এই লেখার বিষয়স্তু – ‘ঢাকার ভেতরের ঢাকা'। তথাপি শুরু করছি কলকাতার গল্প দিয়ে। ঢাকা-কলকাতার দূরত্ব খুব বেশি নয়। এই দুই কাহিনির অন্তর্নিহিত মিলও খুব কাছাকাছি। লেখাটির ধারণা ও প্রেরণার উৎস ইউটিউবে দেখা কলকাতার ‘তারা নিউজ'-এর অনুষ্ঠান - 'বই পড়া বইপাড়া'। দেখেছি অনেক দিন আগে। অনুষ্ঠানটি একটি জনপ্রিয় টক শ' ছিল। প্রতি রোববার প্রাইম-টাইমে প্রচারিত হতো। এখন হয় কিনা জানি না। এর উপস্থাপক, লেখক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় একেক সপ্তাহ পশ্চিমবঙ্গের একেকজন প্রথিতযশা কবি- সাহিত্যিকের সঙ্গে 'স্টারম্যাক্স'-এর নির্দিষ্ট স্টুডিওতে বসে আড্ডা জমাতেন। এই আলোচনায় অনেক মজার মজার কথা, গল্প, কাহিনি, ঘটনা, তথ্য, ইত্যাদি শুনতে পাওয়া যেত। আমন্ত্রয়িতা তার এই অনাড়ম্বর আয়োজনে অতিথি হিসেবে একদিন এনেছিলেন কবি শ্রীজাতকে। শ্রীজাত পশ্চিমবঙ্গের একজন প্রতিষ্ঠিত এবং অপেক্ষাকৃত তরুণ কবি । এখন বয়স একটু বেড়েছে বটে। কিন্তু তাতে কী। মন ও মননে তিনি চিরতরুণ।
কবি শ্রীজাত আগাগোড়া শহুরে মানুষ। কলকাতায় তার জন্ম। কলকাতাতে বেড়ে ওঠা। কলকতাতেই লেখাপড়া, বসবাস, চাকুরি এবং মূলত কলকাতাই তার কবিতার উপাদান-উপকরণ। বিনয় মজুমদার এবং জীবনানন্দ দাস যেখানে পল্লিগ্রামে ধান ক্ষেতের আল ধরে হেঁটে যেতে যেতে কবিতা লিখতেন, সেখানে শ্রীজাত কলকাতার শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে নগরজীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-উচ্ছ্বাস, ঘটনা-দুর্ঘটনা, ব্যস্ততা ও বিড়ম্বনার ছবি আঁকেন - রঙ-তুলি দিয়ে নয়, কবিতার ছন্দে। এই জনপ্রিয় কবির ভাবনা- চিন্তায়, সাহিত্যকর্মে ও কবিতায়, কলকাতা এবং কলকাতার নাগরিক জীবন ঘুরেফিরে প্রতিনিয়ত জীবন্ত হয়ে ফুটে ওঠে। শ্রীজাত তার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে কলকাতাকে আর দশ-পাঁচ জনের চেয়ে ভিন্নভাবে দেখেন। অন্যভাবে নগরের অন্তরাত্মাকে অনুভব করেন। উপভোগ করেন। তিনি নিজেকে আসবাবের কবি মনে করেন না। বরং কলকাতার ফুটপাতের কবি হিসেবেই তার স্বাচ্ছন্দ্য বেশি।
আলোচনার একপর্যায়ে কথাপ্রসঙ্গে এই নাগরিক কবি, শঙ্খ ঘোষের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে রঞ্জন বন্দোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, 'কলকাতার ভেতরে আছে আরেকটি কলকাতা'। তার কথায় আরও বুঝা গেল, ভেতরের কলকাতাকে অনেকে দেখতে পান না। চেনেন না। জানেন না। বুঝেন না এবং বুঝতেও চান না। অথচ এটাই আসল কলকাতা। এটাই কলকাতার প্রাণ। কলকাতার ভেতরের কলকাতা'- টা কোথায়। দেখতে কেমন। তার পরিচয় কী। বৈশিষ্ট্য কী, এসব বিষয়ে শঙ্খবাবুর বক্তব্য আমার জানা নেই এবং কবি শ্রীজাতও ওই দিন তার কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেননি। তবু নিজের সাধারণ জ্ঞান থেকে যা বুঝেছি তা যদি সঠিক হয়, তাহলে শঙ্খবাবুর ভাষায় আমিও বলতে পারি, ঢাকার ভেতরেও আছে আরেকটি ঢাকা।
আর এই ভেতরের ঢাকার গল্পগাঁথা নিয়েই আমি আপনাদের জন্য আজ সাহস করে দুকলম লিখতে বসেছি। সাহস করে বলছি এজন্যে, কারণ ঢাকার অন্তর্নিহিত কিছু কঠিন বাস্তবতা নিয়ে লিখছি অথচ আমি এ শহরে জন্মাইনি। বড় হয়েছি তৎকালীন সিলেট জেলার কোনো এক অজপাড়া গাঁয়ে। তার ওপর দীর্ঘদিন ধরে থাকি সুদূর উত্তর আমেরিকায় । তবে জীবনের একটি মূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ সময় আমি ঢাকার আশেপাশেই থেকেছি। ঢাকায় কাটিয়েছি। মোটামুটি উনিশশ' সত্তরের পুরো দশক ধরেই আমি চষে বেড়িয়েছি ঢাকার অলিগলি তস্যগুলি । ওই সময়টাতে আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে ছাত্র এবং পরে শিক্ষক ছিলাম - একাধারে দীর্ঘ সাত সাতটি বছর। বিভিন্ন কাজে সপ্তাহে অন্তত তিন-চার দিন ইউনিভার্সিটির বাসে করে ঢাকা যেতাম। কিন্তু শহরে বেশিরভাগই চলাফেরা করতাম পায়ে হেঁটে। কারণ পাবলিক বাসে ওঠানামা এখনকার মতো তখনও কঠিন ছিল এবং রিকশা চড়ার মতো পয়সা পকেটে থাকতো না।
দু-এক বার দৈবসুযোগে গাড়িতে করেও ঢাকা শহরে ঘোরার সুযোগ পেয়েছিলাম। কীভাবে, সেটা আজ আর নাই বা বললাম। কর্মচঞ্চল বিশাল ঢাকার বুকে দুইভাবে চলাফেরার অভিজ্ঞতা থাকায় তখনই বুঝতে পেরেছিলাম, জানালার কাচ নামিয়ে ড্রাইভার-চালিত প্রাইভেট মোটরযানে চড়লে যে ঢাকা দেখা যায়, স্যান্ডেল পায়ে তপ্ত রোদে মলমূত্রের দুর্গন্ধ নাকে নিয়ে ফুটপাতে হাঁটলে সম্পূর্ণ অন্য এক ঢাকা নিয়ত মন-প্রাণকে জবরদখল করে রাখে। আর এই অন্য ঢাকাই বোধ করি, 'ঢাকার ভেতরের ঢাকা' ।
যে পথ ধরে সত্তরের দশকে আমি ঢাকার ফুটপাথে হেঁটেছি এবং না জেনেই ঢাকার ভেতরের ঢাকাকে দেখার চেষ্টা করেছি, তার আশপাশের দালানকোঠার হয়ত এখন অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। কিন্তু ফুটপাতগুলো যেমন ছিল তেমনি আছে। আমার আট ন'বছরের ওই জীবনে ঢাকার এমন খুব কম রাস্তাই আছে যে পথে আমার পায়ের ধুলো পড়েনি। দিনে ঢাকায় ঘোরাঘুরি করলেও অবধারিতভাবে আমার রাতের ঠিকানা ছিল সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলা হাওয়ায় ঢেউ খেলা নির্মল নিরিবিলি ক্যাম্পাস যেখানে রাতে শিয়ালের ডাকাডাকি শুনে ঘুমাতাম এবং ভোরবেলা পাখির কলকাকলিতে নিদ্রাবসান হতো। মাঝেমধ্যে বিশেষ প্রয়োজনে ঢাকা শহরে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে কিংবা বন্ধুবান্ধবের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে অথবা ঢাকা কলেজের হোস্টেলে মাত কাটিয়েছি। এ কারণে সকাল আটটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত ব্যস্ত নগরজীবনের চিত্র আমি যেভাবে দেখেছি, সেভাবে ভোরবেলার ঢাকাকে দেখার সুযোগ পাইনি। তবে অনেক বছর আগের একদিনকার কথা আজ বিদেশ বিভুঁইয়ে বড়ই মনে পড়ছে। সেদিনের স্মৃতি আমাকে রীতিমতো নস্টালজিক করে তুলছে। জানি না বর্ণনাটা ঠিকমতো দিতে পারব কিনা।
উনিশ শ' তিয়াত্তর-চুয়াত্তর সালের কথা। এপ্রিল-মে মাসের কোনো একসময়। ঢাকায় ভারতীয় চলচ্চিত্র উৎসব চলছে। ওই উৎসবে যে-সব ছবি দেখানো হচ্ছিল তার মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের সদ্য মুক্তি পাওয়া 'অশনি সঙ্কেত'-ও ছিল। ছবিটি দেখার জন্যে অন্যদের মতো আমারও মনটা আনন্দে দোল খেতে লাগলো। কিন্তু একখানা টিকেট জোগাড় করা ছিল বেজায় কঠিন কাজ। নিউ মার্কেটের উলটো দিকে বলাকা সিনেমা হলে চলছিল ‘অশনি সংকেত'। টিকেটের তাগিদে অনেক কষ্ট করে কয়েক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষের ভিড় ঠেলে যখন বক্স অফিসের কাছে গেলাম তখন শুনলাম - টিকেট সব বিক্রি হয়ে গেছে। তারপর ছোটাছুটি শুরু হলো দালালদের পিছে - যদি কালোবাজারের একটি টিকেট ভাগ্যে জুটে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন ও মহসিন হলের পশ্চিম দিকে তখন ছিল এক বিস্তৃত ঘন বস্তি। সেই বস্তির অলিতে-গলিতে ময়লা নোংরা কাদা-পানি মেখে ঘুরেছি দালালদের পেছনে পেছনে আর ঘামে ভিজিয়েছি গায়ের জামা। অবশেষে অনেক মূল্য দিয়ে ফার্স্ট শো'র (যেটা সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলে) একটি টিকেট কিনতে পেরে নিজেকে বেশ ভাগ্যবান ভেবেছিলাম। পরে পরখ করে দেখি, দালাল আমার থেকে দাম অনেক বেশি নিয়েছে এবং টিকেটেও ঠকিয়েছে। অর্থাৎ ওই টিকেটটি ফার্স্ট শোর নয়, ছিল সেকেন্ড শো' বা লাস্ট শোন, যেটা শেষ হয় রাত ১২টায়। এখন সমস্যা দেখা দিলো - সিনেমা দেখে এতো রাতে ঢাকার বাইরে আমার আবাসিক হলে ফিরবে কী করে।
এ অবস্থায় সিনেমা আদৌ দেখব, না ক্যাম্পাসে চলে যাব – এ নিয়ে নিজেই নিজের সঙ্গে বুঝাপড়া করছি। এমন সময় ফুটপাথে হাজারো মানুষের ভিড়ে হঠাৎ দেখা হলো আমার এক পুরোনো ছোট ভাইয়ের সঙ্গে। উনিশশ' সত্তর দশকের গোড়ার দিকে সে সেই সময়ের সিলেট সরকারি মুরারী চাঁদ (এমসি) ইন্টারমেডিয়েট কলেজে আমার এক বছর জুনিয়র ছিল। তার চেহারা ছিল শ্যামবর্ণ এবং দেহের কাঠামোটা - হাল্কা-পাতলা ও লম্বাটে। তার নাম আব্দুল মান্নান। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই মান্নানের সাথে আমার আলাপ চলছে। কথায় কথায় তাকে জানালাম আমার টানাপোড়নের কথা। সে বলল, “আমি এই মাত্র ছবিটি দেখে বেরিয়েছি। এটা দেখার মতনই । টিকেট যখন কিনে ফেলেছেন – সিনেমাটা দেখেই যান। রাতে অনায়াসে আমার সাথে থেকে যেতে পারেন। আমি ঢাকা কলেজের হোস্টেলে থাকি' । এই বলে তার রুম নাম্বার লিখে একখানা চিরকুট আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে দিয়ে সে চলে গেল। আমি আরও কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম। রেস্তোরাঁয় বসে চা-টা খেলাম। বাড়তি দামে সিনেমা-টিকেট কেনার পর ভাত খাওয়ার জন্য পকেটে পয়সা যথেষ্ট ছিল না। ববিতা-সৌমিত্রের ছবি দেখার উত্তেজনায় খিদের কষ্ট টের পাইনি। রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করেই কয়েক ঘণ্টা কাটালাম।
অবশেষে ন'টা-বারোটা সিনেমা দেখে ঢাকা কলেজ হোস্টেলে গিয়ে মান্নানের রুমে উপস্থিত হলাম। ততক্ষণে মান্নান আর ছোট ভাই মান্নান রইলো না, সেই মুহূর্তে সে আমার একলারাতের' বন্ধু হয়ে গেল। শরীর যেমন ক্লান্ত তেমনি ঘামে গা চিটচিট করছে। খুব অস্বস্তি লাগছে । বন্ধুটির লুঙ্গি চেয়ে নিয়ে ঠান্ডা পানিতে অনেকক্ষণ ধরে আরামসে গোসল করলাম যাকে বলে একেবারে 'কম্প্রিহেনসিভ শাওয়ার!' শব্দ দুটো আরেক বন্ধু থেকে ধার করা। ইংরেজি অভিধানে এমন যুগল শব্দ আছে কিনা আমি বলতে পারব না। গোসলের পর টের পেলাম, খিদে এসে পেটের ভেতর জেঁকে বসেছে। তখন রাত একটা কি দেড়টা। খাবারের কথা এতো রাতে বন্ধুকে বলি কী করে সে হয়ত ভাববে, ‘বাহ! বসতে দিলাম, এখন শুতেও চায়!' কিন্তু আমার যে শোয়ার ব্যবস্থা হয়েই আছে। দরকার এখন আহারের একটা সুবন্দোবস্ত! বসে বসে এই বলে মনকে সান্ত্বনা দিচ্ছি – রাত তো অর্ধেক পার হয়েই গেছে – বাকিটা না হয় এক গ্লাস পানি খেয়েই কাটিয়ে দেবো। এমন অভিজ্ঞতা তো আমার জীবনে নতুন কিছু নয়। ঠিক এমন সময় অপ্রত্যাশিতভাবে মান্নান বলল, ‘ওয়াহিদ ভাই, চলুন ডাইনিং হলে যাই'। আমি বললাম, গিয়ে কী হবে, এতো রাতে খাবার মিলবে? 'চলেন না, দেখা যাক, আপনার ভাগ্যে আজ কী আছে?' উত্তর দিলো মান্নান। ডাইনিং রুমে আর কেউ ছিল কিনা এসব আমার মনে নেই। তবে কতক্ষণ বসার পর হাতে পেলাম এক প্লেট গরম ভাত। তার সাথে এক গোল্লা আলু ভর্তা। যেই সেই আলু ভর্তা নয় – লবণ, শুকনো মরিচ আর সর্ষের তেল দিয়ে চটকানো। সঙ্গে দু'টো কাঁচা পেঁয়াজ। গরম ভাতের সাথে সেই আলু ভর্তার স্বাদ আজও জিবে লেগে আছে! খেয়েদেয়ে ঘরে ফিরলাম। বন্ধুটি যদিও বিছানা ছেড়ে দিয়েছিল। তবু রাতে ঘুম ভালো হলো না। কারণ সে রাতের ভ্যাপসা গরম ছিল ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক! খুব ভোর বেলা পুবের আকাশে আঁধারের কালো চাদর মেলাতে না মেলাতে আমি বেরিয়ে পড়লাম। যখন বের হলাম, তখন মিরপুর রোডের যে চিত্র দেখেছিলাম, তখন বুঝিনি, কিন্তু আজ শঙ্খবাবুর কথা শুনে মনে হচ্ছে, সেটাই ছিল ওই সময়ের 'ঢাকার ভেতরের ঢাকা'-র একটি খণ্ডচিত্র।
এবার সংক্ষেপে শুনুন পাখি-ডাকা সেই ভোরবেলার কাহিনি। মিরপুর রোডের দু'ধারে ফুটপাতে বেশুমার মানুষ শুয়ে আছেন লাইন ধরে। কেউ মাত্র ঘুম থেকে ওঠে দেয়ালের মুখোমুখি হয়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছেন। কেউ বদনা থেকে পানি ঢেলে হাতমুখ ধুচ্ছেন। কেউ ছাই দিয়ে আঙুল ঘষে ঘষে দাঁত মাজছেন। কেউ তখনো ঘুমোচ্ছেন। গভীর আন্নামের ঘুম! কে জানে, কেউ হয়ত ঘুমের মাঝে মধুর মধুর স্বপ্নে বিভোর! কারো গায়ে পাতলা চাদর। কারো গায়ে গেঞ্জি। কেউ খালি গায়েই নিদ্রামগ্ন। দিনে বা রাতের প্রথমদিকে যতই গরম থাকুক, শেষরাতে খোলা আকাশের নিচে ফুটপাথে নির্মল শীতল বাতাস বিনা বাধায় এলোমেলো বয়ে চলে। তাই ক্লান্ত শরীর নিয়ে খেটে খাওয়া মানুষগুলো নিশ্চিত মনে কী আন্নামেই না ঘুমোচ্ছেন! অথচ তিনতলা বিল্ডিং-এ ২-এর নরম বিছানায় গরমে আমি সারারাত ছট্ফট্ করেছি! ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, মানুষের ফাঁকে ফাঁকে দু-একটি কুকুরও সামনের পা দু'খানি ছড়িয়ে দিয়ে নিরুপোদ্রবে নিরবচ্ছিন্ন প্রশান্তিতে ঘুমোচ্ছে। জন্তুজানোয়ারের মধ্যে কুকুরই যে সবার আগে মানুষের পোষ মেনেছিল, তার প্রমাণ সেদিন চোখের সামনেই দেখতে পেলাম। সূর্য তখনো ওঠেনি। রাস্তায় গাড়ি চলাচল নেই বললেই চলে। দু-একজন রিকশাওয়ালা দেখলাম, গুটিসুটি মেরে নিজের রিক্সাতেই আধা-শোয়া আধা-বসা অবস্থায় ঘুমোচ্ছেন, না ঝিমোচ্ছেন – বুঝার উপায় নেই।
পুরো রাস্তা তখন ধাঙড়দের দখলে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। যতদূর চোখ যায়, মিরপুর এবং আজিমপুর দু-দিকে তাকিয়ে দেখি, কয়েক ডজন মেথর রাস্তা ঝাড় দিচ্ছেন এবং ময়লা ধুলোবালি সাফসুতরা করছেন। দু-চোখ ভরে দেখলাম। মেথর-মেথরাণীদের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার পরশে রাস্তা পরিষ্কার হচ্ছে। দেখে শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় তাদের প্রতি আমার মনটা নড়েচড়ে উঠলো। মনে পড়ল ছন্দের জাদুকর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের 'মেথর' কবিতার দু'টো চরণ:
“কে বলে, তোমারে বন্ধু অস্পৃশ্য অশুচি? শুচিতা ফিরিছে সদা তোমারি পিছনে...'।
এরই মধ্যে রাস্তার পরিষ্কার অংশ ঝকঝক তকতক করছে। এতো পরিষ্কার মহানগরের রাস্তাঘাট আগে কখনো চোখে পড়েনি এবং এতো লোক যে ঢাকার রাস্তা সাফ করতে প্রতিদিন ভোরবেলা এভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন সেটাও ছিল আমার ধারণার অতীত।
গল্পের এখানেই শেষ নয়। সকালবেলা নগরের রাস্তা সাফ করতে শুধু যে মেথররা একাই আসেন তা নয়। আসার সময় তারা সঙ্গে করে নিয়ে আসেন তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরও। দেখলাম, মা-বাবারা রাস্তা ঝাড় দিচ্ছেন। বাচ্চারা ফুটপাথে বসেই খেলছে। খাওয়া-দাওয়া করছে। মারামারি করছে। কান্নাকাটি করছে। তাদের যা করার তারা তাই করছে। কেউ ফুটপাথে রাখা অ্যালুমিনিয়ামের বাটি থেকে মুড়ি তোলে তোলে খাচ্ছে। কেউ নীরস কুকিবিস্কুট কামড়াচ্ছে। কেউ কলা খাচ্ছে আর চারদিকে মাছি ভনভন করছে। কেউ প্রস্রাব করে তার ওপরই হামাগুড়ি দিচ্ছে। রাস্তা সাফ করতে করতে মা হয়ত বা চলে গেছেন অনেক দূর! সন্তান পড়ে গেছে দৃষ্টিসীমার আড়ালে। অবুঝ শিশুরা এভাবে নিজেরা নিজেদের মতন করে নিজেদের সামলে নিচ্ছে। অনাদরে, অবহেলায় রাস্তায় সময় কাটাচ্ছে। জীবন শুরুর আগেই তান্না জীবন সংগ্রামের একেকজন লড়াকু সৈনিক হয়ে বড় হচ্ছে। নাগরিকদের পথ চলার সুবিধার জন্যে নিষ্পাপ শিশুরাও যে মূল্য দিচ্ছে, সেকথা ভেবে ভেবে সেদিন কোনো কূলকিনারা পাইনি!
ফুটপাথে তখনো দোকানপাট একদমই খুলেনি। কেনাকাটা কিংবা পথচারীদের আনাগোনা নেই। নাগরিক জীবনের চলাচল-কোলাহল শুরু হতে দেরি আছে। একটু সময় উদাম রাজপথে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। বুঝলাম - দিবসের প্রারম্ভিক পরিবেশে ধোঁয়া নেই, ধুলো নেই। নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে ভোরের নির্মল হাওয়া বুক ভরে টেনে নিলাম। মৃদুমন্দ শিল্প শিল্প বাতাস সারা গায়ে প্রশান্তির প্রলেপ লাগিয়ে দিলো । রবিঠাকুরের মিষ্টি-মধুর সঙ্গীতের সুরে ক্ষণকালের জন্য মনটা নেচে উঠল:
“...এই যে মধুর আলসভরে মেঘ ভেসে যায় আকাশ পরে এই যে বাতাস দেহে করে অমৃতক্ষরণ হৃদয়হরণ, এই যে তোমার প্রেম ওগো হৃদয়হরণ এই যে পাতায় আলো নাচে সোনার বরন হৃদয়হরণ...”
আরও ভাবলাম, দেড়কোটি লোকের বাস এই শহরের নাগরিক জীবন প্রতিদিন এভাবেই পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার ছাড়পত্র নিয়ে শুরু হয়। তবে এটা ক'জন দেখার সুযোগ পায়? আমার ভাগ্য ভালো – আমি না জেনে, না বুঝে কাকতালীয়ভাবে প্রাক-সূর্যদোয়ের ঢাকা দেখা, উপভোগ ও উপলব্ধি করার সুযোগ পেয়ে গেছি। কিন্তু এতে আমার প্রাণ ভরেনি। পিপাসাও মেটেনি।
জেনে অবাক হবেন, স্বেচ্ছায় প্রবাসজীবন বেছে নেওয়ার কারণে আমার দ্বিতীয় পর্বের ঢাকা দেখা সম্ভব হয়েছে প্রায় ২৫ বছর পর ১৯৯৯ সালে এবং তৃতীয় পর্বে একই ঢাকার একই জায়গা দেখেছি আরও ৯ বছর পর ২০০৮ সালে। মালয়েশিয়াতে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যাওয়ার পথে। এই দুই বারই ঢাকা সফরের সময় আমি ভোর বেলা মাত্র ১ দিন করে সংসদ ভবন এবং গণভবনের মাঝখানের চন্দ্রিমা উদ্যানে গিয়েছিলাম। তখন কী কী দেখেছিলাম তার একটি তুলনামূলক চিত্র এবার আপনাদের সামনে তোলে ধরতে চাই।
উনিশশ' নিরানব্বইতে যখন চন্দ্রিমা উদ্যানে গিয়েছিলাম তখন দেখেছিলাম – নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষের বিভিন্ন বয়সের হাজারো মানুষের ছন্দহীন এলোমেলো হাঁটাহাঁটি। ভোরের চন্দ্রিমা এমন এক জায়গা যেখানে মানুষের ভিড়ে মানুষ সহজেই হারিয়ে যেতে পারে। মনুষ্যকুলের বৈচিত্র্য দেখে অবাক হতে হয়। অভিভূত না হয়ে পারা যায় না। বেশভূষায় কারো সাথে কারো কোনো মিল নেই। কেউ হাঁটছেন টুপি পরে। কারো হাতে লাঠি। বগলে ছাতা। দলে দলে সবাই হাঁটছেন। কথা বলছেন। ঘামছেন। কেউ পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছছেন। কেউ ঝরাচ্ছেন তো ঝরাচ্ছেন। কেউ বিড়ি-সিগ্রেট খাচ্ছেন। কেউ কাশছেন। থুথু ফেলছেন। কেউ লেকের পাড়ে একটুখানি বসে জিরিয়ে নিচ্ছেন। কেউ বসে রসিয়ে রসিয়ে চা খাচ্ছেন। কেউ দাঁড়িয়ে খালি পেটে গলগল করে দুধের মাঠা (খোল) গিলছেন। কেউ চিনিগুলা ঠান্ডা পানির শরবত সেবন করছেন। একদিন দেখা হয়েছিল অনেক দিনের পুরোনো এক বন্ধুর সঙ্গে। তার সঙ্গে কোনো এক গাছের তলায় বসে শান্তিতে দু'দণ্ড কথা বলারও ফুরসত পাইনি। সেইদিনই দেখা হয়েছিল আমার এক শিক্ষকদের সাথেও। তিনি আমাকে চিনতেই পারেননি। আফসোস !
পরের বার ২০০৮-এ আমি ঢাকায় মাত্র তিন কি চার রাত ছিলাম। তারমধ্যে একদিন মাত্র ভোরবেলা হাঁটতে গিয়েছিলাম চন্দ্রিমা-য়। ন’বছর আগের সাথে তুলনা করে কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনও লক্ষ করলাম। দু'টো বিষয় আমাকে বেশ নাড়া দিয়েছিল। প্রথমত আমার চোখে ধরা পড়ল, ঢাকার লোকজন সংঘবদ্ধভাবে মর্নিং ওয়াক এবং শরীরচর্চা করতে শুরু করেছেন। বুঝতে পারলাম – শরীরচর্চার সাথে তারা প্রাচীন গ্রিসের অ্যাথেন্সবাসীর মতো আরো কিছু অ্যাজেন্ডা যোগ করেছেন। এ কথায় আবার ফিরে আসব, তার আগে দিয়ে নেই ব্যবসার বিবরণ। মিরপুর রোড পার হওয়ার পরপরই উদ্যানে যাওয়ার পথে ফুটপাথে দেখলাম বসেছে প্রত্যুষের জমজমাট মাছ-তরকারির কাঁচা বাজার। অফিস আদালতে যাওয়ার আগে সকালে হাঁটতে এসে অনেকে দিনের প্রয়োজনীয় বাজার-সদাইয়ের কাজটি ওইখানেই সেরে ফেলছেন। দরাদরি করে তরকারি কিনছেন। সেখানে দেখলাম, হরেক রকম তাজা মাছের ছড়াছড়ি। বড় বড় জ্যান্ত কৈ দেখে আমার ভীষণ লোভ লাগছিল। সেদিন ওয়ালেট সঙ্গে থাকলে আমি কিছু জিয়ল মাছ কিনে নিতে পারতাম। সকালে মর্নিং ওয়াক করতে গিয়ে নাগরিক রান্না ঘরের গ্রোসারি নিয়ে ফেরেন, এমন ঘটনা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে হয় বলে আমার জানা নেই।
এবার আরেকটু বিশদ করে বলতে চাই শরীরচর্চার কথা। যখন পশ্চিম থেকে পুবদিকে আরেকটু সামনে এগোলাম তখন ক্রিসেন্ট লেকের উলটো দিকে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়ার মাজারের পাশে দেখলাম একটি বড় কাপড়ের ব্যানার আগুনে পোড়া মন্না গাছের সাথে টাঙানো। সাদা কাপড়ের জমিনে বড় বড় হরফে লেখা, 'ভোরের শিশির ফিটনেস ক্লাব'। তার সামনে দশ-বারো জন মাঝবয়সী লোক মিলিটারি কায়দায় ড্রিল করছেন । একজন লেফ্ট-রাইট কমান্ড দিচ্ছেন আর বাকি সবাই তাকে অনুসরণ করে অত্যন্ত সিরিয়াসলি শরীরচর্চার নানা কসরত করে যাচ্ছেন। ফিরে আসার সময় লেকের পারে পাকা দেওয়ালে বসে দেখলাম একদল মানুষ মিটিং করছেন। মনে হলো, তারা হাঁটা কিংবা এক্সারসাইজ শেষ করে একসাথে বসে অন্যকিছু করছেন। দেখলাম, একজন বই থেকে দেখে দেখে কী যেন পড়ছেন। অন্যান্য সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। তারপর গ্রুপ লিডার একে একে সবাইকে প্রশ্ন করছেন আর সংগঠনের সদস্যরা উত্তর দিচ্ছেন। আমার ইচ্ছে ছিল পাশে দাঁড়িয়ে তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু কী তা শোনার। কিন্তু সময়ের টানাটানিতে সে কাজটি সম্ভব হয়নি। আমার কাছে মনে হয়েছে, এরা কোনো রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক সংগঠনের লোক।
এই যে কেনা-বেচা, শরীর ও মনের চর্চা, সামাজিক বা রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা, আড্ডা দেওয়া, কথা বলা, নতুন দিনের নতুন সকালটাকে উপভোগ করা, এসব কিছু যেন ‘ঢাকার ভেতরের ঢাকারই চালচিত্র। কলকাতার শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে কবি শ্রীজাত যে কবিতা লিখেন তা যদি বাংলা সাহিত্যে ওঠে আসতে পারে তাহলে প্রতিদিনকার ভোরের নিউমার্কেটের সামনের মিরপুর সড়ক এবং চন্দ্রিমা উদ্যানের নগরজীবন নিয়েও তো সৃষ্টি হতে পারে উন্নত মানের সাহিত্যকর্ম। আশা করি ঢাকার কবি-সাহিত্যিকরা বিষয়টি নিয়ে ভাববেন। জাতিকে উপহার দেবেন সুন্দর সুন্দর গল্প-কবিতা। আমাদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে আরো সমৃদ্ধ করবেন। ‘চন্দ্রিমা'-র ওই অপরূপ দৃশ্য আমি সযত্নে অন্তরে ধারণ করে দীর্ঘ পথ বেয়ে বাড়িতে নিয়ে এসেছি। সেই সব স্মৃতি আমি সব সময় অনুভব করি । উপভোগ করি।
পুনশ্চ: অতি সাম্প্রতিককালে ভোরের ঢাকা দেখতে কেমন, একথা বলতে গিয়ে বাংলাদেশের স্বনামধন্য লেখক, গবেষক ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ চমৎকারভাবে সংক্ষেপে যা বলতে চেয়েছেন, তা এখন আমার মতো করে লিখছি – এখন দৃশ্যপটে কিছু নতুন সংযোজন হয়েছে। ভোরে রাস্তায় বের হলে দেখা যায় - নারী পোশাক-শ্রমিকদের দীর্ঘ মিছিল। কারওয়ান বাজারে গেলে দেখা মেলে, সারি সারি মিনতিরা বাজারের ঝুড়িতে বসা অবস্থায় ঘুমিয়ে আছে। দিনের আলো ফোটার আগে থেকেই পাইকারি মাছ-বাজারে শত শত বেপারির আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। শেষ-রাত থেকে সবজি, মাছ, মুরগি, ডিম, ইত্যাদি বোঝাই শত শত ট্রাক, কুমিল্লা, যশোর, বগুড়া, জয়পুরহাট, রাজশাহী প্রভৃতি জেলা থেকে এসে ঢাকা শহরে ঢুকতে থাকে। একটু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরো দেখা যায় - কর্মচঞ্চল হয়ে উঠছে শাহবাগের ফুলের দোকান। কাঁটাবনে পোষা পশুপাখির বাজার। অলিতে গলিতে প্রাইভেট স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছেলেমেয়েদের কলকাকলীতে মুখরিত হয়ে উঠছে।
আবু এন এম ওয়াহিদ: অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি; এডিটর, জার্নাল অফ ডেভেল্যাপিং এরিয়াজ
মন্তব্য করুন