মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১
ড. মইনুল ইসলাম
প্রকাশ : ১০ মার্চ ২০২৪, ০১:৩৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
ড. মইনুল ইসলামের নিবন্ধ

ব্যয়বহুল প্রকল্প, সরকারের ঋণের স্ফীতি ও পুঁজি পাচার

ড. মইনুল ইসলাম। ছবি : সৌজন্য
ড. মইনুল ইসলাম। ছবি : সৌজন্য

বর্তমান সরকার বাংলাদেশে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত যে মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত করেছে কিংবা বাস্তবায়ন করছে তার অন্যতম: পদ্মা বহুমুখী সেতু, ঢাকা মেট্রোরেল, ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ি ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প, পায়রা বন্দর, পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, বাঁশখালী বিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকা বিআরটি প্রকল্প, ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালসড়ক, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেইনের মহাসড়ক, মিরসরাই-ফেনীতে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী, কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙা-পায়রা-যশোর রেলপথ, যমুনা রেলসেতু, পতেঙ্গা নিউমুরিং টার্মিনাল, আখাউড়া-লাকসাম ডবল লাইন রেলপথ এবং চট্টগ্রাম-দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ। এই মেগা প্রকল্পগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যে অভূতপূর্ব গতিসঞ্চার করেছে তা অস্বীকার করা যাবে না। এগুলো ছাড়াও সারা দেশের গ্রাম ও শহরগুলোতে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে গত পনেরো বছরে প্রশংসনীয় সাফল্য অর্জন হয়েছে।

২০২৩ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা ‘দি ডেইলি স্টার’ জানিয়েছে, বৈদেশিক ঋণের সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ ২০২২-২৩ অর্থবছরের ২.৭৬ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে ৪.৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের এহেন উচ্চপ্রবৃদ্ধি ২০২৯ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। আরো দুঃখজনক হলো, এসব ঋণের অর্থে চলমান প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন যখন সম্পন্ন হবে তখন প্রকল্পগুলোর আয় থেকে ঋণের কিস্তির অতি সামান্য অংশই পরিশোধ করা সম্ভব হবে।

বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ কিংবা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে এখনো ‘সফট লোন’ পাওয়া গেলে আমরা নিতে আগ্রহী হই, কিন্তু আমাদের বৈদেশিক ঋণের সিংহভাগই এখন ‘সাপ্লায়ার’স ক্রেডিট’। সাপ্লায়ার’স ক্রেডিটের অসুবিধে হলো জোগানদাতারা প্রকল্পের প্ল্যান্ট, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ঋণ হিসেবে দেওয়ার সময় প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাজার দামের চাইতে অনেক বেশি দাম ধরে ঋণের পরিমাণকে বাড়িয়ে দেয়। উপরন্তু, সাপ্লায়ার’স ক্রেডিটের সুদের হারও সফট লোনের সুদের হারের চাইতে বেশি, ঋণ পরিশোধের সময়সীমাও কম থাকে। আরও গুরুতর হলো, সাপ্লায়ার’স ক্রেডিটে রাজনীতিবিদ, ঠিকাদার ব্যবসায়ী ও আমলাদের ‘মার্জিনের হার’ অনেক বেশি হয়ে থাকে। সে জন্য বাংলাদেশের মেগা-প্রজেক্টগুলোর ব্যয় বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক হয়ে যাচ্ছে। ২০০৯ সাল থেকে সাপ্লায়ার’স ক্রেডিটের প্রতি অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়েছে বাংলাদেশ।

চীনা সাপ্লায়ার’স ক্রেডিটে যেসব মেগা-প্রকল্প এদেশে বাস্তবায়িত হয়েছে বা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে সেগুলো হলো- পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-যশোর-পায়রা রেলপথ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প এবং ঢাকা-গাজীপুর বিআরটি প্রকল্প। জাপানের জাইকার সাপ্লায়ার’স ক্রেডিটে অর্থায়িত যেসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে বা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে সেগুলো হলো- ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ি কয়লাচালিত বিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল, যমুনা রেলসেতু এবং চট্টগ্রাম আউটার রিং রোড।

বাংলাদেশের নিকৃষ্টতম ‘সাপ্লায়ার’স ক্রেডিট প্রকল্প’ ১২ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণে নির্মীয়মাণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। দুই ইউনিটের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের প্রাক্কলিত ব্যয় হবে ১৩৫০ কোটি ডলার। এর দুটো ইউনিট থেকে নাকি ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। প্রাক্কলিত নির্মাণ ব্যয় ১৩৫০ কোটি ডলারের মধ্যে ১২০০ কোটি ডলার ঋণ দেবে রাশিয়া। রাশিয়ার ঋণের সুদের হার হবে ৪ শতাংশ, যা ১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ২৮ বছরে বাংলাদেশকে সুদাসলে পরিশোধ করতে হবে। অনেকেরই জানা নেই যে মাত্র ৬ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণে ভারতের তামিলনাড়ুর কুদান কুলামে ২০০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপিত হয়েছে কয়েক বছর আগে। অথচ, আমাদের ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ প্লান্টের জন্য ১২ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণ নিতে হচ্ছে কেন?

আমার সাবধান বাণীকে আমলে না নেওয়ায় এখন আমাদের অর্থনীতি যে চরম টালমাটাল অবস্থায় পৌঁছে গেছে তা সামাল দিতে পারছে না সরকার। গত ১২ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে আইএমএফ এর ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির প্রায় ৬৯ কোটি ডলার পাওয়ায় এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ৪০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ায় রিজার্ভ কয়েকদিনের জন্য ২১ বিলিয়ন ডলারের ওপরে উন্নীত হয়েছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে রিজার্ভ আবার ২০.১৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে গেছে। কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের পতনকে থামাতে চেষ্টা করেও এখনো সফল হতে পারেনি। ইতোমধ্যে দেশের আমদানি নিয়ন্ত্রণের নানাবিধ ব্যবস্থা গৃহীত হওয়ায় ২০২২ সালের আগস্ট মাস থেকে সতের মাসে এলসি খোলা ১৬ শতাংশ কমে এসেছে, কিন্তু হুন্ডি ব্যবস্থায় রেমিট্যান্স প্রেরণকে কোনোমতেই নিরুৎসাহিত করা যাচ্ছে না।

হুন্ডি ব্যবসার রমরমা অবস্থা দিনদিন বাড়তে থাকার প্রধান কারণ আন্তঃব্যাংক লেনদেনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ডলারের দামের সাথে হুন্ডি মার্কেটের ডলারের দামের পার্থক্য ৭-৮ টাকায় স্থির থাকা। এই পার্থক্য বজায় থাকলে ডলারের দামের ক্রম-বাজারিকরণের সিদ্ধান্ত তেমন সুফল দেবে না, হুন্ডি ব্যবসা চাঙাই থেকে যাবে শক্তিশালী চাহিদার কারণে। ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে সরকারের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি) এর বরাত দিয়ে দেশের পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল যে শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এর সাথে আমদানির ওভারইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডারইনভয়েসিং এবং রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনার মতো মূল সমস্যাগুলো যোগ করলে দেখা যাবে প্রত্যেক বছর এখন কমপক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে। এর মানে, বাংলাদেশ থেকে বছরে কমপক্ষে ১৫/১৬ বিলিয়ন ডলার পুঁজি এখন বিদেশে পাচার হয়ে চলেছে (অথবা ডলার দেশে আসছে না), যার অর্ধেকের মতো পাচার হচ্ছে হুন্ডি প্রক্রিয়ার বেলাগাম বিস্তারের মাধ্যমে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্স গত ২০২০-২১ অর্থবছরের ২৪.৭৪ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১.৬১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যার প্রধান কারণ হুন্ডি প্রক্রিয়ায় রেমিট্যান্স প্রেরণ আবার চাঙা হওয়া।

সরকারকে দুর্নীতি, পুঁজি-লুণ্ঠন এবং পুঁজিপাচারের বিরুদ্ধে অবিলম্বে কঠোর দমননীতি গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে অবিলম্বে কঠোরভাবে হুন্ডি ব্যবস্থাকে দমন। কারণ, হুন্ডি পদ্ধতিতে বিদেশে থেকে যাওয়া ডলার বা অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রা কেনার ক্ষেত্রে চাহিদার প্রধান অংশটাই আসছে দুর্নীতিবাজ আমলা ও রাজনীতিবিদ এবং ব্যাংকঋণ লুটেরাদের পক্ষ থেকে। কঠোরভাবে দুর্নীতি দমন না করলে পুঁজিপাচার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।

ড. মইনুল ইসলাম: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি; একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ক্রীড়াবিদ শওকত আলীর স্মরণে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল

শাহরিয়ার কবির আটক

সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

রাসূল (স.) আদর্শ ধারণ করে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে

ঝিনাইদহে নাশকতা মামলায় ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী সুজনের গ্রেপ্তারের খবরে বিএনপির আনন্দ মিছিল

মানিকগঞ্জে ধলেশ্বরী নদী থেকে অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার

ভূমি উপদেষ্টার পরিদর্শন, হয়রানি ছাড়া নামজারি খতিয়ান পেয়ে উৎফুল্ল নাজিম  

চট্টগ্রামে জশনে জুলুশে মানুষের ঢল  

বন্যা পরবর্তী প্রাণী চিকিৎসায় বাকৃবি শিক্ষার্থীরা

১০

‘দুনিয়া ও আখিরাতে মুক্তির জন্য রাসুল (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করতে হবে’

১১

নার্সের ভুলে ৩ দিনের শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ

১২

‘স্মরণকালের সবচেয়ে বড় গণসমাবেশ’ করার প্রস্তুতি বিএনপির

১৩

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালিত

১৪

রাত ১টার মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের আভাস

১৫

সিরাজগঞ্জে কবরস্থানে মিলল অস্ত্র ও গুলি

১৬

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে জামায়াতের নায়েবে আমিরের মতবিনিময়

১৭

২৮ থেকে ৪২তম বিসিএসের বঞ্চিত সেই ক্যাডাররা ফের বঞ্চনার শিকার

১৮

তিন বিভাগে ভারি বৃষ্টির আভাস

১৯

আমার কষ্ট নেই, আজ আমরা স্বৈরাচারমুক্ত : আহত তানভীরের পিতা

২০
X