ড. কামরুল হাসান মামুন
প্রকাশ : ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৭:০৪ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
ড. কামরুল হাসান মামুন

আমরা কি আসলে বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়েছি?

ড. কামরুল হাসান মামুন। ছবি : সৌজন্য
ড. কামরুল হাসান মামুন। ছবি : সৌজন্য

আমার কন্যা আমেরিকায় পড়ছে। আবাসিক হোস্টেলে থাকছে। সেই হোস্টেলের প্রতি ফ্লোরের এক পাশে ছাত্ররা আরেক পাশে ছাত্রীরা থাকছে। আমার কন্যা অনেক রাত পর্যন্ত লাইব্রেরিতে পড়ে। রুমে আসে শুধু ঘুমাতে। ল্যাবে কাজ করে যখন তখন শুধু পুরুষ শিক্ষক থাকতে অথবা শুধু ছেলে শিক্ষার্থী থাকতে পারে অথবা উভয়ই থাকে। ওর শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন কনফারেন্স বা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা রিসার্চ ল্যাবে নিয়ে গিয়েছে এবং সেখানে হোটেলে থাকতে হয়েছে। এই গল্প শুধু আমার কন্যার ক্ষেত্রেই না। দেশ থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার ছেলেমেয়ে যাচ্ছে তাদের সবার গল্প।

অনেকেই ক্যাম্পাসের বাইরে আলাদা বাসা ভাড়া করে আলাদা রুমে মিলেমিশে থাকে। আমরা বিগব্যাং সিরিজ কিংবা ফ্রেন্ডস সিরিজেও এমন দেখি। কত আনন্দের সাথে ছেলেমেয়ে শেয়ার করে থাকে। সবার আড্ডা দেওয়ার জন্য কমন স্পেস আছে। সেখানে একসাথে হয়ে জম্পেশ আড্ডা দেয়। কোনো মারামারি নাই। কোনো রাজনীতি নাই। কেবলই লেখাপড়া অথবা নানা সামাজিক ইস্যু নিয়ে আড্ডা।

এই যে হাজার হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ে লাখ লাখ ছেলেমেয়ে মিলেমিশে থাকছে কোনো দিন তো মারামারি হয়েছে শুনিনি। কোনো দিন তো গেস্ট রুমে নিয়ে টর্চারের কথা শুনিনি। আমাকে তো আমার কন্যাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় না। বাংলাদেশের হাজার হাজার বাবা-মায়ের সন্তান এখন ইউরোপ আমেরিকায় লেখাপড়া করে। ওদের লেখাপড়া করতে পাঠিয়ে সবাই আমরা নিশ্চিন্তে থাকি। এই দেশের ক্ষমতাবানদের সন্তানদেরও সেই নিরাপদ স্থানে লেখাপড়া করায়। আর দেশের গরিব পিতামাতার সন্তানদের রাজনীতির নামে মাস্তানি, হেডমগিরি, ছিনতাই ইত্যাদি নানা অপকর্ম শেখায়।

প্রকাশ্যে এক ক্ষমতাপ্রত্যাশী দল আরেক ক্ষমতাপ্রত্যাশী দলকে বলে "তোমাদেরকে শায়েস্তা করার জন্য আমার ছাত্র...-ই যথেষ্ট। পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশের একজন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতা এমন বলতে পারে? কেউ যদি বলে তাহলে জনগণই তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ঐদিন-ই শেষ করে দিত।

বাংলাদেশের মাদ্রাসা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য মৃত্যুকূপ। সেই মৃত্যু হতে পারে শারীরিক মৃত্যু বা মেধার মৃত্যু- যার দায়ভার শিক্ষকদের ওপর বর্তায়। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আমাদের ক্যাম্পাসে যা ঘটে তা কোনো সভ্য দেশে ঘটা অকল্পনীয়। বুলিং, ইভটিজিং, গেস্ট রুম টর্চার, ঘুমানোর বিছানা না থাকা, পড়ার টেবিল না থাকা, ভালো খাবার না থাকা। এরপরও কয়জন শিক্ষককে দেখেছেন এর প্রতিবাদ করতে? কয়জন শিক্ষককে দেখেছেন শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি জানাতে? কয়জন শিক্ষক নিয়মিত নিজে লেখাপড়া করেন এবং ক্লাসে নিয়মিত পড়ান? কয়জন শিক্ষক নীতি নৈতিকতা ও চরিত্রের দিক থেকে সত্যিকারের শিক্ষক?

বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা সত্যিকারের শিক্ষক পাব কীভাবে? ১০০ বছর আগে শিক্ষক নিয়োগের যেই প্রক্রিয়া ছিল আজও সেই প্রক্রিয়া চালু আছে। ইন ফ্যাক্ট, পুরোপুরি সেই প্রক্রিয়া না। বরং সেই ১০০ বছর আগে যেই ভালো নিয়মগুলো ছিল যেমন অধ্যাপক হিসাবে প্রমোশনের সময় সকল প্রার্থীর সকল কাগজপত্র একজন বিদেশি বিখ্যাত স্কলারের কাছে পাঠানো হতো। সেটা এখন আর নাই।

তখন অরাজনৈতিক এবং জ্ঞান বিজ্ঞানে বিখ্যাত কাউকে উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হতো। সেই সময় উপাচার্যের অনেক ক্ষমতা ছিল। সেই ক্ষমতা তারা ধারণও করতে পারত এবং তা যথাযথ ডিসচার্জও করতে পারত। যেমন- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আশুতোষ মুখার্জী। তিনি ছিলেন স্বৈরাচারীর মতো। যখন যাকে যোগ্য মনে করতেন তাকেই শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দিতেন। কিন্তু কখনোই ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি। প্রতিষ্ঠানের ভালোকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন। এখন আমরা আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেই মানের শিক্ষকদের ভিসির দায়িত্ব দেই তাদের অনেকেরই শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতাই নাই let alone ভিসি। ফলে ভিসিদের ওপর সকল ক্ষমতা প্রদান প্রচণ্ড রিস্কি। যার প্রমাণ আজকের বিশ্ববিদ্যালয়।

আমি তো চারপাশে শিক্ষক দেখি না। অধিকাংশই দলান্ধ মূর্খ। অনেক পুরুষ শিক্ষকের কাছে ছাত্রী মানে একটি সেক্স অর্গান। তাদের ওপর নম্বর দেওয়ার ক্ষমতা আছে। সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে তারা যৌন নির্যাতন করে। এই পর্যন্ত যত যৌন নির্যাতন রিপোর্টেড হয়েছে তার অনেকগুন বেশি রিপোর্টেড হয়নি। অনেক ছাত্রী রিপোর্ট করতে পর্যন্ত ভয় পায়। আসলে আমাদের শিক্ষক প্রক্রিয়াটাই পচা গলা। কেবল একটি মৌখিক পরীক্ষা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ হয়। ১৫-২০ মিনিটের একটা ইন্টারভিউ-ই শিক্ষক নিয়োগের একমাত্র প্রক্রিয়া হতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশে পারে বলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে অসংখ্য অযোগ্য, দলান্ধ মূর্খ শিক্ষক শিক্ষকতা পেশায় ঢুকে পড়েছে।

সারা বিশ্বে শিক্ষক নিয়োগের নানা স্তর থাকে যার প্রতিটি স্তরেই ফিল্টারিং হয়। একাধিক স্তরের কোনো একটিতে বিভাগের সকল শিক্ষক এমনকি ছাত্রদের মতামতও নেওয়া হয়। প্রার্থীদের কাছ থেকে টিচিং ও রিসার্চ স্টেটমেন্ট চাওয়া হয়, ৩ জন গুণী স্কলারের কাছ থেকে রেকমেন্ডেশন লেটার চাওয়া হয়। প্রার্থীদের দিয়ে সেমিনার দেওয়ানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নিয়োগ একটা বিরাট ব্যাপার। আমরা এইটাকে খেও বানিয়ে ফেলেছি।

শিক্ষক নিয়োগ এখন মাফিয়া তন্ত্রের হাতে বন্দি। প্রতিটা বিভাগে মাফিয়াদের প্রতিনিধি আছে। ছাত্ররাও জানে সেই প্রতিনিধি কে। তারা তার সাথেই থিসিস করতে চায়, তার সাথেই সম্পর্ক উষ্ণ রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে, সে যাকে অপছন্দ করে ছাত্ররাও সেই শিক্ষকের ধারেকাছেও যায় না। তাহলে আমরা কি আসলে বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়েছি? সমাজের কোনো পক্ষ কি এইসব অনিয়ম নিয়ে কথা বলে? ছাত্ররা কি প্রতিবাদ করে?

একজন সত্যিকারের শিক্ষক কতজন শিক্ষার্থীর জীবন বদলে দিতে পারে আমাদের কি ধারণা আছে? তবে একজন মিথ্যাকার শিক্ষক অনেক ছাত্রের জীবন ধ্বংস করতে পারে সেই উদাহরণ বাংলাদেশে অনেক আছে। তারপরেও কেউ প্রতিবাদ করে না। বলে না যে, এইভাবে চলতে পারে না, এইভাবে চলতে দিব না। (লেখাটি ড. কামরুল হাসান মামুনের ফেসবুক পোস্ট থেকে নেওয়া)

ড. কামরুল হাসান মামুন: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাকার যেসব এলাকায় আজ মার্কেট বন্ধ

আজকের নামাজের সময়সূচি

প্রথম দিনে উইন্ডিজ তুলল ২৫০ রান

গাঁজা-জাল নোটসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের শীতবস্ত্র বিতরণ

উইন্ডিজের প্রতিরোধ ভেঙে বাংলাদেশের স্বস্তি

টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস / ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়িক অংশীদার চাই

২০২৪ সালের হাইয়েস্ট কালেকশন দরদের : শাকিব 

নায়িকা পরীমনির প্রথম স্বামী নিহত

রাজনীতিতে আ.লীগের পুনর্বাসন ঠেকাতে হবে: নুর

১০

নির্বাচন যত দ্রুত হবে, সমস্যা তত কমে আসবে : মির্জা ফখরুল

১১

খাসজমির দখল নিয়ে সংঘর্ষে দুজন নিহত

১২

মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ক্রীড়াঙ্গন অন্যতম একটি মাধ্যম : আমিনুল হক 

১৩

তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল

১৪

আহত রানার পাশে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’

১৫

ফেসবুকে দাবি ‘মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ একই ব্যক্তি’, যা বলছে ফ্যাক্ট চেক

১৬

একদিকে প্রশান্তি, অশান্তিও বিরাজ করছে: শামা ওবায়েদ

১৭

চোর সন্দেহে খুঁটিতে বেঁধে যুবককে নির্যাতন

১৮

র‍্যানকন মটরসের সঙ্গে ক্র্যাক প্লাটুন চার্জিং সলুশনের চুক্তি

১৯

জনকল্যাণে কাজ করাই বিএনপির মূল লক্ষ্য : নয়ন

২০
X