১১ জুলাই ২০২৩ থেকে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে রুপির ব্যবহার শুরু করেছে বাংলাদেশ। ঢাকায় দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর একটি পাইলট কর্মসূচি হিসেবে এ কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন। প্রাথমিকভাবে শুধু রুপিতে লেনদেন হবে এবং পর্যায়ক্রমে টাকায়ও লেনদেন চালু হবে বলছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এখন বাংলাদেশের কোনো ব্যবসায়ী ভারতের সঙ্গে আমদানি বা রপ্তানির ক্ষেত্রে রুপিতে এলসি খুলতে চাইলে তা করতে পারবেন। এতদিন বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের পুরোটাই হতো মার্কিন ডলারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ভারতে বছরে প্রায় দুই বিলিয়ন বা ২০০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। এর বিপরীতে ভারত থেকে আমদানি করে প্রায় ১৪ বিলিয়ন বা ১৪০০ কোটি ডলারের পণ্য। অর্থাৎ বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় সাতগুণ।
অন্যদিকে ভারতের মোট আমদানির ১৫.৪৩% আমদানি করে চায়না থেকে— তার পরেই আছে ইউনাইটেড আরব আমিরাত, আমেরিকা, সৌদি আরব, ইরাক প্রভৃতি দেশ। ভারত সবচেয়ে বেশি আমদানি করে ইলেকট্রনিক পণ্য, খনিজ তৈল, মেশিনারিজ ও কেমিক্যাল প্রভৃতি।
যেহেতু বাংলাদেশ ভারতে যে পরিমাণ আমদানি করে তার সাত ভাগের একভাগ রপ্তানি করে, তাই বাংলাদেশের হাতে খুব বেশি রুপি থাকবে না আমদানি ব্যয় পরিশোধের জন্য। অর্থাৎ রুপির ঘাটতির কারণে আপাতত মনে হচ্ছে, এ ধরনের বিনিময় হার টেকসই হবে না কিংবা টেকসই অর্থনীতির জন্য সহায়ক হবে না। এই ধরনের যুক্তি সামনে নিয়ে অনেকেই বলতে চাচ্ছেন রুপি ও টাকার বিনিময়ের সিদ্ধান্ত যৌক্তিক নয় কিংবা বাংলাদেশের জন্য ভালো কিছু হবে না।
অন্যদিকে আমরা দেখি, অতীতের পরিসংখ্যান দিয়ে সবসময় ভবিষ্যৎ নির্ণয় করা যায় না। যেমন আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশ সম্পর্কে অর্থনীতি বিষয় ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। কারণ তিনি বুঝতেই পারেননি বাংলাদেশের মানুষের প্রকৃত উৎপাদন ক্ষমতা ও বর্তমান উৎপাদনের পার্থক্য কত বেশি, অর্থাৎ গ্যাপ বিশ্লেষণ করতে পারেননি।
আমরা দেখতে পাই ভারত এমন কিছু পণ্য আমদানি করে যার অনেক কিছুই বাংলাদেশ রপ্তানি করতে পারে, যেমন : চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ, ইলেকট্রনিকস পণ্য, মেশিনারিজ (বিশেষ করে জিঞ্জিরাকে প্রাধান্য দিয়ে উন্নত মেশিনারি উৎপাদন ও রপ্তানি করতে পারে বাংলাদেশ), পোশাক প্রভৃতি।
যেহেতু এ ধরনের মুদ্রাবিনিময় একটি কৌশলগত পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন দুই দেশের মুদ্রাকে শক্তিশালী করার একটি প্রক্রিয়া। তাই সে পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করার জন্য বৃহত্তর পরিকল্পনা নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। এই বৃহত্তর পরিকল্পনার প্রাথমিক কাজ হবে মুদ্রাবিনিময়ের কাঠামো তৈরি করা, যা ইতোমধ্যে চুক্তিসম্পাদন ও প্রাথমিক লেনদেনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে গেছে। দ্বিতীয় পর্যায় কাজ হবে রুপি ও টাকার চাহিদা ও জোগানে ভারসাম্য রক্ষা করা। যেহেতু বর্তমানে বাংলাদেশের জন্য রুপির চাহিদা বেশি ও জোগান কম, তাই ভারতকেই এগিয়ে আসতে হবে জোগান বৃদ্ধির সহজতর উপায় নিয়ে। জোগান বৃদ্ধির সহজতর উপায় হলো বাংলাদেশ থেকে আরও বেশি আমদানি করা এবং যারা রুপিকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করছে না, তাদের নিকট থেকে আমদানি যথাসম্ভব কমিয়ে দেওয়া।
অনেক বিশ্লেষক ইতোমধ্যে এ প্রক্রিয়াকে নিরুৎসাহিত করেছেন এবং বলেছেন, এ ধরনের বিনিময় সফল হবে না। সত্য হলো, ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ ভ্রমণের জন্য ও চিকিৎসার জন্য ভারতে যায়। এ ধরনের ভ্রমণের জন্য প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হয় অন্যদিকে ভারত থেকে অনেক ছাত্রছাত্রী বাংলাদেশে পড়তে আসেন বিশেষ করে মেডিকেল কলেজে পড়তে আসেন। ভারতের ছাত্রছাত্রীদের জন্য বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়া আরও সহজতর করা প্রয়োজন। এর ফলে বাংলাদেশে রুপির জোগান কিছু হলেও বৃদ্ধি পাবে।
ব্যক্তিগত ভ্রমণের জন্য দুই দেশের মুদ্রায় সহজে বিনিময় সম্ভব এমন একটি প্লাস্টিক কার্ড অর্থাৎ ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করাও একান্ত প্রয়োজন। অর্থাৎ বিনিময় ও বাণিজ্যকে যত বেশি সহজতর করা হবে তত বেশি দুই দেশের মধ্যে রুপি ও টাকার বিনিময় বৃদ্ধি পাবে এবং চাহিদা ও জোগানে সামঞ্জস্যতা থাকবে।
অন্য আরেকটি বিষয় দুই দেশকেই লক্ষ রাখতে হবে তা হলো— অভ্যন্তরীণ বাজারে দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক গতিতে ধরে রাখা, কারণ অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতি দুই দেশের মুদ্রাবিনিময়কেও অস্থির করবে তখন আবার সবাই ডলারে ফিরে যেতেই পরামর্শ দেবে বা স্বাভাবিক গতিতেই এমনটি হবে।
পরিশেষে বলা যায়, ঘাটতি বাণিজ্য কমিয়েই বাংলাদেশ ও ভারতের যে বিনিময় হারের সূচনা হয়েছে; তাকে স্থায়ী বা টেকসই বিনিময় হিসেবে টিকিয়ে রাখা যাবে।
মো. মশিউর রহমান : ব্যাংকার
মন্তব্য করুন