মো. বায়েজিদ সরোয়ার
প্রকাশ : ২৯ মে ২০২৪, ১১:৩০ এএম
আপডেট : ২৯ মে ২০২৪, ১১:৩৫ এএম
অনলাইন সংস্করণ
বিশ্ব শান্তিরক্ষী দিবস

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গৌরবময় পথ চলা

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। ছবি : সংগৃহীত
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। ছবি : সংগৃহীত

মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বময় ভূমিকা ও পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আর এক মহৎ অর্জন হলো, শান্তিরক্ষা মিশনে (পিস কিপিং অপারেশন) অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সামরিক কৃতিত্ব ও অর্জনসমূহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আজ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্রবাহিনী দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যেমন- দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করেছে, তেমনি বিদেশে পেশাদারিত্ব ও নিবেদিত প্রাণ মনোভাবের মাধ্যমে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে বিদেশিদের মন জয় করেছে। আমাদের সৈন্যরা দুর্গত মানবতার সেবায় যেমন কাজ করেছেন, তেমনি বিশ্বে শান্তি বিনষ্টকারী আগ্রাসী বাহিনীর মোকাবিলাও করেছেন। এক সংগ্রামী জাতির বাহিনী হিসেবে সবসময় তারা মানবতার ক্ষেত্রে নিজেদের উৎসর্গ করেছেন।

ব্ল-হেলমেটের অনবদ্য গল্প

দুর্গম রুক্ষ আর বন্ধুর সব প্রান্তরে অজস্র বিনিদ্র রাত আর রক্ত-ঘাম ঝরা দিন কাটিয়েছেন বাংলার শান্তিরক্ষীরা। পরিবারের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা, পানি আর খাবারের কষ্ট, সশস্ত্র-সন্ত্রাসীদের রক্তচক্ষু আর এইডস-ইবোলার ঝুঁকি সঙ্গী করে তারা পথ চলেছেন। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশও দেশের জনগণের ভাবমূর্তি অক্ষুন্নত রাখতে নিরলস পরিশ্রম এবং ত্যাগ স্বীকার করে যাচ্ছেন তারা। জাতি সংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের ভূমিকা খুবই গৌরবের। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা কাজ করছেন সাহস, দৃঢ়তা, শৃঙ্খলা, আত্মত্যাগের ব্রত নিয়ে সেখানে যুক্ত হয়েছে মানবিকতা।

নতুন পরিচয়ে বাংলাদেশ

বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার মহান ব্রত নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাতিসংঘ। বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে শান্তি স্থাপনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জাতিসংঘের এই কার্যক্রমের এক গর্বিত অংশীদার। জাতিসংঘের নিজস্ব কোনো বাহিনী নেই। সদস্য দেশগুলোর প্রেরিত সামরিক সদস্যরাই এর প্রধান শক্তি।

জাতিসংঘে শান্তিরক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নে বিশ্বের বিভিন্ন বিরোধপূর্ণ স্থানে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সর্বদা অঙ্গীকারবদ্ধ। বিশ্বশান্তি রক্ষায় এই দৃঢ় প্রতিশ্রুতির কথা বাংলাদেশের সংবিধানে উচ্চারিত হয়েছে। আমাদের সারল্য, কল্যাণকামিতা এবং সার্বজনীনতার এই সুর অনুরণিত হয়েছে আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে। যার মূল কথা ‘সবার প্রতি বন্ধুত্ব এবং কারও প্রতি বৈরিতা নয়’। আর এই অঙ্গীকারকে সমুন্নত রাখতে গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী ও পুলিশ একযোগে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে (ইউনাইটেড নেশনস পিস কিপিং অপারেশন) অংশগ্রহণ করে আসছে।

লন্ডন থেকে প্রকাশিত স্বনামধন্য সাপ্তাহিক ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ ২০০৭ সালে এই প্রসঙ্গে লিখে- ‘শান্তিরক্ষীদের নীল হেলমেট পরিধান করে বাংলাদেশিরা বিশ্বের কাছে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাজনীতি এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বাইরেও যে বাংলাদেশের একটি পরিচিতি আছে তা তুলে ধরার সুযোগ করে দিয়েছে।’

হাইতি থেকে পূর্বতিমুর উড়ছে লাল-সবুজের পতাকা

হাইতি থেকে পূর্বতিমুর, লেবানন থেকে কঙ্গো পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় সকল সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের পদচিহ্ন রয়েছে। লাল-সবুজের পতাকা উড়ছে আফ্রিকার গহিন বন থেকে শুরু করে উত্তপ্ত মরুভূমিতে। সংঘাতময় সমুদ্র এলাকায়ও উড়ছে বাংলাদেশের শান্তির পতাকা। বসনিয়ার তীব্র শীত, সাহারা মরুভূমির দুঃসহ গরম ও পূর্ব এশিয়ার ক্লান্তিকর আর্দ্রতার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা। ধর্ম, গোত্র, বর্ণ, রাজনৈতিক আদর্শ ও আঞ্চলিক বৈষম্যকে পিছনে ফেলে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা নিজেদের উৎসর্গ করেছেন বিশ্বমানবতার সেবায়। নীল হেলমেট মাথায় নিয়ে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা ছড়িয়ে আছেন বিশ্বের প্রায় সবখানে। শান্তিরক্ষীদের পেশাগত দক্ষতা, অঙ্গীকার, নিরপেক্ষতা, সততা ও মানবিক কারণে বিশ্বের সকল মানুষের কাছে আজ তারা দৃষ্টান্ত স্বরূপ।

সিরিয়ায় সেনাবাহিনীর প্রথম বহির্দেশীয় দায়িত্ব

এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পর, ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সিরিয়ায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি মেডিকেল টিম পাঠানো হয়। এটি ছিল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত সাহসী ও অসাধারণ দূরদর্শী একটি সিদ্ধান্ত। কর্নেল খুরশীদ উদ্দিন আহমেদের (পরে ব্রিগেডিয়ার) নেতৃত্বে এটি ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম বৈদেশিক দায়িত্ব। তবে এটি জাতিসংঘ শান্তি মিশন ছিল না।

ইউনিমগ-বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম জাতিসংঘ মিশন

জাতিসংঘ স্বীকৃত শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের প্রথম পদযাত্রা শুরু। ১৯৮৮ সালে ইরান-ইরাক (ইউনিমগ) শান্তি মিশনে যোগদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৫ জন চৌকস অফিসার প্রথম জাতিসংঘের পতাকাতলে একতাবদ্ধ হয়। বাংলাদেশ পুলিশ ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ পরিবারের সদস্য হয় নামিবিয়া শান্তি মিশনের (ইউনিকম) মাধ্যমে। বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী বসনিয়ার শান্তি মিশনে (আনপ্রফর) যোগ দেয় ১৯৯৩ সালে।

ইরান-ইরাকের মধ্যে প্রায় ৮ বছরব্যাপী (১৯৮০-১৯৮৮) রক্তক্ষয়ী ভ্রাতৃযুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, জাতিসংঘের উদ্যোগে (আগস্ট ১৯৮৮), ‘ইউনাইটেড নেশনস ইরান-ইরাক মিলিটারি অবজারভার গ্রুপ’ (ইউনিমগ) নামে একটি জাতিসংঘ শান্তি মিশন (অবজারভার মিশন) গঠিত হয়। ইউনিমগ মিশনে প্রধান দায়িত্ব ছিল যুদ্ধ বিরতি তদারকি। উল্লেখ্য, ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধ ও বিরোধের শান্তিপূর্ণ মীমাংসার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তবে কার্যকর ও অর্থবহ পদক্ষেপ গ্রহণ করে ইসলামি সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি)। ১৯৮১ সালের প্রথম দিকে ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধে বাংলাদেশের উদ্যোগী ভূমিকা (ইসলামিক পিস কমিটির মাধ্যমে) মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপকভাবে আলোচিত ও প্রশংসিত হয়েছিল। দুই দেশের যুদ্ধ বন্ধে, এই ধরনের কূটনৈতিক উদ্যোগ প্রথম বারের মত নিয়েছিল বাংলাদেশ।

শ্রাবণের সকালে নতুন অভিযানের যাত্রা

১৬ আগস্ট ১৯৮৮। সকাল সাড়ে সাত ঘটিকা। শ্রাবণের এক রোদেলা সকাল। ঢাকা বিমান বন্দরে একদল সেনা অফিসার কুয়েত এয়ার ওয়েজের একটি বিমানে বাগদাদ যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। লে. কর্নেল ফজলে এলাহি আকবরের (পরে মেজর জেনারেল ও সুদান মিশনে ফোর্স কমান্ডার) নেতৃত্বাধীন পর্যবেক্ষক দলটি ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধের জন্য গঠিত শান্তিরক্ষী মিশনে (ইউনিমগ) যোগদানের পথে। তাদের হৃদয়ে প্রিয়জন ও মাতৃভূমি ছেড়ে যাওয়ার বেদনা, চোখে মধ্যপ্রাচ্যের বিস্ময়, আর নতুন গন্তব্যের রহস্যময়তা ও রোমান্টিকতা। কিন্তু তারা কেউ জানে না, সেনাবাহিনী তথা বাংলাদেশের জন্য কী অসাধারণ এক কীর্তির মাইলস্টোন স্থাপন করতে যাচ্ছেন। বিমানটি নীল আসমানে উড়াল দিলে বিশাল মেঘের ভেলার দিকে তাকিয়ে কর্নেল তার নতুন চ্যালেঞ্জের কথা ভাবতে থাকেন...।

স্টাফ কলেজের একটি দূরদর্শী সিদ্ধান্ত

১৯৮০ দশকের মাঝামাঝি সময়েও সামরিক বাহিনীতে শান্তিরক্ষা মিশন তেমন আলোচিত বিষয় ছিল না। ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত, ‘ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড এন্ড স্টাফ কলেজ’ (সংক্ষেপে স্টাফ কলেজ হিসেবে পরিচিত) সশস্ত্র বাহিনীর অত্যন্ত মর্যাদাবান একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান । ১৯৮৫ সালে স্টাফ কলেজের তৎকালীন কমান্ড্যেন্ট মেজর জেনারেল আব্দুল মান্নাফ আশ্চর্য্যরকম দূরদর্শী এক পদক্ষেপ নিলেন। স্টাফ কলেজের পাঠ্যসূচীতে ১৯৮৫ সালেই শান্তিরক্ষা অপারেশন বা পিস কিপিং অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। সে এক অন্য ইতিহাস। অর্থাৎ বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীতে শান্তিরক্ষা বিষয়ক প্রশিক্ষণ পূর্ব থেকেই প্রচলিত ছিল।

একটি ঐতিহাসিক মিশনের গল্প

‘ইউনিমগ’ মিশনটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য একটি ঐতিহাসিক মিশন। এই মিশনেই প্রথম বারের মতো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩১ জন সামরিক পর্যবেক্ষক শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করেন। এই পর্যবেক্ষক দলটি প্রথম কোন শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করে প্রশংসনীয় কর্মদক্ষতা ও সাহসিকতা প্রদর্শনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত করেন। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বীকৃতি স্বরূপ জাতিসংঘ ১৯৮৮ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করে। ইউনিমগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণের বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ৪ টাকা ও ১০ টাকা মূল্যমানের দু’টি ডাক টিকেট ও বিশেষ খাম প্রবর্তন করে যা সেনাবাহিনীর পেশাগত দক্ষতার এক স্বীকৃতি।

উল্লেখ্য, জাতিসংঘ মিশনে প্রথমবারের মতো শান্তিরক্ষী পাঠানোর বিষয়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও সেনাপ্রধান লে. জেনারেল আতিকুর রহমান বিশেষ উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছিলেন। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহেদুল আলম খান ইউনিমগের সামরিক পর্যবেক্ষক দলের সহকারী প্রধান সামরিক পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০ সালের ১২ মার্চ তিনি এ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই পদটি ‘ইউনিমগ’-এর সামরিক পর্যবেক্ষকদের দ্বিতীয় শীর্ষস্থানীয় পদ।

অপারেশন মরুপ্রান্তর- ১৯৯০

১৯৯০ সালে ইরাকিদের কুয়েত আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে, বাংলাদেশ সৌদি আরবে (অপারেশন ডেজার্ট শিল্ড ও ডেজার্ট স্টের্ম) ২২৩২ জনবল বিশিষ্ট সেনাবাহিনীর একটি কন্টিনজেন্ট (অপারেশন মরুপ্রান্তর) পাঠায়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এটি ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য একটি বিশাল এক্সপোজার, যা পরবর্তীকালে জাতিসংঘ মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যাপক আকারে নির্বাচনের ক্ষেত্রে অবদান রেখেছিল। সেই সময়ের জটিল পরিস্থিতিতে, সৌদি আরবে সৈন্যদল পাঠানোর ক্ষেত্রে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এর এই সিদ্ধান্ত ছিল অত্যন্ত সাহসী ও দূরদর্শী। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে, সৌদি আরবে নিয়োজিত তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল কাজী গোলাম দস্তগীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কন্টিনজেন্টের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার হাসান মশহুদ চৌধুরী (পরে লে. জেনারেল ও সেনা প্রধান) লিখেছেন- অপারেশন মরুপ্রান্তরের কারণে পরবর্তীকালে অনেক দেশের সাথে আন্তঃরাষ্ট্রিয় ও আন্ত সেনাবাহিনীর সম্পর্ক জোরদার হয়। জাতিসংঘ শান্তি মিশনে যাবার পথও খুলে যায়। (নানা রঙের দিনগুলো)

বিশ্ব শান্তিরক্ষায় বাংলার শান্তিরক্ষী

বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধ বিধ্বস্ত অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জাতিসংঘের বিশ্বস্ত ও পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। পরিবর্তিত বিশ্বের ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা বিচক্ষণতা, পেশাদারিত্ব এবং বুদ্ধিদীপ্ত উপায়ে সংশ্লিষ্ট দেশের স্থানীয় প্রশাসনকে সর্বদা সহায়তা করা যাচ্ছে। যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে একটি সুন্দর ও বসবাস-উপযোগী সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলার শান্তিসেনারা একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত (২০২৪) ৪৩ টি দেশে/অবস্থানে জাতিসংঘের ৬৩ টি শান্তি মিশনে বাংলাদেশের প্রায় ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮৫৬ জন শান্তিরক্ষী অংশগ্রহণ করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীর সংখ্যা ১ লাখ ৫৭ হাজার ১৮৪ জন। বর্তমানে মোট ৬ টি দেশে সর্বমোট ৬ টি মিশনে ৪ হাজার ৭০ জন সেনা সদস্য নিয়োজিত আছেন। নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বাংলাদেশ পুলিশসহ মোট শান্তিরক্ষীর সংখ্যা বর্তমানে ৬ হাজার ৯২ জন। বর্তমানে যে দেশগুলোতে শান্তিমিশন চলছে, সে দেশগুলো হলো- সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, মালি, সাউথ সুদান, লেবানন, ডিআর কঙ্গো, ওয়েস্টার্ন সাহারা, লেবানন ও আবেই (সুদান)।

বিদেশে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের সাতকাহন

বর্তমানে জাতিসংঘ মিশনে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীর সদস্য সংখ্যা বিশ্বে ২য় সর্বোচ্চ। বাংলাদেশ বিশ্বের প্রায় সকল প্রান্তের দুর্গত নিপীড়িত ও নিরীহ মানুষের সেবায় এই শান্তি সেনাদের হাত সর্বদা প্রসারিত। সংঘাতপূর্ণ ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজের জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়েও তারা আর্ত মানবতার সেবা করে চলেছেন। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৩১ জন বীর সন্তান নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন এবং ২৩৯ জন সদস্য পঙ্গুত্ব বরন করেছেন। তাদের এই ত্যাগ বিশ্ব শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে। আমাদের শান্তিসেনাদের এই আত্মত্যাগ ও বীরত্বের কথা বিশ্ব শান্তিরক্ষার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা মিশন এলাকায় বিবদমান দলকে নিরস্ত্রীকরণ, মাইন অপসারণ, সুষ্ঠু নির্বাচনে সহায়তা দান, সড়ক ও জনপথ এবং স্থাপনা নির্মাণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। সেনাবাহিনী প্রায় দুইশত আর্মাড পার্সোনাল ক্যারিয়ার, অস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যানবাহন নিয়ে তাদের অপারেশন পরিচালনা করছেন। মাঠ পর্যায়ে শান্তিরক্ষা অভিযানে অংশগ্রহণের পাশাপাশি, জাতিসংঘ সদরদপ্তরের ডিপার্টমেন্ট অব পিস কিপিং অপারেশনেরও স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেনা কর্মকর্তা অংশগ্রহণ করে থাকেন। গত ৩৬ বছর ধরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা অসামান্য সাফল্যের ইতিহাস তৈরি করেছেন। কম্বোডিয়া, সাবেক যুগোস্লোভাকিয়া, সোমালিয়া, কঙ্গো, আইভরিকোষ্ট, সিয়েরালিওন, দক্ষিণ সুদান, লাইবেরিয়া, মালি ও সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক এর জটিল ও চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে বাংলার সাহসী শান্তিসেনারা পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করে সেসব দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছে।

শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশ একটি ব্রান্ড

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নে বাংলাদেশ এখন এক গর্বিত অংশীদার। শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশ একটি ব্রান্ড। শান্তিরক্ষা মিশনের প্রতি দশজন সদস্যের ভেতর একজন সদস্য এখন বাংলাদেশের। বাংলাদেশের শান্তি রক্ষীদের পেশাগত দক্ষতা, নিরপেক্ষতা, সততা ও মানবিকতার কারণে বিশ্বের মানুষের কাছে আজ তারা দৃষ্টান্তস্বরূপ। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছে। এ দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এক বিংশ শতাব্দীতে এসে বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে জাতিসংঘের সর্ববৃহৎ সেনা প্রদায়ক দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে।

আফ্রিকার গ্রামের নাম যখন রূপসী বাংলা

বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের অবদান আজ সারা বিশ্বে স্বীকৃত। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান বলেছেন- জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ একটা আদর্শ বা মডেল সদস্য। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে এখন নেতৃত্ব স্থানীয়। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা স্বাগতিক দেশের জনগণের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক বজায় রাখতে সর্বদা সচেষ্ট। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা বিদেশের বৈরী পরিবেশে নিজেদের খাপ খাইয়ে প্রদত্ত সব দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করে থাকে। আমাদের শান্তিসেনাদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ও কাজ, মানবিক গুণাবলি, শৃঙ্খলা এবং স্থানীয় জনগণের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এই সুনামের পেছনে সবচেয়ে বেশী অবদান রাখে। প্রতিটি সেনা সদস্য সেখানে দেশের একেকজন প্রতিনিধি/শান্তিদূত। আইভরি কোস্টে স্থানীয় জনগণ তাদের একটি গ্রামের নাম রেখেছে রূপসি বাংলা। হাইতিতে একটি শিশুর নাম বাংলাদেশ। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের নামে সড়কের নামকরণ করা হয়েছে, যা শান্তিরক্ষীদের প্রতি দেশগুলোর জনগণের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশ মৈত্রী স্কুল, বাংলাদেশ সেন্টার। সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি ও প্রাপ্তি হলো যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশসমূহের সাধারণ মানুষের মুখে ফুটিয়ে তোলা হাসি ও তাদের ভালোবাসা।

জাতিসংঘে নারী শান্তি রক্ষী

শান্তিরক্ষী হিসেবে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী ও পুলিশের নারী সদস্যগণের কর্মকাণ্ড বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশের ৩ হাজার ৩৮ জন নারী শান্তিরক্ষী শান্তিমিশনে অংশগ্রহণ করেছে। ২০০০ সালে পূর্ব তিমুরের শান্তি মিশনে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ পুলিশের একদল নারী শান্তিরক্ষী দায়িত্ব পালন করেন। হাইতিতে বাংলাদেশ সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ মহিলা পুলিশ কন্টিনজেন্ট প্রেরণ করে ২০১০ সালে। উল্লেখ্য ২০০৯ সাল থেকে সশস্ত্র বাহিনীর নারী সদস্যগণ জাতিসংঘ মিশনে অংশগ্রহণ করে আসছেন। বর্তমানে সশস্ত্র বাহিনীর ৩৭৩ জন ও বাংলাদেশ পুলিশের ১২০ জন নারী সদস্য মিশন এলাকায় দায়িত্ব পালন করছেন।

পিস কিপিং এ নেতৃত্বস্থানীয় অবস্থানে বাংলাদেশের কয়েকজন জেনারেল

এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১০ জন লে. জেনারেল/মেজর জেনারেল পদবির উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা জাতিসংঘ শান্তি মিশনের সর্বোচ্চ সামরিক পদ অর্থাৎ ফোর্স কমান্ডার/চিফ মিলিটারি অবজারভার এর দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশের মুখ উ্জ্জ্বল করেছেন। ২০১৪ সালে আমিরা হক পূর্ব তিমুরে শান্তিরক্ষা মিশনের (আনমিট) প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য, তিনিই প্রথম বাংলাদেশি যিনি কোন জাতিসংঘ শান্তি মিশনের প্রধান হিসেবে সগৌরবে দায়িত্ব পালন করেন।

শান্তিরক্ষা মিশন এখন আয়ের খাত

শান্তিরক্ষী ও বিভিন্ন ইকুইপমেন্ট পাঠিয়ে বাংলাদেশ প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। শান্তিরক্ষীদের বেতন-ভাতা এবং ক্ষতিপূরণের হার বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীও পুলিশ সদস্যদের জন আকর্ষণীয়। মিলিটারি কনটিনজেন্টের অস্ত্র, সরঞ্জাম, যানবাহন, তৈজসপত্রের জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক অর্থ পরিশোধ (রিইমবার্সমেন্ট) করা হয়। শান্তিরক্ষীদের দ্বারা অর্জিত আর্থিক সুবিধা দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এটি এখন বাংলাদেশের আয়ের খাত।

শান্তিরক্ষা কূটনীতি জাতীয় কূটনীতির অংশ

বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা বিশ্বের সর্বত্র দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরিতে সাহায্য করেছেন এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে ভূমিকা রাখছেন। শান্তিরক্ষা কূটনীতি এখন, জাতীয় কূটনীতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃত পক্ষে প্রতিটি শান্তিরক্ষীই বিদেশে বাংলাদেশের শান্তিদূত।

লেখালেখির নতুন দিগন্ত

পিস কিপিং এখন বাংলা সাহিত্যে লেখালেখির নতুন ও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বিষয়। সাম্প্রতিককালে শান্তিরক্ষা অপারেশনে অভিজ্ঞতার উপর চমৎকার বেশ কিছু (প্রায় ৫০টি বই) লেখা এসেছে। মূলত শান্তিরক্ষীগন জাতিসংঘ মিশনে তাদের বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতার উপর ঐ বইগুলো লিখেছেন। এটি নিঃসন্দেহ বাংলা সাহিত্যের নতুন দিগন্ত। সম্প্রতি প্রকাশিত (অক্টোবর ২০২৩) এ ধরনের চমৎকার একটি বই হলো, কর্নেল মো. হাফিজুর রহমান এর ‘স্মৃতিময় ইরান-ইরাক ও জর্জিয়া জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন’। উল্লেখ্য, কর্নেল হাফিজ বাংলাদেশের প্রথম শান্তিরক্ষা মিশন ‘ইউনিমগ’ (১৯৮৮) এ একজন তরুণ ক্যাপ্টেন হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

জাতিসংঘে আকর্ষণীয় ক্যারিয়ারের সন্ধানে

বর্তমানে শান্তি মিশনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা (অধিকাংশই সেনাবাহিনীর) জাতিসংঘের অসামরিক কর্মকর্তা হিসেবে চমৎকার অবদান রাখছেন। ইন্টারন্যাশনাল সিভিল সার্ভিস কমিশনের অধীনে বর্তমানে প্রায় ৫০ জনেরও বেশি অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা বিভিন্ন শান্তিমিশনে অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। এ ছাড়াও বাংলাদেশের প্রায় শতাধিক অসামরিক কর্মকর্তা সগৌরবে বিভিন্ন জাতিসংঘ শান্তিমিশনে কাজ করছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা ও উন্নয়নমূলক কাজে এই ধরনের চাকরি তরুণ বাংলাদেশিদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় হতে পারে। এখানে উল্লেখ্য যে, এই ধরনের চাকুরির ক্ষেত্রে ইংরেজি, ফরাসি ও আরবি ভাষায় দক্ষতা বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

শান্তিরক্ষা মিশনে পরিবর্তনের ধারা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা

বিবর্তনের ধারায় পিস-কিপিং এ অনেক পরিবর্তন এসেছে ও বতৃমানে ইন্টিগ্রেটেড অথবা মালটি ডাইমেনশনাল শান্তিরক্ষা মিশনগুলো দিন দিন জটিল ও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে। বর্তমানে ‘ডিজিটাল পিস কিপিং’ ও ‘সাইবার পিস কিপিং’ এর বিষয়গুলো আলোচিত হচ্ছে। এ ছাড়াও আলোচনায় আছে ৪র্থ প্রজন্মের ‘রোবাস্ট পিস কিপিং’-এর বিষয়টি। শান্তিরক্ষা মিশনের ধরনে যে আবশ্যিক পরিবর্তন ও চাহিদা আগামী সময়ে দৃশ্যমান তা বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জগুলো কী ধরনের হতে পারে ও তার মোকাবিলা কীভাবে করতে হবে তার জন্য বিস্তারিত ও খোলামেলা আলোচনা প্রয়োজন।

উল্লেখ্য বর্তমানে, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন অ্যান্ড ট্রেনিং (বিপসট) ভবিষ্যৎ শান্তিরক্ষীদের এ -সংক্রান্ত বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে। ১৯৯৯ সালে পিস কিপিং অপারেশনস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (পিকেওটিসি) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু। ২০০২ সালে নতুন সামর্থ্য ও সম্পদ নিয়ে এই স্টেট অব দ্য আর্ট প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান নামে যাত্রা শুরু করে। রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাসে অবস্থিত এই বিপসট ইতোমধ্যে পিস কিপিং এর প্রশিক্ষণে আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেছে।

শান্তিরক্ষা বিষয়ে গভীর গবেষণা

শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ নিয়ে গভীর চিন্তালদ্ধ, জ্ঞানপ্রসূত, গবেষণা, রচনা ও প্রকাশনা প্রয়োজন। এ বিষয়ে বেশ ঘাটতি রয়েছে। তবে এর মধ্যেও একটি চমৎকার অ্যাকাডেমিক উদ্যোগ আলোচনা করা যেতে পারে। এটি হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্ক’ বিভাগের দুই মেধাবী তরুণ অধ্যাপক রাশেদ উজ জামান ও নিলয় রঞ্জন বিশ্বাস এর লেখা- ‘আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশের দুই দশক : একটি মূল্যায়ন’ (প্রতিচিন্তা, এপ্রিল-জুন ২০১৪)। বাংলাদেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের শুধু ইতিবাচক দিকগুলো গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। জাতিসংঘ মিশনে প্রকৃতি পরিবর্তন বা অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলায় বাংলাদেশের করণীয় সম্পর্কে মিডিয়াগুলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের অভাব রয়েছে।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এগিয়ে যাওয়ার পথরেখা

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের নিরাপত্তা এবং কৌশলগত পরিবেশ দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। অপ্রতিসম হুমকির উত্থান, রাষ্টবিরোধী সদস্য ও সংগঠনের উপস্থিতি, কোভিড-১৯ মহামারি কারণে বিঘ্নিত পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তনে বৈশ্বিক প্রভাব, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং তথ্য যোগাযোগ বিপ্লব জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা পরিস্থিতিকে বহুগুণে জটিল করে তুলেছে। ফলশ্রুতিতে শান্তিরক্ষীরা নিজেরাও নানা প্রকার আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। এছাড়াও নারী ও শিশুরা ক্রমাগত বহুমুখী হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। তাই এ জাতীয় সংঘাত প্রতিরোধ এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় নারীদের ভূমিকা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা কন্টিনজেন্ট সমূহের সাংগঠনিক কাঠামো ও কার্যপদ্ধতির পরিবর্তন জরুরি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য জাতিসংঘের মতো একটি বহুজাতিক পরিবেশে কাজ করার সুযোগ অনেক ব্যাপৃত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এ ধরনের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অংশগ্রহণের কারণে সংগঠিত সব নীতি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের প্রত্যক্ষ অংশীদার হতে পারছে, ঠিক তেমনি শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত সেনাসদস্যরা কর্মসূত্রে বিভিন্ন দেশের সেনা সদস্যদের সঙ্গে কাজের প্রয়োজনে যোগাযোগ ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ পাচ্ছেন। এর ফলে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের বিভিন্ন ভাষাগত দক্ষতা, সামরিক পেশাদারি, নৈপুণ্য এবং ব্যক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা এ দেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা যোগ করেছে। উল্লেখ্য, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিবেচনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য নতুন সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই চলমান প্রক্রিয়া যে কোন দেশের সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নের জন্য অনস্বীকার্য।

আফ্রিকায় নতুন সম্ভাবনা

শান্তিরক্ষা মিশনগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য পরোক্ষ আর্থিক সুবিধাও তৈরি করেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের জন্য কৃষি ও ওষুধ খাতগুলোয় নতুন বাজার সৃষ্টি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমানে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে কৃষিজমি লিজ নিয়ে খামার স্থাপন করেছে, যা বাংলাদেশ এবং লিজ প্রদানকারী দেশ উভয়ের খাদ্য চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে এবং একই সঙ্গে তা উভয় দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

শান্তিরক্ষীদের অভিবাদন

শান্তিরক্ষা মিশনে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থেকে সেনা প্রেরণের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এবং অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নিজ দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য ভবিষ্যতের সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করেছে বাংলাদেশের শান্তিসেনারা।

আজ ২৯ মে বিশ্ব শান্তিরক্ষী দিবস। এই দিন শান্তিরক্ষী কার্যক্রমে আমাদের গর্বিত অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আজ বাংলাদেশ সবার কাছে শান্তি স্থাপনকারী বীরের দেশ হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে। আজকের দিনে আমরা সেই সব বীরকে স্মরণ করি, যাদের আত্মত্যাগের ফলে শান্তি রক্ষা সম্ভব হয়েছে এবং বাংলাদেশ বিশ্বে তার অবস্থান সমুজ্জ্বল করতে পেরেছে। বর্তমানে শান্তি রক্ষা মিশনে কর্মরত সব গর্বিত শান্তিরক্ষীর জন্য রইল প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

মো. বায়েজিদ সরোয়ার : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, গবেষক

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

২৭ নভেম্বর : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

২৭ নভেম্বর : আজকের নামাজের সময়সূচি

দুই বিভাগে বৃষ্টির পূর্বাভাস

বুধবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে ৩১ নাগরিকের বিবৃতি

ঢাকা কলেজে শিবিরের শীতবস্ত্র বিতরণ

উসকানিমূলক প্রতিবেদন না করতে অনুরোধ সিএ প্রেস উইং ফ্যাক্টসের 

আইনজীবী হত্যার বিচারের দাবিতে জাবিতে বিক্ষোভ 

চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যায় জড়িতদের শাস্তি দাবি ইসকনের

দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ফারুকীর স্ট্যাটাস

১০

গণঅভ্যুত্থানে আহত এতিম হাসানকে পাঠানো হলো থাইল্যান্ডে

১১

ভারোত্তোলনে চ্যাম্পিয়ন সেনাবাহিনী

১২

চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যার বিচার চান চরমোনাই পীর

১৩

চিন্ময় ব্রহ্মচারীর নিঃশর্ত মুক্তি দাবি সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের

১৪

যুব হকিতে বাংলাদেশের শুভসূচনা

১৫

পিছু হটতে বাধ্য হলো ইসরায়েল, এলো যুদ্ধ বিরতির ঘোষণা

১৬

ঢাকা কলেজে আগুন

১৭

টঙ্গীতে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে আহত ১০

১৮

চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যার ঘটনায় হেফাজতের বিবৃতি

১৯

সনাতনী জাগরণ জোটের কর্মসূচির সঙ্গে আমাদের সংশ্লিষ্টতা নেই : ইসকন বাংলাদেশ

২০
X