মাহমুদ রেজা চৌধুরী
প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০২৪, ০৪:৩১ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

এরন বুশনেল : অন্যায়ের প্রতিবাদে ইতিহাসের নতুন যোগ

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

এরন বুশনেল (১৯৯৯-২০২৪) ইতিহাসের বিকৃতি, ইতিহাসের সূচনা: দুইটাই ঘটছে পৃথিবীতে এখনো প্রতিদিনই। নির্ভর করে ইতিহাস রচয়িতার কাজ ও বর্ণনায়। এরন বুশনেল, আমেরিকার সেনাবাহিনীতে একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। সাম্প্রতিক ইসরায়েল বনাম প্যালেস্টাইন বা ইজরায়েল ও হামাস যুদ্ধে গাজাতে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে হত্যার প্রতিবাদে আমেরিকার সমর্থন। এর প্রতিবাদ করতে গিয়েই নিজের "গায়ে আগুন দিয়ে" আত্মাহুতি দেন উল্লেখিত তরুণ মার্কিন সৈনিক। গেল ২৬ ফেব্রুয়ারি, রাত আনুমানিক প্রায় সাড়ে ১০টার দিকে তাঁর দেহের নানা আহত ক্ষত নিয়ে বুশনেল শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন হাসপাতালে।

এই তরুণ সৈনিকের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস রাজ্যে, ১৯৯৮ সালে। এক খ্রিষ্টান ধর্মীয় পরিবারে বুশনেল জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের লেকলেন্ড এয়ারফোর্স বেইজ টেক্সাস রাজ্যের সান অ্যান্তনিওতে। এটা সাউথ টেক্সাসে। ১৯২০ সালে বুশনেল আমেরিকার নিয়মিত সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তার কর্মদক্ষতাও অল্প সময়ের মধ্যেই অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ছোটবেলা থেকে ধর্মীয় একটা প্রভাব ও আধিপত্য ছিল তার ওপর। কিন্তু ২০১৯ সালে বুশনেল গির্জার সাথে তার সংশ্লিষ্টতা ছেড়ে দেন। বুশনেলের বন্ধুদের কাছ থেকে শোনা যা নিউইয়র্ক টাইমস এবং অন্যান্য পত্রিকায় ছাপাও হয় যে, বুশনেল অনেকটাই পৃথিবীতে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যবাদ এবং তাদের অন্যায় আচরণের ব্যাপারেও সচেতন এবং প্রতিবাদী ছিলেন।

ঘটনার দিন, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ এরন বুশনেল, ওয়াশিংটন ডিসিতে ইসরায়েল অ্যাম্বাসির সামনে দাহ্য তরল পদার্থ নিয়ে প্রতিবাদ করতে আসেন। উপস্থিত সিকিউরিটির লোকজন তার কাছে এসে জানতে চান তারা কোনো সাহায্য করতে পারে কিনা তাকে। তখনই সৈনিক এরন ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’ বলে চিৎকার করে তার হাতে রাখা বোতলের সেই তরল পদার্থে আগুন ধরিয়ে দেন। তাৎক্ষণিক তার সারা দেহেও আগুন লেগে যায়। দৌড়ে এসে সবাই তাকে রক্ষা করতে চাইলেও এরন বুশনেলের শেষ রক্ষা হয়নি।

সারা পৃথিবীতেই যুক্তরাষ্ট্রের অমানবিক নানা কাজের প্রতিবাদে এই দেশের অনেক নাগরিক আত্মাহুতি দেন ও দিয়েছেন। যাদের অনেককেই আমরা চিনি না বা তাদের কথা শুনি না। মার্কিন মিডিয়াতে সেসব প্রচার হয় খুবই কম। ২০২৩ সালে ডিসেম্বর মাসে এক মহিলা আটলান্টাতে এভাবেই নিজ গায়ে আগুন দিয়ে আত্মাহুতি দেন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যায়ের প্রতিবাদে। বুশনেলের বন্ধুদের কাছ থেকেই জানা যায়, জর্জ ফ্লয়েড কৃষ্ণাঙ্গ এক ব্যক্তিকে শ্বেতাঙ্গ কয়েকজন পুলিশ যখন হাঁটু দিয়ে গলা চেপে মেরে ফেলে ২৫ মে, ২০২০ সালে। ঐ ঘটনাও যুক্তরাষ্ট্রের সৈনিক এরন বুশনেলকে ব্যথিত ও প্রতিবাদী করে তার সরকারের বিরুদ্ধে। বুশনেলের বন্ধুরা এই কথাও জানায় বুশনেলের মৃত্যুর পরে এখানকার সংবাদমাধ্যমকে।

এ ঘটনা মুদ্রার এক পিঠ। অন্য পিঠে দেখতে পাই- খুব ছোট্ট করে লিখছি। যুক্তরাষ্ট্রের এক ধরনের অন্ধ সমর্থন সব সময়ই আছে ইসরায়েলের প্রতি। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক দুই প্রধান দল বা দুই দলই বলা যায়। ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান। উভয় দলই ইসরায়েলের ব্যাপারে একক সমর্থনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকদের মতামত তোয়াক্কাও করে না। যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়াও অনেকটাই তেমন ভূমিকা পালন করে।

আমরা এখন ধর্ম বিষয়ে অনেকেই যে যাই বলি না, প্রকারান্তরে দেখা যায় পৃথিবীতে এখন একটাই ধর্মভিত্তিক লড়াই চলছে। ইসলাম বনাম বাকি বিশ্ব। ইসরায়েল প্যালেস্টাইন বা হামাস প্যালেস্টাইনের দ্বন্দ্ব একদিকে মূলত ধর্মকেন্দ্রিক। ইসরায়েল একটা ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র। ইহুদি ধর্মকে রক্ষা করা এবং তার সম্প্রসারণ ইসরায়েল রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান কাজ। অপরদিকে প্যালেস্টাইনের অধিবাসীরা অধিকাংশরাই ইসলাম ধর্ম অনুসারী। তারাও প্রকারান্তরে চাচ্ছেন ইহুদি এবং মুসলমান একসাথে না থেকে যে কেউ একজন এককভাবে যদি টিকে থাকতে পারে এই অঞ্চলে! দ্বন্দ্বতা সেখান থেকেও প্রকট হচ্ছে।

এটা বলাই বাহুল্য যে, বর্তমান পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী নীতি, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, আদর্শ। এইসব ক্ষেত্রেই ধর্ম ও বর্ণবিদ্বেষের রাজনীতি উচ্ছৃঙ্খলতা এবং নানারকম অন্যায়কে নেয় করে নেবার সংস্কৃতি ছড়াচ্ছে। তাই যে কোনো যুদ্ধ এবং সংঘাতের বাইরের একটা চিত্র আমরা দেখি কিন্তু সেটা পুরো চিত্রের বর্ণনা না। ইসরায়েল ও মার্কিন সম্পর্ক তাদের শাসন ক্ষেত্রে নিজ নিজ রাজনীতির যে বিভক্তি সংস্কৃতির চিত্র তুলে ধরে; সেটাকে না গণতন্ত্রের না গণমানুষের পক্ষের রাজনীতি বলে বলা যায়।

এসব বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য আমাদের পড়াশোনার জায়গাটাকে আরেকটু বিস্তৃত করা দরকার। সেজন্য এই প্যালেস্টাইন ও প্যালেস্টাইনের জনগণের মুক্তি আন্দোলনের ব্যাপারে আমরা এই বিষয়ে একজন অন্যতম লেখক এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ, তাঁর রচনা থেকেও অনেক কিছু জানতে পারি।

প্যালেস্টাইনের জনগণের মুক্তি আন্দোলনের সাথে এডওয়ার্ড সাঈদের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ট ছিল। তিনি দীর্ঘদিন ফিলিস্তিন ন্যাশনাল কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন। ইয়াসির আরাফাতের সাথে তার মত পথের পার্থক্য বিশেষ করে কয়েক দফায় ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আরাফাতের ক্ষতিকর আলোচনা এবং চুক্তির কারণে তাদের উভয়ের সম্পর্কের অবনতিও ঘটে। তাই আজকে ইসরায়েল বনাম প্যালেস্টাইন বা গাজাতে যুদ্ধে যে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ মৃত্যুবরণ করছে তার জন্য কেবল যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েলকে এককভাবে দায়ী করা যায় কিনা! এই ব্যাপারে মুসলিম ও আরব বিশ্বের নেতৃত্বকেও দায়ী করা দরকার। এ বিষয়ে আরব বিশ্বের একতা খুবই দুর্বল। এটাকেও অস্বীকার করা যায় কি!

তবু মজার ব্যাপার, মুসলিম বিশ্বের জাতিগোষ্ঠীর একের প্রতি অন্যের‌ একতা ও ঐক্যবোধ নাই। যা দেখি অমুসলিম জাতির অনেকের মধ্যে আমাদের ব্যাপারে। তারা ইতিহাস বিকৃতির পরিবর্তে তাদের জীবন উৎসর্গ করে সেই নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেন। এই ব্যাপারে দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি এরন বুশনেল তাঁর মৃত্যুর আগে যে শেষ কথা লিখে গেছেন তা উল্লেখ করে।

"My name is Aaron Bushnell. I am an active duty member of the US Airforce and I will no longer be Complicit in genocide. I am about to engage in an extreme act of protest, but compared to what people in Palestine have been experiencing at the hand of their colonizers. It is not extreme at all. This is what our ruling class has decided will be normal. Free Palestine".

আমরা যদি পারতাম মুসলিম বিশ্বে আমাদের ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র শ্রেণি ও রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে সম্মিলিতভাবে সবরকম অন্যায়ের প্রতিবাদে অগ্রসর হয়ে আসতে। যেখানে ধর্ম বা বর্ণ না বরং মানবতা এবং প্রত্যেকের বাঁচার সমান অধিকার সুনিশ্চিত এবং অগ্রাধিকার থাকবে। তাহলে বিশ্বে ইসরায়েল বনাম প্যালেস্টাইন সমস্যার সমাধান, দ্রুত সম্ভব হতে পারে যার আর কোনো বিকল্প আছে কিনা জানা নেই।‌ আপাতত এটা নাই বলে কখনোই এটা হবে না তা তো বলা যায় না। বরং নাই, সেটা কেন নাই! এটা নিয়েই আমরা অগ্রসর হতে পারি ও কাজ করতে পারি, ঐক্যবদ্ধভাবে। অন্যায়ের প্রতিবাদে Aaron Bushnell ইতিহাসের নতুন যোগ। আমাদের কোনো বর্ণনায় একে যেন বিকৃত না করি।

মাহমুদ রেজা চৌধুরী: সমাজ ও রাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

১০০ টাকার রিচার্জে কর ৫৬ টাকা ৩০ পয়সা!

২০২৬ বিশ্বকাপের পর ফ্রান্সের দায়িত্ব ছাড়বেন দেশম

মোংলায় হরিণের মাংসসহ আটক ৬

সাঁওতাল নারীকে মারধরের ঘটনায় ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার

কাতারে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ 

ব্যারিস্টার আরমানের স্ত্রীকে হেনস্তা করিয়েছিলেন টিউলিপ

ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনে ডিএমপির ২২৪৩ মামলা 

গোপনে বাগদান সম্পন্ন করেছেন টম-জেন্ডায়া!

দাবি আদায়ে খোলা মাঠ বেছে নেওয়ার আহ্বান ডিএমপি কমিশনারের

অবৈধপথে ভারতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা, ৮ বাংলাদেশি আটক

১০

পালিয়ে থাকা অপরাধীদের বিরুদ্ধে ভারতের নয়া উদ্যোগ

১১

গাছ চুরির মামলায় যুবদলের ৪ কর্মী কারাগারে

১২

শহীদ আবু সাঈদের নামে বিএসএমএমইউর কনভেনশন সেন্টার

১৩

মেসি-সুয়ারেজের সঙ্গে পুনর্মিলনের ইঙ্গিত দিলেন নেইমার

১৪

ছোট ভাইকে হত্যার ঘটনায় বড় ভাই গ্রেপ্তার

১৫

চিলমারী-রৌমারী নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ

১৬

নতুন টেস্ট কাঠামোর গুঞ্জন নিয়ে মুমিনুলের হতাশা 

১৭

কানাডা দখলে সরব ট্রাম্প, অটল ট্রুডো

১৮

সচিবালয়ের সামনে পুলিশ-শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায় ৩ সদস্যের কমিটি

১৯

পঞ্চগড়ে ২৫ লাখ টাকা মূল্যের কষ্টিপাথর উদ্ধার

২০
X