অতীতের চেয়ে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে অনেক বেশি আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এর কারণ বর্তমানে ব্যাংক খাতে যত সমস্যা পুঞ্জীভূত হয়েছে, সেগুলো আগের তুলনায় অনেক বেশি ও মারাত্মক। বলতে গেলে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হচ্ছে ব্যাংক খাত। এ খাত দুর্বল হলে অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য; কারণ এ খাতের ওপর ভর করেই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং দ্রব্যের চাহিদা ও সরবরাহ নিয়ন্ত্রিত হয়।
মোটা দাগে আমাদের দেশের ব্যাংক খাতের সমস্যাগুলো হচ্ছে—অনাদায়ী বা খেলাপি ঋণের আধিক্য, অবৈধ পন্থায় ব্যাংকের টাকা হাতিয়ে নিয়ে আত্মসাৎ, ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট, ঋণ প্রদানে অনিয়ম, ব্যাংকিং কার্যক্রমে পরিচালকদের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও নামে-বেনামে ঋণ গ্রহণ এবং কখনো কখনো ব্যাংক খাতে খোদ নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষপাতিত্ব আচরণ; সর্বোপরি ব্যাংক পরিচালনায় সুশাসনের অভাব।
খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩-৪ শতাংশ হলে তা সহনীয় বিবেচনা করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ৮টি বিদেশি ব্যাংকসহ ৬১ ব্যাংকের মধ্যে মাত্র ১৩টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এ সীমার মধ্যে রয়েছে। বাকি সব ব্যাংকেরই খেলাপি ঋণ ৮-৯ শতাংশের ওপর। বেশ কয়েকটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬০ শতাংশ অতিক্রম করেছে। শুধু মন্দ ব্যবসার কারণে ঋণগ্রহীতা খেলাপি হচ্ছেন তা নয়। ঋণ নিয়ে ব্যবসার কাজে না লাগানো, বিদেশে অর্থ পাচার এবং আত্মসাতের প্রবণতার কারণে দিন দিন খেলাপি ঋণ বাড়ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দেশে ঋণখেলাপি হওয়া বা ব্যাংকের টাকা নামে-বেনামে আত্মসাৎ করাকে একশ্রেণির মানুষ অনৈতিক কাজ যেমন—চুরি বা ডাকাতির মতো অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে না, বরং এ সংস্কৃতি তাদের ব্যবসায়িক সাফল্যের নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করে। এরা প্রভাবশালী বলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা নিয়ন্ত্রক সংস্থা এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারে না।
তা ছাড়া খেলাপি ঋণ আদায়ে যে আইনি কাঠামোর দরকার, তা আমাদের দেশে নেই। মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা, বিচারকের অভাব, সর্বোপরি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাবে খেলাপি ঋণ পরিশোধে বাধ্যবাধকতা নেই। বড় বড় ঋণখেলাপি বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধা ও আনুকূল্য পেয়ে ঋণ পরিশোধে অনীহা ও দীর্ঘসূত্রতার আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবমতে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। সম্প্রতি সিপিডির একটি সেমিনারে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, পুনঃতপশিলকৃত ঋণসহ খারাপ ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন মামলায় অনাদায়ী ঋণ ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৭ কোটি টাকাসহ মোট অনাদায়ী ঋণ বা নন পারফর্মিং লোন দাঁড়ায় ৫ লাখ ৫৬ হাজার ২০৯ কোটি টাকা।
ব্যাংকের মোট প্রদত্ত ঋণের ২৫-৩০ শতাংশ হচ্ছে নন-পারফর্মিং ঋণ। এমতাবস্থায় ব্যাংকের তারল্য সংকট থাকবে এটাই স্বাভাবিক। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি বছর বৈধ পথে গড়ে ২০ বিলিয়ন ডলার প্রবাসী আয় এবং প্রায় সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে এসে ব্যাংকে জমা না হলে অর্থাভাবে ব্যাংকগুলো বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতো।
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে ঋণ মঞ্জুরিতে অস্বচ্ছতা, অর্থাৎ ব্যাংকে সুশাসনের ঘাটতি। ব্যাংক পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান বা পরিচালকদের যোগসাজশে অনেক সময় যথোপযুক্ত জামানত ছাড়াই ঋণ মঞ্জুর করা হয়। এ ছাড়া নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ থাকলেও পরিচালকরা পরস্পর যোগসাজশে অন্য ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে থাকেন। একটি তথ্যসূত্রে জানা যায়, ব্যাংক খাতের পরিচালকদের ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক পরিচালকদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৫৭ কোটি টাকা। ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণ খারাপ কিছু নয়, বরং ব্যাংক ব্যবসা প্রসারিত হয়, কিন্তু খেলাপি হলে সেটি ব্যাংকের বিপদের কারণ।
এমন দৃষ্টান্ত রয়েছে, কোনো কোনো পরিচালক নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী কিংবা এলাকার দোকানদারদের নামেও ঋণ গ্রহণ করে থাকেন। আবার ব্যাংকের একশ্রেণির অসৎ কর্মকর্তার যোগসাজশে ভুয়া দলিলপত্রের মাধ্যমেও ঋণ দেওয়া হয়, যা খেলাপি হলে আদায় করা দুরূহ হয়ে পড়ে। খেলাপি বা নন-পারফর্মিং ঋণের ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে একশ্রেণির অসৎ ব্যবসায়ী ঋণ গ্রহণ করে সে টাকা বিদেশে পাচার করে দিচ্ছেন। বিদেশে অর্থ পাচার আমাদের ব্যাংক খাতের আরও একটি বড় দুর্বল দিক। অবশ্য পাচারকৃত টাকার সবটাই ব্যাংক ঋণ নয়, বেশিরভাগই অবৈধভাবে উপার্জিত কালো টাকা বা একশ্রেণির ব্যবসায়ীর আমদানি-রপ্তানির আড়ালে ‘ওভার ইনভয়েসিং’ ও ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’-এর মাধ্যমে পাচারকৃত টাকা, যা ফেরত আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
তারল্য সংকটে পড়া একশ্রেণির ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ সহায়তা দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে। সেজন্য দুর্বল ব্যাংক হওয়া সত্ত্বেও এগুলো সংকটাপন্ন হয়ে বিপর্যয়ের মুখে পড়েনি। অন্যদিকে বেশ কিছু ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুর্বল চিহ্নিত করে সেগুলো সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত (মার্জার) করার পদক্ষেপ নিয়েছে। সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ৪ এপ্রিল এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ব্যাংক একীভূতকরণের নীতিমালা জারি করেছে।
প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রণীত নীতিমালা কতটা বাস্তবসম্মত ও সময়ের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম। তা ছাড়া নীতিমালা প্রয়োগের ক্ষেত্রে দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করে সেটি কথিত সবল ব্যাংকের সঙ্গে মার্জার চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। একীভূতকরণের সিদ্ধান্তটি পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে হয়নি। এরই মধ্যে খেলাপি ঋণ জর্জরিত পদ্মা ব্যাংককে অপেক্ষাকৃত সবল এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংককে বেসরকারি সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরের সিদ্ধান্তটি সুবিবেচনাপ্রসূত হয়নি বলে ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা মনে করেন। একটি সরকারি ব্যাংক কী করে একটি বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে। বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিবাদ এবং পরিচালনা কমিটির নারাজির ফলে আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এ মার্জার থেকে সরে এসেছে। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। বেসিক ব্যাংকের ওপর গ্রাহকদের আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে।
বহু আমানতকারী তাদের আমানত অন্য ব্যাংকে সরিয়ে নিচ্ছে। ফলে বেসিক ব্যাংক আরও দুর্বল হচ্ছে। অন্য যে দুটি ক্ষেত্রে কতিপয় ব্যাংক মার্জারের প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলোর কৃতকার্যতা নিয়েও অনেক প্রশ্ন উঠেছে। যেমন—সোনালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) মার্জারের প্রস্তাবে সোনালী ব্যাংকের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকে চিন্তিত। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক আগে একই ব্যাংক ছিল। কাজেই এদের মার্জার যৌক্তিক। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও রাজশাহী অঞ্চলের জনগণের প্রতিবাদে এর একীভূতকরণ থমকে দাঁড়িয়েছে। তবে এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক মার্জারের ফল দেখে দেশে ব্যাংক একীভূতকরণের পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
এদিকে একীভূত ব্যাংকগুলোর মন্দ ঋণ প্রস্তাবিত অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার প্রস্তাবটিও বাস্তবসম্মত নয়, বরং নৈতিকতা-বিবর্জিত। জনগণের টাকা ব্যয়ে ক্রয়কৃত খেলাপি ঋণ নবপ্রতিষ্ঠিত এ কোম্পানি কীভাবে আদায় করবে? অনেকের মতে, এ প্রক্রিয়ায় খেলাপি ঋণ লুকিয়ে ফেলার অপচেষ্টা হচ্ছে।
ব্যাংকসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, খেলাপি ঋণ আদায়ের বাস্তবসম্মত কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে ব্যাংক খাত ‘সবল’ করার এরূপ পরীক্ষণ কোনো ফল বয়ে আনবে না। যেখানে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনগত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণখেলাপিদের সহনীয় সুবিধা দিয়েই যাচ্ছে। সম্প্রতি এক আদেশে ১ শতাংশ ঋণ পরিশোধের মাধ্যমে ১০ বছরের জন্য ঋণ রিশিডিউলের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ঋণ আদায়ে মামলার পরিবর্তে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ‘সমঝোতার’ পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা যে পর্যায়ে খাদের কিনারে এসে পৌঁছেছে, এটাকে রক্ষা করতে হলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের বিকল্প নেই।
ব্যাংক ব্যবস্থায় সুশাসন ফিরিয়ে আনা এবং ব্যাংক খাত পুনর্গঠনে সৎ, অভিজ্ঞ ও উপযুক্ত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী ব্যাংক কমিশন গঠন এখন সময়ের দাবি। এ কমিশন ব্যাংক দুর্বল হওয়ার কারণ উদঘাটন, ব্যাংক সবল ও শক্তিশালীকরণে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের সুপারিশ করবে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বলবৎ কোড অব কন্ডাক্ট প্রয়োজনে সংশোধনের ব্যবস্থা নেবে।
ব্যাংক খাত রক্ষা করা দেশ ও জনগণের স্বার্থে প্রয়োজনীয়। অসংখ্য আমানতকারীর সঞ্চিত টাকা কতিপয় লুটেরার হাতে চলে যাওয়া কোনোভাবে কাম্য নয়। কতিপয় ব্যাংক ‘মালিক’ তথা ব্যাংকের পরিচালকদের অতিরিক্ত ক্ষমতার লাগাম টানতে হবে। জনগণ প্রত্যাশা করে সরকার এ ব্যাপারে কোনো অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হবে না। রাজনৈতিক কারণে খেলাপি ঋণ আদায় হচ্ছে না, ব্যাংকে সুশাসন আনা যাচ্ছে না—এরূপ অপবাদ সরকার নেবে কেন?
স্বাধীনতার অব্যবহিত পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদদের নিয়ে পরিকল্পনা কমিশন গঠনসহ আর্থিক বিষয়ে তাদের পরামর্শ গ্রহণ করতেন। দেশের অর্থনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিরপেক্ষ, দেশপ্রেমিক প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আর্থিক খাতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর উপকারে আসতে পারে।
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া : জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত; সাবেক সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
মন্তব্য করুন