‘বাবার মৃত্যুর পরে আমার ওপর থেকে একমাত্র অভিভাবকের ছায়া সরে গেল’, ভদ্রলোকের কথা বেদনার্ত শোনায়। আমার এক সহকর্মীর বন্ধু তিনি। মুঠোফোনে কথা বলছিলাম। তিনি গল্প করছিলেন কলকাতায় তার বড় হয়ে ওঠা, তার কাজ, তার পরিবার ও বন্ধু-বান্ধব সম্পর্কে। গল্পের পরতে পরতে তার কণ্ঠে কখনো কখনো উচ্ছ্বাসের সুর, কখনো কখনো চমকের আন্দোলন, কখনো কখনো বেদনার আভাস। শুনতে শুনতে দু’টো শব্দ আমার করোটিতে কেন যেন ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে’ কথা কচ্ছিল- ‘একমাত্র’ এবং ‘অভিভাবক’। আমি লেখার টেবিলের পাশের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই।
‘আমার জীবনে কি বাবাই একমাত্র অভিভাবক ছিলেন? কিংবা মা’? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করি আমি। নিজের মনেই উত্তর পেয়ে যাই- না, ছেলেবেলায় আমার অভিভাবক একজন ছিলেন না এবং সত্যিকার অর্থে আমার মা-বাবা ‘আমার বহু অভিভাবকদের’ একজন ছিলেন মাত্র। ‘আমার অভিভাবকরা ’ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন নানান রূপে, নানা জায়গায়, নানাভাবে- ঘরে-বাইরে, স্কুল-কলেজে, পথে-ঘাটে।
ঘরের মধ্যে মা-বাবা তো ছিলেন, তারপর ছিলেন আমাদের রহিমন বু, মায়ের রান্না-বাড়ার সহায়তাকারী এবং রহম আলী ভাই, যিনি বাবার বাগানের কাজের সহকারী ছিলেন। ঘরের মধ্যে উঠতে-বসতে, খেতে-শুতে রহিমন বুর খবরদারিতে কাটতো। ‘খাইতে বসার আগে হাত ধুইয়া আসো বাজান’, ‘অত চা খাইও না, শইর কইষ্যা যাইবো’, ‘অত রাইত জাগো ক্যান? আল্লাহ পাক রাইত বানাইছে ঘুমানের লাইগ্যা। ‘- এমন শত শত খবরদারি চলতো রাত-দিন।
রহম আলী ভাই ছিলেন আরও এক কাঠি সরেস। সারা দিনের সব দুষ্টুমির খবর দিনের শেষে বাবার কানে পৌঁছানোই ছিল তার প্রধানতম কাজ। খেলতে গিয়ে বাগানে গাছ মাড়িয়েছি কিনা, পাশের বাড়ির জানালায় ঢিল ছুঁড়েছি কি না, বাড়ির পোষা বেড়াল ‘পুষির’ লেজে দড়ি দিয়ে খালি টিন বেঁধেছি কি না - সারা দিন বাড়ি না থেকেও বাবা সব জানতেন সন্ধ্যা নাগাদ।
কলেজ গেটের মোড়ে ছিলেন আমার আর দুজন অভিভাবক। ‘ভাই-ভাই কেবিনের’ জলিল ভাইয়ের ছিল শ্যেন দৃষ্টি । কার কার সঙ্গে মিশছি, পথে-ঘাটে, কোন তথাকথিত ‘অন্যায্য কাজ’ (তার ভাষায়) করা যেত না জলিল ভাইয়ের চোখ এড়িয়ে। আমার সব অন্যায্য কাজের বিবরণীই তিনি সযত্নে পেশ করতেন আমার বাবার দরবারে। সুন্দর চা বানাতেন জলিল ভাই- শরীফ মিয়ার ‘মাল্লাই চায়ের’ সঙ্গেই শুধু সে চায়ের তুলনা চলে। নিজেকে কেউ-কেটা প্রমাণ করতে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে তিন বন্ধুকে নিয়ে ‘ভাই-ভাই কেবিনে’ ঢুকেছিলাম চা-পানের জন্যে। না, মোটেই ভ্রাতৃসুলভ ব্যবহার করেননি জলিল ভাই। রেস্টুরেন্টে বসার বয়স আমার হয়নি, এই একটি মাত্র কথা বলে তিনি আমাকে পত্রপাঠ বিদায় করেন।
জলিল ভাইয়ের ‘ভাই-ভাই কেবিনের’ কয়েক ঘর পরেই ছিল অশ্বিনীদা’র (অশ্বিনী মিস্ত্রির) কাঠের দোকান। মাঝ-বয়সী এ মানুষটি আমার মা’কে ‘মা’ ডাকতেন এবং সে সূত্রেই তিনি আমার অগ্রজের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তার মুখের এবং স্বরের কোনো বাঁধন ছিল না। সুতরাং সুযোগ পেলেই তিনি আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে আমার দুষ্কর্মের বিবরণ দিয়ে আমাকে শাসাতেন। জনসমক্ষে অমন বেকায়দায় আমি জীবনে বড় একটা আর পড়েছি বলে আমার মনে পড়ে না। তারপর মায়ের কাছে নালিশের ফিরিস্তি তো আছেই।
কিন্তু একটি দিনের কথা খুব মনে আছে। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে - বরিশালের বর্ষা বলে কথা। আমরা ক’বন্ধু ভিজতে ভিজতে এবং একে অন্যকে ভেজাতে ভেজাতে বাড়ি ফিরছি। হাতের ছোট্ট ছাতাকে তরবারির মতো ব্যবহার করে এক অন্যকে আক্রমণ করছি- জুতো ভেজাচ্ছি রাস্তার জমে যাওয়া জলে। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি সামনেই অশ্বিনীদা’ দাঁড়িয়ে। বন্ধুরা ততক্ষণে হাওয়া।
‘বড়লোক হইয়া গ্যাছো, না? জুতা ভিজাইয়া নষ্ট করলে অসুবিধা কি? বাপে রাইত-দিন খাইট্টা কিন্না দেবে। তোমার চিন্তা কি?’ বর্ষার মুষলধারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাকে বকতে বকতে আর আমার মাথার ওপরে ছাতা ধরে আধা ঘণ্টা পরে তিনি যখন আমাকে আমাদের বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে দেন, তখন আমার শরীরে কোন বৃষ্টির ফোঁটা তিনি পড়তে দেননি, কিন্তু হাঁপানির রোগী অশ্বিনীদা’র শরীরের কেন অংশ আর শুকনো ছিল না।
‘এ্যাই ..ই ..ই’ - বজ্রকণ্ঠের হুঙ্কার। বেশ আনন্দে ক’বন্ধু মিলে বরিশাল জিলা স্কুলের পাশের রাস্তার বিজলী বাতিটা ঢিল ছুঁড়ে ছুঁড়ে তাক করছিলাম। প্রতিযোগিতা হচ্ছে কে ওটা প্রথম ভাঙতে পারে। বেশ কষেই ঢিলটা ছুঁড়েছিলাম - লেগেও গেল। খান্ খান্ শব্দে বাতিটা ভেঙে যাওয়ার শব্দে স্কুলঘর থেকে বেরিয়ে ওই বজ্রকণ্ঠের অধিকারী মানুষটি - স্কুলঘরের খবরদারি যিনি করেন, তিনি। মনসুর নানা - আমাদের সবার ‘নানা’। পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে বরিশাল জিলা স্কুলে যারাই ছাত্র ছিলেন, তারাই ‘নানাকে’ চিনবেন।
আমার এ বিপদকালেও আমার ‘বেইমান’ বন্ধুরা আমাকে ফেলে দৌড় দিল- কাপুরুষ আর কাকে বলে! নানা এসেই খপ করে আমার কব্জি ধরলেন শক্ত হাতে- বুঝলাম ভীষণ রেগেছেন তিনি। ভয়ে আমি তখন আধমরা। আমার ভীত মুখের দিকে তাকিয়ে তার বোধহয় মায়া হলো। নরম গলায় বললেন,’ বাত্তি ভাঙাটা তোমাগো কাছে খেলা। কিন্তু রাইতে কত্তো মানু এই পথ দিয়া বাড়ি যাইব। চিন্তা করছ, আন্ধইরা রাইতে হেগো কি কষ্ট হইবে’? জীবনে সে শিক্ষা আমি ভুলিনি।
আমার এই সব অভিভাবকরা আমাকে শুধু ‘মানুষ’ হতে সাহায্য করেননি, বিভিন্ন সময়ে আমাকে নিয়ে গর্বিত হয়েছেন। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের পরে জিলা স্কুলে আমাকে যখন সম্বর্ধনা দেয়া হয়, সেখানে মনসুর নানার গর্বিত মুখ আমি দেখেছি। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের পরে নিজের বড়শিতে ধরা বিরাট এক রুইমাছ কাঁধে করে বয়ে এনেছেন অশ্বিনীদা’। অত বড় মৎস্যটি আমার মায়ের পায়ের কাছে নামিয়ে বলেছেন,’ মা, মাথাডা অরে দিয়েন’। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষার ফলাফল বেরুলে রহম আলী ভাই লোকের কাছে বলে বেড়াতেন আমার কথা। উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ যাওয়ার সময়ে রহিমনবুর ক্রন্দন আমি ভুলিনি। আমাকে নিয়ে তাদের ছিল এক বুক অহংকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে বি এম কলেজে গিয়েছিলাম বহিরাগত পরীক্ষক হয়ে মৌখিক পরীক্ষা নিতে। ঢুকেছিলাম ‘ভাই-ভাই কেবিনে’ একদিন। জলিল ভাইয়ের আনন্দ কে দেখে! সবাইকে সরিয়ে দিয়ে তিনি আমাকে সাদরে বসতে দিয়েছেন, নিজ হাতে চা বানিয়ে আমার সামনে ধরেছেন। সে অমৃতের সোয়াদ এখনো মুখে লেগে আছে।
আমার এই সব অভিভাবকদের কেউই নেই এখন। স্কুল ছাড়ার পরে মনসুর নানার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়ে অশ্বিনীদাকে আমি নিজে আটঘর-কুরিয়ানায় পৌঁছে দিয়েছিলাম। সত্তরের দশকের শেষাশেষি তিনি কলকাতায় দেহত্যাগ করেছেন বলে শুনেছি। আশির দশকে জলিল ভাই, রহিমন বু’ আর রহম আলী ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। বড় মনে হয় তাদের কথা।
নিজেই এখন বহু মানুষের অভিভাবক হয়েছি। নানান জন আমাকে তাদের আস্থার জায়গা মনে করেন। কিন্তু তবু একবার আক্ষেপ করেছিলাম প্রয়াত অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার কাছে, ‘আমার ছায়ারা সব সরে যাচ্ছে, স্যার’, তিনি শান্ত স্বরে বলেছিলেন, ‘তোমার আর ছায়ার প্রয়োজন নেই। তুমিই এখন অন্যকে ছায়া দেবে’। হয়ত তাই। কিন্তু তবু আমার সব ‘অভিভাবকদের’ অবর্তমানে প্রায়ই নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়।
ড. সেলিম জাহান : ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয় ও দারিদ্র্যবিমোচন বিভাগের সাবেক পরিচালক
মন্তব্য করুন