মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব
প্রকাশ : ০১ মে ২০২৪, ০৫:০৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
মহান মে দিবস উপলক্ষে

শ্রম, শ্রমিক ও মে দিবস

ছবি : প্রতীকী
ছবি : প্রতীকী

Virtually the opposite page of life is work. But some works are formal & some are informal. এ বিষয়ে অনেক ক্ষেত্রে নারীদের প্রাইমারি ও অনানুষ্ঠানিক (Informal) কাজ বিবেচনায় আনা হয় না। কেননা এই অনানুষ্ঠানিক কাজ জাতিসংঘ প্রদত্ত জাতীয় হিসাব পদ্ধতি (UNSNA) মোতাবেক অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে জিপিডির অর্ন্তভুক্ত হয় না। এখানে উদহারণ হিসেবে গৃহকর্ত্রীর কাজ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অথচ একই কাজ অর্থের বিনিময়ে গৃহকর্মী করলে অর্থনীতির আওতায় পড়ে থাকে। অবশ্য গৃহকর্ত্রীর কাজকে ভালোবাসার অর্থনীতি (Love Economics) বলে অভিহিত পূর্বক মর্যাদা দিয়েই অর্থনীতিবিদরা চুপচাপ বসে আছেন। অথচ এতটুকু তলিয়ে দেখছেন না যে, তাদের অবদান কত সুদূর প্রসারী? এদিকে দৈহিক কাঠামোগত দিক দিয়ে কায়িক পরিশ্রমে পুরুষরা অধিকতর উপযোগী, কিন্তু নারীরা ততটা নয়।

উল্লেখ্য যে, প্রত্যেকটি ধর্মে প্রকারান্তরে সৎ কর্মের কথা বলা হয়েছে এবং শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই শ্রমের যথার্থ মূল্য পরিশোধের উপর জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। যাহোক, মে দিবসের কথা বলতে গিয়ে সহজেই সামগ্রিক শ্রমজীবী মানুষের কথা চলে আসে। উৎপাদনের চারটি উপাদানের মধ্যে শ্রম বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত শ্রম বলতে অনেকে শারীরিক শ্রমের কথা বুঝায়। কিন্তু অর্থনীতির ভাষায় শারীরিক ও মানসিক প্রচেষ্টা (Mental-Physical Exertion) হলো শ্রম। অথচ মানুষের সকল কর্ম-প্রচেষ্টা শ্রম নয়। কারণ আনন্দলাভ ও ভালোবাসার সূত্র ধরে যে পরিশ্রম করা হয়, উহা অর্থনৈতিক শ্রমের আওতায় পড়ে না, যা পূর্বেই কিছুটা উল্লেখ করেছি।

এক কথায় সকল প্রকার উৎপাদনশীলতা সম্বলিত শারীরিক ও মানসিক প্রচেষ্টাকে শ্রম বলা হয়। শ্রমের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটা দ্রুত ক্ষয়শীল তথা পচনশীল। কেননা কোন শ্রমিক এক ঘণ্টা কাজ থেকে যদি বিরত থাকে, তাহলে সেই শ্রম ঘণ্টা চির জীবনের জন্যে অব্যবহৃত অবস্থার চলে যায়, আর কখনও ফিরে পাওয়া যায় না। এদিকে মজুরি বৃদ্ধি পেলেও অনেক ক্ষেত্রে এর যোগান বৃদ্ধি পায় না। সাধারণতঃ শ্রমের যোগান অস্থিতিস্থাপক, কারণ চাহিদা বাড়লেও জনসংখ্যা বৃদ্ধি না পেলে যোগান বাড়ে না। তাছাড়া বিভিন্ন স্ট্রাটেজিক কারণে তাদের দর কষাকষির ক্ষমতা কম। এ প্রেক্ষাপটে প্রযুক্তিগত অভিজ্ঞ বা দক্ষ শ্রমের ক্ষেত্রে কিছুটা থাকলেও, অদক্ষ শ্রমের বেলায় কিছুই নেই বললে চলে। রেওয়াজ অনুযায়ী সময়ভিত্তিক কাম্য মজুরির বিধান ছাড়াও অনেক সময় পিছ হিসেবে কাজ করানো হয়। এদিকে স্থানীয় শ্রম বাজার ছাড়াও পূর্বেই তুলনায় অধিকতর বিশ্বজনীন হয়ে পড়েছে। এ প্রেক্ষাপটে কম করে হলেও বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি শ্রমিক বিদেশের বাজারে কর্মরত। It is true that steady wages structure prevailed under Shadow or Accounting price, not under market price.

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, উৎপাদনশীল শ্রম নিয়ে চিন্তা ভাবনার অভাব নেই, ফিজিওক্রাট অর্থনীতিবিদগণের মতে, যে শ্রম চুড়ান্তভাবে উপযোগ (Utility) সৃষ্টি করে, সেটা উৎপাদনশীল শ্রমের মধ্যে পড়ে। কেননা কোন রাজমিস্ত্রি এক তলা ইমরাত তৈরি করে, কিন্তু জটিলতার কারণে পুনরায় যদি ভেঙ্গে ফেলে, তা উৎপাদনশীলতার মধ্যে পড়ে না। এদিকে 6 M's (Man, Money, Machine, Method, Motivation & Market) নিয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা আবর্তিত হলেও Man তথা শ্রমজীবী মানুষ নিয়ে বেশী মাথা ঘামাতে হয়। কেননা শাশ্বত সত্যের আবারণে মানুষের স্বভাবজ প্রকৃতি ও মন গত দিক দিয়ে জটিল বিধায় অবস্থার প্রেক্ষাপটে তারা তাদের মতো করে চলতে চায়, যা অনেক সময় পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর নেতিবাচক ছাপ পড়ে।

আবার একইভাবে মালিকের খাম-খেয়ালীর জন্য খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের প্রাপ্য অধিকারের বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে রানা প্লাজার ট্র্যাজেডি তার প্রমাণ। যাহোক, এক্ষেত্রে মনে পড়ে যায় আইএলও (ILO) সৃষ্টির কথা, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে ১৯১৯ সালে ভার্ষাইল চুক্তির অংশ হিসেবে জন্ম এবং এরই সারথি ধরে শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষণ ও দর কষাকষির লক্ষ্যে সঙ্গতকারণেই ট্রেড ইউনিয়নইজম প্রবর্তিত হয়েছে।

উল্লেখ্য, এই কৃষি নির্ভরশীল বাংলাদেশে কোটি কোটি কৃষি শ্রমিকসহ অন্যান্য খাতের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শ্রমিকই তেমন সংগঠিত নয়। তাছাড়া অপ্রাতিষ্ঠানিক বলে শ্রম বাজারের অর্ধেকের বেশী শ্রমিক শ্রেণি ট্রেড ইউনিয়নের দর্শনের ছাতার তলে আসতে পারে না বিধায় আইনের প্রয়োগ নেই। এ প্রেক্ষাপটে বহুবিধ সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত। এমন দেখা গেছে যে, কিছু কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি পর্যন্ত ভোগ করতে পারে না। আরও উল্লেখ্য, এদেশে শ্রম আইন ব্রিটিশ আমল থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। আর এতে এমন কতগুলো বিধি আছে, যা অপ্রয়োজনীয় এবং আবার বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষাপটে অনেক বিধির কমতি রয়েছে বিধায় যুগোপযোগী করার জন্য কিছুটা সংযোজন ও বিয়োজনের আবশ্যকতা আছে বলে মনে করি। সত্যি কথা বলতে কি, বাংলাদেশে কোন বিধিবদ্ধ আইনে বা বিধিতে শ্রম ও শিল্প আইনের সংজ্ঞা দেয়া হয়নি।

যদিও ব্রিটিশ আমলের ১৯২৩ সাল থেকে পাকিস্তান আমলের মধ্যে দিয়ে ১৯৬৫ সালের কারখানা আইন এবং ১৯৬৯ সালের শিল্প সম্পর্ক অধ্যাদেশের সূত্র ধরে মোট ২৫টি আইন ও অধ্যাদেশের ঢেউ চলে গিয়েছে, তথাপিও পুরোপুরিভাবে শ্রমিকদের মুক্তি আসেনি। তবে ২০০৬ সালের ৪২ নং আইন সংশোধনপূর্বক ২০১৩ সালের ৩০নং শ্রম আইন প্রণিধানযোগ্য। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ম্যানুয়াল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও বাস্তবে সি বি এ’র কার্যক্রম অনেকাংশে সাধারণ ও সরলমনা শ্রমিকদের থেকে দূরে অবস্থান করে বলে প্রতীয়মান হয়। এদিকে বর্তমানে অন্যতম প্যারামিটার হিসেবে ট্রেড ইউনিয়নের বিষয় নিয়ে আমাদের গার্মেন্টেস শিল্পে আন্তর্জাতিকভাবে জটিলতা দেখা দিয়েছে, যা সামগ্রিক গার্মেন্টস শিল্পের উপর হুমকি হিসেবে দাঁড়িয়েছে। যদিও চলমান সরকার এটি নিরসন করতে দেনদরবার অব্যাহত রেখেছেন।

বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ। দেশ সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিতে যতগুলো ফ্যাক্টর আছে, তার মধ্যে সস্তা শ্রম অন্যতম। এরই সুবাদে বাংলাদেশ শত বাধা বিঘ্নের মধ্যেও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী অন্যতম প্রধান খাত হিসেবে গার্মেন্টস শিল্প আশে-পাশের দেশের সাথে বলতে গেলে প্রতিযোগিতা করে বহাল তবিয়তে টিকে আছে। এখানে বার লক্ষ মহিলা শ্রমিকসহ প্রায় পনেরো লক্ষ শ্রমিক দিবা-নিশি কাজ করে চলেছে এবং এদের চাহিদা খুব একটা নেই এবং অল্পে তুষ্টে বলে এক্ষেত্রে প্লাস পয়েন্ট নিয়ে মালিকরা অনেক সময় ছড়ি ঘুরিয়ে থাকে। এখন শ্রম বাজার স্থানীয় বা জাতীয় পর্যায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আন্তর্জাতিকভাবে ম্যাক্রো অর্থনীতির আওতায় দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক প্রতিনিয়ত বিশ্ব শ্রম বাজারে ঢুকছে এবং বয়ে নিয়ে আসছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। তবে দক্ষ শ্রমের চাহিদা বেশী বলে, এই পথ ধরে যুগপৎ যে মেধা চলে যাচ্ছে (Brain-Drain) তা অনেক ক্ষেত্রে ফিরে আসে না এবং এটি উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে শুভ নয়। তাছাড়া বর্তমানে শিশু শ্রম (Child Labour) আর এক ফোঁড়া হিসেবে দেখা দিয়েছে।

বর্তমানে বিশ্বায়নের (Globalisation) পথ ধরে শ্রম বাজারে যতটুকু সংগঠিত হয়েছে এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে যে পরিসরে সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে, তার পিছনে রয়েছে মে দিবসের আওতায় আমেরিকার শ্রমিকদের চরম দুঃখের কাহিনি এবং ত্যাগের প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তবে মে দিবসের দুঃখজনক ঘটনার পূর্বে মে মাস ছিল রূপকথার আওতায় আনন্দঘন পরিবেশ ও মিষ্টি আবহাওয়ায় হিল্লোল সম্বলিত বাতায়ন। কেননা তীব্র শীতের পর মে’র আগমন ও সেই আগমনের সাথে বয়ে নিয়ে আসতো মাধবীর মৃদু উষ্ণতা এবং এর ফলশ্রুতিতে আমেরিকানদের যেন আনন্দ ধরে না। তারা নাচ, গান ও ফুর্তি করতো এবং আনন্দের আতিশয্যে রোপণ করতো মে বৃক্ষ। কিন্তু পট পরিবর্তন হয় ১৮৮৬ সালে।

এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য, ১৮৮০ সালে আমেরিকায় সর্বপ্রথম “দৈনিক সর্বোচ্চ আট ঘণ্টা শ্রম” এর ক্ষেত্রে দাবি উত্থাপিত হয় এবং এর চার বছর পর অর্থাৎ ১৮৮৪ সালে Fedareation of Organized Trades and Labor Unions of the USA and Canada প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীতে, অবশ্য ১৮৮৬ সালে এই সংগঠনটির নাম পরিবর্তন পূর্বক Fedaration of Labor বলে অভিহিত করা হয়। শ্রমিকরা এই সংগঠনের সরণি ধরে দৈনিক ৮ ঘণ্টা শ্রমের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু অধিকাংশ মালিকরা শ্রমিকদের এই বাঁচা-মরার দাবি উপেক্ষা করলে বিশিষ্ট ঢালাই শ্রমিক মি. সিলভিসের নেতৃত্বে ১৮৮৬ সালে ১লা মে আমেরিকার সর্বত্র ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। আর এর কেন্দ্র বিন্দু ছিল যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহর। অবশ্য এই আন্দোলন বড় আকারে ধারণের স্বপক্ষে অন্যতম প্রধান আর একটি কারণ ছিল, তা হল- ১৮৮৪-৮৫ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পব্যবসায় মন্দা দেখা দিলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলশ্রুতিতে শ্রমিকের একটি বিরাট অংশ বেকার হয়ে পড়ে। আর এহেন অবস্থায় তাদের জীবনে নেমে আসে চরম দুঃখ দুর্দশা।

সেহেতু সবকিছু মিলে শ্রমিকদের আট ঘণ্টার দাবি আরও বেগবান পূর্বক তীব্রতর হয়। এদিকে এই সংগঠন আট ঘণ্টা দৈনিক শ্রম নির্ধারণের প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে পাশ করে এবং আইনগত দিক দিয়ে কিছুটা হলেও ভিত্তি খুঁজে পায়। আর সেই সুবাদে মালিক/বণিক এবং শ্রমিক শ্রেণিকে এই প্রস্তাব মেনে নেয়ার জন্য ১৮৮৬ সালের ১লা মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়। একই সাথে সবকিছু তুলে ধরে সকল পর্যায়ের শ্রমিক শ্রেণিকে সংঘটিত হওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো অব্যাহত থাকে। অবশ্য প্রথমে অনেকেই এটিকে কাল্পনিক এবং উচ্চাভিলাষী বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে। এদিকে দেখা যায় যে, মালিক শ্রেণির কোন ধরনের সাড়া না পেয়ে শ্রমিকরা ধীরে ধীরে সুনামির ন্যায় প্রতিবাদী ও তাদের দাবি বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠতে থাকে।

আর একটি মজার ব্যাপার ঘটে, তা হল- ‘অ্যালার্ম’ নামে একটি পত্রিকায় এই মর্মে প্রকাশিত হয় যে, ‘একজন শ্রমিক আট ঘণ্টা কাজ করুক কিংবা দশ ঘণ্টাই করুক সে দাস হিসেবেই গণ্য হবে’। এ রকম বিষয়বস্তু সম্বলিত একটি কলাম ছাপা হওয়ার পর জ্বলন্ত আগুনে যেন ‘ঘি’ এসে পড়ে এবং যুগপৎ আমেরিকার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট-বড় শ্রমিক সংগঠনগুলোর সাথে বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দলও একাত্মতা প্রকাশ করে। এই সব মিলে মে মাসকে ঘিরে আয়োজিত হতে থাকে বিভিন্ন শক্তিশালী প্রতিরোধ এবং অগণিত খণ্ড খণ্ড প্রতিবাদসভা। অথচ মালিক বা বণিকরা শ্রমিক শ্রেণির এ বিষয়টি আমলে না দিয়ে তুচ্ছজ্ঞান পূর্বক প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু শ্রমিক শ্রেণি ধীরে ধীরে এমনই শক্তিশালী এবং প্রতিবাদমুখর হয় যে রেলপথ অবরোধ করে। এ প্রেক্ষাপটে শ্রমিকদের যতটুকু দুর্বল ভেবেছিল, বাস্তবে দেখে অন্য রকম এবং তখন সরকারের টনক নড়ে। তাই সরকার রাষ্ট্রীয় পুলিশ ও প্রতিরক্ষা বাহিনীকে জোরদার করতে থাকে। এক্ষেত্রে সুবিধাবাদী স্থানীয় মালিক ও ব্যবসায়ীরা শিকাগো সরকারকে অস্ত্র ও জনবল সংগ্রহের জন্যে বিপুল অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করে। এতদ্ব্যতীত একই সাথে শিকাগোর বাণিজ্যিক ক্লাব ‘ইলিনয়’ প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ভারি অস্ত্রশস্ত্র কেনার লক্ষ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ প্রদান করে।

এতসব বাধার মুখোমুখি হয়ে অবশেষে ১৮৮৬ সালের ১লা মে সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় তিন লাখ শ্রমিক তাদের কাজ ফেলে রাস্তায় নেমে আসে। এদিকে শিকাগোতে আগে থেকেই শ্রমিক ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছিলো। এখানে প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক কাজ ফেলে শহরের কেন্দ্রস্থলে সমবেত হয়। ইতিমধ্যে মি. পার্সন্স, মি. জোয়ান মোস্ট, মি. আগস্ট স্পিজ, মি. লই লিংসহ অনেকেই এই আন্দোলনের পথিকৃৎ হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে অর্থাৎ ৪ঠা মে আন্দোলন চলাকালে সন্ধ্যায় হালকা বৃষ্টির মধ্যে শিকাগোর ‘হে’ মার্কেট বাণিজ্যিক এলাকায় শ্রমিকরা মিছিলের উদ্দেশ্যে জড়ো হয়। মিছিল শুরুর আগে শ্রমিকনেতা মি. আগস্ট স্পিজ জড়ো হওয়া উপস্থিত শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে কিছু গঠনমূলক কথা বলছিলেন। এ সময় হঠাৎ করেই দূরে দাঁড়ানো পুলিশ দলের কাছাকাছি একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। এতে একজন পুলিশ সার্জেন্টসহ ছয়জন নিহত এবং বেশ কিছু সংখ্যক আহত হয়। আর বোমা বিস্ফোরণের অব্যবহিত পর পুলিশবাহিনী শ্রমিকদের ওপর অতর্কিতে হামলা শুরু করে, যা ভয়াল দাঙ্গায় রূপ নেয়। আর এই দাঙ্গায় প্রাণ হারান ১১জন শ্রমিক।

এদিকে পুলিশ সার্জেন্ট হত্যা মামলায় শ্রমিকনেতা মি. আগস্ট স্পিজসহ আট জনকে অভিযুক্ত করা হয় এবং চিরুনি অভিযান চালিয়ে শিকাগো শহর ও এর আশ পাশের এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় আন্দোলনে আরও নেতৃত্বদানকারী মি. ফিশার, মি. লুইস, মি. জর্জ এঞ্জেল, মি. মাইকেল স্কোয়ার সহ অনেক প্রতিশ্রুতিশীল শ্রমিকনেতাকে এবং ষড়যন্ত্রমূলক একটি মামলা দায়ের করা হয়। আর মামলায় প্রহসনমূলক বিচারের রায়ের সূত্র ধরে ১৮৮৭ সালের ১১ই নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে মি. স্পিজসহ ছয় জনকে প্রাণদণ্ড দেয়া হয়।

প্রসঙ্গক্রমে, ফাঁসিতে ঝোলানোর পূর্ব মুহূর্তে স্পিজ বলেন, এমন একদিন আসবে যেদিন আমাদের নীরব মৃত্যু তোমরা যে কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করতে চাও, তার চেয়েও বেশী শক্তিশালী হবে। উল্লেখ্য যে, মি. লুই লিং নামে একজন শ্রমিক নেতা ফাঁসির একদিন আগেই কারাভ্যন্তরে আত্মহত্যা করেন। অবশ্য লোক দেখানোর নামে অভিযুক্ত আরেকজনের ফাঁসি মওকুফ করে পনেরো বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। আসলে মামলার সবকিছু সাজানো ছিল বিধায় পরবর্তীতে ১৮৯৩ সালের ২৬ শে জুন ইলিনয়ের গভর্নর দাঙ্গার হুকুম প্রদানকারী পুলিশের কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করেন এবং বোমা বিস্ফোরণকারীকে খুঁজে বার করার জন্য সচেষ্ট হন। তবে অজ্ঞাত কারণে সেই বোমা বিস্ফোরণকারীর পরিচয় আর কখনোই প্রকাশ পায়নি।

যতদূর জানা যায়, আন্দোলন দমন করতে পুলিশের গুপ্তচর সাজানো পাতানো খেলার (Arranged game) আবর্তে ইচ্ছাকৃতভাবে এই বোমা হামলা করে। কিন্তু এতে বিপ্লবের আগুন না নিভে ক্রমশ: ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে দেশান্তরে এবং শুধু একটিই স্লোগান হয়ে দাঁড়ায়- “দুনিয়ার মজদুর এক হও”। এমনই ভাবে চলতে চলতে সময়ের পরিক্রমায় আসে ১৮৯০ ইং সাল। আর সেই ৮ ঘণ্টা শ্রমের দাবিতে ধর্মঘটের ট্রেন্ড চলতে থাকে সম্মুখপানে, আর এই ঢেউ ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছায়। এদিকে নিহত শ্রমিকদের স্মরণে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবির সমর্থন নিয়ে ১লা মে শ্রমিক দিবস স্বীকৃতি পূর্বক পালন শুরু হয় এবং সেই সময় থেকে ১লা মে আন্তর্জাতিক সংহতি দিবস ও সাধারণ ছুটি হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। অথচ কথায় বলে প্রদীপের নিচে অন্ধকার। কেননা ১৮৮৬ সাল আজ আমরা ২০১৫ সালের উপর দাঁড়িয়ে আছি সময়ের পরিক্রমায় পার হয়ে গিয়েছে গুনে গুনে ১২৮টি বছর।

অতীব দুঃখের বিষয় হলো সারা বিশ্বে ১লা মে বিশেষ মর্যাদা সহকারে আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস পালিত হলেও খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই মহান দিবস এখনও পালিত হয় না। উল্লেখ্য যে, এ বিশ্বে প্রায় ৮০টি দেশে সরকারি ছুটি পালিত হয়। তাই সংগত কারণেই সেই ত্যাগী শ্রমিকদের জানাই লাখো সালাম। এদিকে কেন এবং কি জন্যে আমরা বিশ্বব্যাপী মে দিবস পালন করছি, তারই একটি সামগ্রিক ছন্দময় আলেখ্যপূর্ণ কবিতা নিম্নে পুনঃ তুলে ধরার প্রয়াসী হয়েছি:

কি? শ্রমজীবী মানুষেরা এ আধুনিক সভ্যতার ধারক ও বাহক; সদা তারা ব্যস্ত গড়তে, নেই কোন ক্লান্তি, আছে শুধু বেগ। তাঁরা যদি সকাল-সন্ধ্যা শ্রম না দিত একান্ত আপন করে; কৃষান এবং কৃষাণীরা যদি ফসল না জন্মাতো ক্ষেত ভরে। আবহমান উষ্ণ ঘামের ধারা বইতো না যদি করে দর দর; কোথায় থাকতো আমাদের অবস্থান ভেবেছি কি একবার?

কখন? পূর্বে মে মাস ছিল বহু সাধের বসন্তের আগমনি বার্তা; পশ্চিমা দেশে অসহ্য শীত চিরে আসতো মে’র রূপকথা। রোপণ করা হতো মে বৃক্ষ ও নাচ-গান দিয়ে করতে বরণ; কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীতে পরিবর্তিত হয় শ্রমজীবীদের দর্শন।

কোথায়? অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে কুড়ি ঘণ্টা দিতে হতো শ্রম; পশুর মতো ব্যবহার করা হতো, না দিয়ে এতটুকু সম্ভ্রম। আঠারশো তেষট্টি সালে গড়ে উঠে ট্রেড ইউনিয়নের ভিত্তি; এ সুবাদে “আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার” ধরে নিক্তি। শ্রমিক শ্রেণি সোচ্চার হয় প্রত্যহ আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে; রক্তের ধারা বয়ে যায় “হে মার্কেট স্কোয়ারের” শক্ত মাটিতে। তাদের এ পবিত্র রক্ত ছিনিয়ে আনে সাধের শ্রম আট ঘণ্টা; সূচিত হয় আঠারো শো ছিয়াশি সালের মে দিবসের পদচারণা।

পরিশেষে: মে’র রাগ-রাগিণীতে আসুন জানাই পবিত্র কর্মের প্রতি সম্মান; কর্মজীবী মানুষের ফুলে-ফলে শোভিত হোক বিশ্বের শ্রম বাগান।

মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব: বিশিষ্ট গবেষক, অথর্নীতিবিদ এবং লেখক

সহায়ক সূত্রাদি:

১। প্রবন্ধ মালঞ্চ- মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব। ২। Chowdhury's Labour Industrial & Allied Laws- A.K.M Mohsanuddin Ahmed Chowdhury. ৩। সাপ্তাহিক লিখনি- (২৯ এপ্রিল-০৫ মে/১৪ইং (বর্ষ-১৯, সংখ্যা- ৫) ৪। দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন- ০/০৫/২০১৪ইং ৫। গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের ভিত্তিতে জাতীয় অর্থনীতিতে নারীদের অবদান- ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট-হেলথব্রিজ। ৬। অন্যান্য পত্র-পত্রিকা।

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নারীসহ সিলেটের সাবেক আলোচিত কাউন্সিলর লায়েক গ্রেপ্তার

ফরিদপুর জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শামীম গ্রেপ্তার

কেন্দুয়ায় মামার হাতে ভাগ্নে খুন

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষ, আহত ১০

বাসে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে তিন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় পল্লী বিদ্যুতের ৭ জন বরখাস্ত

এবার ম্যানসিটি ঘরের মাঠে টটেনহ্যামের কাছে বিধ্বস্ত

বিগত সরকার দেশের স্টেডিয়ামগুলোকে চরণভুমিতে পরিণত করেছে: বকুল

গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি ও নতুন প্রজন্মের প্রত্যাশাবিষয়ক সেমিনার 

আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন বাসে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যাওয়া মাহিন

বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসার্স কাউন্সিলে নীল দলের নিরঙ্কুশ বিজয়

১০

বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত ২

১১

বিমানবন্দরে সাংবাদিক নূরুল কবীরকে হয়রানি, তদন্তের নির্দেশ ড. ইউনূসের

১২

মিনা ফারাহকে জামায়াত আমিরের ফোন

১৩

২৪ চেতনায় সবাইকে জাগ্রত হতে হবে : শামীম

১৪

পাওনা টাকা নিয়ে ঝগড়া, ভাতিজাকে খুন করে গ্রেপ্তার চাচা

১৫

আর পি সাহা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা

১৬

মাছের প্রজননে সময় না দিয়ে মানুষ দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছে : মৎস্য উপদেষ্টা

১৭

আজিজুল হক কলেজে কনসার্ট চলাকালে ছুরিকাঘাতে যুবক খুন

১৮

বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তাপসসহ ৩০ জনের নামে মামলা

১৯

কিছু মানুষের ব্রেইন সিটিস্ক্যান করে দেখার ইচ্ছা, কীভাবে এত ক্রিমিনাল হতে পারে?

২০
X