আজ ৮-ই মে, বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম থ্যালাসেমিয়াপ্রবণ দেশ হওয়া সত্ত্বেও দেশে এটি আলোচনার বিষয় হয়ে উঠতে পারেনি। যদিও প্রতিরোধযোগ্য রোগটি নীরব মহামারির আকার ধারণ করেছে কিন্তু থ্যালাসেমিয়াকে এখন পর্যন্ত দেশে এটিকে জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে না। বিশ্বের কিছু দেশে (বাংলাদেশ এর অন্যতম) থ্যালাসেমিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। আন্তর্জাতিক মাইগ্রেশনের কারণে এই রোগটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। ২০০৬ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থ্যালাসেমিয়াকে বিশ্বের পাবলিক হেলথ সমস্যা হিসেবে ঘোষণা করে। প্রসঙ্গত, দক্ষিণ এশিয়ায় দুই লাখের বেশি থ্যালাসেমিয়া রোগী রয়েছে এবং প্রায় ৭ কোটি মানুষ এই রোগের বাহক।
থ্যালাসেমিয়া একটি অনিরাময়যোগ্য বংশগত রক্তরোগ। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীর দেহে লোহিত রক্তকণিকা ঠিকমতো তৈরি হতে পারে না। এর ফলে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়। শিশু জন্মের কয়েক মাস বা বছরের মধ্যে এই রোগটির লক্ষণ প্রকাশ পায়। থ্যালাসেমিয়া রোগীকে প্রতিনিয়ত অন্যের দান করা রক্ত নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। রোগীরা নিয়মিত রক্ত নিলেও অনেক ধরনের সমস্যা হয়। যার ফলে স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হয়। আমাদের দেশে বেশিরভাগ রোগী পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে ১০-১৫ বছর বয়সের মধ্যে মারা যায়।
দেশে থ্যালাসেমিয়া রোগী এবং বাহকের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে
বায়োমেডিকেল রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (বিআরএফ) উদ্যোগে ২০১৭ সালে প্রকাশিত “থ্যালাসেমিয়া ইন সাউথ এশিয়া : ক্লিনিক্যাল লেসনস ল্যার্ন্ট ফ্রম বাংলাদেশ” শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধ অনুযায়ী বাংলাদেশের শতকরা ১০-১২ ভাগ মানুষ এই রোগের বাহক; অর্থাৎ প্রায় দেড় থেকে দুই কোটির মতো মানুষ তাদের অজান্তে এই রোগের বাহক। একই গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে কমপক্ষে ৬০-৭০ হাজার থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু-কিশোর রয়েছে। গবেষণা প্রবন্ধটি বিখ্যাত ‘অরফানেট জার্নাল অব রেয়্যার ডিজিজেস’-এ প্রকাশিত হয়। শুধু অসচেতনতার কারণে সহজে প্রতিরোধযোগ্য এই রোগটি নিয়ে প্রতি বছর প্রায় ৭-১০ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া রোগে জন্মগ্রহণ করছে।
থ্যালাসেমিয়া রোগটি দেশে অপরিচিত
বিআরএফ উদ্যোগে জামালপুর জেলার চারটি উপজেলার ১১টি কলেজে এই রোগটির সচেতনতা সম্পর্কে ধারণা একটি গবেষণা করা হয়। মোট ১৫৭৮ জন ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ স্টুডেন্ট থ্যালাসেমিয়া নামক রোগের নাম-ই শুনেনি, যদিও এই জরিপের মাসখানিক আগে ডিজি হেলথ সচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশের সমস্ত মোবাইলে ফোনে থ্যালাসেমিয়া নিয়ে খুদে বার্তা পাঠিয়েছিল! যারা নাম শুনেছেন তাদের সিংহভাগ সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের (৮২%)। অন্যদিকে আর্টস (~১৬%) এবং কমার্স (~২২%) ব্যাকগ্রাউন্ডের ছাত্রছাত্রীদের সিংহভাগ নাম শুনেনি। পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিজ্ঞান শাখার নবম শ্রেণির বায়োলজির পাঠ্যক্রমে থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে কয়েকটি লাইনে আলোকপাত করা হয়েছে যার কারণে তারা নাম শুনেছে। প্রায় ২০ ভাগ স্কুল স্টুডেন্ট সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করে যারা মূলত শহরকেন্দ্রিক। কিন্তু দেশের প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ গ্রামাঞ্চলে বাস করে। যারা এই রোগের নাম শুনেছে তারা জ্ঞানের স্বল্পতা এবং সামাজিক কুসংস্কারের কারণে থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করে যা গবেষণায় ওঠে এসেছে।
সম্প্রতি বিআরএফ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে উপজাতি স্টুডেন্টদের নিয়ে পরিচালিত গবেষণা দেখা গেছে, শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ উপজাতি স্টুডেন্ট এই রোগের বাহক হলেও তাদের বেশিরভাগ এই রোগের নাম-ই শুনেনি। তাই থ্যালাসেমিয়াকে দেশের পাবলিক হেলথ সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি না দিলে দেশে উপজাতি সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
থ্যালাসেমিয়া রোগীর পরিবার অর্থনৈতিক এবং মানসিক সমস্যায় জর্জরিত
বাংলাদেশের প্রায় ৪২ ভাগ মানুষ বর্তমানে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। থ্যালাসেমিয়া রোগীকে নিয়মিত রক্ত (মাসে ১ থেকে ৪ ব্যাগ) জোগাড় করার পাশাপাশি চিকিৎসার জন্য প্রতি মাসে প্রায় ১০-২৫ হাজার টাকা খরচ হয়, যা বেশিরভাগ পরিবারের সাধ্যের বাইরে। এ কারণে রোগীর পাশাপাশি পুরো পরিবার মানসিক এবং অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
পিতামাতারা ভুগছে অনুশোচনা এবং সামাজিক অবজ্ঞার স্বীকার
বিআরএফ এবং বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতি হাসপাতাল (আক্রান্ত সন্তানের পিতামাতা দ্বারা পরিচালিত প্রতিষ্ঠান) সাম্প্রতিককালে ৩৬৫ থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত পরিবার নিয়ে একটি গবেষণা করে। সন্তানের মাতা বা পিতাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল- আপনারা যদি থ্যালাসেমিয়ার ভয়াবহতার কথা জানা থাকলে তবে কি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিতেন? পূর্ব থেকে এই বিষয়ে আঁচ করতে পারলে শতকরা ৯৭% পিতামাতা কখনোই বিয়ে করতেন না বলে জানান। প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ পিতামাতা এই রোগ হওয়ার জন্য নিজেদের দোষী মনে করেন, আফসোস করেন। সন্তানের এই রোগ হওয়ার আগে তারা থ্যালাসেমিয়ার নাম শুনেননি। ৪০ ভাগ ভোক্তভোগী পিতামাতা সামাজিকভাবে অপবাদ বা বঞ্চনার শিকার হয়।
নিয়মিত রক্ত জোগাড় করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ
বিআরএফচালিত গবেষণা অনুযায়ী, যে সমস্ত রোগীর নিয়মিত রক্ত সঞ্চালন করতে হয় তাদের প্রতি মাসে ১-৪ ব্যাগ রক্ত জোগাড় করতে হয়। ৭৭ ভাগ পরিবার সন্তানের জন্য নিয়মিত রক্ত জোগাড় করতে সমস্যার মুখোমুখি হন এবং দেশে বহুল পরিচিত ব্লাড ডোনার ক্লাব এবং সংস্থা থেকে তারা (৭৮%) আশানুরূপ সাপোর্ট পায় না। কমিউনিটি লেভেলে রক্তের বড় সংকট বাংলাদেশে। রক্তদান কর্মসূচির মাধ্যমে দেশে মূলত রক্ত সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জেলা পর্যায়ের ব্ল্যান্ড ব্যাংকে সংরক্ষিত রক্ত বেশিদিন রাখা যায় না। অপর্যাপ্তভাবে রক্ষিত রক্ত দিয়ে ট্রান্সফিউশন করলে ইমিউনোলজিক্যাল রিয়েকশনের কারণে রোগী মারা যেতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে মাত্র ৩১ ভাগ রক্ত সংগ্রহ করা হয় স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতার মাধ্যমে। স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতা সংস্থা বা ক্লাবগুলোর কার্যক্রম মূলত শহর বা সিটি এলাকায় সীমাবদ্ধ। দক্ষিণ এশিয়ায় স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতার সংখ্যা বাংলাদেশে সর্বনিম্ন পর্যায়ে।
করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় থ্যালাসেমিয়ার রোগীরা চরম সংকটে পড়েছিল যা আমাদের মাঠপর্যায়ের গবেষণা ওঠে এসেছে। লকডাউন এবং করোনার সংক্রমণের ভয়ের কারণে রক্তদাতারা রক্তদান করতে আগ্রহী ছিল না।
সচেতনতা এবং একটি মাত্র টেস্ট থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের হাতিয়ার
থ্যালাসেমিয়ার বাহকরা সাধারণত সুস্থ, তাদের কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। এজন্য অনেকেই বুঝতে পারে না তিনি থ্যালাসেমিয়ার বাহক। অন্যান্য দুরারোগ্য ব্যাধি যেমন ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং ক্যান্সারের তুলনায় থ্যালাসেমিয়া খুব কম খরচে এবং নিশ্চিতভাবে প্রতিরোধ করা যায়। শুধু দুজন বাহকের বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে সন্তানে এই রোগটি দেখা দিতে পারে। দু-বাহকের মাঝে বিয়ে বন্ধ হলো কখনো এই রোগটি হবে না। তাই সচেতনতাই থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের প্রধান হাতিয়ার।
অবিবাহিত তরুণ-তরুণীর মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি এবং থ্যালাসেমিয়ার বাহক নির্ণয়ের হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস টেস্ট সহজলভ্য এবং সহজপ্রাপ্ত করার মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। বর্তমানে দেশে মূলত ঢাকায় থ্যালাসেমিয়া বাহক নির্ণয়ে টেস্ট করার ব্যবস্থা রয়েছে। জীবনে মাত্র একবার টেস্ট করাই যথেষ্ট।
সরকারের করণীয়
১। থ্যালাসেমিয়াকে জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা:
সবচেয়ে আশঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে, থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে গুরুত্ব না দেওয়া হলে আমাদের অজান্তে দিন দিন বাহক এবং রোগীর সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। ফলে রোগী এবং পরিবারের দুর্ভোগের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ব্যয়ও বেড়ে যাবে। তাই থ্যালাসেমিয়াকে দেশের পলিসি লেভেলে গুরুত্ব দিতে হবে।
২। সচেতনতা তৈরিতে স্কুলের পাঠ্যক্রমে থ্যালাসেমিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা:
দেশের বেশিরভাগ মানুষ এই রোগের নাম-ই শুনেনি। তাই বিয়ের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে (যখন সবকিছু প্রায় পাকাপাকি) থ্যালাসেমিয়া বাহক বা স্ক্রিনিং টেস্ট বাধ্যতামূলক করলে দেশে তা কার্যকর হবে না। প্রসঙ্গত, মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে বিয়ের আগে বাধ্যতামূলক রক্ত পরীক্ষার কার্যক্রম সফল হয়নি। বর-কনে দুজনে বাহকের অবস্থা জানার পরও বিয়ে করেছে; কেননা শেষ সময়ে কেউ বিয়ে ভেঙে দিতে চায় না। সৌদি আরবে বিয়ে রেজিস্ট্রির সময় থ্যালাসেমিয়াসহ অন্যান্য রক্তের টেস্ট রিপোর্ট জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, সৌদি আরবে কলেজ স্টুডেন্টদের শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ থ্যালাসেমিয়া নামক রোগের নাম-ই শুনেনি! তাই যথাযথ সচেতনতা ছাড়া আইন করে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ করা দুরূহ ব্যাপার।
৩। থ্যালাসেমিয়া স্ক্রিনিং এবং চিকিৎসা সেন্টার গড়ে তোলা:
জেলা লেভেলে থ্যালাসেমিয়া বাহক শনাক্তকরণ এবং রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। এর মাধ্যমে কমিউনিটি লেভেলে সচেতনতা তৈরি হবে
ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন: নির্বাহী পরিচালক বায়োমেডিকেল রিসার্চ ফাউন্ডেশন (বিআরএফ), বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ (আইইউবি)
মন্তব্য করুন