জলবায়ু ও জলবায়ু পরিবর্তন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কিন্তু এ বিষয়ে আমরা আসলে কতটুকু সচেতন? এ বিষয়ে তরুণ প্রজন্মই বা কতটুকু জানে? এ বিষয়ে সবারই কি কিছু করণীয় আছে? এ বিষয়ে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আদৌ কি আমরা কোনো পরিকল্পনা করতে পেরেছি? বিশ্বনেতারা কি গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ আদৌ শূন্যে নামিয়ে আনতে পারবেন? সেক্ষেত্রে তরুণ সমাজের কি কোনো ভূমিকা আছে?- জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এ ধরনের নানা প্রশ্ন আমার মতো আশা করি অনেকের মনেই জন্ম নেয়।
প্রায় প্রতিদিনই আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রভাব দেখতে পাচ্ছি। সাম্প্রতিক সময়ে (১ সেপ্টেম্বর, ২০২১) জাতিসংঘের আবহাওয়া সংস্থার তথ্য অনুসারে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে গত ৫০ বছরে বিশ্বে পাঁচগুণ মৃত্যু বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট বন্যা ও দাবদাহের ফলে বিশ্বে মৃত্যু হয়েছে ২০ লাখ মানুষের। এ কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে ৩ লাখ ৬৪ হাজার কোটি ডলার। এছাড়া গত জানুয়ারিতে (২০২১) ১২ লাখ মানুষের ওপর চালানো জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ডের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কিত একটি সমীক্ষা প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, করোনা মহামারির চেয়েও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি এখন তাৎপর্যপূর্ণ।
গ্লোবাল ক্লাইমেট ইনডেক্স অনুসারে ১৯৯৮-২০২১ সালে আবহাওয়ার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের শিশুরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের শিকার হওয়ার অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ৬৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫তম। অথচ করোনা মহামারির কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের আলোচনা যেন অনেকটাই চাপা পড়ে গিয়েছিল। তাই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করার প্রয়াসে আগামী দিনগুলো সত্যিই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বিশ্বকে বাঁচানোর পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে সময় হাতে আর খুব বেশি নেই।
মানুষের নানা কর্মকাণ্ডের পরিণতিতে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন দ্রুতহারে সাগর-পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে এবং বরফ গলছে। সেই সাথে, জীবজন্তুর বিভিন্ন প্রজাতি তাদের আবাসস্থল বদলাচ্ছে। কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে বরফের আচ্ছাদন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে, পরিস্থিতি দিনকে দিন বিপজ্জনক হয়ে পড়ছে (সূত্র: বিবিসি ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯)। ফলে আরও অনেক আগেই (২০১৯ সালে) পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে জাতিসংঘ 'রেড-অ্যালার্ট’ জারি করেছিল।
সঙ্গত কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শপথ গ্রহণের পর প্যারিসের জলবায়ু চুক্তিতে প্রত্যাবর্তনের কথা এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সহযোগিতার কথাও গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেছিলেন।
আমরা জানি, ১ থেকে ১২ নভেম্বর যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো শহরে (স্কটল্যান্ড) জাতিসংঘ আয়োজিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬ (কনফারেন্স অব দ্য পার্টি: জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক ২৬তম সম্মেলন) অনুষ্ঠিত হবে। সম্মেলনের ওয়েবসাইটে মূলত চারটি অভীষ্ট অর্জনের কথা বলা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে: ১. চলতি শতকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন নিটশূন্য (নির্গমন ও শোষণের পরিমাণ একই রাখা) করা ও প্রাক-শিল্পযুগের তুলনায় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা। এর জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি, বিশেষ করে কয়লা ব্যবহার বন্ধ করে সবুজ শক্তিতে দ্রুত স্থানান্তর হওয়া, বন ধ্বংস হ্রাস করা, বিদ্যুৎচালিত যানবাহনের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি করার কথা বলা হয়েছে। ২. মানুষ ও প্রাকৃতিক আবাসস্থল রক্ষা। এই অভীষ্ট অর্জনের জন্য বাস্তুতন্ত্র রক্ষা ও পুনরুদ্ধার, বন্যা প্রতিরক্ষা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো ও ঝুঁকি হ্রাসের প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ৩. অর্থায়নের ব্যবস্থা করা। এর জন্য উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রদান করার প্রতিশ্রুতি পালনের প্রয়োজন বলে বলা হয়েছে। ৪. একত্রে কাজ করা। প্যারিস রুল-বুক চূড়ান্তকরণ, সরকার, ব্যবসায়ী ও সুধীসমাজকে একত্রে কাজ করার মাধ্যমেই বর্ণিত অভীষ্ট অর্জন সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে।
শুধু করোনার কারণে বিশ্ব তোলপাড় হচ্ছে তাই নয়, তোলপাড় হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়েও। কারণ, জলবায়ুর অতি সামান্য যে পরিবর্তন ইতোমধ্যে লক্ষ্য করা গেছে, তার প্রাথমিক ক্ষতিকর প্রভাব পৃথিবীর মানুষকে সত্যি সত্যিই চমকে দিয়েছে। এ ধরনের একটি সময়ে কপ-২৬ আয়োজন সত্যিই খুব তাৎপর্যপূর্ণ। যদিও এ ধরনের সম্মেলন নতুন কিছু নয়। কপ-২৬ মঞ্চে সব পক্ষকে কিছু ছাড় দিয়ে উল্লিখিত চারটি অভীষ্ট অর্জনে ইতিবাচক মনোভাবের পরিচয় দিতে হবে। তা না হলে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ পরিণতি মূলত মানবজাতিকেই ভোগ করতে হবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা প্রতিনিয়ত আবহাওয়ার আচরণ পাল্টাতে দেখছি। আবহাওয়াটা কেমন যেন অস্থির- ঘনঘন নিম্নচাপ হচ্ছে, আমরা মুখোমুখি হচ্ছি ঘূর্ণিঝড়ের, অতিবৃষ্টি আর বন্যার। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্বাভাবিক কাজ-কর্ম, জনজীবন, অর্থনীতি কম-বেশি সবকিছুই।
গত নভেম্বর, ২০২০ থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের একটি বিশেষ অবস্থা বা লা নিনা সক্রিয় হয়ে ওঠার কারণে সাগর থেকে জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু এবং মেঘ বাংলাদেশের দিকে বেশি এসেছে। ফলে বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস অনুসারে দেশে এ বছর বৃষ্টি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আগাম বন্যাও আমরা লক্ষ্য করেছি।
এছাড়া লা নিনার প্রভাবে এবারে শীতকালটাও আমরা ঠিকভাবে বুঝতে পারিনি। ব্যাপারটা কিছুটা আশ্চর্য মনে হলেও সত্যি যে, সাগর থেকে গরম বাতাস এসে আকাশ মেঘলা করে দিয়ে শীতকে কমিয়ে দিয়েছিল। পুঞ্জীভূত তাপের কারণে সাগরে লঘুচাপ ও নিম্নচাপ বেশি তৈরি হওয়ায় আবহাওয়াবিদরা এটাও অনুমান করেছিলেন যে, কালবৈশাখী ও বজ্রপাত আরও বাড়বে।
গত বছর বাংলাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে বজ্রপাত ২০ শতাংশের বেশি হয়েছিল বলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে। আর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে পূর্বের বছরগুলোর চেয়ে গত বছর বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুর হারও ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রসঙ্গত, মন্ত্রণালয় আরও অনেক আগেই বজ্রপাতকে ‘দুর্যোগ’ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
বাংলাদেশের মতো বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এমন নানামুখী পরিবর্তন ঘটছে। এককথায় পৃথিবী পৃষ্ঠের গড় উষ্ণতা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এক সংকটজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে সব মানুষ। অবশ্য বহু বছর ধরেই পৃথিবীর গড় উষ্ণতা কখনো বেড়েছে কিংবা কখনো কমেছে। এসব পরিবর্তন ঘটেছে খুব ধীরে। একেক ধরনের পরিবর্তন হওয়ার জন্য দশ থেকে হাজার লক্ষ বছর কেটে গেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যেসব পরিবর্তন ঘটেছে সেসব খুবই দ্রুত হচ্ছে।
বাংলাদেশে এর সাথে যুক্ত হয়েছে আরও কিছু দিক- ভৌগোলিক অবস্থানগত অসুবিধা, সুশাসনের অভাব এবং প্রশাসনিক দক্ষতা ও নীতিমালা বাস্তবায়নে ঘাটতি, দুর্নীতি ও দুর্বলতাসমূহ। ফলে বাংলাদেশে এ সংক্রান্ত সার্বিক বিপন্নতা ধীরে ধীরে বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাটাই খুব বেশি। ফলে দারিদ্র্য এবং সামাজিক সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কষ্ট ও দুর্ভোগের পরিমাণ বাড়বে আরও বেশি। এসব নিয়েও বিভিন্ন সময়ে কম-বেশি গবেষণা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এবং সময়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এ সম্পর্কিত গবেষণার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
গড় উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রাথমিক অবস্থা বর্তমান প্রজন্ম যেমন প্রত্যক্ষ করছে; তেমনি ধারণা করা হচ্ছে, আগামী কয়েক প্রজন্ম জলবায়ুর কারণে পৃথিবীর ব্যাপক পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করবে। খুব স্বাভাবিকভাবেই তাই বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এ নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং সবাই এক জোট হয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের হার কমিয়ে ফেলার জন্য দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।
নিঃসন্দেহে, জলবায়ু পরিবর্তন এক বৈশ্বিক সমস্যা। এ বিষয়ে স্থানীয়, জাতীয় পর্যায়ে কিংবা রাষ্ট্রীয়ভাবে যেমন অনেককিছুই হয়েছে, তেমনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবেও যেমন: প্যারিস চুক্তি, কিয়োটো প্রোটোকল ইত্যাদি। কিন্তু এতকিছুর পরও আমরা তরুণসমাজের সচেতনতা এক্ষেত্রে বৃদ্ধি করতে পারিনি, তাদের ভয়েস শোনার খুব-একটা তাগিদ আমরা অনুভব করিনি এবং সবচেয়ে বড় কথা এ সকল কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণ তেমনভাবে আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। সাম্প্রতিক দু-একটি গবেষণার উদাহরণ দিলেই তা আরও সুস্পষ্ট হবে।
গত মার্চ (২০২১) মাসে গ্লোবাল ইয়ুথ ক্লাইমেট সামিটে ‘যুব ও জলবায়ু পরিবর্তন: বাংলাদেশ প্রসঙ্গ’ শিরোনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ জরিপের ফল প্রকাশ করা হয়েছে। জরিপটি পরিচালনা করেছিল বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার (বিওয়াইএলসি) ও সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজ (সিইউএস)। আমি নিজেও সেই গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা কার্যক্রমে সিইউএস’র পক্ষ থেকে যুক্ত ছিলাম। জরিপে দেশের প্রত্যেক বিভাগের ১৮-৩৫ বছর বয়সী ২ হাজার তরুণ-তরুণী অংশগ্রহণ করেছিল। জরিপের অন্যান্য ফলের পাশাপাশি জ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে যে ফলটি তুলে ধরা হয় সেটি আমাকে বিশেষভাবে অবাক করেছে। ফলে দেখা যায়- জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি শুনেছে ৯৭ ভাগ তরুণ-তরুণী। তাদের মধ্যে ৫৩.৮৫ ভাগ এ সম্পর্কে ভালোভাবে বলতে পারে। এর মধ্যে আবার তৃণমূল পর্যায়ের (৫৯.৪৮ ভাগ ) অংশগ্রহণকারী এবং নারীদের (৫৬.০৯ ভাগ) হারই বেশি।
এছাড়া মাত্র ২৬.৮২ ভাগ তরুণ-তরুণী এ সম্পর্কিত সরকারি উদ্যোগ ও আইন সম্পর্কে জানে এবং ৪৮.৮৪ ভাগ তরুণ-তরুণী এ বিষয়ে বিভিন্নমুখী উদ্যোগ গ্রহণে আগ্রহী ও তারা সহযোগিতা এবং পরামর্শ চায়।
“অন্যদিকে রাইজিং টু দি চ্যালেঞ্জ: ইউথ পারসপেকটিভস্ অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এডুকেশন ইন বাংলাদেশ” শিরোনামে ইউনিসেফের সাম্প্রতিক (ফেব্রুয়ারি, ২০২১) আরেকটি গবেষণা ফল প্রকাশিত হয়। সেখানে তরুণদের জলবায়ু সম্পর্কে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অনুসন্ধান করা হয়।
দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশে পরিচালিত এই গবেষণায় বাংলাদেশের ১৫-২৪ বছর বয়সী ৫,৫৮৬ জন তরুণ-তরুণী অংশগ্রহণ করে। গবেষণার ফলে দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে বলতে বা ব্যাখ্যা করতে পারবে এমন তরুণ-তরুণীর সংখ্যা ৫০ ভাগ। ৭৭ ভাগ তরুণ-তরুণী প্রায়ই বা মাঝেমাঝেই জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে বিদ্যালয় থেকে জানতে পারে, পুরুষের তুলনায় নারীদের হার এক্ষেত্রে বেশি (৮১ ভাগ)।
৫৪ ভাগ জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ সম্পর্কে আরও জানতে কিংবা শিখতে চান। ৫ ভাগ তরুণ-তরুণীর জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে কোনো ধরনের শেখার আগ্রহ নেই। আর ৬৫ ভাগ বিশ্বাস করেন এ বিষয়ে সরকারেরই সবচেয়ে বেশি পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
ফলে সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত নির্ভরযোগ্য এ সকল গবেষণা থেকে কয়েকটা বিষয় সুস্পষ্ট: এক. তরুণ-তরুণীদের মাঝে এ নিয়ে জানার আগ্রহ ও ঘাটতি আছে এবং তাদের এ সম্পর্কে জানাবার বা এ ধরনের কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করার মতো কার্যক্রম আলাদাভাবে নেই বললেই চলে; দুই. এ বিষয়ে নিজেদের করণীয় জানা না থাকার কারণে সরকারের দিকে মুখাপেক্ষী অনেকেই এবং সরকারি উদ্যোগ সম্পর্কেও বেশিরভাগ তরুণ-তরুণীই কিছু জানেন না। তবে নারীদের এ বিষয়ে শেখার আগ্রহ ও অগ্রগতি লক্ষ্য করার মতো এবং নিঃসন্দেহে সম্ভাবনাময়।
এছাড়া সংখ্যায় অল্প হলেও একদল তরুণ-তরুণী জলবায়ু সম্পর্কে কিছুই জানে না, কিংবা তাদের এ সম্পর্কিত কোনো কার্যক্রমে একেবারেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
পৃথিবীর জলবায়ু ক্রমেই পরিবর্তন হচ্ছে। জলবায়ু প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হলেও এর সাম্প্রতিক পরিবর্তনসমূহ সত্যিই উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো। কারণ এই পরিবর্তনের ব্যাপকতা অনেক। আর এই পরিবর্তনের জন্য মানবজাতি প্রত্যক্ষভাবে দায়ী তার যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য প্রমাণ ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে। ফলে ধর্ম, বর্ণ, বয়স নির্বিশেষে সব মানুষই যদি না জানে তার কারণে জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে এবং কীভাবে সেটা ক্রমেই বাড়ছে। তাহলে জানার ঘাটতি কিংবা না জানানোটুকুই সমস্যাকে ধীরে ধীরে আরও বাড়িয়ে তুলবে।
সাম্প্রতিক সময়ে হাউ টু অ্যাভয়েড আ ক্লাইমেট ডিজাস্টার (জলবায়ু বিপর্যয় যেভাবে এড়ানো যায়) নামে বিল গেটসের নতুন বই সম্পর্কে গেটস নোটস ওয়েবসাইটে তিনি লিখেছেন: “জলবায়ু বিজ্ঞানের কল্যাণে পরিস্থিতি মূল্যায়নের মাধ্যমে আমরা আমাদের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি। এখন প্রয়োজন বাস্তবধর্মী পরিকল্পনা যাতে ভূমিকা রাখতে হবে অন্যান্য বিভাগকেও- পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, প্রকৌশল, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ফিন্যান্স এবং অন্যান্য বিভাগ। … আপনি ক্ষমতাসীন নেতৃত্ব, উদ্যোক্তা অথবা একজন ভোটার- যে-ই হয়ে থাকেন না কেন, আপনার ব্যস্ত জীবনে ফুরসত যত কমই হোক না কেন, তারপরও জলবায়ু দুর্যোগ এড়াতে আপনারও কিছু না কিছু করার সুযোগ রয়েছে। আর কিছু বলার নেই। আসুন কাজ শুরু করা যাক।” নিঃসন্দেহে কথাগুলো অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
জলবায়ু ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়গুলো তাই আমাদের সবাইকেই খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে। বিশেষভাবে জানতে হবে ও বুঝতে হবে তরুণ সমাজকে।
সাধারণভাবে জলবায়ু বলতে আমরা বুঝি, কোনো অঞ্চলে বিশ থেকে ত্রিশ বছরের আবহাওয়ার গড়কে। আবহাওয়ার মতো জলবায়ুরও অন্যতম উপাদান হলো তাপমাত্রা, বায়ুর চাপ, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত প্রভৃতি। দুটি ছোট অঞ্চলের জলবায়ু একেবারে একরকম না হলেও তাদের মধ্যে সামঞ্জস্যতা লক্ষ্য করা যায়। একই ধরনের জলবায়ুর এলাকাগুলোকে অভিন্ন শ্রেণির আওতায় আনা হয়। তাপ, চাপ, আর্দ্রতা ও বায়ুপ্রবাহের ওপর নির্ভর করে পৃথিবীকে কয়েকটি জলবায়ুতে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে আমরা জানি, বাংলাদেশ হলো মৌসুমি জলবায়ুর দেশ।
জলবায়ু পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে ও ঘটছে। এই লেখায় আগেই উল্লেখ করেছি যে, বর্তমান সময়ে মানবসৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ বাড়ছে (প্রধানত কার্বনডাই অক্সাইড এর ঘনত্ব বাড়ছে) যা জলবায়ু পরিবর্তনের একটি অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। আর তাপমাত্রা বাড়ার কারণে বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য নষ্ট হয়, সার্বিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে।
খুব সাম্প্রতিক সময়ে এর সাথে আরও একটি নতুন তথ্য যুক্ত হয়েছে, সেটি হলো ক্ষতিকর মিথেন গ্যাস উৎপাদনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা পালন। বলা হয়ে থাকে, বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ক্ষেত্রে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের থেকেও মারাত্মক মিথেন (Methane)। বাংলাদেশ এই গ্যাস উৎপাদনে শীর্ষে অবস্থান করছে এমনটাই আমরা নির্ভরযোগ্য মিডিয়ার খবরে জেনেছি। প্যারিসভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষক সংস্থা কেরোস এসএএস স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে জলবায়ুর পরিবর্তন সংক্রান্ত গবেষণার আওতায় এই তথ্যটি সাম্প্রতিক সময়ে (এপ্রিল, ২০২১) প্রকাশ করেছে। ফলে অন্যভাবে বলতে গেলে, এসব কারণে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা, বায়ুচাপ, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত ইত্যাদি সবকিছুই পরিবর্তিত হচ্ছে।
যদিও সারা বিশ্বের অধিকাংশ গ্রিন হাউস গ্যাসই উৎপাদন করছে শিল্পোন্নত রাষ্ট্রসমূহ, বাংলাদেশের দায় সেখানে খুবই নগণ্য। অথচ বাংলাদেশ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের সর্বোচ্চ ক্ষতি ভোগের দেশ। ফলে নিজেদের ক্ষতিকর গ্যাস উৎপাদনের বিষয়ে বিশেষভাবে নজর না দিলে বর্তমান ভোগান্তির পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন সংকট আরও গভীরতর হবে । তাই আমাদের সচেতন পদক্ষেপ নিতে হবে, সবদিক থেকেই সতর্ক থাকতে হবে।
এটা সুস্পষ্ট যে, অদূর ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। যেটুকু সময় ও সুযোগ এখনো আমাদের হাতে আছে, তার সদ্ব্যবহার করা এজন্য একান্ত প্রয়োজন হবে। আপদকে ভয় পেলে হবে না, শক্তভাবে তার মোকাবিলা করতে হবে, মোকাবিলা করার জন্য বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ করাটাও তাই খুব জরুরি হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় যে সকল অর্থ আসছে এবং আসবে সে সবের স্বচ্ছ, জনস্বার্থমূলক ব্যবহার; উন্নত দেশসমূহের কাছ থেকে আর্থিক, প্রযুক্তিগত ও ব্যবসায়িক অভিযোজন সহায়তা গ্রহণ; পরিবেশ স্বার্থ বিবেচনায় দূষণকারীদের নয়, জনগণের সর্বোচ্চ অধিকার; ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় মানুষকে পূর্ণ পরিমাণের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া ও তাদের পুনর্বাসন; বাংলাদেশের নদী নেটওয়ার্ক পুনরুজ্জীবনে উন্নত বিশ্বকে নির্দিষ্ট আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান ইত্যাদি নিশ্চিত করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হবে।
জাতিসংঘের উদ্যোগে বাংলাদেশে একটি অভিযোজন গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা তাৎপর্যপূর্ণ আরেকটি পদক্ষেপ হতে পারে। একইসাথে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন ও মোকাবিলায় জাতিসংঘের উদ্যোগ জোরদার করতে হবে ও তা অব্যাহত রাখতে হবে। বাংলাদেশকে তার সকল অভ্যন্তরীণ নীতিমালার প্রকৃতিবান্ধব সংস্কার ও সেসবের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিশ্চিত করাটাও খুবই জরুরি হবে।
পরিশেষে, যুক্তরাষ্ট্র ঐতিহাসিক প্যারিস চুক্তি তৈরিতে সহায়তা করেছিল, যার মাধ্যমে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করতে এবং “বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প স্তরের উপরে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে” প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই সেই চুক্তি যে চুক্তিতে এক দিনে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক রাষ্ট্র একসঙ্গে স্বাক্ষর করে রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল।
২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত ৪৬তম ধরিত্রী সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছিলেন, ‘আজ আমরা ভবিষ্যতের এক নতুন অঙ্গীকারনামায় সই করছি। প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতের সব প্রজন্মের জীবন সুন্দরভাবে চালিত হবে, যা এখন ঝুঁকির মুখোমুখি।’ আমরা ইতোমধ্যে জানি যে, প্যারিস চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র আবার ফিরে এসেছে এবং এর বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার জন্য নতুন প্রেসিডেন্ট বিশেষভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। যা সবার মনেই আবার নতুন করে আশার সঞ্চার করেছে।
অন্যদিকে এটাও আশার কথা যে, বাংলাদেশ ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (সিভিএফ) ও ভালনারেবল টোয়েন্টি (ভি২০) গ্রুপের চেয়ার হিসেবে বর্তমানে কাজ করছে। কপ-২৬ সামনে রেখে কোভিড-১৯-এর মধ্যেও বাংলাদেশ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : থিমেটিক অ্যামবাসাডর নিয়োগ (৯ আগস্ট ২০২০), গ্লোবাল সেন্টার অব অ্যাডাপটেশনের (জিসিএ) দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক অফিস স্থাপন (৮ সেপ্টেম্বর ২০২০), যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আহ্বানে জলবায়ুবিষয়ক ভার্চুয়াল শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ (২২-২৩ এপ্রিল ২০২১), ভি-২০ ক্লাইমেট ভালনারেবল ফিন্যান্স প্রথম সামিট (৮ জুলাই ২০২১) সম্পন্নকরণ, ‘দ্য জুলাই মিনিস্ট্রিয়াল’-এ অংশগ্রহণ (২৫-২৬ জুলাই ২০২১) ইত্যাদি। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা মোকাবিলা ও সবুজ উন্নয়নের মাধ্যমে সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান’ তৈরি করা হয়েছে। আসন্ন কপ-২৬-এর অভীষ্ট অর্জনে সিভিএফ ও ভি২০-এর প্রধান হিসেবে বাংলাদেশের এ সকল কর্মকাণ্ড নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।
জাতিসংঘ আয়োজিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬-এ বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বিভিন্ন প্রেক্ষিত বিবেচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সার্বিক দৃষ্টিকোণ (যেমন, সামাজিক, অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ব্যবস্থার সক্ষমতা ইত্যাদি ) থেকে তরুণ সমাজকে যুক্ত করাটা এখন সবচাইতে জরুরি হবে। কারণ, ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের জনসংখ্যা পর্যালোচনা করে দেখা যায় সব দেশেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তরুণ জনগোষ্ঠী রয়েছে। বাংলাদেশেও মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই তরুণ। আর এই তরুণরাই অন্যান্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও ইতিহাস সৃষ্টি থেকে প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনন্য অবদান রেখে আসছে।
ফলে তাদের ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করার দিকটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সম্মেলনে আলোচিত হবে এবং সেই লক্ষ্যে প্রতিটি দেশ উপযুক্ত বাস্তবসম্মত কর্ম-পরিকল্পনা তৈরি করবেন- সেটাও আমি আন্তরিকভাবে প্রত্যাশা করব। তাহলেই প্রকৃতঅর্থে জাতিসংঘ মহাসচিবের বাণী সফলতার মুখ দেখবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
বিধান চন্দ্র পাল: সংস্কৃতিকর্মী ও গবেষক; সদস্য, নির্বাহী পরিষদ, নগর গবেষণা কেন্দ্র (সিইউএস, ঢাকা) এবং প্রতিষ্ঠাতা ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর, প্রভা আরোরা
মন্তব্য করুন