তি অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে ঝুঁকি এড়ানোর পন্থা হিসেবে অনেকেই যৌথ অ্যাকাউন্ট খোলার পথ বেছে নেয়। অর্থাৎ, অ্যাকাউন্টধারীর যে কোনো একজন অ্যাকাউন্টের যাবতীয় বিনিময় করতে পারবে। এর ফলে যে কোনো যুগলের পক্ষে নমিনি ও ওয়ারিশের ঝামেলা এড়ানো সম্ভব।
৩(গ) কর্মবিরতি-পরবর্তী জীবনের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সঞ্চয়ী আমানত যথেষ্ট নয়। তাই অনেকে অধিক সুদের এবং কম ঝুঁকির দীর্ঘ-মেয়াদি আমানত খোঁজে। শেষোক্তের মাঝে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রকারের সঞ্চয়পত্র তুলনামূলকভাবে আকর্ষণীয়। মাত্র কয়েক বছর আগে, সুদের হার কমানো ছাড়া, সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে দুটো উল্লেখজনক পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রথমত, সঞ্চয়ের মোট পরিমাণের সঙ্গে প্রান্তিক সঞ্চয়ের ওপর সুদের হারে পরিবর্তন। অর্থাৎ, ১৫ লাখ টাকা সঞ্চয়ের জন্য একজন যে সুদ পাবে, ১৫ থেকে ৩০ লাখ অবধির জন্য তার কিছুটা কম পাবে এবং ৩০ লাখের অধিক সঞ্চয়ের জন্য সুদের হার আরও কম থাকবে। সব গ্রাহকদের পক্ষে এর নিখুঁত হিসাব নজরে রাখা দুঃসাধ্য হতে পারে। যেহেতু সাদামাটা প্রোগ্রাম দিয়ে এটা নির্ধারণ সম্ভব, অনুমান করছি, এ ব্যাপারে সুদহার নির্ধারণে কোনো ত্রুটি নেই। দ্বিতীয় পরিবর্তন এসেছে একক বা যৌথ ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে একক বা যৌথ নামে করা সঞ্চয়পত্রের যোগসূত্রতা স্থাপন। যৌথ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে চেক দিয়ে একজন পূর্বে একক নামে সঞ্চয়পত্র কিনতে পারত—যার আসল ও সুদ ওই যৌথ অ্যাকাউন্টে জমা পড়ত। নতুন নিয়মে সেটা আর সম্ভব নয়। সে কারণে, যৌথ অ্যাকাউন্ট থেকে হয় যৌথ নামে সঞ্চয়পত্র কিনতে হবে, অন্যথায় একক নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে একক নামে সঞ্চয়পত্র কিনতে হবে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সঙ্গে আলাপে বুঝেছি, একক নামে সর্বাধিক ৫০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে এবং যৌথ নামে সর্বাধিক ১ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে। কিন্তু কিছু কিছু ব্যাংক, সম্ভবত হিসেবের জটিলতার কারণে, এই সুযোগ দিতে রাজি হয় না। একটি নির্দিষ্ট যুগলের জন্য একক অথবা যৌথ নামে ক্রয় করা সঞ্চয়পত্রের সর্বমোট মূল্য সর্বোচ্চ সীমার ভেতরে রাখা নিশ্চিত করা সম্ভব। কিন্তু একজন চতুর গ্রাহক নিয়মের বেড়াজাল পেড়িয়ে অন্য কোনো (নিষ্ক্রিয়) ব্যক্তির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে সঞ্চয়ের মাত্রা ১ কোটি পর্যন্ত করতে পারেন। মনে প্রশ্ন জাগে, এ জাতীয় চতুরতা ঠেকানোর জন্যই কী জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে সঞ্চয়পত্রের একক বা যৌথ স্বত্বা বেঁধে দিতে চাইছে। লক্ষণীয়, এ ব্যাপারে (আমার জানামতে) কোনো লিখিত নির্দেশ আসেনি এবং ব্যাংকগুলো কোনো সদুত্তর দিতে পারে না।
এ পরিপ্রেক্ষিতে, কর-বিভাগের সম্পত্তি বিভাজনে যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি স্মরণীয়—সঞ্চয় মানেই (আর্থিক) সম্পদ সৃষ্টি যা করদাতার আয়-ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। যৌথ নামে সঞ্চয়পত্র কিনলে তাকে বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করা হবে এবং দুজনের কার কত অংশ তা উল্লেখ করতে হবে। আমার সংশয় যে একজনের ১০০% এবং অন্যজনের ০% অবদান দেখালে হিসাববিজ্ঞানে পারদর্শী করবিভাগের কর্মকর্তাদের দৃষ্টিতে তা ‘যৌথ’ হিসেবে গণ্য হবে না!
সমস্যা পুনঃব্যক্ত এবং তা সমাধানে কয়েকটি প্রস্তাব
তথ্য-মজুত ও তা বিশ্লেষণে পরিবার নামক কোনো স্তর থাকা উচিত কিনা ভেবে দেখা প্রয়োজন এবং সেই অনুযায়ী তথ্য-কাঠামো ও তথ্য-প্রক্রিয়াজাতের (সফটওয়্যার) প্রোগ্রাম রচনা প্রয়োজন। রাষ্ট্রের উপার্জন-সক্ষমতা যথেষ্ট নয় বলে নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পরিবার ও অন্যান্য সমাজ সংগঠনকে কার্যকর ভূমিকা রাখবার সুযোগ সৃষ্টি করা জরুরি।
আর্থিক সম্পদের উত্তরাধিকার নির্ণয়ে নমিনি প্রথা ও ওয়ারিশ-ব্যবস্থার যে বৈপরীত্য রয়েছে, আইনে স্পষ্টতা ও সংশোধনী এনে তার নিরসন হওয়া প্রয়োজন।
শুরুতেই আলোচনার কেন্দ্রে রেখেছিলাম বয়স্ক ব্যক্তি, দম্পতি বা পরিবারের একাধিক সদস্য। বাংলাদেশের সমাজ-প্রেক্ষাপটে এদের সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে এযাবৎকাল বিমা খাতের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। তার কারণ অনুসন্ধান না করে ব্যাংকগুলোকে (সদ্য গৃহীত ব্যাংকাস্যুরেন্স নীতির আওতায়) বিমা কোম্পানির এজেন্ট বানালে বিমাব্যবস্থার উন্নতি ঘটবে নাকি ব্যাংক ব্যবস্থার অবনতি ঘটবে এবং সেসবের প্রভাব গ্রাহক-কল্যাণের ওপর কী হবে, তার বিশ্লেষণ ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখছি। নাগরিক স্বার্থ রক্ষার্থে জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর, ব্যাংক ব্যবস্থাপনা এবং কর ও রাজস্ব বিভাগ কী ধরনের নীতি-সমন্বয় করতে পারে, সেই আলোচনা দিয়ে নিবন্ধটি শেষ করব।
সাধারণত, সঞ্চয়ের প্রাথমিক প্রতিষ্ঠানিক রূপ ব্যাংকের আমানত। আমানত খোলাকে এক বা একাধিক গ্রাহকের সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট ব্যাংক শাখার মধ্যকার চুক্তি হিসেবে গণ্য করা যায়, অথচ আমরা তা বেমালুম ভুলে যাই। এ জাতীয় চুক্তিতে দুপক্ষের স্বাক্ষর প্রয়োজন এবং তার একটি মূল কপি গ্রাহকেরও প্রাপ্য। অথচ আমার জানামতে, ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুললে গ্রাহককে যে তথ্য ইমেইল, ফোনে মেসেজ অথবা কাগজে দেওয়া হয়, সেখানে নমিনিসংক্রান্ত কোনো তথ্য থাকে না। উত্তরাধিকারে আইনি জটিলতা যেভাবেই মীমাংসা হোক না কেন, ব্যাংকের পক্ষ থেকে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষরসহ এবং আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য উভয় গ্রাহক ও নমিনির সব তথ্য-সংবলিত কাগজ (দস্তাদি) গ্রাহককে দেওয়া বাধ্যতামূলক হওয়া প্রয়োজন। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এমনটি করা হয়। তবে অনেক ব্যাংক শাখা, আমার জানামতে, গ্রাহকের হাতে ছবি-সিলসহ প্রাপ্তিপত্র দেয় না। জানতে চাইলে ব্যাংকের কেন্দ্রীয় অফিসের নিয়মের দোহাই দেওয়া হলেও এর গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা আজও আমার অজানা। এ ব্যাপারে, জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে পারে এবং উন্মুক্ত সাইটে গ্রাহকদের নালিশ গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। যদি প্রয়োজনীয় নীতিমালা থাকে, তবে তা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে গ্রাহককে (ক্রেতাকে) তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা প্রয়োজন।
আলোচনার শুরুতে একক ও যৌথ নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে সঞ্চয়পত্র কেনার যোগসূত্রের প্রসঙ্গ তুলেছিলাম। একপেশেভাবে একটি বয়স্ক দম্পতিকে উদহারণ হিসেবে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করব। এরা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ভেবে ব্যাংক-ব্যবস্থাকে সঞ্চয়ের কেন্দ্রবিন্দু গণ্য করবে। তাছাড়া, অন্য সব লেনদেনের জন্যও তাদের ব্যাংকের আশ্রয় নিতে হবে। এদের যে কোনো একজনের মৃত্যু-পরবর্তী সম্ভাব্য পরিস্থিতি বিবেচনা করে—এরা যৌথনামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রাখতে চায়। বাধাহীনভাবে সেটা করা সম্ভব যদি আয়কর বিভাগ জানে, এই অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লেনদেন সুনির্দিষ্টভাবে কার আয়-ব্যয় দেখাচ্ছে এবং যদি সঞ্চয় অধিদপ্তরের প্রোগ্রাম দুজন ব্যক্তির কেনা সব সঞ্চয়পত্রের তথ্য বিবেচনা করে সর্বাধিক মাত্রার ভেতরে ক্রয় বেঁধে রাখতে সক্ষম হয়। সত্যি বলতে কী, দুটিই কার্যকর করা সম্ভব। অর্থাৎ, আলোচ্য এই দম্পতির দুজনে একক ও যৌথ মিলিয়ে সর্বাধিক এক কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র কিনতে পারবে এবং তা একক নামে হোক বা যৌথ নামে হোক, যৌথ নামে খোলা অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লেনদেন করতে পারবে। এই রীতি চালু করলে একটি সমস্যা দেখা দিতে পারে। যে উদ্দেশ্যে যৌথ নামে অধিক অর্থের সঞ্চয়পত্র কেনার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, অনেক ব্যক্তি তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে পরিবার বহির্ভূত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে যৌথনাম দেখিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন। যেহেতু সরকারের তথ্যভাণ্ডারে স্বামী-স্ত্রী এবং পিতা-মাতার নাম রয়েছে, উপযুক্ত আইন প্রণয়ন ও প্রোগ্রামের মাধ্যমে অনাকাঙ্ক্ষিত সঞ্চয়পত্র ক্রয় রোধ করা সম্ভব।
শেষ করব দুটো কথা পুনরাবৃত্তি করে। প্রথম, যদি নমিনি প্রথায় আর্থিক সম্পদের উত্তরাধিকার (মৃত্যু-পরবর্তী বণ্টন) নির্ণয় গ্রহণযোগ্য হয়, তার জন্য আইনে প্রয়োজনীয় সমন্বয় ও সংশোধন আনতে হবে। একই সঙ্গে গ্রাহকের হাতে উপযুক্ত আইনি অস্ত্র তুলে দেওয়ার জন্য অ্যাকাউন্ট খোলাকে চুক্তি গণ্য করে, প্রয়োজনীয় তথ্য-সংবলিত চুক্তিপত্রের (প্রমাণাদির) একটি কপি গ্রাহককে (ব্যাংক কর্তৃক) দেওয়া বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। দ্বিতীয়, অনেক ক্ষেত্রে নমিনি প্রথার চাইতে যৌথ অ্যাকাউন্ট খোলা কালিক (টেম্পোর্যাল) নিরাপত্তা বিধানে অধিক কাম্য। তাই ব্যক্তি সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে আইনি জটিলতায় না ঠেলে দিয়ে গ্রাহকদের পছন্দের ক্ষেত্রগুলো উন্মুক্ত রাখা যেতে পারে।
ড. সাজ্জাদ জহির : নির্বাহী পরিচালক, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ
মন্তব্য করুন