আধুনিক স্থাপত্যঃ প্রেক্ষাপট:
অন্যান্য শিল্পকর্মের তুলনায় একটি স্থাপত্যকর্মের আয়ু সাধারণত দীর্ঘতর, তাই অন্যান্য শিল্প মাধ্যমের তুলনায় স্থাপত্যে পরিবর্তন আসে অনেক ধীরগতিতে। এই প্রেক্ষিতে বিচার করলে আধুনিক স্থাপত্যের উদ্ভব এবং বিশ্বজুড়ে দ্রুত বিস্তার স্থাপত্যের ইতিহাসে একটি চমকপ্রদ ঘটনা, কারণ উত্তর আমেরিকা এবং পশ্চিম ইউরোপে ঊনবিংশ শতকের শেষ প্রান্তে এসে মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে এই নতুন স্থাপত্যশৈলী কয়েক সহস্রাব্দের স্থাপত্য সংস্কৃতিকে বদলে দেয়।
উত্তর আমেরিকা এবং পশ্চিম ইউরোপে ঊনবিংশ শতকে শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে ঘটে দ্রুত নগরায়ণ, ইট-পাথরের বিকল্প শিল্পজাত নির্মাণ উপকরণ স্টিল, কংক্রিট, কাচ সুলভ ও সহজলভ্য হয়ে যায়, বহুতল ভবন, কলকারখানা, রেলস্টেশন ইত্যাদি নতুন ধরনের ভবন নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়, সেই সাথে পুরোনো রীতিনীতির অন্ধ অনুসরণ করাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনস্কতা এবং আধুনিকতা, সেই সাথে গড়ে ওঠে নব্য ধনিক এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণি। বিংশ শতকের শুরুতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নৈরাজ্য কাটিয়ে উঠে বিজ্ঞানসম্মত ভাবনা এবং প্রযুক্তির সমন্বয়ে নতুন পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখে মুক্তিকামী মানুষ। আধুনিক স্থাপত্যের জন্ম এই জটিল যুগ সন্ধিক্ষণে।
প্রায় তিন সহস্রাব্দ ধরে স্থাপত্যের মূল উপকরণ ছিল দৃঢ়, অনড়, নিরেট ইট পাথরের দেয়ালে গড়া কাঠামো। শিল্পবিপ্লব এনে দেয় লোহা, কাচ আর কংক্রিট, যা দিয়ে গড়া গেল উন্মুক্ত, নির্ভার ভবন। তবে শুধু নতুন উপকরণ এবং প্রযুক্তির কারণেই যে বাহ্য অবয়বগত বিশাল পরিবর্তন এসেছিল তা নয়। আধুনিক স্থাপত্য রীতির সাথে সনাতন স্থাপত্যের পার্থক্য বাহ্য অবয়ব বা ফর্মেঃ নিরালঙ্কার, নিরাভরণ বিশুদ্ধ জ্যামিতিক আকার নিয়ে আধুনিক স্থাপত্যের বিন্যাস।
আধুনিক স্থাপত্যের আবশ্যিক লক্ষণ হলো ব্যবহার উপযোগিতা বা ফাংশনালিটি অনুযায়ী বাহ্য অবয়ব বা ফর্ম নির্বাচন করার স্বাধীনতা। আধুনিক স্থাপত্যের মূলমন্ত্র 'ফর্ম ফলজ ফাংশন'। এই স্থাপত্য রীতির মূলে ছিল মার্কিন স্থপতি ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইটের (১৮৬৭-১৯৫৫) পরিসর বা স্পেস নিয়ে নতুন ভাবনাঃ বিংশ শতকের গোড়ায় শিকাগোতে তার প্রেইরি বাড়িগুলোতে আয়তকার ঘরের সীমানা ভেঙে দিয়ে তিনি উন্মুক্ত খোলামেলা পরিসরের বাধাহীন প্রবাহকে প্রাধান্য দিলেন। উত্তর আমেরিকা আর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রগতিশীল স্থপতিরা সেই সময় সন্ধান করছিলেন আধুনিক যুগের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি স্থাপত্যশৈলীর। এই সন্ধান বেগবান হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সমকালীন বিমূর্ত শিল্প থেকে উৎসারিত স্থাপত্য, ডিজাইন, চারু এবং কারুশিল্পের একটি সমন্বিত শিল্প আন্দোলনের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে। রুশ শিল্পী কান্দিন্সকি ১৯১৩ সালে লিখলেন রং, রেখা, স্পেস তথা চিত্রকলার বিমূর্ত উপাদানগুলোকে নিয়ে সম্পূর্ণ বিমূর্ত একটি চিত্রভাষার ইস্তেহার।
আধুনিক স্থাপত্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী স্থপতি ফ্রান্সের লে করবুসিয়ে (১৮৮৯-১৯৬৫) প্যারিসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে পিকাসো এবং ব্রাকের কিউবিজমের অনুপ্রেরণায় গড়ে তোলেন পিউরিজম নামের একটি শিল্প আন্দোলন। আর একই সময়ে হল্যান্ডের পিয়েট মন্দ্রিয়ান, ভ্যান দের লাক এবং তাদের বন্ধুরা কেবল আনুভূমিক এবং উল্লম্ব সরল রেখা, আয়তকার ক্ষেত্র এবং মৌলিক রং দিয়ে নিও প্লাস্তিসিজম নামে একটি শিল্প আন্দোলন গড়লেন। এই আন্দোলনগুলোর মাধ্যমে বাহ্য অবয়ব বা ফর্ম নিয়ে আধুনিক সমাজের উপযোগী একটি নতুন নন্দনতত্ত্ব জন্ম নেয়।
ব্যবহার-উপযোগিতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে, নিরাভরণ আয়তকার কিংবা অন্য বিশুদ্ধ জ্যামিতিক আকার, লোহা, কাচ আর কংক্রিটের শৈল্পিক ব্যবহার, স্থাপত্যের ঐতিহাসিক ধারার সাথে দৃশ্যমান স্বাতন্ত্র্য, নির্মাণ উপকরণ এবং জলবায়ুবান্ধব হওয়া ছিল এই নতুন স্থাপত্যের মূল লক্ষণ। এই ধারাকে ইন্টারন্যাশনাল স্টাইল বা আন্তর্জাতিক শৈলী বলে স্থাপত্য ইতিহাসবিদ এবং শিল্পবোদ্ধারা অভিহিত করলেন ১৯৩২ সালে, আর এরপর এই ধারা লাভ করে বিশ্বব্যাপী প্রসার মাত্র দুই দশকে, বিশেষতঃ যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপ এবং ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তি পাওয়া নতুন স্বাধীন দেশগুলোতে।
পূর্ব পাকিস্তানে আধুনিক স্থাপত্য:
ব্রিটিশ ভারতে পূর্ব বাংলা আর আসামের সরকারি ভবনগুলো নির্মাণ করত সি অ্যান্ড বি নামের সরকারি প্রতিষ্ঠান, যা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর নাম বদলে হয় পিডব্লিউডি বা পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট, বর্তমানের গণপূর্ত বিভাগের পূর্বসূরি। পূর্ব পাকিস্তানের এই বিভাগে কোনো স্থপতি না থাকায় যুক্তরাজ্য থেকে আসেন স্থপতি আর সি ম্যাককনেল। তার ডিজাইনে নির্মিত হয় আজিমপুরে সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসন, হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল, তোপখানা রোডের সচিবালয় ভবন। আন্তর্জাতিক শৈলীতে নির্মিত এই ভবনগুলোর মধ্যে মানসম্মত আধুনিক স্থাপত্যের লক্ষণ অনুপস্থিত। ১৯৫২ সালে স্থপতি মাজহারুল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্থাপত্য অধ্যয়ন শেষে সি অ্যান্ড বিতে স্থপতি হিসেবে যোগদান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি চারুকলা অনুষদ এবং গণগ্রন্থাগারের নকশা প্রণয়ন করেন। গণগ্রন্থাগার ভবনটিতে পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার স্থানান্তরিত হয়।
স্থপতি মাজহারুল ইসলামের এই দুটি প্রকল্প বাংলাদেশের প্রথম শিল্পমানসম্পন্ন আধুনিক স্থাপত্যকর্ম। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের স্বপ্নের ফসল চারুকলা অনুষদের নির্মাণ- ভূমি ছিল বৃক্ষ ও জলাধার সমৃদ্ধ, যেন সংলগ্ন রমনা উদ্যানের একটি অংশ। তরুণ স্থপতি মাজহারুল ইসলাম এই নির্মাণ ভূমির নৈসর্গিক চরিত্র অক্ষুণ্ণ রেখে বাংলাদেশের জলবায়ু আর আবহমান কালের স্থাপত্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ খোলামেলা একটি ভবন নির্মাণ করলেন, মিলেমিশে গেল উদ্যান, উন্মুক্ত উঠান, বারান্দা, জলাধার, সম্মুখ অংশের হাওয়াখানা আর পেছনের দেয়ালে ঘেরা শ্রেণিকক্ষগুলোর সারি। এই স্থাপত্য ভাষা, নির্মাণ উপকরণ, কাঠামো শৈলী সবই আধুনিক, স্থপতি এই আধুনিকতাকে প্রবলভাবে প্রয়োগ করলেন দীর্ঘকালের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে একটি নতুন স্বাধীন দেশের শিল্প-সংস্কৃতির প্রকাশ-মাধ্যম হিসেবে।
১৯৫৮ সালে জারিকৃত আইয়ুব খানের সামরিক শাসন বদলে দেয় পাকিস্তানের রাজনীতির খোল-নলচে। বৈদেশিক সাহায্য এবং ঋণনির্ভর এই আর্থ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শুরু হয় অবকাঠামো নির্মাণের কর্মযজ্ঞ। এর ফলে প্রতিষ্ঠিত হয় বহু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, কলকারখানা ইত্যাদি। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৬২ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের প্রথম স্থাপত্য বিভাগ যাত্রা আরম্ভ করে।
প্রথমদিকের শিক্ষকগণ এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। একই সময়ে প্রকল্প সূত্রে আসেন আরও অনেক কৃতি বিদেশি স্থপতি। ষাটের দশকে স্থপতি মাজহারুল ইসলাম এবং এই সময়ে আসা শিক্ষক এবং প্রকল্প সূত্রে আসা পেশাজীবী স্থপতিরা এ দেশের জলবায়ু, প্রকৃতি, নির্মাণ উপকরণ এবং সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি পূর্ণাঙ্গ স্থাপত্যরীতি সন্ধান করছিলেন। এই সন্ধানের প্রকাশ পাওয়া যায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে রিচারড ভ্রূমানের স্থাপত্য অনুষদ ভবন, বব বুইর কমলাপুর রেলস্টেশন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে শেরেবাংলা, তিতুমীর এবং সোহরাওয়ার্দী ছাত্রাবাস, মোহাম্মদপুরে সেন্ট জোসেফ স্কুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কন্সতান্তিন দক্সিয়াদিসের টিএসসি এবং কুমিল্লা বার্ড, ময়মনসিংহে পল রুডলফের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মাজহারুল ইসলামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিপা ভবন, (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন, বর্তমানের কমার্স ফ্যাকাল্টি), মতিঝিলের কৃষি ভবন, রংপুর, সিলেট, বগুড়া, বরিশাল এবং পাবনার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট (স্থপতি স্তানলি টাইগারমানের সাথে) ঢাকার বিজ্ঞান গবেষণাগার, চট্টগ্রাম এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নকশা এবং সার্বিক পরিকল্পনায়। ষাটের দশকে স্থানীয় এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের সাথে সংবেদনশীল এই আধুনিক স্থাপত্যের বুনিয়াদ ছিল দৃঢ় এবং আন্তর্জাতিক রীতির অন্ধ অনুসরণ থেকে অনেকটাই স্বাধীন।
এই দশকে শুরু হয় জাতীয় সংসদ ভবন নির্মাণের কাজ, বিশ্ববরেণ্য স্থপতি লুই কান ঢাকায় গড়লেন তার সবচেয়ে বৃহৎ প্রকল্প, যা দিয়ে তিনি আধুনিক স্থাপত্যের সাথে প্রাচীন স্থাপত্যের ইতিহাসকে সংযুক্ত করলেন। বিংশ শতকের সেরা বিশটি স্থাপনার একটি হিসেবে স্বীকৃত এই ভবনটির কারণে বিশ্ব স্থাপত্যের মানচিত্রে ঢাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
১৯৫৮ সালে প্রথমবারের মতো নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকা মহানগরকে নগর পরিকল্পনার আওতায় আনা হয়। ২০ বছর মেয়াদি এই পরিকল্পনা অনেকটাই ব্যর্থ হয় অতি দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং যথাযথ তত্ত্বাবধানের অভাবে। এই পরিকল্পনার আওতায় গড়ে ওঠে ঢাকার মূল যাতায়াত অবকাঠামো, নগর বিন্যাসে কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ভূমি পরিকল্পনা করা হয়। পরবর্তীকালে এই ধরনের পরিকল্পনা প্রণয়নের পদ্ধতি অন্যান্য শহরে গ্রহণ করে, যার ফল মিশ্র।
আধুনিক স্থাপত্য স্বাধীন বাংলাদেশে:
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের অগ্রাধিকার ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন। এই সময়ের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যেও সংসদ ভবন এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধের নির্মাণকাজ চলতে থাকে। স্থপতি মাজহারুল ইসলামের জয়পুরহাট চুনাপাথর আবাসিক এলাকা, আগারগাঁও এর জাতীয় গ্রন্থাগার ভবন এবং স্থপতি রবিউল হুসাইনের ফার্মগেটে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ ভবন এ সময়ের উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য কর্ম। সেই চারুকলা অনুষদের নির্ভার, উন্মুক্ত, প্রায় স্বচ্ছ ভবনগুলোর স্থলে স্থপতি মাজহারুল ইসলামের পরের দিকের নকশায় আসে নিরেট ইটের দেয়ালের প্রবল উপস্থিতি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ ভবনে স্থপতি কংক্রিট এবং ইটের সমন্বয়ে একটি ছায়াঘেরা হাওয়া-খানার আবহ তৈরি করেছিলেন। সাভারে স্থপতি মাইনুল হুসাইনের জাতীয় স্মৃতিসৌধ কংক্রিট, ইট, জলাধার আর সবুজের একটি অনন্য বিন্যাস। একাধারে দুর্নিবার গতি এবং সৌম্যতার অনন্য অভিব্যক্তি ধারণ করে এই সৌধ।
আশির দশক থেকে ব্যক্তি মালিকানাধীন খাত বেড়ে ওঠে ধীরে ধীরে। ডেভেলপারদের তৈরি বহুতল আবাসন, বাণিজ্যিক ভবন, তৈরি পোশাকের কলকারখানা এবং বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণ স্থাপত্যশিল্পে গতি সঞ্চার করে। স্থপতি বশিরুল হকের ইন্দিরা রোডের নিজস্ব বাসভবন, কালিন্দী এপার্টমেন্ট এবং পরবর্তীতে ধানসিঁড়ি এপার্টমেন্ট ভবনগুলোতে বাংলাদেশের জলবায়ুবান্ধব এবং দেশজ উপকরণ ইটের নিরীক্ষা লক্ষণীয়। শেষোক্ত প্রকল্প দুটিতে সফলভাবে তিনি ঘনবসতিপূর্ণ বহুতল আবাসিক ভবনে উঠানের ব্যবহার করেন। স্থপতি উত্তম সাহা দক্ষতার সাথে ঢাকার পরিবাগে প্রিয় প্রাঙ্গণ বহুতল আবাসিক প্রকল্পের অধিবাসীদের জন্য একটি উন্মুক্ত পরিসর ব্যবহার করলেন, কংক্রিটের তৈরি এই অত্যন্ত সমকালীন স্থাপত্যকর্মের অধিবাসীদের জীবনযাপনে সংযুক্ত করলেন একটি নগর চত্বর।
আশির দশকে বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের গ্রামীণ আবহে সংযুক্ত করলেন কার্যালয়, আবাসিক এবং অনাবাসিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র। এই ধরনের ভবনগুলোতে সাইফুল হক, জালাল আহমেদ, নাহাস খলিল, উত্তম সাহা, খাদেম আলি প্রমুখ স্থপতিরা আবহমান বাংলার গ্রামীণ পরিসর সংস্কৃতির আধুনিক রূপ দিলেন। জালাল আহমেদ এবং সাইফুল হকের যশোরের 'বাঁচতে শেখা', বগুড়ায় ব্র্যাক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এই ধারার কাজের সফল উদাহরণ। স্থপতি রাজিউল আহসানের ঢাকায় অবস্থিত হারমান মাইনর স্কুলেও অনুরূপ পরিসর পরিকল্পনার ছাপ মিলে।
আশির দশকের শুরুর দিকে প্রবল প্রতাপশালী আধুনিক স্থাপত্যকে উত্তর আধুনিক ঘরানার স্থপতিরা প্রশ্নবিদ্ধ করলেন। আধুনিকতার অন্যতম ভিত্তি ছিল প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানমনস্কতা প্রয়োগ করে আদর্শ সমাজ গড়ার স্বপ্ন, উত্তর আধুনিকরা এই স্বপ্নকে অলীক আখ্যা দিলেন। ইতিহাসের সাথে আধুনিকতার বিরোধ অবসান করার জন্য তাই ঐতিহাসিক স্থাপত্যের উপাদানগুলোর যথেচ্ছ ব্যবহার শুরু হলো, ব্যবহার উপযোগিতা নয়, প্রাধান্য দেওয়া হলো ভবনের শুধু দর্শন গ্রাহ্যতাকে বা visual দিকগুলোকে। এর ঢেউ এসে পড়ে বাংলাদেশেও। আশির দশক থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত বহু স্থাপনায় ইউরোপীয় প্রাচীন স্থাপত্যের আদলে আবাসিক বাড়ি, ভবন, গ্রিক বা রোমান থাম, খিলান এবং অন্যান্য আলঙ্কারিক উপাদানের ব্যবহার লক্ষণীয়।
একবিংশ শতকের প্রথম থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতির দ্রুত বৃদ্ধি স্থাপত্যশিল্পকে আরও সুসংহত করে। বেসরকারি খাতের বিপুল বৃদ্ধির ফলে বাণিজ্যিক ভবনগুলোর স্থাপত্যে আসে ইতিবাচক পরিবর্তন। স্থপতি মুস্তাফা খালিদ পলাশ এবং স্থপতি ফয়েজউল্লার নকশা করা ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার গ্রামীণফোন ভবন এবং স্থপতি পাট্রিক ডি রোজারিও এবং সেলিম আলতাফ বিপ্লবের ঢাকার উত্তরায় আড়ং ভবনের উৎকর্ষ এই পরিবর্তনের সাক্ষ্য দেয়। গ্রামীণফোন ভবনের প্রশস্ত সম্মুখ চত্বর, গোলাকার জলাধার মিশে যায় ভবনের অভ্যন্তরের পরিসরের সাথে; একই সাথে স্থপতিরা ভবনটির বিদ্যুৎ এবং পানির সাশ্রয় করেছেন বিভিন্ন টেকসই প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে।
ফার্মগেটে অবস্থিত স্থপতি ইশতিয়াক জহির, ইকবাল হাবিব এবং নাইয়ারা ইসলামের কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট চলতি দশকের একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। স্থাপনার একটি প্রসারিত খোলা বারান্দা এই ভবনের সম্মুখের উন্মুক্ত চত্বরের পরিসরকে সংযুক্ত করে ভেতরের উঠানের সাথে। সমকালীন বেইলি রোডে মহিলা সমিতির ভবনে স্থপতি এহসান খান নির্মাণ করেছেন নগরের নাট্যপ্রেমিকদের জন্য প্রবেশমুখে একটি বিশাল নগর বারান্দা। আগারগাঁওতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ভবনে স্থপতি তানজিম হাসান সেলিম এবং নাহীদ ফারযানা নিরাভরণ কংক্রিট দিয়ে খোলা বারান্দা, উন্মুক্ত চত্বর আর বন্ধ প্রদর্শন কক্ষকে উল্লম্ব এবং আনুভূমিক বহুস্তরে বিন্যস্ত করেছেন।
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের স্থাপত্যে সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রভাব লক্ষণীয়। অতি ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা নগরীর উন্মুক্ত পরিসর (যেমন ভিত্তি স্থপতি বৃন্দের নকশায় ধানমন্ডি লেক সংস্কার এবং হাতিরঝিল প্রকল্প) এবং উদ্যানগুলোর সংস্কারে স্থপতিদের অগ্রণী ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। আরেকটি হলো দেশের সুবিধা বঞ্চিত শ্রেণির জন্য বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর প্রকল্প। গ্রামীণ ব্যাঙ্কের নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য আবাসন প্রকল্প এ ধরনের একটি উদ্যোগ, যা ১৯৮৪ সালের আগা খান পুরস্কার লাভ করে। ঝিনাইদহ শহরে স্থপতি খন্দকার হাসিবুল কবিরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সমবায়ভিত্তিক আবাসন প্রকল্প এ ধরনের একটি উদ্যোগ, যার লক্ষ্য সমবায় তহবিলের মাধ্যমে সাশ্রয়ী আবাসিক গৃহ নির্মাণ। স্থপতি জালাল আহমেদ সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য গাইবান্ধা জেলায় যমুনা নদীর প্রত্যন্ত চর অঞ্চলে টেকসই এবং ঘাতসহিষ্ণু বসতির ভাবনা থেকে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন।
অস্ট্রিয়ার স্থপতি আনা হেরিঙ্গার দিনাজপুরে বাঁশ আর মাটি দিয়ে গড়লেন মেটি স্কুল, আবহমান বাংলার নির্মাণ উপকরণ পেল এক নতুন রূপ। মাটির দেয়াল নিয়ে সাভারে স্থপতি নাহাস খলিলের পারিবারিক অবকাশে একটি চমৎকার নিরীক্ষাধর্মী স্থাপত্য কর্ম করলেন। স্থপতি জালাল আহমেদ মাওনায় নির্মাণ করলেন সুবর্ণদিঘী নামে পিটানো মাটির দেয়াল দিয়ে একটি অবকাশ।
আশির দশকে উত্তর আধুনিক স্থাপত্যের দৌরাত্ম্য প্রতিরোধ করেন কিছু স্থপতি এবং বরেণ্য স্থাপত্য ঐতিহাসিক। আধুনিকতার বিজ্ঞান মনস্কতা, ব্যবহার উপযোগিতার অগ্রাধিকার সামনে রেখে নির্মাণ-ভূমির স্থানীয় লোকাচার, সংস্কৃতি, নির্মাণ উপকরণ এবং নির্মাণকৌশলকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা তারা বললেন। এর সাথে তারা আধুনিক স্থাপত্যের অতিসরলীকৃত রূপ আন্তর্জাতিক শৈলীর বিরোধিতা করলেন, কারণ এই ধারার অযাচিত প্রয়োগের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রসার ঘটেছে স্থান-কাল-পাত্র অস্বীকার করে এমন স্থাপত্যের, যে কারণে বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের সব শহর প্রায় একই রকম, বৈচিত্র্যহীন। এই ভাবনাগুলো জন্ম দেয় ক্রিটিকাল রিজিওনালিজম নামের একটি বিকল্প ধারার। বাংলাদেশের বরেণ্য স্থপতি রফিক আজম, কাশেফ চৌধুরী, মেরিনা তাবাসসুম, সাইফুল হক প্রমুখ এই ধারায় স্থাপত্য চর্চা করে সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছেন।
ঢাকার ধানমণ্ডিতে মেঘনা রেসিডেন্সে এবং গুলশানে এস এ রেসিডেন্সে স্থপতি রফিক আজম ঘনবসতিপূর্ণ শহরে ক্রান্তীয় অঞ্চলের প্রকৃতিকে কংক্রিট আর ইটের ভবনের সাথে মিলিয়ে দেন অনায়াসে। স্থপতি কাশেফ গাইবান্ধার বন্যাপ্রবণ গ্রামীণ নির্মাণ-ভূমিতে বেসরকারি সংস্থা ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারের জন্য নকশা করলেন একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র যেখানে সমকালীন স্থাপত্যের নিরালঙ্কার ভাষায় নিরাভরণ ইটের চত্বর, উঠান, বারান্দা ঘর, সব একাকার হয়ে যায় অনেকটা গ্রামীণ বসতের আদলে। ঢাকার উত্তরা সংলগ্ন ফায়দাবাদ এলাকায় মিনার কিংবা গম্বুজ না দিয়ে স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম সুলতানি আমলের নিরেট ইটের দেয়ালের তৈরি মসজিদগুলো থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে বাইতুর রউফ মসজিদে নির্মাণ করলেন একটি ছায়া সুশীতল অথচ আলোকোজ্জ্বল পরিসর, যা নিষ্করুণ নগরে দেয় স্বস্তির সন্ধান। ঢাকার অদূরে বরষায় প্লাবিত হয় এমন নির্মাণ ভূমিতে বাঁশের একটি কাঠামো দিয়ে আরকেডিয়া নামের একটি বিদ্যালয়ের ভবন, যা বর্ষায় কিংবা বন্যায় ভেসে থাকতে পারে; এভাবেই জলবায়ু পরিবর্তনের শতাব্দীতে ঘাতসহিষ্ণু এবং টেকসই ভবনের সন্ধান করলেন স্থপতি সাইফুল হক। শেষোক্ত স্থাপত্যকর্ম তিনটি লাভ করেছে আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার। এই পুরস্কার বাংলাদেশের স্থাপত্যকে এনে দিয়েছে বিশ্বে অনন্য সম্মান।
বাংলাদেশ অনেক বাধা অতিক্রম করে আজ সুদিনের প্রত্যাশী। পদ্মা মেঘনা যমুনার পাললিক এই ভূখণ্ডের আধুনিক স্থাপত্যের উৎকর্ষ আজ বিশ্বে সমাদৃত। স্থপতিরা পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই স্থাপনার প্রতি মনোনিবেশ করছেন, সমকালীন স্থাপত্যের উপকরণ এবং নির্মাণকৌশলের উন্নতি লক্ষণীয়। দেশের এই বিশাল অগ্রযাত্রায় পিছিয়ে আছে নগর পরিকল্পনা, স্থাপত্য তাই নান্দনিক জনবান্ধব নগরবসতি সৃজনে অনেকটা অসফল। জলবায়ু পরিবর্তনের যুগে এই অতি ঘনবসতিপূর্ণ কৃষিনির্ভর দেশে কার্যকর এবং সৃজনশীল অঞ্চল ও নগর পরিকল্পনার সাথে সমন্বিত স্থাপত্য দিতে পারে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশিদের উন্নত জীবনযাত্রার সন্ধান।
স্থপতি সুজাউল ইসলাম খান: সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন