ক্রমবর্ধমান রিয়েল এস্টেট বাজার, মানুষের আয় বৃদ্ধি এবং নগরায়ণের সূত্র ধরে বাংলাদেশে ইন্টেরিয়র ডিজাইন ব্যবসা ও উপকরণের বাজারের আকার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ১০ বছরের ব্যবধানে এই ব্যবসা ও বাজারের আকার চার গুণ বেড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, এ ব্যবসার বাজারে বিনিয়োগ এখন প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। আগামী পাঁচ বছরে অর্থাৎ ২০২৯ সাল নাগাদ এর পরিধি বর্তমান বাজারের চেয়ে দিগুণ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হবে। সব সেক্টরের মতো আমাদের কাজের জায়গা, প্রাণের জায়গা, প্রিয় ইন্টেরিয়র সেক্টরেও বাজেট প্রস্তাব করা হবে। কিন্তু আমাদের দেশ ডিজিটাল বাংলাদেশ হওয়ার পাশাপাশি নগরায়ণের জন্য ইন্টেরিয়র সেক্টরকে যতটুকু গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন, তা গত বাজেটগুলোতে প্রতীয়মান হয়নি। তাই সব দিক থেকে বিবেচনা করে দরকার আরও বাজেটবান্ধব ইন্টেরিয়র সেক্টর।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে আইটি ফ্রিল্যান্সিং সেবা হতে উদ্ভূত আয়কে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতির প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে, যা আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। কারণ ফ্রিল্যান্সিং ইন্টেরিয়র ডিজাইন এর মাধ্যমে বেকারত্ব কমানো সম্ভব এবং ইন্টেরিয়র ডিজাইনের আন্তর্জাতিক বাজার তৈরি করা এবং আমাদের ইন্টেরিয়র ডিজাইনারদের জায়গা করে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
ডিজিটাল ও স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনে ইন্টেরিয়র সেক্টরে এরই মধ্যে ৭ লাখ তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থান নিশ্চিত হয়েছে এবং ২০২৯ সালের মধ্যে আরও ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে গবেষণায় দেখা গেছে। দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশ তরুণ হওয়ায় অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। এই হার উন্নত বিশ্বে ২০-২৫ শতাংশের বেশি নয়। প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখেরও বেশি মানুষ শ্রমবাজারে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। চলমান চতুর্থ শিল্প বিপ্লব দেশে-বিদেশে দক্ষ জনশক্তির জন্য নতুন নতুন কর্মসংস্থানের অভূতপূর্ব সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। আর এই নতুন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে একটি সম্ভাবনাময় একটি খাত হতে পারে ইন্টেরিয়র ডিজাইন সেক্টর।
‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’, ‘ভিশন ২০৪১’ ও ‘ডেল্টা প্ল্যান ২১০০’-এর বাস্তবায়নে দেশে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও কারিগরি জ্ঞানে পারদর্শী মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে। কর্মসংস্থানের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় রেখে শিক্ষা কার্যক্রমের বিষয় সংশোধন ও পুনর্বিন্যাস করে শিক্ষার সঙ্গে শিল্পের নিশ্চিত যোগসূত্র স্থাপন করা হচ্ছে। কারিগরি দক্ষতার এই জায়গাতেও ইন্টেরিয়র হতে পারে ভালো একটি সেক্টর।
দেশের ইন্টেরিয়র কোম্পানি এবং প্রতিষ্ঠানগুলো কিন্তু দিন দিন বড় হচ্ছে। এই সেক্টরও বড় হচ্ছে এবং এগিয়ে যাচ্ছে। অভিজ্ঞ ও দক্ষ লোকবলও তৈরি হয়েছে। এই সেক্টর নিয়ে সরকারকে আরও ভাবতে হবে। আরও বাজেটবান্ধব সেক্টরে পরিণত করতে হবে। তাহলে ইন্টেরিয়র সেক্টরের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট সবাই শান্তিতে শ্বাস নিতে পারবে। আর এগিয়ে যাবে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ।
ইন্টেরিয়র সেক্টরে ভ্যাট-কর কমানো প্রয়োজন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে অর্থনীতির এ সম্ভাবনাময় সেক্টরকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ইন্টেরিয়র সেক্টরে ভ্যাট-কর কমানোর জোর দাবি জানাচ্ছি।
প্রতিবারের মতো এবারের বাজেটেও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। যা ইন্টেরিয়র ডিজাইনের সাথে কিছুটা সম্পৃক্ত বিধায় এই সেক্টরের উন্নতি তথ্য-প্রযুক্তির উন্নতির উপর নির্ভরশীল। পাশাপাশি গত বছরের মতো এই বাজেটেও ইন্টেরিয়রের প্রায় সব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য সুপারিশ করা হলে, এই সেক্টরের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে।
ইন্টেরিয়র সেক্টরের উন্নতির জন্য ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমানো প্রয়োজন। কর কমিয়ে এ সেক্টরে উদ্যোক্তা বৃদ্ধির সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা উচিত।
এ ব্যবসার বাজারে বিনিয়োগ এখন প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা, আগামী পাঁচ বছরে এর পরিধি বর্তমান বাজারের চেয়ে দিগুণ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আগামী বাজেটে পরিকল্পিতভাবে এ খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা দরকার। সম্ভাবনাময় এই খাতে চাইলে প্রচুর পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ আনা সম্ভব। তাই এই খাতের জন্য দেশি-বিদেশি বিনিয়োগবান্ধব একটি বাজেট সকল ইন্টেরিয়র ব্যাবসায়ী প্রত্যাশা করে।
ইন্টেরিয়র ডিজাইন ও উপকরণের এ ব্যাবসা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুনভাবে ভূমিকা রাখছে, তাই এই খাতের জন্য পলিসি প্রণয়ন ও উন্নয়নের মাধ্যমে এটির পরিসর আরও বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।
ইন্টেরিয়র খাতে যতো প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, তার শতভাগ বিদেশ থেকে আমদানি করা। আর উপরকণের মধ্যে ২০ শতাংশ উপকরণ দেশে উৎপাদন হয়। বাকিগুলো চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাহজ্যসহ প্রায় ২০টি দেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে।
ইন্টেরিয়র ডিজাইন ও উপকরণ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর যে ২০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ বা বাজার রয়েছে, এর মধ্যে ১৫ হাজার কোটি টাকার উপকরণ মার্কেট। তার মধ্যে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার মার্কেট তৈরি হয়েছে ইন্টেরিয়র প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট।
উপকরনের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ উপকরণ আমদানি করতে হয়। ২০ শতাংশ উপকরণ দেশে উৎপাদন হয়। এর মধ্যে ডলার সংকটের কারণে আমদানি নীতিতে কড়াকড়ি, ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে যাওয়া, ঋণপত্র খুলতে না পারা, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি এবং বিলাসী দ্রব্যের আমদানি কমে যাওয়ার কারণে আমদানি কমে গেছে। তাই সকল আমদানি পণ্যের পাশাপাশি ইন্টেরিয়র খাতের আমদানি পণ্যের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক বেশি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ইন্টেরিয়র খাতের সকল পণ্যের আমদানি সহজলভ্য করার জন্য নীতি গ্রহণ জরুরি।
ইন্টেরিয়র ডিজাইনার প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকাসহ সারা দেশে প্রায় সেবা ও উপকরণ মিলিয়ে ১০ হাজার প্রতিষ্ঠান রয়েছে ইন্টেরিয়র ডিজাইন ও ডেকোরেশনের। এ ছাড়াও অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে এই কাজ করে থাকেন। এখন রাজধানীতে আবাসন ব্যবসায়ীরা যেসব ভবন ও অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ করছে সেগুলোর ৯০ শতাংশতেই মূল ভবনের ডিজাইনের বাইরে নতুন করে ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন করা হয়ে থাকে। ফলে এই সেক্টর দেশের অর্থনীতিতে একটি নতুন ধারা তৈরি করছে। আবাসন খাতের পাশাপাশি এটিও দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।
তবে এই খাতের বেশিরভাগ উপকরণ আমদানি করায় দেশের অর্থনীতিতে পুরোপুরি সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। এসব উপকরণের খাত গড়ে তুলতে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে এই খাতের জন্য নীতিপ্রণয়ন ও উন্নয়ন করলে এটির পরিসর আরও বাড়বে। তাই কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নগরায়ণ ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে এই বাজেটই হোক ইন্টেরিয়র সেক্টর বান্ধববাজেট এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
সিইও, রিয়েল ইন্টেরিয়র সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ইন্টেরিয়র ডিজাইন কোম্পানি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন-বিডকোয়া অনার্স ও মাস্টার্স (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) পিএইচডি গবেষক (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
মন্তব্য করুন