আমরা দাঁত থাকতে কেউ দাঁতের মর্যাদা দেই না। তবে, অযত্নে এবং অবহেলায় দাঁত ক্ষতিগ্রস্ত, নষ্ট বা পড়ে যাওয়ার পর দাঁতের গুরুত্ব বুজতে পারি। তখন আমাদের আপসোস করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। বাকি জীবন বিনা দাঁত বা নকল দাঁত নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। সুস্থ্য থাকতে কেউ আমরা স্বাস্থ্যের গুরুত্ব বুঝি না। অসুস্থ্য হয়ে হাসপাতালের বিছানাতেই কেবল আমরা স্বাস্থ্যের গুরুত্ব বুঝি। অর্থাৎ হাসপাতালের বিছানাতেই কেবল বুঝতে পারি ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মানুষের মূল’। আবার আমরা জীবন থাকতে কেউ জীবনের মর্যাদা দেই না। তাই জীবন সায়াহ্নে এসে কবি-কায়কোবাদের মতো হয়তো আফসোস করে বলি যে ভুলে তোমারে ভুলে - হীরা ফেলে কাচ তুলে। ভিখারি সেজেছি আমি, আমার সে ভুল প্রভু তুমি ভেঙ্গে দাও। প্রভু ভুল ভেঙ্গে দাও। তবে মৃত্যুর মুখোমুখি হলে বিশেষ করে মৃত্যুদূত উপিস্থিত হলে জীবনের মর্যাদা পুরুপুরি বুঝার সুযোগ হয়, যদিও তখন জীবনের মর্যাদা দেওয়ার কোনো সুযোগ থাকেনা। বিচার দিবসে জাহান্নামীরা কল্যাণময় কার্য সাধনের নিমিত্তে দুনিয়াতে ফেরত পাঠানোর জন্য আল্লাহর কাছে ব্যাপক কাকুতি-মিনতি করবে, কিন্তু তা সম্পূর্ণ নিষ্ফল হবে।
ক্ষমতা পেলেও আমরা ক্ষমতার যথার্থ ব্যবহারের মাধ্যমে নিজ দপ্তর কিংবা দেশের মঙ্গল সাধনে ব্যস্ত থাকার মাধ্যমে ক্ষমতার মর্যাদা দেই না। বরং, স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্বেচ্চাচারিতা বা ক্ষমতার অপব্যবহারে সর্বদা ব্যস্ত থাকি। ক্ষমতার দাপটে তখন হিদায়েত জ্ঞান হারিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করি। এ দৌড়ে গৃহ কর্মী থেকে শুরু করে মুনিব, পায়েক-পেয়াদা, সৈন্য-সামন্ত, নাজির-উজির কিংবা রাজা-বাদশা কেউ পিছিয়ে নেই। আবার ছাত্র, শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবীসহ কোন পেশাজীবীও বাদ নেই। তবে মরিচের মতো পদ মর্যাদায় যার অবস্থান যত ছোট ক্ষমতা পেলে তার ঝাঁজ তত বেশি হয়।
গৃহকর্মী, গাড়ি চালক, নিরাপত্তা প্রহরী, অফিস সহায়ক, সাধারণ রাজ কর্মচারী কিংবা কোন সাধারণ রাজনৈতিক কর্মীর নিকট কিছু ক্ষমতা অর্পণ করে দেখুন তাদের ক্ষমতার ঝাঁজ কতটুকু। ক্ষমতার অপব্যাবহার আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। পত্রিকার পাতায়, টেলিভিশনের পর্দায় কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ পড়তেই দেখা যায় ক্ষমতাধারীদের কেউ চিবিয়ে চিবিয়ে নদী খাচ্ছে, কেউ খাল-বিল ও জলাশয় খাচ্ছে, কেউ পাহাড়-পর্বত খাচ্ছে, কেউ বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যায় খাচ্ছে, কেউ ব্যাংক খাচ্ছে, আবার কেউ আস্ত দেশটাই গিলে খাচ্ছে।
ক্ষমতায় বসার আগে যাদের ফেরেস্তা ভাবা হয়, ক্ষমতার বসতেই তারা স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানে কামড় বসাচ্ছে। আর যে যত ক্ষমতাবান তার কামড় তত বড় এবং বিষও তত বেশি। তাদের কামড়ে দেশ আজ রক্তাক্ত, মানচিত্র ক্ষত-বিক্ষত এবং দাঁতের বিষে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। তাদের করুণ আর্তনাদ ক্ষমতাসীনদের কর্ণগহ্বর-এ পৌঁছাচ্ছে না। কারণ তারা অন্ধ ও বধির হয়ে গেছে। এসব নির্যাতিত এবং নিষ্পেষিত মানুষের সারি ক্রমেই লম্বা হচ্ছে।
তবে, যৌবন বা নদীর জোয়ারের মতো আমাদের ক্ষমতা একসময় চলে যায়। তখন বড় আপসোস হয়। তখন ভাবি কোনটা করা উচিত ছিল আর কোনটা করা ঠিক হয়নি। কিন্তু, দাঁত পড়ে যাওয়ার মতো এ ভাবনাও কোনো ফল দেয় না। বরং, ক্ষমতা থেকে পতনের পর অত্যাচারীরা আস্থা খুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয় এবং তারা সম্পূর্ণ নিঃস্বঙ্গ ও একা হয়ে যায়। তখন তার নিকট থেকে সুবিধাভোগী তোষামোদি চক্র এবং ক্ষমতা অপবাহারের মদদদাতারা তাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলে। আবার ক্ষমতার অপব্যাবহার করে দেশে-বিদেশে সম্পদের যে পাহাড় গড়ে তোলে তা তার কোন কাজে আসে না। একদিকে নিঃস্বঙ্গতা, রোগ-শোক এবং অনুশোচনা, অন্যদিকে ক্ষমতায় থাকাকালীন চরম ভোগ-বিলাসিতায় কাটানোর পর জনগণের ঘৃনা-অপমান এবং কটূক্তি থেকে বাঁচার জন্য তাদেরকে জন-মানবহীন আশ্রয়স্থল খুঁজতে হয়। দেশ-বিদেশের ইতিহাস ঘাটলে এর ভুরি ভুরি উদাহরণ পাওয়া যাবে।
ক্ষমতা না থাকলে যে আম-ছালা দুটিই যায় তার প্রমান তো দেশের ইদানিং কালের কিছু ঘটনা প্রবাহ থেকে সহজে অনুমেয়। এসব প্রতাপশালী ব্যক্তিদের টিকি কখনো স্পর্শ করা যাবে তা সাধারণ মানুষের ধারণাতেই ছিল না। কিন্তু, কথায় বলে পাপের ষোলো-কলা পূর্ণ হলে কেউ রেহাই পায় না। এটি পুরোপুরি সত্য কথা। তবে কারো কারোর ক্ষেত্রে ষোলো-কলা পূর্ণ হতে একটু বেশি সময় লাগে। তথন তারা ভাবতে থাকে এত পাপ করছি তাতে কোনো শাস্তি আসছে না। ফলে তাদের পাপের মাত্রা বেড়ে যায় এবং একসময় তা ষোলো-কলায় পূর্ণ হয়।
মনে রাখা দরকার, দাঁত, স্বাস্থ্য, কিংবা জীবন নষ্ট হলে তার ফল মূলতঃ নিজেকেই ভোগ করতে হয়। তাই এর ব্যাপ্তি কেবল ব্যক্তিগত যন্ত্রনা এবং অনুশোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু , ক্ষমতার অপব্যবহারে প্রতিষ্ঠান, কোন অঞ্চল, পুরো দেশ কিংবা সমগ্র বিশ্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইতিহাসের পাতা উল্টালে এটাও দেখা যায় ক্ষমতার পতন হলে ব্যাপক জনরোষের মুখোমুখী হতে হয় যেখানে ক্ষমতাচ্যুত ব্যক্তিদের জীবন হানির শঙ্কাও তৈরি হয়।
ক্ষমতাধারীদের এ সকল বিষয় জানা থাকলেও তা মানার কোন তাড়না থাকে না। কেননা ক্ষমতার দম্ব ও অহংকার তাদের চোখ অন্ধ করে দেয় । তবুও, ক্ষমতাধারীদের বলব, ক্ষমতা থাকতে ক্ষমতার দম্ব ও অহংকারের অন্ধত্বের পর্দা সরিয়ে ফেলে দেখুন মানুষ কত কষ্টে আছে। তোষামোদি চক্রের বুহ্য ভেদ করে শাসকের দৃষ্টির পরিবর্তে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে দেখুন তাহলে জনগণের দুঃখ-যাতনা, গঞ্চনা-বঞ্চনা এবং কষ্ট বুঝতে পারবেন। আর সেই কষ্ট নিবারণ করে ক্ষমতার প্রকৃত মর্যাদা দিন। তাহলে ক্ষমতা হারালেও জনগণের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিয়ে উপযুক্ত মান-সম্মানসহ বীরত্বপূর্ণ জীবন কাটাতে পারবেন। আর না হলে ইতিহাসের বইয়ে স্থান পাওয়া ক্ষমতাচ্যুত ব্যক্তিদের মত করুন দশা বরণ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক
মন্তব্য করুন