রেবেকা (ছদ্মনাম) একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেন। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখী পরিবার তার। হঠাৎ একদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অপরিচিত আইডি থেকে বন্ধুতের রিকোয়েস্ট আসে। বারবার রিকোয়েস্ট গ্রহণ করার জন্য তাকে অনুরোধ করা হয়। রেবেকা কোনো মারপ্যাঁচ না বুঝে রিকোয়েস্ট গ্রহণ করেন। রেবেকাকে ওই আইডি থেকে একটি অশ্লীল ছবি পাঠানো হয়। ছবিটি দেখে তিনি চমকে যান। ছবিটি রেবেকারই মাথা সংযুক্ত করে এডিটিং করা একটি অশ্লীল ছবি।
অপরিচিত সেই আইডি থেকে রেবেকাকে ছবি পাঠানোর পর যোগাযোগ করতে বলা হয়। রেবেকা তাকে খুদে বার্তা পাঠায়। তিনি কী চাচ্ছেন রেবেকা জানতে চাইলে বলে রেবেকার কাছে ২ লাখ টাকা দাবি করেন। দাবি পূরণ না করলে এই ছবি তিনি তার স্বামী ও পরিবার পরিজনদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন।
নিজের এই ছবি দেখার পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন রেবেকা। তিনি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। দাবি করা ২ লাখ টাকা না দিলে তার ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হবে। সেই ভয় গ্রাস করে রেবেকাকে। একদিকে নিজের সম্মানের কথা ভাবছেন অন্য দিকে অর্থের কথা চিন্তা করছেন। মানসিক দোটানায় পড়ে আত্মহত্যা কথাও ভাবেন রেবেকা। আত্মহত্যা করতে গিয়ে বারবার সন্তানের মুখ চোখের সামনে ভাসে তার।
কোনো উপায় না পেয়ে রেবেকা একসময় তার স্বামী, বাবা-মা ও ভাইয়ের কাছে ঘটনাটি শেয়ার করেন। কিন্তু পরিবারের কাছে রেবেকা সাহায্যের পরিবর্তে তিরস্কারের সম্মুখীন হন। তারা বিষয়টি অনুধাবন করতে পারেন না বরং বাজে মন্তব্য করেন। আরও বেশি মানসিক চাপে পড়েন রেবেকা। হীনমন্যতা, নিঃসঙ্গতা, লজ্জা, অপরাধবোধ, একাকিত্ব, অবিশ্বাস ও হতাশায় নিমজ্জিত রেবেকা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েন।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান বিবেচনা করে প্রথমে থানা-পুলিশ বা সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে সেবা নিতে আগ্রহী ছিলেন না রেবেকা। তবে পরবর্তীতে আইনি প্রতিকারের জন্য আবেদন করেন তিনি। রেবেকা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন এবং Police Cyber Support for Women-এ লিখিত অভিযোগ জানান। রাষ্ট্র তাকে আইনি সহায়তা দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি সুন্দরভাবে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন। Police Cyber Support for Women নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারে সবাইকে সচেতন করছে এবং সাইবার যৌন হয়রানি ঘটনায় নারীদের মানসিক শক্তি জোগান দিয়ে থাকে।
রেবেকার সঙ্গে ঘটে যাওয়া তিক্ত ঘটনার পর তার অনুভূতি- ‘সমাজে নারীরা বিপদে পড়লে কোনো পুরুষ এগিয়ে আসে না বরং তারা সন্দেহ করে, অপবাদ দেয়, অবহেলা করে। সমাজ তাকে বাজে চোখে দেখে। তাকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে। যার ফলে নারীদের বেঁচে থাকা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে এবং সমাজের চাপে কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। সমাজ সব কাজের জন্য নারীকে দোষী মনে করে।’
রেবেকা বলেন, বিপদের সময় আমি স্বামী, বাবা-মা, ভাইবোন কারো সাহায্য পাইনি। সবাই আমাকে দোষী ভেবেছে। এমটা ঘটলে মানসিক হতাশা বেড়ে যায়। নিঃসঙ্গতা, হীনমন্যতা, একাকীত্ব আমাকে গ্রাস করে। প্রতিটা মুহূর্ত নিজেকে অপরাধী মনে হতো। নারী হয়ে জন্মানোটা পাপ মনে হতো। প্রতিটা মুহূর্ত অসহ্য যন্ত্রণায় কাটত। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে এবং আমি বাজে চরিত্রের নারী এটাই ভাবা হয়েছে। দুঃসাহস নিয়ে নিজেকে প্রমাণ করার পরে পরিবারের সম্মান ফিরে পেয়েছি।
তিনি আরও বলেন, প্রতিটি নারীকে ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার শিখতে হবে। আইসিটি আইন সম্পর্কে সমাজের সব নারীকে সচেতন হতে হবে। নারীর নিজস্ব অধিকার সম্পর্কে তাকে সচেতন করতে হবে। নারীদের ভিতরে প্রতিবাদী মনোভাব তৈরি করতে হবে। সমাজের পুরুষদের চিন্তাভাবনা পরিবর্তন করতে হবে এবং সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীকে আইসিটি আইন সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে হবে।
নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আইডি বা ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে অনেক নারী তুলনামূলক কম জানেন এবং সরল বিশ্বাসের কারণে নারীরা অনলাইনে সহিংসতার সহজ লক্ষ্যে পরিণত হোন। ক্রমবর্ধমান উন্নত ডিজিটাল যুগে সাইবার যৌন হয়রানির বিষয়টি ক্রমেই উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। এটি শুধু নারীদের গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করে না বরং তাদের মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
সাইবার ক্রাইমের শিকার হলে প্রাথমিকভাবে থানায় অভিযোগ করা যেতে পারে অথবা আইনজীবীর সহায়তা নিয়ে সরাসরি সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করা যেতে পারে। পাশাপাশি নিম্নবর্ণিত যে কোনো বিষয়ে হেল্প ডেস্কের সহযোগিতা নেওয়া যাবে : সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন, কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম, ৩৬, মিন্টো রোড, রমনা, ঢাকা। হেল্পডেস্ক নম্বর : ০১৭৬৯ ৬৯১ ৫২২। ই-মেইল: [email protected], সাইবার পুলিশ সেন্টার, সিআইডি, ফোন : ০১৩২ ০১০ ১৪৮, ই-মেইল: [email protected], ফেসবুক পেইজ-পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন (পিসিএসডব্লিউ), ফোন নম্বর: ০১৩২০ ০০০ ৮৮৮, ই-মেইল: [email protected], জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ ফোন করা যেতে পারে। জোসেফ মাহতাব : সমাজকর্মী ও প্রতিষ্ঠাতা, আর্থকেয়ার ফাউন্ডেশন
মন্তব্য করুন