প্রাইম মিনিস্টারস ফেলোশিপ দিয়ে সরকারি কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীদের বিদেশে মাস্টার্স ও পিএইচডি করতে পাঠায়। দরখাস্ত করতে পাড়ার ন্যূনতম যোগ্যতার শর্ত হিসেবে থাকে ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে ১০০-এর মধ্যে বা ২০০-এর মধ্যে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ যোগ্যতায় ভর্তি অফার থাকতে হবে। এই ফেলোশিপের মাধ্যমে সরকার ফেলোদের পুরো টিউশন ফি দেয়। তার ওপর জীবনযাত্রার জন্য মাসে ২৫০০ ডলার বা প্রায় ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ফেলোশিপ হিসেবে দেওয়া হয়।
তা ছাড়া বছরে একবার আরও কিছু সুবিধা যেমন ভ্রমণ ভাতা, শিক্ষা উপকরণ ক্রয়ভাতা, বীমা ভাতা ইত্যাদিও দেওয়া হয়। এই ফেলোশিপের আওতায় গত বছর ৪৮ জনকে ফেলোশিপ দেওয়া হয়েছিল। এই রকম ২০১৮ সাল থেকে এই ফেলোশিপ দেওয়া হচ্ছে।
সত্যিকারের যোগ্যরা জিআরই ও টোয়েফলে ভালো স্কোর করলে অন্তত পিএইচডির জন্য পুরো টিউশন ফি মওকুফ পায়। পিএইচডি কেউ নিজ টাকায় করতে আমি আজ পর্যন্ত শুনিনি। দেশের টাকায় বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি দিয়ে পিএইচডি করতেও জীবনেও শুনিনি।
পিএইচডি একটি গবেষণালব্ধ ডিগ্রি। এইটা যেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে করা হয় সেই বিশ্ববিদ্যালয় ও সেই দেশের লাভ। শিক্ষার্থীরা একটি ভালো জিআরই স্কোর এবং টোয়েফল স্কোর করতে পারলেই অন্তত টিউশন ফি মওকুফ পাবে।
তারপরেও সরকার ইচ্ছে করলে বিদেশের খ্যাতিমান কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এমওইউ করতে পারে যার মাধ্যমে আলোচনা করে ক্ষেত্রবিশেষে টিউশন ফি সম্পূর্ণ কিংবা আংশিক মওকুফের ব্যবস্থা করতে পারত। আমি যখন ইংল্যান্ডে ছিলাম তখন দেখেছি পাকিস্তান সরকার ইংল্যান্ডের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এই রকম এমওইউ করে অনেক অর্থ সাশ্রয় করেছে।
তার চেয়ে ভালো হতো এত টাকা বিদেশে না ঢেলে দেশে একটি উন্নতমানের ইনস্টিটিউট করে সেখানে বিশ্বমানের বেতন দিয়ে বিশ্বমানের শিক্ষক ও গবেষক নিয়োগ দিয়ে দেশেই শক্তিশালী পিএইচডি ও মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালু করা। কেন একেকজনের পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিদেশে গবেষণা করিয়ে ডিগ্রি করাতে হবে? এই রকম চলতে থাকলে দেশে তো কখনো উন্নত গবেষণার পরিবেশ তৈরি হবে না। আমাদের উচিত বিশ্বমানের একটা ইনস্টিটিউট করে সেখানে আন্তর্জাতিক মানের একটি গেস্ট হাউস করে দেশি ও বিদেশি যারা বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানের গবেষক তাদের ৩ মাসের জন্য এনে ইনস্টিটিউটের রেসিডেন্ট সায়েন্টিস্টদের সঙ্গে গবেষণা করে পিএইচডি সুপারভাইস করা। আমরা পিএইচডি ফেলোদের ফেলোশিপ দেই ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। তা না দিয়ে দেওয়া উচিত ন্যূনতম ৬০ হাজার টাকা। রেসিডেন্ট সায়েন্টিস্টদের বিশ্বমানের বেতন দিলে আমাদের দেশের অনেক বড় বড় স্কলার দেশে ফিরে আসবে। আমাদের দরকার ব্রেইন গেইন। পিএইচডি প্রোগ্রামকে শক্তিশালী করতে পিএইচডি কমিটিতে বিদেশি খ্যাতিমান স্কলারদের এক্সপার্ট হিসেবে রাখা এবং পিএইচডির জন্য ন্যূনতম শর্ত দেওয়া উচিত অন্তত ২টি আর্টিকেল ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর ওয়ালা Q১ জার্নালে প্রকাশ করতে হবে। তাহলে দেশেই বিশ্বমানের পিএইচডি সম্ভব। শুনছি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও নাকি পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়ার পারমিশন দেওয়া হচ্ছে। দিতে কোনো আপত্তি থাকার কথা না বা উচিত না। শুধু এই শর্ত জুড়ে দিলেই মান স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডিগ্রির মান ভালো থাকবে।
আমরা কি কখনো নিজের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের উন্নয়নে নজর দেব না? আমরা কি কখনো নিজের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশ্বমানের পিএইচডি তথা গবেষণার পরিবেশ তৈরিতে মনোযোগ দেব না? পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে সেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিংয়ে একটা সম্পর্ক আছে। আমেরিকা সুপার পাওয়ার হয়েছে কারণ বিশ্বসেরা অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সেখানে আছে। ইংল্যান্ড দ্বিতীয় সেরা কারণ এখনো তাদের কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড, ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন আর ইম্পেরিয়াল কলেজের মতো প্রতিষ্ঠান আছে। সিঙ্গাপুর এত উন্নত কারণ ছোট্ট এই দেশটিতেও দুটি বিশ্বমানের বিশ্ব মানের বিশ্ববিদ্যালয় আছে।
চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিংয়ে উন্নতির সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্পর্ক আছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও মানের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও মানের একটা সম্পর্ক আছে। র্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান নিচে নামছে, এর অর্থ বাংলাদেশের আসলে সত্যিকারের টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে না যার স্বাক্ষর আমাদের মানুষের মানে, পরিবেশের মানে, রাস্তাঘাটের মানে স্পষ্ট। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিংয়ের উন্নয়ন হচ্ছে না বলেই আমাদের উন্নয়ন সত্যিকারের উন্নয়ন নয়। সত্যিকারের উন্নয়নের ইনডেক্স হলো সেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয় তথা গবেষণার উন্নয়ন হচ্ছে কি না নির্ভর করে তার ওপর।
ড. কামরুল হাসান মামুন: অধ্যাপক, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন