বিশ্বব্যাপী পেনশন খুবই নিরাপত্তা ও সম্মানজনক পদ্ধতি হলেও বাংলাদেশে এর প্রক্রিয়া ও তাৎপর্য ভিন্ন। দীর্ঘদিন ধরে লাখ লাখ সরকারি কর্মকর্তা ও তাদের পরিবার পেনশনের ওপর নির্ভর করে কোনোমতে জীবনের শেষের সময়টুকুতে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করে আসছেন। তবে পেনশন গ্রহণ ও আদায় করার প্রক্রিয়া কখনোই সম্মানজনক ও সহজ ছিল না। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার অবসর জীবনকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যেতে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে ‘সর্বজনীন পেনশন স্কিম’।
শুরুতে সবাই উৎসুক থাকলেও, এটি ঘোষণার পর স্কিমে নিবন্ধনের হার প্রমাণ করে যেভাবে শুরু হয়েছে সেভাবে এটি সর্বজনীন ও সবার জন্য সম্মানজনক প্রতীয়মান হয়ে উঠতে পারেনি বলে হতাশা, শঙ্কা ও বৈষম্যের গন্ধ রয়েছে এই উদ্যোগের মধ্যে।
প্রথমে নাম নিয়েই কথা বলা হয়েছে ‘সর্বজনীন’। ‘সর্বজনীন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে সবার জন্য। আরেকটু বড় করে বললে, সবার মঙ্গলের জন্য নিহিত বা উদ্দিষ্ট। আর সর্বজনীন পেনশন বলতে বোঝায় বাংলাদেশের সব নাগরিকের জন্য। তবে এ ক্ষেত্রে বয়স-বিভাজন থাকতে পারে, সেটি যৌক্তিক বটে: যেমন ১৮-৬০ বছর। কিন্তু বিভিন্ন পেশার মধ্যে বিভাজন এনে যেভাবে উঁচু-নিচু ক্রম সৃষ্টির কৃত্রিম প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা কোনোভাবেই সর্বজনীন তো নয়ই, রীতিমতো বৈষম্যমূলক। আর তাই দেশজুড়ে প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহারের ডাক এসেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে।
এরই মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক সরকারি কর্মচারীদের অবসরোত্তর জীবনের আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষা দিতে বিদ্যমান ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে সরকার সর্বজনীন পেনশন স্কিম ঘোষণা করা হয়েছে। এটি জনবান্ধব কি না, জনগণের আর্থিক সক্ষমতায় এটি কতটা যৌক্তিক ইত্যাদি ছাপিয়ে যে বিষয়টি সবাইকে হতাশ ও শঙ্কিত করেছে, তা হলো কার্যত এটি সর্বজনীন নয়। বিশেষ করে আমলাসহ কয়েকটি সংস্থার জন্য এই স্কিম বাধ্যতামূলক না হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে।
অথচ সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় নতুন যুক্ত হওয়া প্রত্যয় স্কিমের রূপরেখা ঘোষণা করা হয়েছে এবং বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আগামী জুলাইয়ের পর স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থার চাকরিতে যারা যোগদান করবেন, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় প্রত্যয় স্কিমে যুক্ত করা হবে। কোনো কোনো পেশাকে এর আওতামুক্ত রাখা কোনোভাবেই সর্বজনীনতার পরিচায়ক নয়। কোনো পেশার মানুষকে এই স্কিমের আওতামুক্ত করার অর্থ—হয় তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে, কিংবা তাদের স্থান সবার ওপরে; তাই সাধারণ নাগরিকের সঙ্গে তাদের এক কাতারে ফেলা অনুচিত।
বাংলাদেশে প্রচলিত চর্চা অনুযায়ী সামরিক, বেসামরিক, বিচার বিভাগ ও আমলাতন্ত্রকে এই তথাকথিত ‘সর্বজনীন’ স্কিমের আওতামুক্ত রেখে যখন স্কিমটিকে সর্বজনীন নাম দেওয়া হয়, তখন এর আসল অর্থ, তাৎপর্য ও অন্য পেশাজীবীদের বৈষম্যের কথা কাগজে-কলমে লেখা না থাকলেও সহজে তা অনুমেয়। সম্প্রতি সরকারের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ১ জুলাইয়ের পর থেকে স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার চাকরিতে যারা যোগ দেবেন, তারা বিদ্যমান ব্যবস্থার মতো আর অবসরোত্তর পেনশন সুবিধা পাবেন না। তাদের সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয়’ স্কিমে বাধ্যতামূলকভাবে আওতাভুক্ত করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা এই পেনশন স্কিমের কোথায় থাকবেন, তা নিয়ে তাদের সঙ্গে একবার আলাপ করার প্রয়োজন বোধ না করার-ই বা কী কারণ, বোধগম্য নয়।
সামরিক, বেসামরিক, বিচার বিভাগ ও আমলাদের জন্য বিদ্যমান পেনশনসহ সুবিধাদি অপরিবর্তিত থাকবে। অন্যদিকে সর্বজনীন পেনশনে নিবন্ধন না করলে ভবিষ্যতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পেনশন সুবিধাবঞ্চিত হবেন—এমন দ্বৈত নীতি কোন নীতির ওপর ভিত্তি করে রচিত?
বৈষম্যমূলক ধারাটি যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পেরে এই স্কিমটি এরই মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসমাজ প্রত্যাখ্যান করেছেন। স্বায়ত্তশাসিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিষয়ে সরকারের সাম্প্রতিক পরিবর্তিত (২০১৫ বেতন কাঠামো গঠনের প্রাক্কালে নানা অসম্মানজনক ও অবজ্ঞাসূচক আলোচনায় পরিলক্ষিত) যে মনোভাব পরিলক্ষিত হয়েছে, তারপর এই বৈষম্য শিক্ষকসমাজকে চরমভাবে ব্যথিত করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন ইতোমধ্যে সরকারকে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছে। পৃথকভাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে যে, এই বৈষম্যমূলক স্কিম কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এর ফলে ভবিষ্যতে মেধাবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশায় আকর্ষণ বোধ করবেন না, বরং বিকর্ষিত হবেন।
এমনিতেই আমলানির্ভর সমাজ-সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থার দৌরাত্ম্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আগের সেই জৌলুস-সম্মান ও মর্যাদা নেই, ফলে আগে যেটা উল্টো দেখা যেত, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্য থেকে বিসিএসের চাকরিতে যোগদান করতে দেখা যায়। এই বৈষম্যমূলক ও আমলা-প্ররোচিত ও বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত স্কিম বাস্তবায়িত হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্ষতির সম্মুখীন হবে, আমলারা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী তার অপেক্ষায় আছেন।
কিন্তু সরকারকে তো পুরো বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে, পুনর্বিবেচনা করতে হবে। সরকার তো সবার জন্য, আর সর্বজনীন শব্দের অর্থও সবার জন্য। আমলাসহ কোনো কোনো পেশার মানুষ কেন আইভরি টাওয়ারে অবস্থান করবেন। তারা কি ভিন্ন গ্রহ থেকে দেশমাতৃকার সেবায় নিয়োজিত হয়েছেন? এমতাবস্থায়, শিক্ষকতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির দাবিগুলো বাস্তবায়ন না করে উল্টো তাদের ভবিষ্যৎকে হতাশাজনক ও অন্ধকারাচ্ছন্ন করার উদ্দেশ্য নিয়ে শিক্ষকসমাজ আজ উদ্বিগ্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পেশাকে কি আরও ঝুঁকিময় না করলেই নয়!
শুরুতে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হলেও আমলাপ্রীতি, অস্পষ্টতা, বৈষম্য ইত্যাদি কারণে পেনশন প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ার দশায় পড়েছে। যেখানে ১০ কোটি মানুষ পেনশন স্কিমের আওতায় আসবে বলে ধারণা করা হয়েছিল, সেখানে প্রথম ১০ মাসে শুধু এক লাখের কিছু বেশি মানুষ পেনশন স্কিমে নিবন্ধন করেছেন। কারণ এটি যে সর্বজনীনতা পায়নি, দেশের মানুষ তা জানে। আমলাসহ কয়েকটি খাতকে এর আওতামুক্ত রাখায় শুধু শিক্ষকসমাজ নয়, জনমনে পেনশন স্কিম নিয়ে সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। তা ছাড়া আলোচনার শুরুতে বলা হয়েছিল এই স্কিমটি বাধ্যতামূলক নয়, আট-দশ বছর মানুষ যখন এর সুবিধা বুঝতে পারবেন, ধীরে ধীরে সবাই নিবন্ধন করবেন। কিন্তু এখন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে; এর ভিত্তি কী?
মোট কথা হলো, দেশের যে কোনো আইন, সুযোগ-সুবিধা সর্বজনীন করতে হবে। দেশের প্রতিটি নাগরিক যেন এর থেকে সুবিধা পায়, তা হলে প্রতিদানস্বরূপ দেশও তার কাছ থেকে সেবা ও ভালোবাসা পাবে। ফলে দেশ ও দেশের মানুষ উভয়ই উপকৃত হবে। তবে কোনোকিছুই যেমন চাপিয়ে দেওয়া যাবে না, তেমনি কারও জন্য প্রযোজ্য, কোনো কোনো পেশা এর আওতামুক্ত—এ জাতীয় বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ কোনোভাবেই সমীচীন নয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোনো বৈষম্যমূলক সমাজের স্বপ্ন দেখেননি। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন ‘সোনার বাংলা’র। বৈষম্যমূলক নীতি ও আচরণ দিয়ে ‘সোনার বাংলা’ বাস্তবায়ন করা কোনোদিন সম্ভব হবে না। তাই সর্বজনীন নাম দিয়ে যে অ-সর্বজনীন ও বিভাজিত স্কিম ঘোষিত হয়েছে, তা পুনর্বিবেচনা করত প্রকৃতপক্ষে জনবান্ধব পেনশন স্কিম প্রবর্তন সময়ের দাবি।
একইভাবে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের মতো এমন মহতী উদ্যোগের সঙ্গে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদাহানিকর ও পদাবনতিসূচক নীতি একেবারেই বেমানান। সরকারের এই জনকল্যাণমূলক উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই; কিন্তু প্রশাসন-ঘনিষ্ঠ কোনো বিশেষ মহলের প্ররোচনায় উদ্যোগটি যেন জনভোগান্তি, ভয়, শঙ্কা বা বৈষম্যসূচক নীতিতে পর্যবসিত না হয়, সরকারকে সেদিকে সচেষ্ট থাকতে হবে। কোনো মহল বা পেশাকে অত্যধিক গুরুত্ব না দিয়ে সবার জন্য সমতাভিত্তিক ও সম্মানজনক নীতি গ্রহণ আবশ্যক।
বৈষম্যমূলক নীতি দ্রুত বন্ধ করে সবার জন্য সমতাভিত্তিক, মঙ্গলজনক ও সবার জন্য প্রযোজ্য (সত্যিকার অর্থে সর্বজনীন) নীতি বাস্তবায়নে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি।
ড. আলা উদ্দিন: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়