আজাদ হোসেন
প্রকাশ : ২৩ মে ২০২৪, ০৯:১০ পিএম
আপডেট : ২৩ মে ২০২৪, ০৯:৩১ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
আজাদ হোসেনের নিবন্ধ

এমপি আনার হত্যা : এবার শাহীনকে ধরে ফেলা হোক

বাঁ থেকে এমপি আনার ও মাসুক মিয়া (মাঝে)। পুরোনো ছবি
বাঁ থেকে এমপি আনার ও মাসুক মিয়া (মাঝে)। পুরোনো ছবি

আপনি কি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার করেন? যদি করে থাকেন তাহলে অবশ্যই ‘শাহীন’ নামটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা বা ট্রল করতে দেখেছেন।

ফেসবুক ব্যবহার না করলেও বাস্তব জীবনে ‘শাহীন’ নামটির অতিব্যবহারের সাক্ষী নিশ্চয়ই হয়েছেন। ২০২৩ সালের শুরুর দিকের ঘটনা। হঠাৎ চারদিকে শাহীন শাহীন রব ওঠে। ভাইরাল হয় শাহীন। দৈনন্দিন জীবনের নানা পরিস্থিতিতে, কথার ছলে মানুষ শাহীন নামটি বলতে শুরু করে।

এখনো যারা বিষয়টি ধরতে পারেননি, তাদের জন্য একটু পরিষ্কার করা যাক। ২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে সুনামগঞ্জের ছাতকে যুক্তরাজ্য প্রবাসী মাসুক মিয়ার বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। তবে প্রবাসীর উপস্থিত বুদ্ধিতে চার ডাকাত ধরা পড়ে।

এরপর কীভাবে, কোন কৌশলে ডাকাতদের ধরেছিলেন গণমাধ্যমকে জানাচ্ছিলেন মাসুক মিয়া। ডাকাতদের হামলার একপর্যায়ে এক ডাকাতকে ধরে ফেলেছিলেন তিনি। এরপরই ছোট ভাই শাহীনকে আহ্বান জানান অন্য ডাকাতদের ধরে ফেলতে। মাসুক মিয়া ছোট ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘শাহীন নটীর পোলাদের ধরে ফ্যাল।’

গণমাধ্যমকে দেওয়া ওই বর্ণনার একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতে আপলোডও করা হয়। এর দুইমাস পর হঠাৎ ডাকাত ধরার বর্ণনা দেওয়ার সেই ভিডিওটি ভাইরাল হয়। ভাইরাল হয় শাহীন নামটি। শাহীনকে নিয়ে অনলাইনে শুরু হয় ট্রল, স্যাটায়ার, মিম বানানো। ওই ভিডিও বা স্যাটায়ার, মিমে শাহীন নামের লোকদের মেনশন দেওয়া শুরু হয়। বাস্তব জীবনেও শাহীন নামের লোকেদের নিয়ে শুরু হয় মজা করা।

এতদিন পরে বিষয়টি নতুন করে টেনে আনার একটি কারণ আছে। সেটি হচ্ছে- ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের হত্যাকাণ্ড এবং এর পেছনেও ‘শাহীন’!

চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়ে খুন হন এমপি আনার। তার মরদেহ টুকরা টুকরা করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গোপন করা হয়। এই নির্মম ঘটনা সামনে আসার পর থেকেই শুরু হয়েছে নানা জল্পনা। একের পর এক বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

ঘটনা জানাজানি পর থেকেই কাজে লেগে পড়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ভারতের পুলিশও নামে তদন্তে। উভয় তদন্তেই বেশ কয়েক জনের নাম উঠে এসেছে। তবে মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে আক্তারুজ্জামান শাহীন।

আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহীন এমপি আনারের বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার। তিনি মার্কিন পাসপোর্টধারী ও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। তার বাড়ি ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে। আরও একটি পরিচয় আছে তার, কোটচাঁদপুরের পৌর মেয়র শহিদুজ্জামান সেলিমের ছোট ভাই তিনি।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জান যায়, আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাকারবারী চক্রের সঙ্গে যুক্ত এই শাহীন। এমপি আনারের সঙ্গে তার সখ্য এবং দুজন মিলেই সীমান্তের চোরাচালান চক্র নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন। সর্বশেষ গত ১০ মে কলকাতা হয়ে বাংলাদেশে আসেন শাহীন।

এমপি আনারের সঙ্গে শাহীনের স্বর্ণের বড় একটি চালানের টাকা নিয়ে ঝামেলা চলছিল। বিষয়টি মীমাংসার জন্য কলকাতা যান এমপি আনার। মূলত এক নারীকে দিয়ে ফাঁদে ফেলে কলকাতায় নেওয়া হয় তাকে। এরপর পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। কালবেলায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

প্রতিবেদনটি থেকে আরও জানা যায়, আনারকে যে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে, তার প্রমাণ পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ। তবে মরদেহ এখনো পাওয়া যায়নি। এ ঘটনার তদন্ত করছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডির মহাপরিদর্শক অখিলেশ চতুর্বেদী বলেছেন, ‘আমরা কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছি, যার ভিত্তিতে মনে করা হচ্ছে যে ওনাকে হত্যা করা হয়েছে।’

আবার ডিবির দেওয়া বর্ণনামতে, কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জীবনী গার্ডেনে ট্রিপ্লেক্স ফ্ল্যাট ভাড়া করেন মূল পরিকল্পনাকারী এবং নিহত এমপির বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার আক্তারুজ্জামান শাহীন। আগে থেকেই ভারতে অবস্থান করা কয়েক সন্ত্রাসীর সঙ্গে চুক্তি করেন তিনি। এরপর বাংলাদেশ থেকে ওই ফ্ল্যাটে নিয়ে যান চরমপন্থি নেতা আমানুল্লাহকে। সবশেষে শিলাস্তি রহমান নামে এক নারীকে দিয়ে ট্রাপ তৈরি করেন শাহীন। শিলাস্তিকে দিয়েই এমপি আনারকে ওই ফ্ল্যাটে ডেকে নেওয়া হয়। সেখানেই হত্যা করা হয় আনারকে।

এদিকে আনার হত্যা মিশনে জড়িত কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও হোতা শাহীন এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে।

আমাদের সমাজে এমন শাহীনের অভাব নেই। শাহীনের মতো এমন অনেকেই আছে যারা নানা অপরাধ করেও ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকে। আবার একটি অপরাধ করে এরা থেকে থাকে তেমনটাও নয়। করে চলে একের পর এক অপরাধ। এভাবেই দিনের পর দিন বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা। এর পেছনে বড় কারণ হলো বিচারহীনতা।

পেশাগতভাবে সাংবাদিক হওয়ার প্রায় প্রতিনিয়ত এমন ঘটনা বা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু এমন কিছু কিছু ঘটনা থাকে যা অনেক সময় আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। কেন এত বেপরোয়া। একটুতেই বর্বর হয়ে উঠছে একে অন্যের ওপরে। সামান্য কিছু টাকার জন্য ঘটছে খুনের ঘটনা। এ ছাড়াও অনেক হত্যার ঘটনা আছে যার কোনো মোটিভই নেই। শুধু ক্রোধের বশে খুন করে বসেন একে অন্যকে।

এ তো গেল হত্যার ঘটনা। এর বাইরে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে যৌন হয়রানি, চাইল্ড অ্যাবিউজ, শিশু হত্যা, সংঘর্ষ ও রাজনৈতিক সংঘর্ষের মতো ঘটনা। পত্রিকার পাতা উল্টালেই এমন খবর চোখে পড়বে। আবার এসব দিন দিন যেন বেড়েই চলেছে। যেন দেখার কেউ নেই। মাঝে মাঝে কিছু ঘটনা নিয়ে তোলপাড় হলেও আড়ালে থেকে যায় অধিকাংশ। যাকে পুঁজি করে ঘটে আরও নানা অপরাধ।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের গত ছয় মাসের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দেখা গেছে, চলতি বছরে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ছয় মাসে দেশে ১৫২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। যেখানে ধর্ষণের পর ৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে। যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ৬১ জন। এ ছাড়াও ১৭৬ জন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে মামলা হয়েছে মাত্র ৬৩টি। শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ২২৬টি। মামলা হয়েছে ১৩৯টি।

রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন ২৭ জন। এই ছয় মাসে ঘটনা ঘটেছে ২৮৯টি। একই সময়ে বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলন করার সময় আরও ২৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এসব ছাড়াও প্রতিনিয়ত নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হচ্ছে যা সবার আড়াইলে থেকে যাচ্ছে। এগুলো দেখে প্রশ্ন আসে এত বর্বরতা-নিষ্ঠুরতা কোথা থেকে আসে। কোথায় এর শেষ?

তবে অন্যান্য ঘটনার তুলনায় এমপি আনার হত্যার তদন্তকাজ হয়তো খুব দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছে। এখন দেখার বিষয় বিচারকাজ কতটা দ্রুত এগিয়ে যায়। আমরা চাই প্রতিটা হত্যা, প্রতিটি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিচার হোক। সব অপরাধী আইনের মুখোমুখী হোক। এমপি আনার হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী শাহীনের সঙ্গে সঙ্গে সব অপরাধীকে এবার ধরে ফেলা হোক।

লেখক: সাংবাদিক

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কোয়ার্টার ফাইনালেই ক্রুসকে অবসরে পাঠাতে চায় স্পেন

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা মিথ্যা : বরকত উল্লাহ বুলু

মালয়েশিয়ায় প্রবাসীদের জন্য এনআইডি কার্যক্রম বিষয়ক মতবিনিময় সভা

অপুকে ছাগলের বাচ্চার সঙ্গে তুলনা করলেন বুবলী

উইম্বলডন ২০২৪ / দ্বিতীয় রাউন্ডে জোকোভিচ, ভন্দ্রোসোভার বিদায়

আওয়ামী লীগ নয়, জিয়া, খালেদা, এরশাদ দেশ বিক্রি করেছেন : প্রধানমন্ত্রী

ফল উৎসব আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ : আব্দুস সালাম 

সমুদ্রসম্পদ আহরণে সব সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে : বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী

এমপি আনার হত্যা, যেভাবে পালিয়ে যান ফয়সাল

নতুন ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দুই কোরিয়ার

১০

যমুনার গর্ভে বিলীন ৫ শতাধিক বাড়িঘর

১১

প্রধানমন্ত্রীর বেইজিং সফরে উন্নয়ন ইস্যু প্রাধান্য পাবে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

১২

মুম্বাইয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রোহিতদের সংবর্ধনা

১৩

এমপি আনার হত্যা : এবার ফয়সালের দোষ স্বীকার

১৪

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী

১৫

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ করার পরিকল্পনা নেই : জনপ্রশাসনমন্ত্রী

১৬

দেশকে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিয়েছে সরকার : নিতাই রায়

১৭

সুনীল অর্থনীতিকে মূল অর্থনীতিতে কাজে লাগাতে হবে : প্রতিমন্ত্রী

১৮

আলমগীর হোসেনের ওপর হামলার প্রতিবাদে উদীচীর সমাবেশ

১৯

জামিন পেলেন ছাত্র মৈত্রীর সম্পাদক অদিতি

২০
X