কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠানের ওপর অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগের প্রত্যক্ষ প্রচেষ্টা হলো- বয়কট। তবে অর্থনৈতিক চাপ ছাড়াও রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়াতে এবং সম্মিলিত পদক্ষেপের সূত্রপাত ঘটাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে এই বয়কট কৌশল। গাজায় ইসরায়েলি হামলা শুরুর পর থেকে বিভিন্ন দেশে ইসরায়েল বয়কট মুভমেন্টটি সামনে চলে এসেছে।
সম্প্রতি, স্টারবাকসের মধ্যপ্রাচ্যের ফ্র্যাঞ্চাইজি, আলশায়া গ্রুপ তার প্রায় ২ হাজার চাকরি ছাঁটাই ঘোষণা করেছে। এই কর্মী ছাঁটাই কোম্পানিটির মোট কর্মশক্তির ০৪ শতাংশ। ম্যাকডোনাল্ডস, অ্যামাজন, কোকা-কোলা, ডিজনিসহ ইসরায়েল বা তার সেনাবাহিনীর সমর্থক হিসাবে পরিচিত কোম্পানিগুলোকে বয়কটের ঘোষণা এসেছে বিভিন্ন কোম্পানি এবং বিভিন্ন দেশে গাজায় ইসরায়েলি হামলার বিরুদ্ধে ডাকা প্রোটেস্টগুলো থেকে।
গত ছয় মাস ধরে ফিলিস্তিনের গাজায় টানা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। গাজায় বোমা হামলার সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলিতেও ইসরায়েল বয়কটের আহ্বান জোরে শোরে বেড়েছে। X, Facebook এবং TikTok-এর মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে ইসরায়েলবিরোধী হ্যাশট্যাগগুলো জনপ্রিয় হচ্ছে। ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্ত কোম্পানি এবং সংস্থাগুলোকে বয়কট করার আহ্বান জানিয়ে ডাকা হচ্ছে বয়কট আন্দোলন।
NoThanks এবং Buycott-এর মতো মোবাইল অ্যাপগুলোও এসব ব্রান্ড শনাক্ত করতে মানুষকে সহায়তা করেছে।
বয়কট কি যথেষ্ট?
শুধু বয়কটই কি কোম্পানিগুলোকে ধ্বংস করতে এবং ইসরায়েলের নীতি পরিবর্তনের জন্য পর্যাপ্ত চাপ সৃষ্টি করতে যথেষ্ট? এমনটাই প্রশ্ন করছেন অনেকে। বয়কট নীতি কার্যকর হবে বলে যরা আশা করছেন তাদের জন্য কিছুটা হলেও সুসংবাদ রয়েছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিকা চেনোয়েথের গবেষণা অনুসারে, একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটানোর জন্য প্রয়োজন মাত্র ৩.৫% জনসংখ্যার সম্মিলিত এবং সক্রিয় অবস্থান। গবেষণা মতে, সক্রিয় কণ্ঠস্বর সংখ্যালঘুতে থাকলেও, এই কণ্ঠগুলো একটি পার্থক্য তৈরি করতে পারে।
ইতিহাসে সফল বয়কটের উদাহরণ রয়েছে অনেক। ১৭৯১ সালে ইংল্যান্ডে দাস ব্যবসায়ীদের দ্বারা উৎপাদিত চিনি বর্জন করার জন্য বয়কট আহ্বান করা হয়। মানুষ স্বতঃস্পূর্তভাবে সেই বয়কট আহ্বানে সাড়া দিলে চিনি কলগুলোর লাভ কমে যায়। ট্রান্সআটলান্টিক দাস ব্যবসার বিরুদ্ধে জনমত গঠিত হয় এবং মাত্র কয়েক দশক পরেই দাশপ্রথা বিলুপ্ত হয়।
অনুরূপভাবে, দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদবিরোধী বয়কটের সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানুষ পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর পণ্য বয়কট নীতি গ্রহণ করে। এই বয়কট পশ্চিমা সরকারগুলোর বিরুদ্ধে চাপকে আরও বাড়িয়ে তোলে যা ১৯৯৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বর্ণবাদ শাসনের অবসান ঘটাতে সাহায্য করেছিল।
বয়কট রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়াতে পারে:
বয়কট কোম্পানিগুলোর মুনাফা এবং ইসরায়েলের অর্থনীতিকে আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এটা কোম্পানিগুলোর বা ইসরায়েলের নীতি পরিবর্তনের জন্য যথেষ্ট নয়। তবে এই বয়কট অন্যদিকে রাজনৈতিক সচেতনতাও বাড়াতে পারে। অর্থনৈতিক চাপের সঙ্গে রাজনৈতিক চাপ মিলে একটি কঠিন প্রভাব তৈরি করতে যা ইসরায়েলের সরকারেও পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
বয়কট, ডিভেস্টমেন্ট এবং নিষেধাজ্ঞা (বিডিএস) এগুলো স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এবং সমতার জন্য ফিলিস্তিনি-নেতৃত্বাধীন একটি আন্দোলন। নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডগুলোকে টার্গেট করা এর লক্ষ্য নয় বরং এই ধরনের আন্দোলনের লক্ষ্য কোম্পানিগুলোকে ইসরায়েল থেকে বিচ্ছিন্ন করার দিকে ঠেলে দেওয়া। বয়কটের লক্ষ্য হল - ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে কয়েক দশকের দখলদারিত্বের অবসান ঘটাতে ইসরায়েলকে চাপ দেওয়া।
শিক্ষা খাতে চাপ:
শিক্ষা ক্ষেত্রের চাপও বড় ভূমিকা পালন করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় গত অক্টোবর থেকে ইসরায়েল বা ইসরায়েল-সংযুক্ত সংস্থাগুলির সঙ্গে কন্টাক্ট বিচ্ছিন্ন করার পক্ষে ভোট দিয়েছে এবং সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
অনেক শিক্ষাবিদদের মধ্যেও এক ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ডিসেম্বরে, ইসরায়েলের পার্লামেন্ট বা নেসেটে পাঠানো একটি ইসরায়েলি গবেষণায় সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে, পশ্চিমে ইসরায়েলি শিক্ষাবিদদেরকে এক ধরনের “বেসরকারিভাবে বয়কট”-এর মধ্যে ফেলা হয়েছে। সেই গবেষণায় ইসরায়েলের বৈজ্ঞানিক অবস্থান এবং অর্থনীতির জন্য বিপদের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
এমনকি ইসরায়েলের বর্তমান হামলার আগে, হলিউড অভিনেত্রী টেলর সুইফ্ট থেকে শুরু করে বিয়ন্স পর্যন্ত অনেক গায়ক ইজরায়েলে কাজ করতে অস্বীকার করেছিলেন। এসব ঘটছে আংশিকভাবে রাজনৈতিক চাপের কারণে। ইজরায়েলে কাজ না করার ঘোষণা দিয়েছেন আরও অনেক মার্কিন শিল্পি ও অভিনেতা।
ইসরায়েলের প্রতি পশ্চিমের সবচেয়ে বড় সমর্থন হলো অস্ত্র বিক্রি। আমেরিকার পাশাপাশি ইউরোপীয় দেশগুলোও ইসরায়েলকে অস্ত্র সাপ্লাই দিয়ে থাকে। সম্প্রতি এসব দেশে ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র বিক্রির বিষয়ে আইনি চাপ এবং প্রতিবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে। নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, বেলজিয়াম, স্পেন এবং এমনকি যুক্তরাজ্য সহ ইউরোপজুড়ে ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র বিক্রিতে আইনি চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে।
গাজার মানবিক অবস্থা আরও খারাপ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো আরও সোচ্চার হচ্ছে। তাদের আহ্বান ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে প্ররোচিত করেছে বিশ্ব নেতাদের। যদিও এটি এখনো উল্লেখযোগ্যভাবে নীতি পরিবর্তনের চেহারায় প্রকাশ পায়নি।
এটি স্পষ্ট যে, রাজনৈতিক নীতি পরিবর্তনের জন্য সম্মিলিত চাপ প্রয়োজন। আর এই চাপ প্রয়োগে ভূমিকা রাখতে পারে বয়কট। ইসরায়েল বয়কটের আহ্বানগুলো তাই অবহেলার সুযোগ নেই।
জনাথন হার্ভে: গবেষক এবং সাংবাদিক
মন্তব্য করুন