বাংলাদেশের অর্থনীতির তিন দিকপাল- তিনজনই আমার শিক্ষক। দু'জন আমার সরাসরি শিক্ষক এবং তৃতীয়জন আমাকে শ্রেণিকক্ষে না পড়ালেও শিক্ষক তিনি আমার সর্ব অর্থেই। প্রথম দু'জনের একজন হচ্ছেন প্রয়াত অধ্যাপক মুশাররফ হোসেন, অন্যজন অধ্যাপক আনিসুর রহমান এবং তৃতীয়জন অধ্যাপক রেহমান সোবহান। গতকাল ছিল অধ্যাপক রেহমান সোবহানের ৮৯তম জন্মবার্ষিকী।
গত তিন দশকে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বিভিন্ন সময়ে নানা উপলক্ষ্যে নিউইয়র্ক এসেছেন এবং এলেই তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। আমি তখন নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচিতে কর্মরত। নিউইয়র্কে এসেই অধ্যাপক রেহমান সোবহান ফোনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন এবং তারপর সময় ঠিকঠাক করে তিনি আসতেন আমার দপ্তরে। তবে সে আসা হতো প্রায় ঝড়ের বেগে।
নানা কাজের ব্যাপারেই তিনি আসতেন আমার দাপ্তরিক কক্ষে। আমি যখন জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের প্রধান কিংবা মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের পরিচালক ও মুখ্য প্রণেতা, তখন নানা সময়ে নানা বিষয়ে তিনি আমি যৌথভাবে কাজ করেছি নানা কর্মসূচিতে।
কখনো কখনো বিভিন্ন আলোচনায় তাঁর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে আমার দপ্তর দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ কিংবা আমার মানব উন্নয়ন দপ্তর একসঙ্গে কাজ করেছে কোনো প্রকাশনা উপস্থাপনে। মনে আছে একবার দিল্লিতে এমন এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন অধ্যাপক অমর্ত্য সেন, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, ড. মন্টেক সিং আহলুওয়ালা, মুচকুন্দ দু'বের মতো দিকপালেরা।
আমার দপ্তরে এসেই দু'কথার পরেই তিনি কাজের কথায় চলে যেতেন। যেহেতু যৌথ কাজ, আমার নানা সহকর্মীরাও এসব আলোচনায় যোগ দিতেন। তাঁর চিন্তার স্বচ্ছতা, খুঁটিনাটির প্রতি মনোযোগ আমার সহকর্মীদের মুগ্ধ করত। কখনো কখনো বৈঠক ভাঙতে বিলম্ব হলে উদ্বিগ্ন হয়ে অধ্যাপক রওনক জাহান ফোন করতেন। বড় মিষ্টি লাগল তাঁর উদ্বিগ্নতার মাধুর্য্য।
অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সঙ্গে মূলত কাজের কথা হলেও পারিবারিক অনেক আলাপ করতাম আমরা। তিনি সবসময়েই বেনুর কথা বলতেন- প্রায়ই স্মরণ করতেন, তাঁর বিভিন্ন কাজে তিনি বেনুর এম. এস. সি অভিসন্দর্ভের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করেছেন। আমাদের কন্যাদের হাল-হকিকত জানতে চাইতেন। বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে আমাদের কণিষ্ঠা কন্যার করা অভিসন্দর্ভ যখন পুস্তকাকারে বেরুল, তার একটি অনিন্দ্যসুন্দর ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান। স্যারের জ্যেষ্ঠ পুত্র বাবর সোবহান একসময়ে আমার সহকর্মী ছিলেন। তার খবরও দিতেন তিনি আমাকে।
অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সঙ্গে রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে নানা কথা হতো। আমার সঙ্গে দেশজ রাজনীতির নানা বিষয়ে গল্পে মাততেন তিনি। আমি প্রবাসে থাকি বলে আমার দৃষ্টিভঙ্গিটি তিনি বিশেষভাবে জানতে চাইতেন। রাজনীতির নানা বিষয়ে তাঁর ভবিষ্যৎবাণী তিনি জানাতেন আমাকে। ভাবতে অবাক লাগে বহুক্ষেত্রে তাঁর কথাগুলো ঠিক প্রমাণিত হয়েছে। মাঝে মাঝে গল্প হতো ষাটের দিকের সাপ্তাহিক Forum পত্রিকা বিষয়ে। তাঁর সম্পাদনায় এ পত্রিকাটি তদানীন্তন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্য তুলে ধরা এবং আমাদের গণআন্দোলনে একটি বিরাট ভূমিকা রেখেছিল।
ছাব্বিশ বছর বাদে জাতিসংঘের কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করেছি ছ'বছর হলো। পাঁচ বছর হলো নিউইয়র্ক ছেড়েছি। মাঝে-মধ্যেই তাঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয় বটে, তবে প্রায়ই যোগাযোগ নেই অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সঙ্গে। তবু কোনো কোনো অবসর মুহূর্তে নিউইয়র্কে তাঁর সঙ্গে হিরন্ময় স্মৃতির মায়াময় সুরভিটুকু আমি বড় মমতার সঙ্গে উপভোগ করি। আজ অধ্যাপক রেহমান সোবহানের জন্মদিবসে সে হিরন্ময় স্মৃতির মায়াময় সুরভিটুকু তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ হিসেবে হিসেবে দিলাম।
ড. সেলিম জাহান: ইউএনডিপি'র মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয় ও দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের সাবেক পরিচালক
মন্তব্য করুন