অনেকদিন আগে রাশিয়াকে নিয়ে একটি আর্টিকেল পড়ছিলাম। তাতে লেখা ছিল, সে দেশের সিক্রেট বিভাগের কাজগুলো যেখানে সম্পন্ন হয়, সেখানে কম্পিউটারের ব্যবহার নিষেধ। পরিবর্তে, তারা পুরানো দিনের টাইপ রাইটারে ফিরে গেছে। পেপারলেস থেকে পুনরায় পেপার-বেইজড পদ্ধতিতে! ঘটনাটা বলার কারণ হলো- উন্নত দেশের উচ্চ শিক্ষায় প্রচুর লেখালেখির বিষয় রয়েছে। সেখানকার শিক্ষার্থীদের অনেকগুলো অ্যাসাইনমেন্ট লিখে সফট কপি অনলাইনে সাবমিট করতে হয়।
সম্প্রতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রোগ্রাম, চ্যাটজিপিটির আগমনে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ বেকায়দায় পড়েছে। এতদিন অনলাইনে সফট কপি লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে নির্দিষ্ট তারিখে জমা দিত। এভাবে লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি প্ল্যাগারিজম সংক্রান্ত দূষণ থেকে মুক্ত থাকবে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্ল্যাগারিজম চেক করার সফটওয়্যার চালালে সহজেই তা ধরা পড়ে। তবে, মুশকিল হলো- চ্যাটজিপিটির মতো সফটওয়্যার ব্যবহার করে ইউনিক অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি সম্ভব। প্ল্যাগারিজম চেক করার সফটওয়্যার তাতে কিছুই ধরতে পারবে না। অবস্থা বেগতিক দেখে অস্ট্রেলিয়ার কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান গতানুগতিক খাতা-কলমের যুগে ফিরে গেছে, যাতে শিক্ষার্থীরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করতে না পারে [একইভাবে কিছু দিন পূর্বে তারা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় পাঠ্যপুস্তকের সফটকপির পরিবর্তে হার্ডকপিকে ফিরিয়ে এনেছে।]।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI (Artificial Intelligence) নিয়ে কাজ হচ্ছে অনেক দিন ধরেই। এআই নির্ভর নানারকম প্রযুক্তি সাধারণ মানুষের হাতে এলেও, এর ব্যবহার ও প্রভাব ততো ব্যাপক ছিল না। আবার এআই নির্ভর সব প্রযুক্তি সাধারণ মানুষের হাতের নাগালেও আসেনি। সম্প্রতি উন্মুক্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যাদুমন্ত্র নিয়ে হাজির হয়ে প্রযুক্তি জগতে সিরিয়া-তুরস্কে হওয়া ভূমিকম্পের চেয়ে বড়ো ভূমিকম্প ঘটিয়ে দিয়েছে- ChatGPT (Chat Generative Pre-trained Transformer). এখানে চ্যাট মানে বাতচিত করা। আর GPT হলো সর্বাধুনিক মেশিন শিখন মডেল, যা পূর্বাহ্ণে বিপুল ডাটা নির্ভর প্রশিক্ষণে মানুষের মতো পাঠ প্রদান করতে পারে।
অপরদিকে, এক কথায় চ্যাটজিপিটিকে বলা যায়- একটি ইলেক্ট্রনিক বট। বট মানে web robot. এটি এমন এক অ্যাপ্লিকেশন যা মানুষের অনুকরণে ইন্টারনেটে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে। এটিকে "talkbot," "bot," "IM bot," "interactive agent" or "artificial conversation entity" নামেও ডাকা হয়। ChatGPT-এর মতে, ”ChatGPT হচ্ছে OpenAI দ্বারা প্রশিক্ষিত একটি ভাষা মডেল। এটি প্রশ্নের উত্তর দেয়, লেখা তৈরি করে, প্রবন্ধ লিখে, ডেটা এন্ট্রি করে, ইত্যাদি।” চারদিকে হৈচৈ ফেলে দেওয়া এই অ্যাপ্লিকেশটি ব্যবহারকারীর প্রশ্নে ইন্টারনেটের তথ্য ব্যবহার করে নিজের তৈরি উত্তর প্রদান করে।
এটি অন্য বট থেকে বিশেষ হয়েছে এ কারণে যে, এটি মানুষের ন্যায় টেক্সট তৈরি করতে পারে ও ফলোআপ প্রশ্ন বুঝতে পারে। পূর্বের প্রশ্নের সাথে মিলিয়ে নতুন প্রশ্নের যে কনটেক্স তৈরি হয়, তা বুঝে উত্তর প্রদান করতে পারে। যাতে ব্যবহারকারীর মনে হবে- তিনি কোনো এক পণ্ডিত ব্যক্তির সাথে কথোপকথন করছেন। তবে, এ চ্যাটবটের আসল মুন্সিয়ানার জায়গা হলো এটি নতুন জ্ঞান তৈরি করতে পারে, যা পূর্বসূরিদের সাথে এর পার্থক্য তৈরি করে দিয়েছে। এটি ”মানুষের ন্যায়” পাঠ তৈরি, বাক্য ও প্যারাগ্রাফ সম্পূর্ণ করে, অনুবাদ, প্রশ্নোত্তর প্রদান, সারমর্ম তৈরি, ও ভাষা প্রক্রিয়াকরণের নানা কাজ করে থাকে। আর এসব টেকনিকেই চ্যাটজিপিটি বাজিমাত করেছে।
চ্যাটজিপিটির টেকনিকটা আসলে কী? মানুষ সবসময় তার মতো কাজ করে এমন কিছু তৈরির চিন্ত করেছে। এআই-এর মূল ধারণা নেওয়া হয়েছে মানুষের মস্তিষ্কের কাজ করার প্রক্রিয়া থেকে। মানব মস্তিষ্ক পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবেশ ও ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে, সে তথ্য প্রক্রিয়াজাত করে, নতুন পরিস্থিতিতে ভিন্নরকমভাবে তা ব্যবহার করতে পারে। নতুন জ্ঞান তৈরি করতে পারে।
মানুষ দীর্ঘদিন ধরে চাচ্ছিল, কম্পিউটারকেও এভাবে তথ্য দেওয়া হলে, সেটি যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে মানুষের মতো করে ইউনিক বা মৌলিক উত্তর দিতে পারে। আর এখানেই চ্যাটজিপিটি বাজিমাত করেছে। এ বটটি মানুষের মস্তিষ্কের প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে পারে। এর সাথে কথাবার্তায় মনেই হবে না, আপনি মেশিনের সাথে কথা বলছেন। কথা বলা মানে, এটি এখনও লিখে লিখে উত্তর দেয়। ভবিষ্যতে আরো ফিচার যুক্ত হবে- তখন অকল্পনীয় অনেক কিছুই পাওয়া যাবে।
প্রশ্ন হলো- এটি কী কী করতে পারে? আমার তো মনে হয়- প্রশ্নটি বরং উল্টোভাবে করা যায়- এটি কী কী করতে পারে না? একটা বিখ্যাত ঘটনায় এ অংশটুকু শুরু করি। একবার সুরসম্রাট আব্বাসউদ্দীন আহমদ গেলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নিকট একটি গানের জন্য। জানা যায় আব্বাসউদ্দীন কবির জন্য পান নিয়ে গিয়েছিলেন। আর সে পান খেয়ে ১৯৩১ সালে নজরুল লিখে দিলেন বাংলা ভাষার অন্যতম জনপ্রিয় গান- ”ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।“ তবে, আজ এরকম একটা গানের জন্য আপনাকে হয়ত কারো জন্য পান নিয়ে যেতে হবে না। চ্যাটজিপিটিকে কনটেক্স্ট, কবিতার ধরণ ও স্টাইল বুঝিয়ে দিন, দেখবেন- কবি নজরুলের থেকে কম সময়ে আপনার কবিতা হাজির। অবশ্য সে কবিতা নজরুলের কবিতার কতটা কাছাকাছি যাবে তা নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন আছে। সে যাক- তবে গড়পড়তা কবিদের চেয়ে ভালো কবিতা পাওয়া যেতেই পারে। এ যেন আলাদিনের প্রদীপের দৈত্য। আপনার সেবায় সবসময় হাজির।
কোনো বিষয়ের উপর আপনার ১০০০ ওয়ার্ডের আর্টিকেল দরকার। জাস্ট আদেশ করেন- আর্টিকেল হাজির। লেখা দেখে ফিদা হয়ে যাবেন! ঠাহর করাই কঠিন- এটা কি মানব মস্তিষ্কের কাজ নাকি এআই-এর কাজ। আপনি যদি বলেন, কোনো বিষয়ের উপর এক সেট প্রশ্ন তৈরি করে দিতে হবে- নো সমস্যা। বাংলাদেশ নিয়ে একটু দীর্ঘ লেখার জন্য কী কী প্রশ্ন করতে হবে বলার পর, এটি আমার সামনে এক গাদা প্রশ্ন হাজির করে। আবার আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম- এটি কীভাবে আমাকে গবেষণায় সাহায্য করতে পারে। উত্তরে যা জানালো সে এক বড়ো তালিকা। এটি বলেছে, আর্টিকেল থেকে এর বিভিন্ন দিক খুঁজে বের করা, লেখকের ঝোঁক বুঝা, সারাংশ তেরি করা, তুলনা করা, ডাটা অ্যানালাইসিস করা, ব্যাকরণের ভুল ধরে সংশোধন করে দিতে পারবে। চাইলে অনেক অংশ এর মাধ্যমে লিখেও নেওয়া যেতে পারে। অনুবাদও করে দিবে। একইভাবে, প্রয়োজনমতো নির্দেশনা দিয়ে এ বটকে দিয়ে বিভিন্নরকমের অ্যাপলিকেশও তৈরি করে নেওয়া সম্ভব।
বুঝাই যাচ্ছে, ChatGPT শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, মানবসম্পদ উন্নয়ন, গবেষণা, সেবাপ্রদান খাত, যোগাযোগ, বিনোদনসহ নানাক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের সুবিধা লাভ করার সুযোগ রয়েছে। সহজেই অনেক তথ্য হাতের মুঠোয় পাওয়া সম্ভব। যেমন- কোনো জটিল ও দীর্ঘ বিষয় সম্পর্কে জানার জন্য সময়ের প্রয়োজন। উন্মুক্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বটকে বলে দিলে সে সংক্ষিপ্ত ও বোধগম্য উপায়ে সেসব উপস্থাপন করবে। ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে এটি উন্নততর সেবা প্রদান, দক্ষতা বৃদ্ধি, ব্যয় কমানো, দ্রুত তথ্য প্রদান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখতে পারে। কর্মী নিয়োগ, রেকর্ড তৈরি, ফিডব্যাক প্রদান, ও অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতেও এটি ভূমিকা রাখতে পারে।
গবেষকদেরকেও চ্যাটজিপিটি সহায়তা করতে পারে- নানারকম তথ্য দিয়ে, তথ্য প্রক্রিয়াকরণে সহায়তা করে, কুম্ভিলকবৃত্তি ধরতে ও ব্যাকরণসম্মত ভাবে লিখতে। চাইলে, তথ্য সরবরাহের একঘেয়েমি কাজগুলো এখন এই বটের হাতে তুলে দেওয়া যায়। প্রতিষ্ঠানগুলো কল-সেন্টারের দায়িত্ব সামলানোর দায়িত্বও দিতে পারে চ্যাটজিপিটির মতো অ্যাপ্লিকেশনকে। গল্প-কবিতা, প্রবন্ধ, কৌতুক, শুভেচ্ছা বার্তা তৈরিতে সহযোগিতা ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ডিজাইন ও ফটোশপের কাজও করে দিতে এ ধরনের বটগুলো। এক কথায়- হাতের মুঠোয় বিশ্ব। অন্যদিকে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে, যেমন- তথ্য সংগ্রহ, মডেল প্রশিক্ষণ ও ব্যবহার, এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষণা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে এটি নতুন উদ্যোক্তা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে। এতো সুবিধার চ্যাটজিপিটি হয়ে দাঁড়িয়েছে এ যাবৎকালের বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অ্যাপ্লিকেশন।
ডিসেম্বর ২০২২-এ সালে চালু হওয়া, মাইক্রোসফটের সাপোর্ট পাওয়া, এ বটের ব্যবহারকারীর সংখ্যা বর্তমানে ১০ কোটির বেশি। এর গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধির গতি এতই বেশি যে, প্রযুক্তি দুনিয়ার দানব গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফেবেটও নড়েচড়ে বসেছে। তারাও তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর প্রযুক্তি দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাজারে আনতে উঠেপড়ে লেগেছে। দেরি হলে, তারা একসময় হয়ত নোকিয়া ফোনের মতো হারিয়ে যেতে পারে।
এ তো গেলো নানারকম সুবিধা ও প্রযুক্তি দুনিয়ার যুদ্ধের দামামার কথা। চ্যাটজিপিটির মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর প্রযুক্তি মানব সম্প্রদায়ের জন্য নানারকম অসুবিধাও ডেকে আনবে। তবে, প্রথমেই মনে রাখতে হবে, এটি সর্বরোগনিরোধক কোনো ‘প্যানাশিয়া’ নয়। বুকার পুরস্কার জয়ী সাহিত্যিক Howard Jacobson তাঁর “The Finkler Question” নামক গ্রন্থে সতর্ক করেছেন- ”Social media and smartphones will lead to an increase in illiterate children within a generation.” অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও স্মার্টফোন এক প্রজন্মের মধ্যে মূর্খ শিশুদের সংখ্যা বৃদ্ধি করবে। সোশ্যাল মিডিয়া ও স্মার্টফোন মূর্খতা বৃদ্ধি করলে, উন্মুক্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সনদধারী অশিক্ষিত ও অক্ষম প্রজন্ম তৈরি করবে, যারা যন্ত্রের সহযোগিতা ব্যতীত নিজে নিজে কিছুই করতে পারবে না। ’না পড়িয়াই’ তারা বিদ্বান হবে।
যাক সে কথা, চ্যাটজিপিটি যে তথ্য প্রদান করে, তা মূলত ২০২১ সাল নাগাদ ইন্টারনেটে প্রাপ্ত তথ্যভিত্তিক। যে সব তথ্য ইন্টারনেটে নেই, সে বিষয়ে চ্যাটজিপিটি নীরব। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে এটি ভুল উত্তরও প্রদান করতে পারে। ঠিক প্রশ্ন করা বা প্রম্পট দিতে না পারলে, কাঙ্ক্ষিত ফলাফল নাও পাওয়া যেতে পারে।
কথোপকথনের ক্ষেত্রে চ্যাটজিপিটি অনেকটাই ফরমাল। বাগধারা ও বাগ্বিধি সম্পর্কে এর ব্যাপক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মানুষের পরস্পরের কথাবার্তায় অনেক সময় ডাবল মিনিং থাকে, তাতে হয়ত আলোচনর প্রসঙ্গও পরিবর্তন হয়। কিন্তু এ বট সবসময় দৃশ্যমান অর্থটাই গ্রহণ করে। এটি এখনও শিখে চলেছে, চলছে প্রশিক্ষণ। আসলে এর শেখা বন্ধ হবে না। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডিটেইলড উত্তর প্রদানে এটি ব্যর্থ। প্রায় ক্ষেত্রেই এটি সারাবার্তা প্রদান করে। ঘটনার শৈল্পিক প্রকাশেও চ্যাটজিপিটির সমস্যা রয়েছে। অন্যদিকে, অঞ্চলভেদে সাংস্কৃতিক ভিন্নতা, তথা কনটেক্স্টের বিষয়টি সামাল দেওয়াও এর জন্য ব্যাপক কঠিন কাজ। অনুবাদেও ঝামেলা পাকাতে পারে। যেমন- আমি চ্যাটজিপিটিকে বলেছিলাম, রবিঠাকুরের “আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী” অংশটুকু ইংরেজিতে অনুবাদ করতে। চ্যাটজিপিটির অনুবাদ হলো- “I am Chini go, Chini to you, foreigner.” পরে আবার গুগলকে দায়িত্ব দিলাম- দেখি সে নিজের ভুল অনেকটা শুধরে নিয়েছে। গুগলের অনুবাদ হলো- “I know you Oh foreigner.“
এতদিন প্রযুক্তি মানুষের কায়িক শ্রমের চাহিদা কমিয়ে দিচ্ছে। রোবট নির্ভর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হতে রক্ত-মাংসের অনেক মানুষের কর্ম বিলোপ হয়েছে। তবে, একসময়ে অকল্পনীয় হলেও, এবার মানসিক শ্রম বা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজেও মানুষের চাহিদা হ্রাস পাবে। চ্যাটজিপিটি অনেক মানুষকে কর্মচ্যুত করবে। বিশেষ করে, উন্নয়নশীল দেশের যারা বিভিন্ন উন্নত দেশের জন্য আউটসোর্সিং-এর কাজ করে, তারা তাদের কাজ হারাতে পারে। বিভিন্ন কল সেন্টারে কাজ করা মানুষদের চাহিদাও কমে যাবে। এছাড়া প্রকাশনার সাথে জড়িত সেক্টরেও লোকবলের চাহিদা কমতে পারে। নিম্ন থেকে মাঝারি মানের সৃষ্টিশীল কাজে নিয়োজিত অনেকে লেখক, গবেষক তাদের কাজ হারাবে। কেননা এ মানের চেয়ে ভালো কাজ চ্যাটজিপিটিই করে দিতে পারবে। এছাড়া পক্ষপাতমূলক ডাটার ব্যবহারে এ ধরনের অ্যাপ্লিকেশন সমাজে বৈষম্য ও বঞ্চনা বৃদ্ধি করতে পারে।
উপরন্তু, উপযুক্ত অবকাঠামোর অভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলো চ্যাটজিপিটির পুরো সুবিধা নিতে পারবে না। আবার, এখন বিনামূল্যে হলেও, ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য ফি আরোপ উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যেকার বিদ্যমান বৈষম্য আরও বৃদ্ধি করবে। অন্যদিকে, অনেকে চ্যাটজিপিটির মতো ভাষা মডেলের ব্যবহারের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের বক্তব্য হলো, চ্যাটজিপিটি হয়ত কোনো উৎস হতে সরাসরি কপি করে কোনো তথ্য প্রদান করে না। এটি এক বা একাধিক লেখকের লেখার প্যাটার্নের অনুকরণে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর তৈরি করে। কিন্তু ঐসব লেখকদের স্বীকৃতিও দেয় না। আবার একই কারণে চ্যাটজিপিটির লেখায় সৃজনশীলতা ও মৌলিকত্বের ঘাটতি থেকে যায়। ফলস্বরূপ, নজরুল বা কবিগুরুর লেখার প্যাটার্নের ন্যায় লেখা পেলেও, তাঁদের মতো মৌলিক ও সৃজনশীল কাউকে পাওয়া যাবে না। এছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাজাত কাজ ও সিদ্ধান্তের জন্য কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান জবাবদিহিতার আওতায় আসবে। একইভাবে, এসব বটের মাধ্যমে গুজব ও প্রোপাগান্ডা ছড়াতে পারে, যা সমাজে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। সমস্যা হতে পারে সংবেদনশীল ব্যক্তিগত তথ্যের সংরক্ষণ ও গোপনীয়তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও।
প্রত্যেক নতুন কিছু- সম্ভাবনা যেমন আনে, তেমন করে সমস্যাও আনে। নতুন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি করে বলা যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুনিয়ায় চ্যাটজিপিটি যেভাবে হৈচৈ ফেলে দিয়েছে, তাতে করে- এর সাথে আরও নতুন নতুন প্রতিযোগী যুক্ত হবে।
আগামী এক দশকে এ সেক্টরে বিশাল পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। আর এ পরিবর্তন এত দ্রুত হবে যে, একটু এদিকে সেদিক হলেই ট্রেন মিস হয়ে যাবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, কর্মসংস্থান, ব্যক্তি জীবন কোনো ক্ষেত্রই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আওতার বাহিরে থাকবে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভাষা মডেলের সাথে নতুন নতুন প্রযুক্তি যুক্ত হয়ে নতুন নতুন ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধিত হবে। উন্নয়নশীল দেশে উন্মুক্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুবিধা ঘরে তোলার ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের উপর নির্ভর করতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমাত্রার জালে সাধারণ মেধাবীরা আটকা পড়লেও, মেধাবী, সৃজনশীল ও পরিশ্রমী আদম সন্তানদের অবস্থান অক্ষুণ্ন থাকবে, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংহত হবে। এ ছাড়াও উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে নেতিবাচক প্রভাব হ্রাস পায় এবং ইতিবাচক প্রভাব সর্বোচ্চ হয়। এছাড়া, নৈতিক ও আইনগত বিষয়গুলো কর্তৃপক্ষের নজরদারির আওতায় আনতে হবে। নতুন নতুন সফটওয়্যার হয়ত মানুষ আর মানুষের লেখা আলাদা করতে পারবে।
সে যা-ই হোক, আমাদের মনে রাখতে হবে, আগামীর বিশ্বে কার কর্মক্ষেত্র কোনটি হবে, ব্যক্তি নিজে যেমন তা বলতে পারবে না, কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও হয়ত সে বিষয়ে কোনো পূর্বানুমান করতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে সুযোগের জন্য সবসময় চোখ-কান খোলা রাখা, এবং যুগের পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলাটা হবে সৌভাগ্যের চাবিকাঠি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়ত আমাদের পিছনের দিকে ফিরে যেতে হবে। যেমন- পড়াশোনার ক্ষেত্রে সফটওয়্যারের ব্যবহার কমে গিয়ে হার্ডওয়্যারের ব্যবহার বাড়তে পারে। এ প্রসঙ্গে আইনস্টাইনের একটা মন্তব্য দিয়ে শেষ করবো। তিনি বলেছিলেন, "তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কোন অস্ত্রে হবে জানি না, কিন্তু চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ অবশ্যই লাঠি পাথর দিয়ে হবে।"
ড. জাহাঙ্গীর এইচ মজুমদার: শিক্ষক ও গবেষক
মন্তব্য করুন