প্রফেসর ড. মো. শাহ্ আজম
প্রকাশ : ১৭ মে ২০২৪, ০২:৪২ পিএম
আপডেট : ১৭ মে ২০২৪, ০৪:৩৫ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

শেখ হাসিনা: স্বাধীন বাঙালির অনিঃশেষ প্রেরণা

বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি : সৌজন্য
বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি : সৌজন্য

আজ আমাদের আনন্দের দিন। বাঙালি যে মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারে তার প্রমাণ যে মানুষটি রেখেছেন আজ তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন। বাঙালিকে স্বমর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন যিনি, যার উদ্যোগে ভিক্ষুকের হাত আজ কর্মীর হাতে পরিণত হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত বাঙালি নয়, বরং নিজের অর্থে নিজেদের পদ্মা সেতু তৈরির সাহসী বাঙালি আমরা। সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, বাঙালির শেষ ভরসাস্থল শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন আজ।

শেখ হাসিনা ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার সবুজে ঘেরা, পাখি ডাকা, মায়াময় টুঙ্গিপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত বাঙালি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবকাল থেকেই তিনি ছিলেন মেধাবী ও সৃজনশীল মানুষ। তার পিতা বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, বাংলার গরিব-দুঃখী মেহনতি মানুষের পরম বন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদের পুরোধা ব্যক্তিত্ব, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মাতা বাঙালি জাতির সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে অনুপ্রেরণাদাত্রী, সুচিন্তাবিদ, শেখ ফজিলাতুন নেছা। তিনি পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড়। তার সহোদর: বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, শেখ রাসেল, বোন শেখ রেহানা।

বাংলাদেশের রাজনীতির গুণমান পরিবর্তনে শেখ হাসিনা অনন্য। গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনার লক্ষ্য বাংলাদেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন। তার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র হিসেবে আজ বিশ্বে সমাদৃত। বাংলাদেশের সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার আজকের যে অবস্থা, তা একদিনে রচিত হয়নি। এর পেছনে রয়েছে সুদীর্ঘ সাধনা।

১৯৫৪ সালে শেখ হাসিনার বয়স যখন ৭ বছর তখন তিনি গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসেন। ১৯৫৪ সাল থেকে জননেত্রী শেখ হাসিনা সপরিবারে ঢাকায় মোগলটুলির রজনী বোস লেনের বাড়িতে বসবাস করেন। পরবর্তীকালে ঢাকার মিন্টো রোডে অবস্থিত সরকারি বাসভবনে স্থানান্তরিত হন। ১৯৫৬ সালে শেখ হাসিনা ঢাকায় টিকাটুলির নারীশিক্ষা মন্দির বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে নান্দনিক পরিবেশে সপরিবারে বসবাস শুরু হয় তার। ১৯৬২ সালে তিনি আজিমপুর গার্লস স্কুলের ছাত্রী। হাইস্কুলে পড়াকালীন তিনি রাজনীতি সচেতন হয়ে ওঠেন। ১৯৬২ সালে কুখ্যাত হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট দিলে সারাদেশের ছাত্রসমাজের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে তিনিও প্রতিবাদে সোচ্চার হন। আজিমপুর গালর্স স্কুল থেকে যে প্রতিবাদী মিছিলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অভিমুখে যাত্রা করেছিল তার নেতৃত্বে ছিলেন শেখ হাসিনা।

শেখ হাসিনা ১৯৬৫ সালে ঢাকায় আজিমপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাস করেন। ম্যাট্রিক পাস করে তিনি একই বছরে গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট গালর্স কলেজে (বর্তমান বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয়) উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ভর্তি হন। ১৯৬৬-১৯৬৭ মেয়াদে কলেজ ছাত্রী সংসদের ভিপি (ভাইস প্রেসিডেন্ট) নির্বাচিত হন। সে সময় তিনি ছাত্রীদের অগ্রদূত হিসেবে কাজ করেন। ছাত্ররাজনীতিতে ছাত্রীদের সম্পৃক্ত করে অধিকার সচেতন করেন। এবং গরিব-দুঃখী মেহনতি মানুষের পাশে দাঁড়ান।

১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর তিনি বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৭৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে রাজনীতির সঙ্গে অন্বিত করেছেন দেশরত্ন শেখ হাসিনা। তাইতো ২০১৪ সালে সার্ক সাহিত্য উৎসবের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বলেছেন,

: বাংলার উর্বর ভূমি অসংখ্য কবি-সাহিত্যিকের জন্ম দিয়েছে। সেই মধ্যযুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত আছে। বাঙালি শিক্ষিত তরুণ কবিতার দুটো লাইন লেখেনি, এ রকম উদাহরণ খুব কমই আছে। বাংলার কোমল মাটি ও মানুষ আর প্রকৃতিই হয়ত বাঙালিকে ভাবুক করে তুলেছে। বাংলার বাউল, কবিয়াল, সাধক, বয়াতিরাও আমাদের সাহিত্য-সংগীতকে সমৃদ্ধ করেছেন। বাংলার কামার-কুমার-ছুতোরগণও এক একজন সৃষ্টিশীল শিল্পী।

সেকালের ফকির লালন শাহ্, সিরাজ সাঁই বা একালের আব্দুল করিম, রাধারমণ দত্ত প্রমুখ আমাদের মনোজগৎকে শাণিত করেছেন।

সাহিত্যের প্রসঙ্গ যেহেতু এলো সেহেতু দুয়েকটি কথা বলা দরকার। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় এই দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়কের জন্মদিনকে কেন বিশেষভাবে উপস্থাপন করছে? তিনি বাংলাদেশেকে, বাঙালিকে তার পিতার মতোই বিশ্বের সকলের কাছে উঁচু করেছেন। এর বাইরেও সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অভিভাবক হিসেবে লেখক শেখ হাসিনার জন্মদিন আমাদের একটি বিশেষ দিন বলে বিবেচনা করছি। রাষ্ট্রীয় সকল দায়িত্বের ভেতরেও লেখাকে সঙ্গী করেছেন তিনি। সাহিত্যের সঙ্গে তার যোগ কতটুকু সেটি উপলব্ধি করার জন্য তার বক্তৃতা থেকে কয়েকটি বাক্য পাঠ করছি।

: মহাকবি আলাওল, আব্দুল হাকিম, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসিম উদ্দিন, জীবনানন্দ দাশরা যুগে যুগে ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার অর্জনের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে আবারও এই ভাষাকে বিশ্ব পরিমণ্ডলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।

সাহিত্য শুধু মানুষের সুকুমারবৃত্তিগুলোকেই জাগ্রত করে না, সাহিত্য মানব ইতিহাসের মহাসড়ক। এই মহাসড়ক ধরেই পৃথিবীর এক প্রান্তের মানুষের সঙ্গে অন্য প্রান্তের মানুষের যোগাযোগ ঘটে।

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শেখ হাসিনা লড়াই করেছেন। তিনি বর্তমান বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রলীগ নেত্রী ছিলেন। এখান থেকেই বঙ্গবন্ধুঘোষিত বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা আন্দোলনে অংশ নেন। তিনি একই কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন। এক বর্ণাঢ্য সংগ্রামমুখর জীবন শেখ হাসিনার। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তিনি গৃহবন্দি থেকেছেন। তাকে অন্তত ১৯ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। বাঙালির রক্ত আর প্রার্থনায় বেঁচে আছেন তিনি।

বাংলার প্রকৃতির হিসেবে আগস্ট মাস বর্ষার মাস। আকাশ ভেঙে শ্রাবণের জল নামে। বাঙালির শ্রাবণ জলের মাস আগস্ট, জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হারিয়েছি আমরা সেদিন। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সকলের রক্তে ধানমন্ডির সবুজ মাটি লাল হয়েছিল। বেঁচে ছিলেন জাতির পিতার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। তাদের বেঁচে থাকার কারণ সে সময়ে তারা জার্মানিতে ছিলেন। শেখ হাসিনার স্বামী ও বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া তখন জার্মানির শীর্ষস্থানীয় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় কালর্সরুয়ে প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ৩০ জুলাই ১৯৭৫ পুত্র-কন্যা ও বোনসহ শেখ হাসিনা জার্মানিতে চলে যান। এর পেছনে শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের একটা বড় ভূমিকা আছে। এ বিষয়ে এম এ ওয়াজেদ মিয়া রচিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিতে চাই

বঙ্গবন্ধু আমাকে আরও জানান যে, রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে হাসিনা আমাদের ছেলেমেয়েদেরসহ জুলাই মাসের শেষের দিকে জার্মানি চলে আসবে। আর কয়েক মাস পর আমি দেশে ফিরতে পারি বিধায় হাসিনার অত টাকা পয়সা খরচ করে তখন জার্মানি চলে আসা সমীচীন হবে না, আমি এ কথা বললে বঙ্গবন্ধু বলেন, “তোমার ছেলে জয়কে কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না। ও সারাক্ষণ তোমার কথা বলে, তোমার খোঁজ করে এবং তোমার কাছে যেতে চায়। অতএব, তুমি আর কোন আপত্তি ওঠাইও না।” এ কথাগুলো বলে বঙ্গবন্ধু আমাকে তখন হাসিনার সঙ্গে কথা বলতে বলেন। হাসিনাকেও আমি একই কথা বলি। হাসিনাও আমাকে বঙ্গবন্ধুর কথাগুলো বলে। হাসিনা আমাকে এও বলে যে, আমি যতই আপত্তি করি না কেন, সে জার্মানি চলে আসবেই। এই কথোপকথনে প্রায় বিশ মিনিট অতিক্রান্ত হয়।

তিনি আরও লিখেছেন, ১৯ জুলাই রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন একান্ত সচিব আমার অফিসে ফোন করে আমাকে জানান যে, হাসিনারা ২৫ জুলাই তারিখে প্যানামের একটি ফ্লাইটে ফ্রাঙ্কফুর্ট পৌঁছবে। তিনি আমাকে উক্ত ফ্লাইটের নম্বর ও সময়সূচিও জানান। ২০ জুলাই তারিখে তিনি আবার অফিসে ফোন করে আমাকে জানান যে, হাসিনারা উক্ত ফ্লাইটে যাচ্ছে না কারণ সেটি করাচি হয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট যায়। তিনি আমাকে আরও জানান যে, পরিবর্তিত সফরসূচি অনুযায়ী হাসিনারা লুখফানসার একটি ফ্লাইটে ৩০ জুলাই সকালে ফ্রাঙ্কফুর্ট পৌঁছাবে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর শেখ হাসিনা বেলজিয়াম ও ভারতে অবস্থান করেন। ১৯৮১ সালে প্রবাসে থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব লাভ করেন তিনি। যখন তিনি দেশে ফিরে আসেন তখন তার দুটো পরিচয়, একটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি আর অন্যটি বঙ্গবন্ধুর মেয়ে। যে নেতাকে এদেশেই সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে সেই নেতার মেয়ে শুধু মানুষের ভালোবাসায় স্বদেশে ফিরে এলো! একবার ভেবে দেখুন, পরিবারের কেউ নেই, দেশ শাসনে খুনির সহযোগী, সেই সময়ে একা ফিরলেন স্বদেশের মাটিতে। তারপর শুরু হলো তার গণতন্ত্র উদ্ধারের সংগ্রাম। কাজটি সহজ ছিল না। ৬ বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব হাতে নিলেন। তখন সামরিক সরকারের চাপে দলের নেতাকর্মীরা দিশেহারা। নানা বিভাজন নেতৃত্বের প্রসঙ্গে, দলের ঐক্যের প্রতীক হলেন মুজিবকন্যা।

মহান স্বাধীনতা দিবসে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে বঙ্গবন্ধুকন্যা এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামের লক্ষ্যে নেতাকর্মীদের শপথ পাঠ করান। তিনি জীবন দিয়ে হলেও জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেন। ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল দেশে ঘরোয়া রাজনীতি চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাম ও প্রগতিশীল শক্তির সমন্বয়ে ১৫ দলীয় জোট গঠিত হয়। ১৫ দলীয় জোটের মূল লক্ষ ঘোষিত হয় অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। ১৯৮৩ সালের ১৪ নভেম্বর প্রকাশ্য রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার সাথে সাথে সর্বাগ্রে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে ১৫ দলীয় ঐক্যজোট নেত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ২৮ নভেম্বর সংসদ নির্বাচনের দাবিতে শেখ হাসিনার আহ্বানে সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালিত হয়। হাজার হাজার মানুষ এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। শেখ হাসিনা স্বয়ং এ কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন। এই কর্মসূচির পরপরই রাতে সকল রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করেন সামরিক শাসক এরশাদ। শেখ হাসিনাকে মহাখালীর বাসায় অন্তরিন করা হয়। ১৯৮৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর গৃহবন্দিত্ব থেকে শেখ হাসিনা মুক্তি পান। ১৯৮৪ সালের ৭ জানুয়ারি সামরিক সরকার আবার ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি প্রদান করে। স্থানীয় সরকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করে সামরিক শাসক। সেই সূত্রে এরশাদ উপজেলা নির্বাচনের ঘোষণা দিলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৫ দলীয় জোট উপজেলা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দাবি করে। ১৯৮৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি উপজেলা নির্বাচন বাতিলের দাবিতে ছাত্রলীগের একটি মিছিলে সামরিক জান্তার পেটোয়া বাহিনী ট্রাক উঠিয়ে দেয়। মৃত্যুবরণ করেন সেলিম ও দেলোয়ার। শেখ হাসিনা এই ঘটনাকে ফ্যাসিস্ট ও বর্বরোচিত বলে বর্ণনা করে পরদিন হরতালের ডাক দেন। ১৯৮৪ সালের ৩ মার্চ ১৫ দলীয় জোট নেত্রী শেখ হাসিনা উপজেলা নির্বাচনে সকল প্রার্থীকে তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের আহ্বান জানান। ৪ মার্চ জননেত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে ৭ প্রার্থী তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। ১৮ মার্চ আন্দোলনে শেখ হাসিনা বিজয় অর্জন করে। ১৯৮৪ সালের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের জনসভায় বোমাবাজির ঘটনা ঘটানো হয়।

শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের বলেন, ‘মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না। ভয় দেখিয়ে জনগণের আন্দোলন থেকে আমাকে সরিয়ে রাখা যাবে না। নিজের জীবন দিয়ে হলেও এদেশের মানুষের গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেব।’ ১৯৮৪ সালের ২০ ডিসেম্বর তীব্র আন্দোলনের মুখে এরশাদ সরকার আবার রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করে। তার এই দৃঢ়চেতা মানসিকতার জন্যই বাংলাদেশের জনগণ তাকে ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’ বলে অভিহিত করে।

বাংলাদেশের জনগণের মঙ্গলের জন্য বারবার গ্রেনেড আর বুলেটের সামনে দাঁড়াতে হয়েছে তাকে। কিন্তু তিনি মনস্থির করে নিয়েছেন মানুষের কল্যাণে লড়াই করতে হবে। তাই তিনি বলতে পারেন, “২০৪১ সালে আমরা বাংলাদেশকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ উচ্চআয়ের দেশে পরিণত করব, ইনশাআল্লাহ।” তিনি সে পথে হাঁটছেন, আমাদের কাজ তার সমর্থনে আত্মনিয়োগ করা। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন দুর্নীতিকে। এখানে বলতে দ্বিধা নেই, পাকিস্তান আমলে প্রায় দুই যুগের সামরিক শাসন এবং বাংলাদেশের প্রায় কুড়ি বছরে সামরিক ও বেসামরিক স্বৈরাচার মানুষকে দুর্নীতিপরায়ণ করে তুলেছে। এই ক্ষত থেকে জাতির মুক্তিলাভ সহজ হবে না। তিনি সে চেষ্টায় নীরবে কাজ করে চলছেন। তাইতো বাংলাদেশের প্রকৌশলীদের উদ্দেশে এক ভাষণে তিনি বলেছিলেন, “আমরা টেকসই উন্নয়ন চাই। আমরা এমন কাজ চাই যাতে সাধারণ মানুষের করের একটি পয়সাও অপচয় না হয়।”

বাঙালির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ই তার অভিপ্রায়। তিনি ব্যবহারিকভাবে প্রমাণ করেছেন সামরিক শাসকদের অধীনে স্বচ্ছ নির্বাচন হয় না। ১৯৮৬ সালে এরশাদ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। ১৯৮৬ সালের ২১ মার্চ ১৫ দল ও ৭ দলের লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠকে আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু রাতে বিএনপি তাদের অবস্থান থেকে সরে এসে এরশাদকে একক নির্বাচনের সুযোগ করে দেয়। শেষ পর্যন্ত ৭ মের নির্বাচনে ১৫ দলের ৮টি দল অংশ নিতে রাজি হয়। ৭ মে ব্যাপক সহিসংতার মধ্যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। রাতে নির্বাচনী ফলাফলে আওয়ামী লীগ যখন এগিয়ে তখন আকস্মিকভাবে ফলাফল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৬ সালের ৮ মে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এক বিবৃতিতে ৭ মে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জনগণ স্বৈরাচারকে প্রত্যাখ্যান করেছে বলে অভিহিত করেন। তিনি নির্বাচনের সঠিক ফলাফল ঘোষণার দাবি জানান। ১৯ মে দীর্ঘ ১২ দিন পর মিডিয়া ক্যু-এর মাধ্যমে নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে জাতীয় পার্টি ১৫৮ আসন পেয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এই ফলাফলকে একটি প্রহসন বলে চিহ্নিত করে বলেন, ‘সংসদে এবং রাজপথে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’ ১৯৮৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর তারিখে এরশাদ ১৫ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। শেখ হাসিনা এ নির্বাচনী তফসিল প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৮৭ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে আওয়ামী লীগের তিনদিনব্যাপী দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন হয়। অধিবেশনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সেনাবাহিনী সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যেকোনো মূল্যে আমাদের জাতীয় সশস্ত্র বাহিনীর মর্যাদা ও সম্মান রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর।’ তিনি সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করার দাবি জানান। কাউন্সিলের পর গণতান্ত্রিক আন্দোলন আরও বেগবান করা হয়। নব্বইয়ের নাগরিক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারের পতন হয় কিন্তু দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তখনও অনেক বাকি। জাতির ত্রাতা হয়ে এলেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু করলেন। তার নেতৃত্বে জনগণের আন্দোলনের ফলে দেশ সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে শুরু করল।

শেখ হাসিনা আজ শুধু বাংলাদেশের মানুষের কাছে নয় সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তার নিষ্ঠা, একাগ্রতা তাকে বিশ্বজুড়ে গণমানুষের নেত্রী হিসেবে পরিচিত করিয়েছে। তিনি সারা পৃথিবীর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রেরণা। যেখানে মানবতার বিপর্যয় সেখানেই শেখ হাসিনা। রোহিঙ্গা শরনার্থীদের তিনি মাতৃস্নেহে আশ্রয় দিয়েছেন। জলবায়ু, শিক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, নারী অধিকার, শান্তি প্রতিষ্ঠা আঞ্চলিক সহায়তা ইত্যাদি বিষয়ে তিনি জনতার কণ্ঠস্বর হয়েছেন। এ কারণে আমরা বলতে পারি বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ও শেখ হাসিনা এক সূত্রে গাঁথা। আমি তার বিভিন্ন মেয়াদের অর্জন নিয়ে দু-একটি কথা জানাতে চাই।

প্রথম মেয়াদ (১৯৯৬-২০০১)

শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম মেয়াদে বাংলাদেশ বিমসটেক (বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকা ও থাইল্যান্ড) এবং ডি-৮ (বাংলাদেশ, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান ও তুরস্ক)-এ অর্থনৈতিক জোটে যোগ দেওয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতায় সুযোগ আরও সম্প্রসারিত হয়। ১৯৯৯ সালের মার্চে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনে ‘ঢাকা ঘোষণা’ গৃহীত হয়। ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে রাজধানী ঢাকায় বিনিযোগ ও বাণিজ্য সহযোগিতা বিষয়ে প্রস্তুতিমূলক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯৯ সালে আঞ্চলিক সহযোগিতা বিষয়ক ভারত মহাসাগরীয় রিম অ্যাসোসিয়েশনে বাংলাদেশকে সদস্য হিসেবে বরণ করা হয়। শেখ হাসিনার উদ্যোগেই বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) আইনে স্বাক্ষর করে।

১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মেয়াদে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সাফল্যের মধ্যে রয়েছে : ১৯৯৬ সালের নভেম্বর মাসে ভারতের সাথে স্বাক্ষরিত ৩০ বছরমেয়াদি গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি, ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, খাদ্যশস্য উৎপাদনের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি, প্রতিবেশী রাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়ন এবং ১৯৯৮ সালে যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতুর নির্মাণ সম্পন্ন করা।

ভূমি আইন চুক্তি অনুস্বাক্ষরেও বাংলাদেশ ছিল দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম রাষ্ট্র। ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বরে শান্তি ও সহযোগিতায় এশীয় সাংসদদের প্রথম সম্মেলন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংগঠনটির প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে শেখ হাসিনা সরকারের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সাফল্যের মধ্যে ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা অর্জন, জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ লাভ, অ্যাসোসিয়েশন ফর এশিয়ান পার্লামেন্টারিয়ান ফর পিস (এএপিপি) গঠন। ১৯৯৯ সালে শিল্পায়ন ত্বরান্বিত করার জন্য শেখ হাসিনা সরকার একটি নতুন শিল্পনীতি ঘোষণা করে। উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তিখাত শক্তিশালীকরণ ও অধিক বৈদেশিক বিনিয়োগে আকৃষ্টকরণ।

আওয়ামী লীগ সরকার, ১৯৯৯ সালে জাতীয় সংসদে আলোচনার মাধ্যমে কুখ্যাত ইনডেমনিটিট অধ্যাদেশটি বাতিল করে- যা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের হত্যাকারীদেরর রক্ষার জন্য ১৯৭৫ সালে জারি করা হয়েছিল। যার ফলে খুনিদের বিচারের লক্ষ্যে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব হয়। শেখ হাসিনা একটি সুবিস্তৃত সামজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী নির্মাণে সচেষ্ট ছিলেন। ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে তিনি বয়স্ক ভাতা প্রবর্তন করেন, যার মাধ্যমে ৪ লাখ বয়স্ক ব্যক্তিকে মাসিক ভাতা প্রদান করা হয়। প্রথম মেয়াদে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। অর্থনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে দেশ অনেকটা উন্নতি লাভ করে।

দ্বিতীয় মেয়াদ (২০০৯-২০১৩)

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০০৫ সালে ‘১৪ দলীয় জোট’ এবং ২০০৬ সালে ‘মহাজোট’ নামে রাজনৈতিক দলগুলোর মোর্চা গঠন করে। ২০০৭-২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি দুর্নীতির মামলা রুজু করা হয় এবং তাকে এক বছর কারান্তরীণ রাখা হয়। এরপর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট ভোটবিপ্লবের মাধ্যমে ২৬২ আসনে (আওয়ামী লীগ ২৩০) বিজয়ী হয়।

এ মেয়াদে জাতীয় সংসদে ফৌজদারি কার্জবিধি (সংশোধন) বিল-২০০৯ পাস করার মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ সম্পূর্ণভাবে কার্যকর করা; সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন বেতন কাঠামো চালু করা; গৃহহীন দুস্থ ও অতি দরিদ্রদের জন্য আশ্রয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন আশ্রয়ণ প্রকল্প গ্রহণ; অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে দ্বিতীয় ‘দারিদ্র্য নিরসন কৌশলপত্র’ জাতীয় সংসদের অনুমোদন; খাদ্য নিরাপত্তা মজবুত, নারীর সক্ষমতা বিকাশ এবং জীবন মান উন্নয়নে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পটি পুনরায় চালু করা; ২০০৯ সালে জাতীয় গ্রিডে নতুনভাবে বিদ্যুতের সরবরাহ বৃদ্ধি; প্রায় ৫০০ ফোরামে অংশগ্রহণের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন ও বিদেশে বাঙালিদের শ্রমবাজার উন্নয়নে ইতিবাচক ফলাফল আনয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান অনন্য।

দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ অনুমোদন করেছে। এই শিক্ষানীতিতে শিক্ষাব্যবস্থাকে কর্মমুখী ও প্রযুক্তি নির্ভর করার সুপারিশ পাশাপাশি রাষ্ট্রের মৌলিক মূল্যবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার করা হয়েছে।

দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সঙ্গে অন্যান্য রাষ্ট্রের মধ্যকার বৈদেশিক সম্পর্ককে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তিনি প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় করেছেন এবং একটি উদার ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন।

চীন, ভুটান, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার ও সুইডেন প্রভৃতি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়ন ঘটানোর মধ্য দিয়ে দেশের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়েছে। শেখ হাসিনার গৃহীত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে আছে-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূর করা, নতুন স্থলবন্দর স্থাপন এবং বিদ্যমান স্থলবন্দরগুলোর উন্নয়ন সাধন, পরীক্ষামূলকভাবে সীমান্ত বাজার চালু করা, বাংলাদেশের আশুগঞ্জ ও ত্রিপুরার শিলাঘাটকে পোর্ট-অব-কল ঘোষণা, আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। ভারত, নেপাল ও চীনকে বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিতে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দরে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, ২০৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির জন্য ভারতের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর, বাংলাদেশ ও ভারতের বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থার যৌথ উদ্যোগে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে চুক্তি এবং বাংলাদেশের যোগাযোগ অবকাঠামো ও নদীপথের উন্নয়নে ভারতের কাছ থেকে সহজ শর্তে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণপ্রাপ্তি।

আশা করা হচ্ছে ভারত, নেপাল, ভুটান ও চীনকে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ব্যাপকভাবে লাভবান হবে।

অর্থনৈতিক সহযোগিতা ছাড়াও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে নিরাপত্তাবিষয়ক সহযোগিতা বৃদ্ধির ব্যাপারেও আগ্রহ দেখিয়েছে।

২০১২ সালে সমুদ্র আইন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালের রায়ের ফলে সমুদ্রে ১ লাখ ১১ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জননেত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে।

তৃতীয় মেয়াদ (২০১৪-২০১৮)

সপ্তম, অষ্টম এবং নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় ক্ষমতা ধরে রাখা এবং রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমনের নামে মামলা ও নির্যাতনের অভিযোগ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক এ ব্যবস্থা অবৈধ ঘোষিত হওয়া প্রভৃতি কারণে সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের উদ্যোগ নেয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অগণতান্ত্রিক এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। ২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠিত হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ১৭টি দল অংশগ্রহণ করে। ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা জয়লাভ করে। ৫ জানুয়ারি রোববার বাকি আসনগুলোতে ভোট অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। সরকার গঠনের পর জননেত্রী শেখ হাসিনা গণতান্ত্রিকভাবে দেশ পরিচালনা করেন। দেশের নিজস্ব অর্থায়নে শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করার নির্দেশ দেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ২০১৫ সালে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০১৮ সালে স্বল্পোন্নত হতে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ১৭৫১ মার্কিন ডলার।

২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা হয় এবং দেশ-বিদেশের ২০ জন নাগরিক নিহত হয়। ৭ জুলাই একই গোষ্ঠী কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে জঙ্গি হামলা চালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তবে তাদের আত্মঘাতী হামলায় সেদিন ৩ জন নিহত হয়। এই হামলার পরিপ্রেক্ষিতে দেশ বিদেশের অনেক বিশ্লেষক আশঙ্কা করেছিলেন যে, বাংলাদেশ আফগানিস্তান অথবা পাকিস্তানের পরিণতি বরণ করতে যাচ্ছে। সকলের আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণিত করে সরকার কঠোরভাবে জঙ্গিবাদ দমন করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে শক্তিশালী করা ছাড়াও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।

তৃতীয় মেয়াদে শেখ হাসিনা দেশকে আরও গতিশীল ও উন্নত করার লক্ষ্যে কাজ করেন। আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়।

চতুর্থ মেয়াদ (২০১৯-চলমান)

শেখ হাসিনার চতুর্থ মেয়াদ শুরু হয় ২০১৯ সাল থেকে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৩০০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে বেশিরভাগ সংসদীয় আসনে জয়লাভ করলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ চতুর্থবারের মতো নির্বাচনে জয়ী হয়। বিরোধীদলীয় প্রধান নেতা ছিলেন ড. কামাল হোসেন। ড. কামাল হোসেন ব্যাপক ব্যবধানে পরাজিত হন। দেশকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষে শেখ হাসিনা সরকার ও তার দল কাজ করে চলেছে।

শেখ হাসিনা চতুর্থ মেয়াদে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হাতে নিয়েছেন। বিভিন্ন জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ অব্যাহত আছে। ২০২২ সালের ২৫ জুন প্রতীক্ষিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন হয়েছে। এ ছাড়া মেট্রোরেল প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ও পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণসহ বেশকিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে কিংবা বাস্তবায়নের পথে রয়েছে।

আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শক্তি দিয়েছেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। বাংলাদেশ এক সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের প্রতীক। উন্নয়ন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। ক্রমবর্ধমান ধারায় দ্রুতগতিতে তা অগ্রসরমান। অদম্য অগ্রগতির এই ধারাকে অব্যাহত রাখার প্রয়াসে সকলকে তিনি দেশের জন্য কাজ করার নিরন্তর প্রেরণা জুগিয়ে চলেছেন। তাই গর্বের সঙ্গে বলতে পারি আমাদের একজন শেখ হাসিনা আছেন আর তিনিই বাঙালির শেষ ভরসা। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, অসীম সাহস, মানুষের প্রতি অগাধ বিশ্বাস-ভালোবাসা, সততা, নিষ্ঠা আর নিরলস পরিশ্রম তাকে উন্নয়ন ও জাতীয় ঐক্যের সমার্থক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

প্রফেসর ড. মো. শাহ্ আজম: উপাচার্য, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ [লেখাটি ২০২২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার জন্মোৎসবে রবীন্দ্র বিশবিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মোঃ শাহ্ আজম কর্তৃক প্রদত্ত প্রধান অতিথির ভাষণ থেকে সংকলিত]

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সকালের মধ্যে দেশের ১৮ অঞ্চলে ঝড়ের আভাস

৫ অক্টোবর : নামাজের সময়সূচি

আজও কি দিনভর সারাদেশে বৃষ্টি হতে পারে?

শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

বিদ্যালয়ে কোনোরকম উচ্ছৃঙ্খলতা ছিল না

নারায়ণগঞ্জে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় কাপড় জব্দ

ইদানীং শিক্ষকদের এক ধরনের হেয় করার প্রবণতা তৈরি হয়েছে

মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষা খুব জরুরি

কক্সবাজার সড়ক দুর্ঘটনায় ছাত্রদল নেতা নিহত

শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে বন্ধন সেটি ছিন্ন হয়ে গেছে

১০

হত্যা মামলায় রসিকের সাবেক কাউন্সিলর মিলন গ্রেপ্তার

১১

শিক্ষকদের শিক্ষাবাণিজ্য থেকে বেরিয়ে আসতে হবে

১২

হুইলচেয়ারে বসেই আলো ছড়াচ্ছেন ফয়সাল

১৩

হেঁটে এক টাকায় জ্ঞান বিলিয়ে যাচ্ছেন লুৎফর রহমান

১৪

সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী মারা গেছেন

১৫

ময়মনসিংহে মায়ের হাতে মেয়ে খুন

১৬

কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না : সুলতান সালাউদ্দিন টুকু

১৭

টিসিবির পণ্যসহ আটক বিএনপির সেই সভাপতিকে অব্যাহতি

১৮

বাংলা ভাষাকে ‘ধ্রুপদী ভাষা’র মর্যাদা দিল ভারত

১৯

রাজশাহী মহানগর আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক গ্রেপ্তার

২০
X