অবস্থা যেমনই হোক না কেন, অনেক পশ্চিমা সাংবাদিকরা শুধু ইসরায়েলের সমর্থনে কথা বলেন, তারা মুখ ফুটে কখনো এটা স্বীকার না করলেও বারবার একই কাজ করেন। যখন বর্ণবাদী একটি রাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদী নেতারা জেনিনের রিফিউজি ক্যাম্পে শিশু, নারী-পুরুষসহ ১৪ হাজার ফিলিস্তিনির আবাসস্থলে হামলা চালায় এবং নিয়ম করে তাদের হত্যা করে, পশ্চিমা গণমাধ্যম সেটা নিয়েও মিথ্যা বলে।
উপরের প্যারাগ্রাফে তিনটি শব্দ রয়েছে—যা পশ্চিমা সম্পাদকরা সংবাদ শিরোনামে ইসরায়েলের ধ্বংসাত্মক কার্যপদ্ধতি বর্ণনায় ব্যবহার করতে নিতান্ত অনিচ্ছুক। শব্দ তিনটি হলো—‘সন্ত্রাসবাদী’, ‘বর্ণবাদী’ এবং ‘হামলা’।
এ কারণে তারা মিথ্যা কথা বলার সিদ্ধান্ত নেয়। আমি ‘সন্ত্রাসবাদী’ এবং ‘বর্ণবাদী’ এই দুটি শব্দের ব্যাপারে পরে আলোচনা করছি। আগে আমাকে ‘হামলা’ শব্দটি দিয়ে আলোচনা শুরু করতে দিন।
চলতি সপ্তাহের শুরুর দিকে ২০০০ ইসরায়েলি সৈন্য সুসজ্জিত যানবাহন, ড্রোন, রকেট এবং সশস্ত্র হেলিকপ্টার নিয়ে দুদিন ধরে পশ্চিম তীরের দখলকৃত এলাকায় বসবাস করা ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালায় এবং ভীতির সঞ্চার করে।
যদিও দ্য নিউইয়র্ক টাইমস বা সিএনএনের শিরোনাম লেখকদের কাছে ব্যাপারটা মোটেও এমন ছিল না। তাদের ভাষায়, ইসরায়েল জেনিনে ‘হামলা’ চালায়নি বরং ‘অভিযান’ ‘শুরু করেছে’। ‘অভিযান’ শব্দটি কী নিরীহ এবং নির্বিবাদী, তাই না? শব্দটি অনেক কিছু বলে। প্রথমত, একটি ‘অপারেশন’ বা ‘অভিযান’ বলতে বোঝায় জনগণকে ‘অপারেট’ করা হচ্ছে এবং ‘অভিযানের’ বিষয়ে আগে থেকে সম্মতি রয়েছে। দ্বিতীয়ত, ‘অভিযান’-এর আরেকটি অর্থ হলো—কোনোকিছু ভেঙে গেলে সেটা জোড়া লাগানো। সর্বোপরি, একবার একটি ‘অভিযান’ শেষ হওয়ার অর্থ হলো আরেকটি ‘অভিযান’ সাধারণত অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়া। এগুলোর কোনোটিই জেনিনে ঘটেনি। জেনিনে শিশুসহ অন্তত ১২ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে। আরও অনেক ফিলিস্তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে আহত হয়েছে। বাসাবাড়ি তছনছ করা হয়েছে, নষ্ট করা হয়েছে বাণিজ্যকেন্দ্র। শরণার্থীদের শরণার্থী শিবির বাদ দিয়ে নতুন জায়গায় আশ্রয় খুঁজতে হয়েছে। এদিকে এ অবস্থায় ইসরায়েল যখন ইচ্ছা তখন হামলার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবু, টাইমস ও সিএনএনের শিরোনাম লেখকরা সত্য বলার সিদ্ধান্ত বাতিল ‘অভিযান’ লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
কেন?
যেমনটা জর্জ অরওয়েল্ ১৯৪৬ সালে লিখেছিলেন, ‘পরিষ্কার ভাষার প্রধান শত্রু হলো অনান্তরিকতা।’
বেশিরভাগ পশ্চিমা সাংবাদিকরা ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক কারণে যখন ইসরায়েলের বিষয়ে লিখতে যান, তখন তারা এই অনান্তরিকতা দেখান, কেননা এটাই নিরাপদ ও প্রত্যাশিত ব্যাপার। এটা তাদের অবচেতন থেকে আসে না। এটা তাদের সহজাত ও প্রকাশ্য সিদ্ধান্ত। এ কারণে ‘ভালোরা’ কখনোই ফিলিস্তিনিদের ওপর ‘হামলা’ চালায় না, তাদের ‘অপারেট’ করে। কী মিষ্টি একটা ব্যাপার!
অরওয়েল্ মনে করেন—এই ইউফেমিজম (সত্যিকার শব্দের পরিবর্তে অন্য কোনো শব্দের প্রয়োগ) প্রয়োগ করা হয় তখনই—যখন মূল সত্যকে বিমূর্তের ভেতর হারিয়ে ফেলার তাগিদ তৈরি হয়।
যে নিগূঢ় সত্য এবং বীভৎস দৃশ্য জেনিনে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা ও ভীতিকে প্রকাশ করে সেগুলো পশ্চিমা সাংবাদিকদের নিরর্থক বিমূর্ততা ও ছদ্মবেশী আচরণের কারণে সামনে আসে না। সত্য গোপন করে মিথ্যার বেসাতি গড়ে, ফিলিস্তিনিদের বিমানবিক অবস্থাকে এড়িয়ে, তারা কেবলই ইসরায়েলের আগ্রাসী মনোভাবকে লুকিয়ে রাখে।
এমন অভ্যাসের ফলাফল হিসেবে, পশ্চিমা সম্পাদকরা জেনিনে ইসরায়েলি হামলার ঐতিহাসিক প্রকৃতি এবং ইসরায়েলের ‘অভিযানের’ সম্ভাবনা নিরূপণ করেন। তারা ইসরায়েলি হামলায় নিহত বা পঙ্গু ফিলিস্থিনি নাগরিকদের নাম, বয়স ও ইতিহাস নিয়ে লেখেন না, তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের গল্পগুলো তুলে ধরেন না। এসবের ধারাবাহিকতায় পশ্চিমা সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো মুখরোচক শিরোনামকে অনুমোদন দেয়। সেগুলো অনেকটা এমন—পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের বৃহত্তম সামরিক অভিযান দ্বিতীয় দিনে প্রবেশ করল।
অভিনন্দন, ইসরায়েল! আসলেই এমন অবস্থা। জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ‘দৈনিক দানবের’ শিরোনাম লেখক লিখবেন, তথাকথিত ‘অভিযানে’ ইসরায়েলি সেনারা ফিলিস্তিনিদের ‘হত্যা’ করেনি বরং ‘অভিযোগ’ তোলা হয়েছে ফিলিস্তিনিরা মারা গেছে এবং আহত হয়েছেন।
এবার আসা যাক আরও সুচারুরূপে লেখা আরেকটি শিরোনামের দিকে : ‘শরণার্থী ক্যাম্পে ইসরায়েলি অভিযান ৯ জনের মৃত্যু ঘটিয়েছে বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনিরা।’
‘অভিযান’ এবং ‘ঘটিয়েছে’ শব্দ দুইটি শুনতে খুবই শ্রুতিমধুর—নিরপেক্ষ এবং কোনো প্রকার অশুভ ইঙ্গিতবিহীন। এগুলোর মাধ্যমে এটাই বোঝানো হচ্ছে, ইসরায়েলের সশস্ত্র সৈন্যরা কোনো ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে আসেনি। সত্যিই তো, তারা আসেনি!
‘রেইড’ বা ‘অভিযান’ শব্দটা নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি হামলার বিষয়টিকে গোপন করে। চারদিক থেকে ঘেরাও করা ক্যাম্পটি থেকে পালাবারও পথ নেই। তবুও ফিলিস্তিনিদের ‘পালিয়েই’ বাঁচতে হয়েছে।
শিরোনামটিতে ‘জানিয়েছে ফিলিস্তিনিরা’ অংশটি সংশয়বাদীতার ইশারা দিচ্ছে। আসলে কি ফিলিস্তিনিরা কোনো সুনির্দিষ্ট সংখ্যা জানাতে পারে? এই সংখ্যাটি কি বানিয়ে বলা? পুরো সংবাদের মূল অংশজুড়ে এই সন্দেহটিই প্রতিধ্বনি তুলে গেছে।
আরও পড়ুন : শিশু হত্যা : পুতিনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, ইসরায়েলের ব্যাপারে নীরব কেন?
দৈনিক দানবের সাবধানী প্রতিনিধি আরও লেখেন, ‘অভিযোগ করা হয়েছে, সেনারা বাকিদের আহত করেছে।’
একটি হামলাকে ‘হামলা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পশ্চিমা মিডিয়ায় যে ব্যাপক অনাগ্রহ তা মুহূর্তেই উবে যায়—যখন একজন ফিলিস্তিনি একটি পিকআপ ট্রাক নিয়ে তেল আবিরের একটি বাসস্টপে হামলা চালায় এবং ৯ ইসরায়েলিকে আহত করে।
টাইমের সম্পাদকীয়’র হিসেবে ২০০০ ইসরায়েলি সেনা অস্ত্রসজ্জিত যুদ্ধযান নিয়ে ডজনখানেক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করলে সেটি ‘হামলা’ নয় বরং একাকী একজন ফিলিস্তিনি যখন পথচারীদের মধ্য দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যান তখন সেটা ঠিকই ‘হামলা’ বলে বিবেচিত হয়।
এটাই বুঝলাম।
পশ্চিমা সম্পাদকদের প্রায় বৈশ্বিক হয়ে ওঠা ধারণা অনুযায়ী, ইসরায়েলের ‘অভিযানের’ ‘উদ্দেশ্য’ ফিলিস্তিনিদের ভীত সন্ত্রস্ত করে বশে আনা নয় বরং ‘ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো’র যে কোনো প্রতিরোধ মুছে ফেলা।
এটা সম্পূর্ণভাবে চেপে যাওয়া হয়, জেনিনে হামলা ইসরায়েলি সরকারের পরিকল্পনা এবং বর্ণবাদী মনোভাবের প্রতিফলন। একাধিক মানবাধিকার সংস্থা জানিয়েছে, দখলকৃত ফিলিস্তিনে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে এবং ফিলিস্তিনি ঘেটোগুলো ধ্বংসে অমানবিক তৎপরতা চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। ফিলিস্থিনের ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ডিপ্লোমেসির নির্বাহী পরিচালক ইনেস আবদেল রাজেক আলজাজিরাকে বলেন, বিগত বছরগুলোকে গাজাকে যেভাবে একঘরে করে কোণঠাসা করা হয়েছে, জেনিনের ক্ষেত্রেও একই ধরনের আচরণ করা হচ্ছে।
পশ্চিমা নিউজরুমগুলোতে ‘বর্ণবাদী’ এমন একটি শব্দ যেটা কখনো দখলকৃত পশ্চিম তীরে, গাজায় এবং জেরুজালেমে ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের পদ্ধতিগত নিপীড়নের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় না।
ইসরায়েলিরা যখন ফিলিস্তিনিদের আরেকবার ‘শিক্ষা’ দিল, কানাডার জাতীয় দৈনিক দ্য গ্লোব এবং মেইল পত্রিকা শিরোনাম করল : পশ্চিম তীরের সন্ত্রাসবাদী দুর্গ থেকে ইসরায়েল সেনা প্রত্যাহার করেছে এবং দুই দিনব্যাপী এমন অভিযান আরও সামনে ঘটতে পারে বলে জানিয়েছে। একটু অন্যভাবে বলতে গেলে এর অর্থ হলো—যদি ফিলিস্তিনিরা ‘ঠিক’ আচরণ না করে তাহলে ড্রোন ছেড়ে, হেলিকপ্টারে হামলা চালিয়ে তাদের হত্যা করা হবে। ইসরায়েলিরা ভাবে এই ফিলিস্তিনিরা বাসায় থাকে না, তারা সন্ত্রাসী দুর্গে বসবাস করেন।
যে কেউ এ বিষয়ে বিতর্ক করতে পারবে, ইসরায়েল খুব ভালোভাবে গড়ে তোলা সন্ত্রাসীদের দুর্গ। এর সংসদ ভরে আছে বর্ণবাদী মন্ত্রীদের নিয়ে যারা ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব অস্বীকার করে এবং শত শত লুটেরা ইসরায়েলি দখলদাররা ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে দেয় এবং তারা ফিলিস্তিনি জলপাই চাষিদেরও ছাড়ে না।
ইসরায়েলের ধ্বংসযজ্ঞ শেষ হওয়ার পর যখন দৃপ্ততার সঙ্গে জেনিনের ফিলিস্তিনিরা সবকিছু পুনর্গঠনে ব্যস্ত—তখনো সিএনএন তাদের চূড়ান্ত শিরোনামটি লেখার লোভ সামলাতে পারেনি। তারা লিখেছে, ‘ইসরায়েলি অভিযানে নিহত ১২ জনের জন্য ক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনিরা শোক করছে।’
আহা... ‘ক্ষুব্ধ’, এই শব্দটিই তো ফিলিস্তিনিদের নিয়ে চিরকাল ধরে ব্যবহার করা হয়ে আসছে। বেদনাবোধ, দুঃখ বা সমাধানের মতো শব্দগুলো পশ্চিমা ক্ষীণদৃষ্টির এডিটররা শুধু ইসরায়েলিদের জন্য তুলে রেখেছেন। ফিলিস্তিনিদের জন্য এই শব্দগুলো তারা কখনো ব্যবহার করেন না।
এগুলো সবই মিথ্যা।
পশ্চিমা মিডিয়ার এই অজ্ঞতা, ঔদাসীন্য এবং অহংকার সারা সপ্তাহজুড়েই দেখা গেছে। এমন অবস্থায় আরেকবার এটিই প্রমাণ হলো—ফিলিস্তিনের মুক্তি ও পরিত্রাণ শুধু ফিলিস্তিনিদের মাধ্যমেই আসবে।
মূল লেখা: অ্যান্ড্রু মিত্রোভিকা , ভাষান্তর: সরকার জারিফ।
মন্তব্য করুন