পরিবেশ সংগঠন গুলো মিলে প্রতি বছর অনুষ্ঠান হয় পরিবেশ অধিদপ্তর মিলনায়তনে । ২০২৩ সনের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘প্লাস্টিক দূষণ থামাও’। অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধ তৈরির দায়িত্ব পড়ে আমার উপর। অনেককিছু ঘাঁটাঘাটি করে, নীতি আইন ও বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে লেখাটি দাঁড় করাই। লেখাটিকে উপস্থিত সকলেই খুব গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কারণ সেখানে কীভাবে আমরা প্লাস্টিকের বিকল্পগুলি গ্রহণ করে ধাপে ধাপে প্লাস্টিক যন্ত্রণা থেকে আমাদের মুক্ত করতে পারি তার প্রস্তাবনা ও করণীয় ছিল।
অনুষ্ঠানে স্কুলের শিক্ষার্থী, পরিবেশকর্মী, সংস্কৃতিকর্মী, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, গণমাধ্যমসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নিয়েছিলেন। সরকারি কর্মকর্তা এবং জনপ্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন। প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হলেও পরিবেশ অধিদপ্তর ঐ বছরও বরাবরের মতোই প্লাস্টিক ব্যানার দিয়ে সর্বত্র ভরিয়ে দিয়েছিল। উপস্থিত জনপ্রতিনিধি ও পরিবেশবাদীরা এই প্লাস্টিক ব্যানারের সমালোচনা করেন।
তবে পরিবেশ দিবসের সেই অনুষ্ঠানেরর আয়োজক পরিবেশ সংগঠনসমূহ কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে কোনো প্লাস্টিক ব্যবহার করেননি। কোনো প্লাস্টিকের ব্যানার ব্যবহৃত হয়নি মঞ্চে ও মিলনায়নস্থলে। কাপড় ও পাটের চটে হাতে লেখা ব্যানার ব্যবহৃত হয়েছে। ব্যানার গুলো কেবলমাত্র পরিবেশবান্ধবই ছিল না, বরং সেসব অনেক সৃজনশীল এবং টেকসই ছিল। অংশগ্রহণকারীরা এসব কাপড়ের ব্যানার খুব পছন্দ করেছিল। অনেকেই নস্টালজিক হয়েছিল। কারণ বাংলাদেশে এই হাতে লেখা কাপড়ের ব্যানারেরই চল ছিল। অনুষ্ঠানটিতে প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে কাপড়, পাট, বাঁশ-বেত, কাগজ, মাটি ও কাঠের বহু উপকরণ প্রদর্শিত হয়েছিল।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেছিলেন তারা ‘একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক বন্ধে’ সোচ্চার থাবেন। পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল অনেকেই সেই অনুষ্ঠানে প্লাস্টিক ব্যানার ব্যবহার বন্ধে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ২০২৬ সালের ভেতরে দেশকে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকমুক্ত করার লক্ষ্য অর্জনে প্রথম ধাপে সকল সরকারি দপ্তরে প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধে উদ্যোগ নেয়ার কথা জানা যায়। সরকারি দপ্তর গুলোতে প্লাস্টিকের পরিবর্তে কাচের বোতলে পানি রাখার জন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
এমনকি সরকারি আমন্ত্রণপত্র, নিমন্ত্রণপত্র, ভিজিটিং কার্ড এবং ফাইল ফোল্ডারে প্লাস্টিক ব্যবহার ও লেমিনেটিং ব্যবহার বন্ধ করতে বলা হয়েছে। একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বন্ধে প্রাথমিকভাবে দেশের ১২টি জেলার ৪০টি উপজেলাকে বেছে নিয়েছে সরকার। কিন্তু আমরা কি প্লাস্টিক বন্ধে সোচ্চার? সরকারি অফিসগুলোতে কি প্লাস্টিক বন্ধ হয়েছে? ২০২৬ হতে আর মাত্র আড়াই বছর বাকী। রাষ্ট্র কি তার অঙ্গীকার ভঙ্গ করবে? আমরা আশা করবো এ বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসে কোনো প্লাস্টিকের ব্যানার ব্যবহৃত হবে না। কাপড়, পাটের চট, পাটি কা কাগজের ব্যানার ব্যবহৃত হবে। তবে দেশজুড়ে এটি ঘটবে সেটি আমরা আশা করি না।
কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সরকারি অফিসের আয়োজনে প্লাস্টিকের ব্যানার নিষিদ্ধ হবে এই অতি সাধারণ একটা ছোট্ট আশা আমরা করতে পারি। এমনকি প্রতিদিন সরকারি অফিস এই প্লাস্টিক ব্যানার ব্যবহার নিষিদ্ধ রাখবেন এমনটিও আমরা আশা করি না। কেবলমাত্র পরিবেশ দিবসের একটিমাত্র দিনে দেশে সরকারিভাবে কাথাও প্লাস্টিকের ব্যানার ব্যবহৃত হবে না এই দাবি আমাদের।
প্রতিবার পরিবেশ দিবসে রাস্তায় রাস্তায় প্লাস্টিকের ব্যানার আর ফেস্টুনে সয়লাব হয়ে যায়। মিলনায়তন আর মঞ্চ জুড়ে থাকে প্লাস্টিকের ব্যানার। ব্যানার থেকে রঙের বিষাক্ত গন্ধ ছড়ায়। দেশের ৮টি বিভাগ, ৬৪ জেলা, ৪৯৫টি উপজেলায় সরকারিভাবে একটি করে হলেও কমপক্ষে ৫৬৭ টি পরিবেশ দিবসের অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। সরকারিভাবে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অন্যান্য বেসরকারি সংগঠন, পরিবেশ সংগঠনসহ অনেকেই অংশ নেয়। এই ৫৬৭ টি অনুষ্ঠানে কমপক্ষে ৫৬৭টি প্লাস্টিক ব্যানার ব্যবহৃত হয়। এছাড়া দেশজুড়ে পরিবেশ দিবসের অন্যান্য বহু অনুষ্ঠানেও বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক ব্যানার ব্যবহৃত হয়। এর ভেতর রাজধানী ঢাকায় সরকারিভাবে পরিবেশ দিবসের ব্যানার ফেস্টুন বেশি দেখা যায়। পরিবেশ দিবসের এতো ব্যানার ফেস্টুন সর্বশেষ যায় কোথা? কোন ভাগাড়ে?
আজ আমরা আমাদের চারপাশে যা কিছু দেখি এবং ব্যবহার করি তার বেশিরভাগই বিপজ্জনক প্লাস্টিক। পানির বোতল থেকে খাবারের থালা, শিশুদের খেলনা থেকে প্রসাধনীর মোড়ক। পৃথিবীর জনসংখ্যার মোট ওজনের সমান প্লাস্টিক প্রতিবছর উৎপাদিত হয়। যদি বিশ্বব্যাপি প্লাস্টিক ব্যবহারের ধারা অব্যাহত থাকে তবে ২০৫০ সালের ভেতর ১,১০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদিত হবে। দুনিয়ায় প্রতিবছর প্রায় ৬০ মিলিয়ন টন পলিথিন সামগ্রী তৈরি হয়। বর্তমানে পৃথিবীতে একক দেশ হিসেবে চীন সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক উৎপন্ন করে এবং প্লাস্টিক দূষণ ঘটায়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিপ মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১০ লাখ ৯৫ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। কঠিন বর্জ্যের দশভাগই প্লাস্টিক। বেসরকারি পরিবেশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান এসডোর জরিপ বলছে, দেশে বছরে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক উৎপন্ন হয় ৮৭ হাজার টন। প্লাস্টিক পচে না, গলে না, প্রকৃতিতে মিশে যায় না। ৫০০ থেকে ১ হাজার বছর লাগে প্লাস্টিকের রূপান্তর ঘটতে। প্লাস্টিক ভেঙে অতিক্ষুদ্র কণা হিসেবে বাতাস, মাটি, পানি, খাদ্যচক্র এবং প্রাণীর শরীরে মিশে যায়। প্লাস্টিক কণা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে আজ আমাদের খাদ্যশৃংখলে ঢুকে পড়েছে। শস্য, মাংস, মাছ, সর্বত্র মিলেছে মাইক্রোপ্লাস্টিক।
২০১৪ সনে ১ম জাতিসংঘ পরিবেশ সম্মেলনে শীর্ষ দশ জরুরি পরিবেশগত সমস্যার ভেতর সামুদ্রিক প্লাস্টিক বর্জ্য দূষণকে তালিকাভুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৫ সনে ২য় পরিবেশ সম্মেলনে মাইক্রো প্লাস্টিক দূষণকে পরিবেশ গবেষণার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈজ্ঞানিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ এর বহু আগেই পলিথিন নিষিদ্ধ করে। ১৯৯৫ সনের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ৬(ক) (সংশোধিত ২০০২) ধারা অনুযায়ী ২০০২ সনের ১ জানুয়ারি ঢাকা শহরে এবং একই সনের ১ মার্চ বাংলাদেশে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়।
খাবার পানি, ওষুধসহ খাদ্যদ্রব্য বাজারজাতকরণে ব্যবহৃত প্লাস্টিক বাজার থেকে প্রত্যাহার ও ধ্বংসের নির্দেশ কেন দেয়া হবে না তা জানতে রুল জারি করেছিল হাইকোর্ট ২০১৪ সালে। একই সনের ২৩ নভেম্বর সংসদীয় কমিটির বৈঠকে নিষিদ্ধ পলিথিনের যত্রতত্র ব্যবহার বন্ধে করণীয় নির্ধারণে জাতীয় সংসদে একটি সাবকমিটি গঠিত হয়েছিল। সাবকমিটি বাজার পরিদর্শন ও কয়েক দফা বৈঠক শেষে পলিথিন নিষিদ্ধকরণে করণীয় সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন মূল কমিটির কাছে জমা দেয়। ২০১৫ সনের ৭ মে মূল কমিটির বৈঠকে প্রতিবেদনটি অনুমোদন করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে মন্ত্রণালয়কে বলা হয়।
২০১৯ সালে বেলাসহ ১১টি পরিবেশ সংগঠন একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক পণ্য বন্ধে রিট করে। পরবর্তীতে দেশের উপক’ল অঞ্চলে, দেশের সর্বত্র হোটেল-মোটেল ও রেস্তোরাঁয় পানিবহনকারী প্লাস্টিকের বোতলসহ একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহার বন্ধে হাইকোর্ট নির্দেশ দেয়। প্লাস্টিক দূষণ রোধে দশ বছর মেয়াদি এবং একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক বন্ধে তিন বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। সুন্দরবনে একবার বিষাক্ত গ্যাস বন্ধে কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারি অফিসে একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু অন্য সব দিন বাদ দিলাম, এখনো পরিবেশ দিবসের সরকারি অনুষ্ঠানে ব্যাপকভাবে প্লাস্টিক ব্যানার ব্যবহৃত হচ্ছে। এই দূষণ-যন্ত্রণা ভাঙবে কে?
প্লাস্টিক টিকে থাকবার অন্যতম কারণ উৎপাদন, ভোক্তার সংস্কৃতি এবং বাজার। এখানকার পণ্য, ক্রয়-বিক্রয়, বিজ্ঞাপন, ক্রেতা-ভোক্তার রুচি ও চাহিদা, সহজলভ্যতা, লাগাতার ভোগবাদী মনস্তত্ত্ব সবকিছুই মানুষকে প্লাস্টিকমুখী করে তুলে। একমাত্র আমরাই পারি প্লাস্টিক বন্ধ করতে। যদি আমরা তা মনেপ্রাণে চাই। আমাদের ব্যক্তিগত, সাংগঠনিক এবং অফিসের কার্যক্রমে প্লাস্টিকের বিকল্পগুলোকে যদি আমরা বেশি বেশি ব্যবহার করি তবে স্বাভাবিকভাবেই প্লাস্টিকের ব্যবহার ধাপে ধাপে কমে আসবে।
একইসাথে দরকার আমাদের সর্বজন সর্বপরিসরের সক্রিয় সচেতনতা। একসাথে প্লাস্টিক বন্ধে দরকার রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক সদিচ্ছা। সমন্বিত পরিকল্পনা এবং বিশেষ বাজেট বরাদ্দ। কারণ দেশকে প্লাস্টিকমুক্ত করতে হলে অবশ্যই আমাদের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। পরিবেশবান্ধব সৃজনশীল বিকল্পগুলিকে উৎসাহিত করতে হবে। এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য ‘মরুময়তা ও খরা রোধে ভূমি পুনরুদ্ধার করতে হবে’। জলাভূমি, কৃষিজমি, বনভূমি সহ ভূমি দূষণের এক অন্যতম কারণ প্লাস্টিক দূষণ। দখল ও দূষণ থেকে ভূমির প্রাকৃতিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট্য সুরক্ষা করা জরুরি। লোকায়ত ভূমি ব্যবস্থাপনাকে স্বীকৃতি দেওয়া জরুরি।
একইসাথে প্লাস্টিক দূষণের উৎস, অনুশীলন ও কারণ গুলিকে চিহ্নিত করা জরুরি। প্লাস্টিক দূষণ রোধ না করে সমকালে ভূমি পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। আশা করি এবারের পরিবেশ দিবসে অন্ততপক্ষে সরকারি অফিসের অনুষ্ঠানে প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করে ভূমি পুনরুদ্ধারে আমরা একটা উদাহরণ তৈরি করতে পারব।
পাভেল পার্থ: লেখক ও গবেষক; পরিচালক, বারসিক
মন্তব্য করুন