আমার মতে, হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে কম আলোচিত বিষয় তার রচিত ছোটগল্প। বাংলাসাহিত্যে যারা অসাধারণ ছোটগল্প লিখেছেন, তাদের নামের লিস্ট করলে বা সেরা ছোটগল্পের লিস্ট করলে সেখানে হুমায়ূন আহমেদের নাম বা তার লিখিত কোনো না কোনো ছোটগল্পের নাম থাকবে বলেই আমার মনে হয়।
গল্পগুচ্ছ আর বনফুলের শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পের পর আমি সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছি হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্প পড়ে। সিম্পলি ব্রিলিয়ান্ট কিন্তু আলোচনা কম। তার উপন্যাস নিয়ে সে পরিমাণ আলোচনা আর সমালোচনা হয়, ছোটগল্প নিয়ে আলোচনা সে জায়গায় অনেকটাই নীরব।
‘ভয়’ নামের একটা ছোটগল্প আছে হুমায়ূন আহমেদের। বাংলাসাহিত্যে এমন ভূতের গল্প আমার জানামতে নেই। এই গল্পে কোনো ভূত নেই, কোনো জিন পরীর গল্প বলেন নাই হুমায়ূন আহমেদ, জাস্ট আছে কোনো ভয়ংকর কিছুর উপস্থিত থাকার অশরীরী অনুভূতি। একজন নির্দিষ্ট মানুষের জন্য এই ভয়ের উৎপত্তি হয়; যার কোনো ব্যাখ্যা নেই। এই ব্যাখ্যাহীন অনুভূতিটা অস্বস্তির জন্ম দেয় গল্পটা পড়ার সময়! গরমের ছুটির এক দুপুরে গল্পটা পড়েছিলাম বলে মনে আছে। দুপুরবেলা ভূতের গল্প পড়ে কখনো শরীর ঘেমে উঠতে পারে, এই গল্প না পড়লে জানা হতো না।
আরেকটি পছন্দের ছোটগল্প ‘সৌরভ’। আরও অনেক আছে, নাম শেষ হবে না বলে।
হুমায়ূন আহমেদের নাটক আর সিনেমায় বাড়ির কাজের বুয়া বা কাজের লোকদের চরিত্র খুবই ইন্টারেস্টিংভাবে দেখানো হতো। বিশেষ করে তারা প্রচুর কথা বলে। এ ব্যাপারটা বেশিরভাগ পরিচালকের নাটক-সিনেমায় আপনি পাবেন না; সেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ক্যারিকেচারিশ হয়ে যায় অথবা এসব ক্যারেক্টার অগুরুত্বপূর্ণ থাকে কিংবা লেখাই হয় না ! ‘চেহারা সুরত সুন্দর হওয়ায় কী যে বিপদে পড়ছি! খালি বিবাহের সম্বন্ধ আসে’ কিংবা
‘মিরপুর-৩ নম্বরে ডেরাইভিং শিখতেসি। ডেরাইভিং শেখনের পরে পেলেনে চইড়া ইনশাআল্লাহ মিডল ইস্টে চলে যাব। বাকিটা আল্লাহপাকের ইচ্ছা।’ এসব ডায়লগ এখনো কী পরিমাণ রিলেভেন্ট, সেটা মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সংখ্যা দেখলেই হয়তো টের পাওয়া যায়।
অনেক ডিরেক্টর হয়তো ভবিষ্যতে হুমায়ূন আহমেদের চেয়ে বেটার নাটক বানাবেন, বিশেষ করে মেকিংয়ের দিক থেকে। তবে হুমায়ূন আহমেদকে বিট করা যে জায়গাটায় মোটামুটি অসম্ভব মনে হয় আমার- চরিত্র নির্মাণ আর সংলাপ। এ দুটি জায়গায় তিনি জাস্ট আনবিটেবল।
এত এত নাটক দেখেছি জীবনে, বেশিরভাগ সময় সংলাপ একদম মনে থাকে না। গল্প আর অভিনয় মনে থাকে জাস্ট বা বেশি হলে মেকিং আর সাউন্ড ডিজাইন।
কিন্তু এসব লাইন সম্ভবত মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মনে থাকবে-
তিতলী ভাইয়া, এক গ্লাস পানি হবে? নরমাল! মতি মিয়া কারো ধার ধারে না। হ্যালো! রমনা থানা? ওসি সাহেব আছেন? জি কে বলছেন? আজকে তো তোমাকে বড়ই সৌন্দর্য লাগতেছে। চাচা মিয়া, আপনি তো কথার দোকান খুলে বইছেন! বিয়া করব না, লইজ্জা লাগে। চা গররররম! হুদা মাটি খাবা?
খেয়াল করে দেখবেন, হুমায়ূন আহমেদের নাটকে আপনার কখনো জাহিদ হাসানকে মনে থাকবে না, মনে থাকবে আনিসকে। শাওন আর শীলাকে আপনার মনে থাকবে না, মনে থাকবে তিতলী আর কংকাকে। ফারুখ আহমেদকে মনে থাকবে না, মনে থাকবে মতি মিয়া আর তৈয়বকে। চ্যালেঞ্জারকে মনে থাকবে না, দোতারা চাচাকে মনে থাকবে।
এই ঘোর সৃষ্টির ক্ষমতা, এই এক আশ্চর্য ক্ষমতা আমি খুবই মিস করি। কীভাবে একটা মানুষের পক্ষে দিনের পর দিন এই জিনিস করা সম্ভব? এটা তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাই না সেভাবে অন্যদের কাজে।
হুমায়ূন আহমেদের অনেক বই ভীষণ পছন্দের, অনেক বই ভালো লাগে না, অনেক বই পড়লে মনে হয় কেন লিখলেন এটা, অনেক বই পড়লে মনে হয় এ রকম আরেকটা কেন লিখলেন না! জীবনের বেশিরভাগ সময় লেখালেখি, নাটক, সিনেমা, নুহাশপল্লী নিয়ে ব্যস্ত থেকে বিদায় নেওয়ার আগে হুট করে টিভিতে অনেক সাক্ষাৎকার কেন দিলেন, সেটাও বুঝি না! কারণ জীবনে তো এর আগে এত সাক্ষাৎকার দেন নাই তিনি, এত মানুষের সামনে তো এর আগে আসেন নাই। তিনি কি টের পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি আর ফিরবেন না? তা না হলে কেন ঘেঁটুপুত্র কমলা বানিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে এটা আমার বানানো শেষ সিনেমা’?
উত্তর জানা নাই। রহস্য বিরাজমান এখনো তার অনেক কিছুতে। তিনি তো সবসময়ই এমনই থাকতে চেয়েছিলেন। রহস্যমানব।
লেখক : শিক্ষক, সিনেমা বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন