তিনি ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের ২ নং সেক্টরের ‘কে’ ফোর্সের ঢাকা ক্র্যাক প্লাটুনের দুঃসাহসী এক কমান্ডো। ছোটকাল থেকে তার মুখ থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অনেক সফল অপারেশনের গল্প শুনে এসেছি। এই মুক্তিযোদ্ধা এমনই এক নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক ছিলেন, নিজের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় ব্যবহার করে সরকারি খাতায় নাম লিখান নাই। সরকারি ভাতাও তাই নেন নাই।
মাঝে মাঝে গর্ব করেই বলতেন, ‘আমি দেশের নির্যাতিত মানুষের জন্য যা করেছি তার সঙ্গে সনদপত্রের কী যোগাযোগ! যদি কখনো প্রযোজন হয়, আমার কাছে তো ওসমানী সাহেবের স্বাক্ষরকৃত সনদপত্র আছেই!’
এই মুক্তিযোদ্ধা গত ২৮ এপ্রিল ঢাকার বারডেমে ইন্তেকাল করেন। তিনি মারা যাওয়ার পরে আমার কাছে তার সার্টিফিকেটগুলো আসে। আমি সঙ্গে সঙ্গে সিলেটের পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বললাম। তারা বললেন, থানা নির্বাহী অফিসারের কাছে জানাতে হবে। আমি মৃত মুক্তিযোদ্ধার দেশের বাড়ি সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার থানা নির্বাহী অফিসারের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি আমাকে এলাকার একজন সিনিয়র মুক্তিযোদ্ধাকে ফোন করতে বললেন। সেই সঙ্গে জানালেন, লাল বার্তা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেটেড লিস্টে মৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম নাই।
আমি তাদের আমার কাছে রক্ষিত ওসমানী সাহেব এবং মেজর হায়দারের স্বাক্ষরকৃত সনদপত্র পাঠালাম। সেগুলো কর্তৃপক্ষ উপেক্ষা করলেন। বললেন যে, গেজেটেড সার্টিফিকেট লাগবে। এভাবে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সিদ্ধান্ত পেতে পেতে ঢাকার উত্তরায় ও সিলেটের বালাগঞ্জে দুবার জানাজা হয়ে গেল। সিলেটের দরগাহ শরিফে শেষ জানাজা হওয়ার আগে তারা আমাকে জানালেন, গার্ড অব অনার দেওয়া সম্ভব নয়।
আমি তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, একজন মৃত মুক্তিযোদ্ধার কাছে গার্ড অব অনার কোনো অর্থবহন করে না। যিনি জীবিত থাকা কালেই রাষ্ট্রীয় সম্মানকে পায়ে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন, এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে একটি গার্ড অব অনার ক্র্যাক প্ল্যাটুনের কমান্ডো মিছবা জায়গীরদার সাহেবের আত্মার কী এমন উপকার করতে পারবে!!!
দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। আমি বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সিলেট শাহ জালাল (র.) দরগাহ কবরস্থানে শায়িত করে বাড়ির পথে হাঁটা ধরলাম। বুকে একটু চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছি। রাষ্ট্র তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজনকে উপেক্ষা করল, ক্ষোভ শুধু এতটুকুই! এর বেশি কিছু না!
একটু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে চাইলাম। পৃথিবীর সবাই ভালো থাকুক, সুস্থ্য থাকুক নিরন্তর।
মোহাম্মদ ফাছিহ-উল ইসলাম শাইয়্যান : আইটি উদ্যোক্তা
মন্তব্য করুন