স্বাধীনতার পরপরই যে বিষয়টি একটি রাষ্ট্রের মৌলিক বিষয় হিসেবে সংবিধানে প্রাধান্য পায়, তা হলো বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্র। অর্থাৎ রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। তার প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকও জনগণ। প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে এ দেশে প্রধানত জ্বালানি সম্পদই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য খনিজসম্পদ লোহা, রুপা, তামা— এ জাতীয় খনিজ সম্পদ না থাকালেও রয়েছে গ্যাস ও কয়লা। উৎপাদন ব্যয় ও এর বাজারমূল্য বিবেচনায় লাভজনক না হওয়ায় কয়লা উত্তোলনের বিষয়টি অতীতে সামনে আসেনি। কয়লার ব্যবহারও সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। তাই জ্বালানি আমদানি ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশজ গ্যাসের ব্যবহার প্রাধান্য পায়। অতঃপর বাপেক্স পুনর্গঠন হয় এবং গ্যাস অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেশীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে তারা পায়।
সংবিধানের ১৪৩ ধারার বিধানমতে প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক প্রজাতন্ত্র। প্রজাতন্ত্রের মালিক ৭ ধারা অনুযায়ী জনগণ। এ হিসেবে প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানা জনগণের হাতে চলে আসে। ১৩ ধারা মতে উৎপাদন যন্ত্র ও বণ্টন প্রণালি চলে আসে রাষ্ট্রীয় মালিকানায়। সেই হিসেবে বিদ্যুৎ উৎপাদন-বণ্টন-বিতরণ ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডারের আওতায় রাষ্ট্রীয় মালিকানায় চলে আসে এবং পিডিবি প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্য ১৯৭৩ সালে পিএসসির আওতায় অগভীর সমুদ্রে তেল অনুসন্ধানের একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে উদ্যোগ সফল হয়নি। স্বাধীনতার আগে যেসব গ্যাসক্ষেত্র বিদেশি কোম্পানির হাতে ছিল সেসবই ক্রয়সূত্রে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আনা হয়। ১৯৭৪ সালে পেট্রোলিয়াম অ্যাক্টের আওতায় পেট্রোবাংলা গঠন করে তার মাধ্যমে জ্বালানি সম্পদে রাষ্ট্রীয় মালিকানা সুপ্রতিষ্ঠিত করা হয়। এরপর পেট্রোবাংলাকে অধিকতর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে এর চেয়ারম্যানকে সচিবের মর্যাদা দেওয়া হয় এবং এ পদে আনা হয় জ্বালানি বিষয়ে অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ ড. হাবিবুর রহমানকে। গ্যাস তথা জ্বালানি খাতের এই নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলাকে আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা চলে। ফলে পেট্রোবাংলার শাসন ও প্রফেশনাল ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হয়।
অন্যদিকে পরিকল্পনা কমিশনের মাধ্যমে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সুসংহত করা হয়। এ পরিকল্পনা কার্যক্রমে রেহমান সোবহান, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, অধ্যাপক আনিসুর রহমানের মতো বিদগ্ধ অর্থনীতিবিদদের বিভিন্নভাবে সমবেত করা হয়েছিল। রাষ্ট্র/সরকারপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু এসব বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করতেন, তাদের মতামত নিতেন। মূলত রাষ্টের সকল উন্নয়ন কার্যক্রম পরিকল্পনা কমিশনের অওতায় সুসমৃদ্ধ পরিকল্পনামাফিক যেন হতে পারে, তা নিশ্চিত হয়। এই পরিকল্পনার বিষয়টি সার্বিকভাবে বুদ্ধিজীবী ও বিশেষজ্ঞদের ওপর নির্ভরশীল। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এভাবে শুরু হয় এবং এর বাস্তবায়ন এভাবেই চলতে থাকে। এ পকিল্পনায় প্রথমিক জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়।
১৯৭৫ সালে যখন বিয়োগান্তক পথে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলো, তখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে জনস্বার্থবিরোধী নানা পরিবর্তন এসেছে। এর মধ্যে জ্বালানি খাতে আনীত পরিবর্তনগুলো সবচেয়ে মারাত্মক হিসেবে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়। স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে পেট্রোবাংলার যে ক্ষমতা ছিল, সে ক্ষমতা খর্ব করা হয়। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান পদে আসীন হতে থাকেন জ্বালানি বিষয়ে অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞের পরিবর্তে প্রশাসনিক ক্যাডারের যুগ্ম সচিবরা। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদেও আনা হতে থাকে ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের। বিদ্যুৎ খাতেও অনুরূপ ঘটনা ঘটে। পরিকল্পনা কমিশনের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে অভিজ্ঞ ও খ্যাতিমান বিশেষজ্ঞের পরিবর্তে সচিবদের হাতে। উন্নয়ন পরিকল্লনা প্রণয়নে জড়িত হন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কনসালটেন্ট বা কনসালটিং ফার্ম। অর্থায়ন হতে থাকে বিশ্বব্যাংক, এডিবির মতো আর্থিক সংস্থা থেকে।
পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যেসব উন্নয়ন প্রকল্পে বিদেশি অর্থায়নের বিষয় ছিল, সেসব প্রকল্প কার্যক্রম বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও আইএমএফ বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণে আনে। সে নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা কমিশন, মন্ত্রণালয় এবং পেট্রোবাংলা ও পিডিবির মতো সংস্থাকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আনা হয়। এরা সমন্বিতভাবে তাদের হয়ে তাদের কাজ করতে থাকে। তাতে সরকারের কাঠামোগত চরিত্র বদলে যায়। অর্থনীতি নাকাল হয়। জনস্বার্থ খাবি খায়। পরিকল্পনায় উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নে সরকারি ও বিদেশি আর্থিক সংস্থার অর্থপ্রবাহে অসংগতি ও সমন্বয়হীনতার কারণে বিভিন্ন ধরনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয় এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন অদক্ষতা ও ব্যর্থতার শিকার হয়। পাশাপাশি জাতীয় আর্থিক সমৃদ্ধি অর্জনে স্বনির্ভর অর্থনীতি অনুসরণ না করে বিদেশি সাহায্য ও সহযোগিতানির্ভর অর্থনীতি অনুসরণে পরিকল্পনা কমিশন ও অর্থ মন্ত্রণালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এভাবেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত বিদেশি আর্থিক সংস্থার নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য স্বাধীন ও স্বনির্ভর অর্থনীতি নির্মাণ। কোনো স্বাধীন দেশের এ লক্ষ্য অর্জনে মৌলিক নিয়ামক তার প্রাকৃতিক সম্পদ ও এ সম্পদে তার জনগণের মালিকানা এবং ব্যবহারের শতভাগ নিশ্চয়তা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আমরা এখনো তা নিশ্চিত করতে পারিনি। তাই জ্বালানি ও বিদ্যুতের রাজনৈতিক অর্থনীতি স্পষ্ট হওয়া জরুরি।
পিএসসি সম্পাদনে দর কষাকষিতে অনেক ক্ষেত্রেই জনস্বার্থ রক্ষা করা যায়নি। মাগুরছড়া গ্যাসফিল্ড উন্নয়নে সম্পাদিত পিএসসি চুক্তি বাতিল হওয়ার পর অক্সিডেন্টালের সঙ্গে সম্পাদিত সম্পূরক চুক্তি, এ গ্যাসফিল্ড বিস্ফোরণের ক্ষতিপূরণ না পাওয়া, ছাতক ও ফেনী গ্যাসফিল্ড প্রান্তিক/পরিত্যক্ত হিসেবে নাইকোর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি (জেভিএ) এসব ক্ষেত্রে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যে বিদেশি কোম্পানির পক্ষে বিদেশি সংস্থা ও সরকারের চাপ ছিল। সে চাপের কাছে সরকারকে নতিস্বীকার করতে হয়েছে। জনস্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে জনগণের প্রতিরোধের মুখে পরিশেষে আইওসি পাইপলাইনে গ্যাস রপ্তানি করতে পারেনি। সাগরের দুটি ব্লকের গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনের ব্যাপারে আইওসির সঙ্গে সম্পাদিত পিএসসিতে এলএনজি হিসেবে গ্যাস রপ্তানির সুযোগ দিতে হয়েছে। আইওসির গ্যাস কেনা একক ক্রেতা হিসেবে সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক হলেও তৃতীয় পক্ষের নিকট সে গ্যাস বেশি দামে বিক্রি করার সুযোগ আইওসি’কে দিতে হয়েছে। সাংগু গ্যাসফিল্ডের গ্যাস তৃতীয় পক্ষের নিকট বেশি দামে বিক্রি করা সম্ভব না হওয়ায় সে গ্যাস তৃতীয় পক্ষ হিসেবে পিডিবিকে দিয়ে ৪.৫০ ডলার দামে কিনিয়ে আইওসিকে লাভবান করতে হয়েছে। অথচ সরকারের পক্ষে একক ক্রেতা হিসেবে ২.৯ ডলার দামে এ গ্যাস কিনেছে পেট্রোবাংলা।
অন্যদিকে গ্যাসের চাহিদা অবদমিত হলে বিদেশি কোম্পানির মালিকানায় গ্যাস ও গ্যাসজাত পণ্য (সার, সিমেন্ট, ইস্পাত) রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হবে। সেই বিবেচনায় জ্বালানিনির্ভর শিল্পের বিকাশ ও উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো সব আর্থিক সংস্থা। সে বাধা অতিক্রম করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ১৯৯০ সালের পরে নতুন সার কারখানা গড়ে ওঠেনি। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ইস্পাত কারখানা টিকে থাকতে পারেনি। ছাতক সিমেন্ট কারখানা মৃতপ্রায়। বিপরীতে বিদেশি মালিকানাধীন রপ্তানিমুখী কাফকোর সারকারখানা ও লাফার্জের সিমেন্ট কারখানা হয়েছে। তাতে আমরা নিরবচ্ছিন্নভাবে কম দামে গ্যাস জোগান দিচ্ছি। উৎপাদিত সিমেন্ট ও সার বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। একদিকে আইওসির নিকট থেকে বেশি দামে গ্যাস কিনে আইওসিকে স্ফীত মুনাফা লাভের সুযোগ দিচ্ছি, অন্যদিকে সার ও সিমেন্ট উৎপাদনে কমদামে লোকসানে গ্যাস দিয়ে বিদেশি মালিকানাধীন রপ্তানিমুখী ওই সব কোম্পানিকে অধিক মুনাফা করার সুযোগ দিয়েছি।
২০০৫ সালের পর আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম বাড়ায় কাফকোর কাছে গ্যাস বিক্রির লোকসান মোকাবিলা করা সম্ভব হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজার দরে কাফকোর কাছ থেকে এ সার কিনে নিতে হয়। কাফকোকে গ্যাস না দিয়ে একই গ্যাসে নিজেরাই সার উৎপাদন করলে আমরা অধিক লাভবান হতাম। সার আমদানি ব্যয় কমত। বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হতো। কৃষি খাতে ভর্তুতি অনেক কমিয়ে আনা যেত। সার থেকে পাওয়া আর্থিক লাভ কৃষিতে ব্যবহৃত ডিজেল ও বিদ্যুতের ভর্তুকিতে সমন্বয় হতো। কৃষি আর্থিকভাবে সাবলম্বী হতো। একইভাবে সরকারি মালিকানায় ইস্পাত ও সিমেন্ট উৎপাদন হলে উৎপাদন ব্যয় কম হওয়ায় কম দামে আমরা ইস্পাত ও সিমেন্ট পেতাম। তাতে কম খরচে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন হতো। জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ন্ত্রণ সহজ হতো এবং তা হতো সমৃদ্ধ অর্থনীতি গড়ার ক্ষেত্রে অন্যতম নিয়ামক।
প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে উন্নত প্রযুক্তির সম্পৃক্তিতে সার, সিমেন্ট ও ইস্পাত কারখানাগুলো সম্প্রসারণ ও উৎপাদন দক্ষতা বাড়িয়ে লাভজনক করার কোনো উদ্যোগ সরকার নিতে পারেনি। বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইএমএফ তা হতে দেয়নি। বরং ২০০৫ সালে তারা টাটার রপ্তানিমুখী সার, ইস্পাত, কয়লা ও আইপিপি প্রকল্পকে প্রমোট করেছে। সেখানেও অত্যন্ত কম দামে লোকসানে নিরবচ্ছিন্নভাবে ২.১৪ টিসিএফ গ্যাস দিতে হতো। জনগণের প্রতিরোধের মুখে এ প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি। কথিত বিদেশি বিনিয়োগের নামে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বহুজাতিক ও বিদেশিদের প্রমোট করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এগুলো এসেছে রাজনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে। এসব কিছুই এসেছে ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। এগুলোর সবকিছুই সামরিক সরকারের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে প্লান্টেশন হয়েছে। পরে তার ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়েছে। এভাবে বিশেষ করে দেশীয় জ্বালানি নির্ভর শিল্পকে দাতাসংস্থার পরামর্শে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে বেসরকারিকরণের নামে বিদেশি মালিকানাধীন রপ্তানিমুখী জ্বালানিনির্ভর শিল্পকারখানাকে প্রমোট করা হয়েছে।
অন্যান্য উৎপাদনমুখী শিল্প যেমন পাটশিল্পে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চূড়ান্ত বিপর্যয় এসেছে। লোকসানের অজুহাতে এ শিল্পকেও বেসরকারিকরণের নামে হঠাৎ এক ফ্যাক্সের সূত্রে বন্ধ করে দেয়া হলো। যখন এগুলো রিভিউয়ের কথা বলা হলো, তখন জানা গেল পাট মন্ত্রণালয় এসবের কিছুই জানে না। অথচ জুট করপোরেশনের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত/যুগ্ম সচিব)-এর নির্দেশে পাঠানো একটি ফ্যাক্সে এমন অঘটন ঘটে গেল। পাটকল সরকারের হাত ছাড়া হয়ে গেল। অথচ সরকারের কিছুই বলার থাকল না। প্রতিকারও হলো না।
এই পাটখাতের অনুরূপ বিদ্যুৎ খাতেরও ওই একই অবস্থা। এভাবেই ১৯৯৩ সালে সচিবের সভাপতিত্বে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব ও উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভায় বিদ্যুৎ খাত সংস্কারের সিদ্ধান্ত হয়। এই সিদ্ধান্তের সূত্রে বিদ্যুৎ খাত বেসরকারিকরণের পথ ধরে দেশি/বিদেশি ব্যক্তি/গোষ্ঠীর হাতে চলে গেল। দেশের সংবিধান, আইন, সরকার, সংসদ, মন্ত্রিপরিষদ ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে রইল।
এভাবেই স্বাধীন দেশে সাংবিধানিকভাবে দেশের সম্পদ ও উৎপাদনব্যবস্থা জনগণের মালিকানায় থাকার যে বাধ্যবাধকতা ছিল, তা লঙ্ঘন করে বা বলা যায় জনগণের কর্তৃত্ব খর্ব করে বেসরকারিকরণের নামে দেশি-বিদেশি ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বা তুলে দেওয়ার পথ প্রশস্ত করা হয়েছে।
এ সংস্কার প্রস্তাব ও পরিকল্পনা ছিল বিশ্বব্যাংকের। তাতে অর্থও জুগিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ১৯৯৬ সালে আইপিপির আওতায় বিদেশি ব্যক্তি খাত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরু হলো। সলিসিটেড বিডিংয়ের মাধ্যমে ময়মনসিংহে আরপিসিএনের বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং বাঘাবাড়ীতে ওয়েস্টমন্টের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হলো। এসব আইপিপির বিদ্যুৎ কিনতে হলো সরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অপেক্ষা অনেক বেশি দামে। ফলে বিদ্যুৎ খাত আর্থিক ঘাটতির শিকার হলো।
আইপিপির বিদ্যুৎ যে দামে কেনা হয়, সে দাম অপেক্ষা অধিক দামে ২০০৩ সালে ক্ষুদ্র প্লান্টের বিদ্যুৎ ব্যক্তি খাত থেকে কেনা শুরু হলো। সরকারি খাতে বিশ্বব্যংকের আর্থিক সহায়তায় কেবলমাত্র পিকলোড প্লান্ট হতে থাকল। ব্যক্তি খাত বিনিয়োগ আকর্ষনের অজুহাতে সরকারি খাতে নতুন বেজলোড প্লান্ট নির্মাণ না করায় একদিকে চাহিদা বৃদ্ধির বিপরীতে কমদামি বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি হলো না, অন্যদিকে গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ বৃদ্ধি হলো দামি পিকিংপ্লান্ট বিদ্যুৎ ও ব্যক্তি খাত বিদ্যুতে। বিদ্যুতের মূল্যহার সে অনুপাতে বৃদ্ধি না হওয়ায় আর্থিক ঘাটতি আরও বাড়ে। আর্থিক ঘাটতির পাশাপাশি চাহিদা বৃদ্ধির অনুপাতে উৎপাদন/সরবরাহ বৃদ্ধি না হওয়ায় বিদ্যুৎ ঘাটতিও ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে।
২০০৫ সালে বিদ্যুৎ ঘাটতি সংকটে পরিণত হয়। ২০০৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সিদ্ধান্ত মতে ব্যক্তি খাত থেকে ভাড়া প্লান্টের বিদ্যুৎ আরও বেশি দামে কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে উদ্যোগ জনগণের আপত্তির মুখে সফল হয়নি। তবে জরুরি অবস্থার সুযোগ নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তা বাস্তবায়ন হয়। এ বিদ্যুৎ গ্রিডে আসে। বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি মোকাবিলা মূলত এই বিদ্যুতের উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধি আজ অবধি অব্যাহত রয়েছে। সেই সঙ্গে পরবর্তী সময়ে দ্রুত ভাড়া প্লান্টের বিদ্যুৎ আগের দাম অপেক্ষা আরও অধিক দামে কেনা হয়েছে। ফলে আর্থিক ঘাটতি আরও বেড়েছে। এ ঘাটতি মোকাবিলায় বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির জন্য বিশ্বব্যাংকের চাপ এখন প্রকট। বিশ্বব্যাংক বিদ্যুাৎ উৎপাদন খাতকে সরকারি খাত থেকে যেমন ব্যক্তি খাতে নিয়ে যেতে তৎপর, তেমন ব্যক্তিখাতের যেন স্ফীত মুনাফা নিশ্চিত হয় সে জন্য বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে আরও তৎপর। যে কারণে বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি বাবদ কোনো অর্থ বরাদ্দ নেই।
বিদ্যুৎ সংকট আকস্মিকভাবে দেখা দেয়নি, ধীরে ধীরে পুঞ্জীভূত হয়েছে। এ সংকট অপরিহার্য বা অবশ্যম্ভাবি ছিল না। আবার সংকট মোকাবিলায় ব্যক্তিখাতের ওপর নির্ভর না করে সরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ ছিল। তাহলে ব্যক্তি খাতে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করায় গ্যাস স্বল্পতার কারণে সরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রাখার মতো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হতো না। তাছাড়া তেল-বিদ্যুতের পরিবর্তে গ্যাস-বিদ্যুতে সংকট মোকাবিলা করার সুযোগ ছিল। তা সত্ত্বেও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি আদৌ গুরুত্ব পায়নি। বরং গ্যাসের অবৈধ সংযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই সার্বিক বিবেচনায় বলা যায়, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যক্তি খাতের প্লান্টেশন এবং মুনাফা অর্জনের টেকসই ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে আজকের এই বিদ্যুৎ সংকট এবং সংকট মোকাবিলায় ভাড়া-বিদ্যুৎ ও তেল-বিদ্যুৎ। তা না হলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে তরল জ্বালানির ব্যবহার ও তার মূল্যবৃদ্ধিকে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির একমাত্র কারণ হিসেবে গণ্য করা হতো না।
বিদ্যুৎ খাত সংস্কারের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছিল, সরকারি খাতের পাশাপাশি এ খাত উন্নয়নে ব্যক্তি খাত বিনিয়োগ নিশ্চিত করা এবং উভয়ের জন্য এ খাতকে প্লেইং ফিল্ড হিসেবে একই রকম লেভেল করা। বাস্তবে দেখা গেল, সরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রেখে ব্যক্তি খাত উৎপাদনে জ্বালানি সরবরাহ করা হয়েছে। আবার ব্যক্তি খাত উৎপাদন করুক না করুক ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বাবদ তাকে ঠিকই লাভবান করা হয়েছে। সরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা রেগুলেটরি কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত হলেও ব্যক্তি খাতের ক্ষেত্রে নয়। ফলে ব্যক্তি খাত বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অত্যধিক হয়। সলিসিটেড বিডিংয়ের অজুহাত দেখিয়ে ব্যক্তি খাতকে রেগুলেটরি আওতাবহির্ভূত রাখা হয়। যদিও সরকারি খাতে প্লান্ট নির্মাণ সলিসিটেড বিডিংয়ের আওতায় হয়। তাছাড়া বিদ্যুৎ খাতকে সংস্কারের আওতায় বিভাজিত করে নানা রকম বিতরণ, সঞ্চালন ও উৎপাদন কোম্পানি করা হয়েছে এবং হচ্ছে। যেসব কোম্পানি বাণিজ্যিক বিবেচনায় লাভজনক, শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে তাদের মালিকানা ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। অলাভজনক বা লোকসান কোম্পানি/সংস্থা সরকারের হাতে থেকে যাচ্ছে। ভর্তুকি দিয়ে সরকার তা চালাচ্ছে। এভাবেই সংস্কারের আওতায় ব্যক্তিখাত প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে সরকারি খাতকে প্রান্তিক/বিলুপ্তির দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
বিদ্যুৎ খাতের অনুরূপ পরিস্থিতি গ্যাস খাতেরও। বলা হয়, গ্যাস খাত উন্নয়নে সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানির বিনিয়োগ সক্ষমতা নেই। তাই পিএসসির আওতায় আইওসির মাধ্যমে স্থলভাগের গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন করতে হয়। ২০০৮ সালে বিইআরসি’র গণশুনানিতে প্রতীয়মান হয়, সরবরাহকৃত গ্যাসে আইওসির গ্যাসের পরিমাণ ২০০৩ সালে ২০ শতাংশ হলেও ২০০৮ সালে সে পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৪৮ শতাংশ। এমতাবস্থায় যদি দেশি কোম্পানির গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধি না হয়, তাহলে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না। তাই বিআরসির মাধ্যমে ভোক্তারা প্রতি গ্যাস বিলের সঙ্গে প্রতি মাসের বিলের ১০.৪১ শতাংশ বাড়তি অর্থ দিয়ে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল গঠন করে। এ তহবিল ২০০৯ সাল থেকে কার্যকর হলেও ৩ বছর অবধি এ তহবিলের অর্থ কাজে লাগানোর ব্যাপারে মন্ত্রণালয় গড়িমসি করেছে। এরই মধ্যে স্থলভাগের গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনের জন্য পিএসসি ২০১১ মাধ্যমে আইওসিকে সামনে আনার চেষ্টা চলেছে। আইওসির গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি চেষ্টাও অব্যাহত থাকে। ইতিমধ্যে সরবরাহকৃত গ্যাসে আইওসির গ্যাসের পরিমাণ ৫৩-৫৪ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছর গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা জমা হলেও সরবরাহকৃত গ্যাসে দেশি কোম্পানির গ্যাসের অংশ বৃদ্ধির দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।
জাতীয় তেল গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন সংস্থা বাপেক্সের পুঁজি ছিল না। বিনিয়োগ সক্ষমতা ছিল না। তাই আইওসির ‘কামলা’ হিসেবে কাজ করেছে। বাপেক্স নিজেও অনুসন্ধানে যেতে পারেনি। আবার গ্যাস রপ্তানি চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে কোন কোন আইওসি দেশ ত্যাগ করে। পিএসসিভুক্ত গ্যাসফিল্ড অনুসন্ধানে অনেক আইওসি নামেনি। এভাবেই গোটা গ্যাস উৎপাদন ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে ফেলা হয়। এ প্রভাব প্রকটভাবে পড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। ১৯৭৫ সালের ধারাবাহিকতায় আজ অবধি গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জনস্বার্থ সম্মত যেসব উদ্যোগ নেওয়া জরুরি ছিল। তার কোনো কিছুই নেয়া হয়নি। বরং সকল পর্যায় থেকে আইওসির স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে। জনস্বার্থ তছনছ হয়েছে।
৭৫-এর আগে যে আদর্শ ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অধীনে রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছিল এবং যে সব দর্শন-নীতি-পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে যাত্রা হয়েছিল, তাতে জ্বালানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় কয়লা প্রাধান্য পায়নি। ৯০ দশকে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের পাশাপাশি কয়লা বিবেচনায় আসে এবং পরিকল্পনায় কয়লা খাত উন্নয়ন প্রাধান্য পায়। তবে বিশেষভাবে লক্ষণীয়, ১৯৬৮ সালে যে মাইনিং রুলস ছিল, সেটি সংবিধান পরিপন্থি। যদিও ১৯৭৪ সালে নতুনভাবে পেট্রোলিয়াম আইন করে তার আওতায় পেট্রোবাংলা সৃষ্টি করে তার ওপর তেল-গ্যাস উন্নয়ন ন্যস্ত করা হয়। কিন্তু কয়লা খাত উন্নয়নের বিষয়টি সামনে আসলেও সংবিধানসম্মত পেট্রোলিয়াম এক্টের অনুরূপ কয়লার ব্যাপারে কোনো অ্যাক্ট তৈরি হয়নি। পেট্রোবাংলার মতো অনুরূপ কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানও তৈরি হয়নি। ওই মাইনিং রুলসের ভিত্তিতে কয়লা খাত উন্নয়নে হাত দেওয়া হয়। তবে ২০০৫ সালে ফুলবাড়ি ও বড়পুকুরিয়া এ দুটি কয়লাখনি যথাক্রমে এশিয়া এনার্জি ও টাটাকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে রপ্তানির উদ্দেশ্যে রয়্যালটির বিনিময়ে নিজস্ব মালিকানায় কয়লা উত্তোলন করতে দেওয়ার জন্য কয়লানীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। টাটা তাদের বিনিয়োগ প্রস্তাব প্রত্যাহার করলেও এশিয়া এনার্জির প্রশ্নে সে উদ্যোগ এখনো অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যেই ১২ বার প্রস্তাবিত কয়লানীতিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে তাতে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসেনি এবং তা সংবিধানসম্মত হয়নি। কয়লা রপ্তানি, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লাখনি উন্নয়ন, রয়্যালটির বিনিময়ে ব্যক্তি খাত বিনিয়োগকারীর কয়লার মালিকানা লাভ- এসব সুযোগ কয়লানীতিতে কোনো না কোনোভাবে রাখা হয়েছে। ফলে এ কয়লানীতি জনস্বার্থবিরোধী হওয়ায় গণপ্রতিরোধের সম্মুখীন।
ওই মাইনিং রুলসের আওতায় ৬ শতাংশ রয়্যালটির বিনিময়ে ১৯৯৪ সালে আনসলিসিটেডভাবে বিএইচপিকে উন্নয়নের জন্য ফুলবাড়ি কয়লাখনি লিজ দেওয়া হয়। পরে এ লিজ এশিয়া এনার্জির নিকট হস্তান্তর হয়। এশিয়া এনার্জি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে এ খনি উন্নয়নের জন্য সরকারের নিকট পরিকল্পনা প্রস্তাব পেশ করে। পরিবেশ ও প্রতিবেশগত কারণে উন্মুক্ত খনি বাংলাদেশে অচল এই কারনে সরকারের কারিগরি বিশেষজ্ঞ কমিটি এ প্রস্তাব নাকচ করে। জনগণের আন্দোলন ও প্রতিরোধের মুখে কয়লানীতি যেমন হতে পারেনি, তেমন এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ি খনি উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রস্তাবও বাস্তবায়ন হতে পারেনি। আন্দোলনের মুখে সরকার ২০০৬ সালে বাংলাদেশে উন্মুক্ত খনি না করার ব্যাপারে ফুলবাড়ির জনগণের সঙ্গে লিখিত চুক্তিতে অঙ্গীকারবদ্ধ রয়েছে। তা ছাড়া এ আন্দোলনে আজকের প্রধানমন্ত্রী তথা তখনকার বিরোধীদলীয় মহাজোট নেত্রীর সমর্থন রয়েছে। তার পরেও এশিয়া এনার্জি এখনো তৎপর। জামালপুর, দিঘিপাড়া ও খালাশপীর খনির কয়লা উত্তোলনের কোনো উদ্যোগ নেই। আজকের বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে কয়লা-বিদ্যুতের যদিও বিকল্প নেই। তবে কয়লা খাত উন্নয়নের ব্যাপারে আকার ও অবয়বহীন কোলবাংলা নামের একটি প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়েছে। পিডিবির চেয়ারম্যান পদাধিকার বলে তার চেয়ারম্যান। এভাবে পুরো কয়লা খাত এখন প্রহসনের মধ্যে। যদি বিদেশি বিনিয়োগে কয়লা তুলতে হয়, তাহলে রয়্যালটির বিনিময়ে কয়লার মালিকানা তাদের দিতে হবে। সে কয়লা তাদের ইচ্ছামাফিক রপ্তানির সুযোগ দিতে হবে। তা না হলে তারা বিনিয়োগ করবে না। রপ্তানি করতে দিলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে চাহিদামাফিক কয়লা পাব না। ফলে আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তা বিপন্ন হবে। আমাদের উন্নয়নের অমিত সম্ভাবনা শেষ হয়ে যাবে। আমরা জ্বালানি বুভুক্ষুর মধ্যে আছি, মধ্যেই থেকে যাব। এর পরও এমন অবস্থা থেকে কেন আমরা বেরিয়ে আসতে পারছি না?
এসবের কারণ বিশ্বব্যাংকের মতো সাহায্য সংস্থার প্রেসক্রিপশন, তাদের অদৃশ্য প্রেসার এবং তাদের হয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারের মধ্যে যারা কাজ করছেন, তারা ওই সব কার্যক্রমকে মন্থর করেছেন, সুযোগমতো বাধা দিচ্ছেন। রাজনৈতিক যে সক্ষমতা দিয়ে জনগণের অধিকার রক্ষা করা ও অর্থনীতিকে স্বাবলম্বী করার ক্ষেত্রে যে নেতৃত্ব রাজনীতিবিদরা দেবেন, তারা সে সক্ষমতা দ্রুত হারাতে বসেছেন। রাজনৈতিক কর্তৃত্বের জায়গাগুলো হাতছাড়া হচ্ছে। সামরিক শাসন যতদিন চলেছিল রাজনীতিবিদরা বিচ্ছিন্ন ছিলেন। সামরিক শাসকরা অসামরিক জায়গা থেকে যেসব পরামর্শ পেয়েছেন, সব সময় সেগুলো বুঝে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা বলা যায় না, তারা অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হয়েছেন। তাদের ক্ষেত্রে এটিই সহজ ও স্বাভাবিক। জনগণের সঙ্গে যেহেতু তাদের সম্পর্ক থাকে না, সেহেতু জনস্বার্থ নিয়ে তাদের মাথাব্যথাও থাকে না। গণসন্তোষ-অসন্তোষে তাদের কিছু যায় আসে না। ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসার বিষয়ও তাদের বিবেচনায় থাকে না। ফলে জনগণের কথা বা আস্থা ও তাদের কল্যাণের বিষয়টি তাদের মধ্যে মুখ্য হিসেবে কাজ করে না।
সামরিক শাসনের দীর্ঘ ২০-২৫ বছর রাজনৈতিক সংস্কৃতি নির্বাসনে থাকার কারণে সরকারের রাজনৈতিক সক্ষমতার বিষয়টি আরও বেশি দুর্বল হয়ে পড়ে, গুণগত চরিত্র নষ্ট হয়। সেখানে আমলাতান্ত্রিক তথা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের প্রভাব বাড়ে। এরা বিভিন্নভাবে বিদেশি ঋণদাতা সংস্থার আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত হয়। ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্নভাবে তাদের স্বার্থ রক্ষায় প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের ব্যবহার করতে থাকে। সভা-সেমিনার, বিদেশ ভ্রমণের মাধ্যমে তাদেরকে অধীনস্ত করে। বিভিন্ন সংস্থায় তাদের চাকরির ব্যবস্থা করে আরও বেশি কাছে টেনে নেয় এবং তাদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে প্রজাতন্ত্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার সুযোগ নেয়। ঋণদাতা সংস্থার কথামতো সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়োগও হয় তাদেরই অনুগতদের।
এমন দুষ্টচক্র থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি। এখান থেকে বের হয়ে আসার জন্য সরকারের যে নীতিগত অঙ্গীকার দরকার তাহলো ‘জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন রাষ্ট্রীয় মালিকানায় করব।’ সে অঙ্গীকার না থাকায় এ জায়গায় হাত দিচ্ছে না বা হাত পড়ছে না। বিদেশি ঋণদানকারী সংস্থা বিভিন্নভাবে সরকারকে বেঁধে ফেলেছে। এ জায়গা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দরকার রাজনৈতিক সক্ষমতা। এটি না থাকলে অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করা যায় না।
বিদ্যুৎ কেনায় কারণে ব্যক্তি খাতকে যে টাকা ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হচ্ছে প্রতিবছর। তা দিয়ে বছরে ১ হাজার মেগাওয়াটরে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেত। গ্যাস উন্নয়ন তহবিল যথাযথভাবে ব্যবহার করা গেলে বছরে ১০টি কূপ খনন করা যেত। সেখান থেকে গ্যাস আনা গেলে গ্যাসের অভাবে যে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো যাচ্ছে না, তা চালানো যেত। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের শুল্ক, ভ্যাট ও করমুক্ত করে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত। সিএনজি খাতের উদ্বৃত্ত অর্থ জ্বালানি অনুসন্ধান ও উৎপাদনে বিনিয়োগ করা যেত। এসবের কোনো কিছুই আমরা করতে পারিনি। কেবল ব্যক্তি খাত থেকে কেনা গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে ঘাটতি মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ ঢেলে চলেছি। পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি বিশ্বব্যাংকের চাপে অব্যাহত রেখেছি।
আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ছিল না বা নেই, এমন কথা মানতে রাজি নই। আমাদের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে জিটুজি করে ফেলা হয়েছে। আমাদের ইনটেলিকচুয়াল এবিলিটিকে অলস ও নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। আমাদের বিশেষজ্ঞরা, ইঞ্জিনিয়াররা বিদেশি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। এরা যখন তাদের হয়ে কাজ করে, তখন তারা লাভবান হয়। অথচ আমাদের হয়ে কাজ করলে আমাদের লোকসান হয়। কেন? এ এক অদ্ভূত রহস্য। খাদ্যের জন্য লড়াই সভ্যতার এক প্রাচীনতম ক্ষত। খাদ্যের জন্য লড়ায়ের পাশাপাশি আজকের আধুনিক সভ্যতার জ্বালানি ও বিদ্যুতের জন্য লড়াই এক গভীরতম ক্ষত। এ উপমহাদেশে আমরা এ লড়াইয়ে এগিয়ে আছি। জ্বালানি ও বিদ্যুতের রাজনৈতিক অর্থনীতি পরিষ্কার করার ওপরই নির্ভর করছে এ লড়ায়ের চূড়ান্ত সফলতা।
ড. এম শামসুল আলম: জ্বালানি বিশেষজ্ঞ; বর্তমানে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অনুষদের ডিন
মন্তব্য করুন