অনেক বিশ্লেষক এবং গুণী ব্যক্তিরাও মনে করেন, ১৯৮৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে মিখাইল গর্ভাচভের নেতৃত্বে যে সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়, সেটার পরিণতিতেই শেষ পর্যন্ত ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান হয়। ১৯৮৯ সালে ‘ওয়ারশ’ জোট ভুক্ত দেশগুলির বিদেশ মন্ত্রীদের এক সম্মেলনে এটা প্রথম ঘোষণা করা হয় যে এই দেশগুলি তাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ স্থির করে নেয়ার পক্ষে কোনো বাধার সম্মুখীন হবে না। ১৯৯০ সালে দুই জার্মানির পুনর্মিলন হয়। ২১ নভেম্বর ১৯৯০ সালে।
এর পরেই ইউরোপের ৩৪টা দেশ প্যারিস সম্মেলনে ঘোষণা করে, ইউরোপের দীর্ঘদিনের সংঘর্ষের পরিসমাপ্তি ঘটল। ১৯৯১ সালের এপ্রিলে ওয়ারশ জোটের ও ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান হয় বলেও মনে করা হয়।
এই ঠান্ডা যুদ্ধ বা কোল্ড ওয়ারের কিছু কথা উল্লেখ না করলেই না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর প্রায় দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠার এক অঘোষিত যুদ্ধ চলছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে এরই নাম ঠান্ডা যুদ্ধ বা কোল্ড ওয়ার। কারণ, এই দুই বৃহৎ শক্তির মধ্যে সরাসরি কোনো সামরিক সংঘাত ঘটেনি। গোড়ার দিকে এই লড়াই মূলত দুইটা দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও কালক্রমে এটা পর্যবসিত হয়
ধনতান্ত্রিক বনাম সমাজতান্ত্রিক শক্তি জোটের এক দীর্ঘ, অঘোষিত যুদ্ধে। গোড়া থেকেই এই ধারণাটা নিয়ে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যাহতি পরে পূর্ব ইউরোপে এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কোথাও কোথাও কমিউনিজম একটা ধারা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এই আতঙ্ক কারো কারো মতে ‘লাল জুজুকে’ মোকাবিলা করার জন্য বা রুখে দেয়ার জন্য তখন তৎপর ও উদ্যোগী হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের নির্দেশে কমিউনিজমের গতিরোধ করার এই নীতি ইতিহাসে ‘ট্রুম্যান নীতি’ নামেও পরিচিত এবং এই ভাবেই সূত্রপাত হয় ঠান্ডা যুদ্ধের। ১৯৪৭ সালে মার্কিন কংগ্রেসের এক অধিবেশনে মার্কিন ধনকুবের ও মার্কিন প্রেসিডেন্টের এক পরামর্শদাতা, বার্নাড বারুচ প্রথম কোল্ড ওয়ার অথবা ঠান্ডা যুদ্ধ কথাটা ব্যবহার করেন।
১৯৪৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটাতে সফল হয় ফলে একদিকে যেমন দুই বৃহৎ শক্তি ওই সময়ের, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় সামরিক ভারসাম্য, অন্যদিকে শুরু হয় কমিউনিজমের প্রসার এবং কমিউনিজমকে রক্ষার এক দীর্ঘস্থায়ী অঘোষিত যুদ্ধ, যা ১৯৪৯ সালে চীন বিপ্লবের পর আরও এক নতুন মাত্রা অর্জন করে। এই যুদ্ধ তীব্রতম আকার ধারণ করে ৫০ ও ষাটের দশকে এবং ৯০ দশকের প্রারম্ভে ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান হয়।
কারো কারো মতে, কার্যকরভাবে ঠান্ডা যুদ্ধ শুরু হয়, ১৯৪৮ সালে, যখন পশ্চিম ইউরোপে কমিউনিজমকে রক্ষার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মার্শাল প্ল্যানের মাধ্যমে যুদ্ধবিধ্বস্ত পশ্চিমা দেশগুলিকে মার্কিন অর্থ সাহায্য প্রদান করে যুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় অর্থনীতিতে তার নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে থাকে।
এই বিপুল আর্থিক সাহায্যের অন্যতম লক্ষ্য ছিল পশ্চিম ইউরোপের ভেঙে যাওয়া পুঁজিবাদী অর্থনীতির দ্রুত পুনর্গঠন, যাতে বিধ্বস্ত আর্থিক অবস্থার সুযোগ নিয়ে এই সব দেশে কোন ধরনের কমিউনিজম মাথা চাড়া দিয়ে না ওঠে। ১৯৪৯ সালে তখন গঠিত হয় কমিউনিজমের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিম ইউরোপের প্রধান কয়েকটা দেশকে দিয়ে ‘NATO’ (উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা) একটা সামরিক জোট তৈরি করা। শুধু ইউরোপে নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন বিশেষভাবে সচেষ্ট হয়, লাতিন আমেরিকা এবং মধ্য আমেরিকার দেশগুলিতে কমিউনিজম থেকে রক্ষার জন্য ওই কিছু দেশে যে কোনো ধরনের গণতান্ত্রিক ও বামপন্থি সরকারকেও উচ্ছেদ করতে।
এইভাবে ১৯৫৪ সালে গুয়াতেমালায়, ১৯৬৫ সালে কিউবার বিপ্লবের পরে ডমিনিকান রিপাবলিকে ও ১৯৭৩ সালে চিলিতে প্রগতিশীল সরকারকে কখনো সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটিয়ে বা পরোক্ষভাবে সামরিক বাহিনী ও প্রশাসনকে মদত জুগিয়ে উচ্ছেদ করাও হয়।
১৯৫৫ সালে ‘নাটোর’ জবাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিকে নিয়ে গঠিত হয় ‘ওয়ারশ’ চুক্তির নামে পাল্টা সামরিক জোট। ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে এবং ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় প্রত্যক্ষভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক ও সামরিক হস্তক্ষেপে নতুন শক্তি জোটকে ভেঙে দেয়া হয় এই যুক্তিতে যে, সমাজতন্ত্রের গণতান্ত্রিকরণের নামে নতুন যে কোনো শক্তির উত্থান আসলে কমিউনিজমের বিরুদ্ধে মার্কিন মদতপুষ্ট সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত ছাড়া আর কিছু না।
এই যুক্তিকে সামনে রেখেই ১৯৬৮ সালে Chekoslovalia তে ওয়ারশ জোটের সামরিক হস্তক্ষেপের পরে ঘোষিত হয় ব্রেজনেভ নীতি, যার মর্মার্থ হলো, পূর্ব ইউরোপের যে কোনো দেশে প্রতিষ্ঠিত সমাজতন্ত্র বিপন্ন হলে সেই দেশকে পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্র থেকে মুক্ত করার অধিকার উল্লিখিত ‘ওয়ারশ’ দেশগুলির থাকবে। এভাবেও ইউরোপের দেশগুলিকে কেন্দ্র করে ঠান্ডা যুদ্ধ তীব্র হয়ে যায়। এর সাথে যুক্ত হয় সংস্কৃতি ও মতাদর্শগত স্তরে দুইটা বৃহৎ শক্তির পারস্পরিক আক্রমণ ও বিদ্বেষ। ঠান্ডা যুদ্ধ কোনো সময়েই প্রত্যক্ষ সামরিক সংঘর্ষের রূপ নেয়নি, তবে ১৯৬২ সালে কিউবাতে রুস ক্ষেপণাস্ত্রের ঘাঁটি প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রায় সরাসরি সংঘর্ষের মুখোমুখি হয়। ভাগ্যিস সেটা শেষ পর্যন্ত এক ধরনের সমঝোতায় ঘটেনি।
ঠান্ডা যুদ্ধ, এই বিষয়টা উর্বর মস্তিষ্কে আসবার কারণ, ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কেও যে গণিত, জ্যামিতি ও অ্যালজেব্রা এখন দেখি। মনে হয়, উপমহাদেশে এই দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে একটা ঠান্ডা যুদ্ধের মহড়াই চলছে। মতাদর্শগত এবং সাংস্কৃতিক যুদ্ধ রয়েছে দুদেশের মধ্যে। এর সাথে যুক্ত অর্থনীতি ও রাজনৈতিক স্বার্থ। আপাতত বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতা বা ভারত মগ্নতা। দুইটাই ক্ষমতার রাজনৈতিক প্রচারণা ও স্বার্থে পরিচালিত এবং সুসংগঠিত বলা যায়। এটাও এক ধরনের কোল্ড ওয়ার কিনা, কে জানে!
মাহমুদ রেজা চৌধুরী : সমাজ ও রাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন