সেই ১৯৭১ইং সাল থেকে কালের পরিক্রমায় এখন আমরা ২০২৪ইং সালে পা রেখেছি। এ সূত্র ধরে ইতিমধ্যে গুণে গুণে ৫৩টি বছর চলে গিয়েছে। কিন্তু এখনও ভুলিনি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ। কেননা এই ভাষণ কেবল সেই সময়কালের উপযোগী নয়। এর অর্ন্তনিহিত ভ্যালুস ধ্রুপদী তথা ক্লাসিক্যাল বিধায় যুগযুগান্তরের জন্য স্মরণীয়, বরণীয় ও যুগপৎ নির্দেশণার কাজ করবে বলে আমার বিশ্বাস। যাহোক, এ যাবতকালে কার ভাষণ এবং কোন ভাষণটি সর্বশ্রেষ্ঠ, তা নিয়ে মতভেদ আছে এবং যুক্তিতর্কের শেষ নেই। কেননা একেক জন একেক আঙ্গিকে মনের মাধুরী দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করে থাকে। এটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করলে তো চলে না। শ্রেষ্ঠতার আরশীতে একটিকে তো মর্যাদা দিতেই হবে? আর তাই সেটা নিয়েই এই নিবন্ধ লিখা হয়েছে।
এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, বাংলার জনপদে মাঝে-মধ্যে একটি বচন কানে ভেসে আসে, তা হলো, “কাহারো একটি কথার ওজন শুধু একতোলা, আবার কাহারো হাজার মণে ভরা”। বস্তুত কথাটি তাত্বিক নয়, পুরোপুরি সত্য ও প্রায়োগিক। তাছাড়া এটি ধ্রুপদীর আওতাভুক্ত। কেননা সৃষ্টির প্রথম থেকেই এ বিষয়টি সমান তালে এবং একই মর্যাদা ও গুরুত্ব নিয়ে চলে আসছে। আসলে সঠিকভাবে কথা বলা বা উপস্থাপন করা একটি বিশেষ কলা (Art)। কেননা কারও কথা বন্দুকের গুলির মতো কাজ করে। আবার কারও কথায় কোন কিছু তো হয়ই না বরং নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। যাহোক, এর সমর্থক বা প্রতিশব্দ হলো- উক্তি, বাক্য, বচন, বিবৃতি, বক্তৃতা, ভাষণ, ইত্যাদি। এ প্রেক্ষাপটে প্রতিপাদ্য বিষয়টি ভাষণরূপে অধিকতর প্রযোজ্য।
উল্লেখ্য, যুগ যুগ ধরে নেতা বা বক্তারা অনেক ভাষণ দিয়েছেন, দিচ্ছেন এবং আগামীতেও দিবেন। কিন্তু এর মধ্যে কতগুলো ভাষণ জনমনে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। অবশ্য আমি এক্ষেত্রে আরাফাত ময়দানে দশম হিজরী সালের জিলহজ্ব মাসের ৯ তারিখে (শুক্রবার) জাবালে রহমত পাহাড়ের পাদদেশে সোয়া লক্ষ সাহাবীদের উপস্থিতিতে আমাদের প্রিয় নবী করীম (সঃ) কর্তৃক প্রদত্ত ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ক্ষনে ক্ষনে মোট প্রায় ৩০ মিনিটের বিদায় হজ্বের ভাষণের প্রসঙ্গ টেনে আনছি না। কেননা This is superior most & by far the religious speech for human kind over the horizon, সেহেতু এর মধ্যে সঙ্গতকারণেই অর্ন্তভুক্ত করা হয়নি। যাহোক, এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ প্রতিপাদ্য বিষয় হলেও এটাকে অধিকতর প্রস্ফুটিত ও তুলনামূলকভাবে বিকশিতকল্পে সম্যক ধারণার জন্যে এই বিশ্বের অন্যান্য আরও ৬টি শ্রেষ্ঠ ভাষণের উপর আলোকপাত বিধেয় বলে মনে করি। তাই এ গুলোর ওপর কিছুটা হলেও নিম্নে তুলে ধরা হলো।
আসলে এ বিশ্বে লিডার বা নেতা বা রাষ্ট্রের ধারক ও বাহকরা সদা নিয়ত বিভিন্ন আঙ্গিকে ও দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষণ দিয়ে থাকেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে অবস্থা বা যুগের দাবীর সূত্র ধরে কতিপয় ভাষণ অধিভাষনে রূপান্তরপূর্বক অবিস্মরণীয় হয়ে উঠে। কেননা মানুষের যখন আশা-আকাঙ্খা, মৌলিক অধিকার, আর্থিক, রাজনৈতিক ও বাক স্বাধীনতা এবং ধ্যান-ধারণা বা অভিব্যক্তি পূরণ না হয় এবং মূল্যবোধের বিচ্যুতি ঘটতে থাকে; তখনই তা সমাধান বা সুরাহাকল্পে ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব কর্তৃক প্রদত্ত শিক্ষণীয় বা অনুসরণীয় উদ্ধৃতি ও নির্দেশনামূলক বক্তব্যের গঠনমূলক ভূমিকা জনমনের আরশীতে চিরস্মরণীয় ও আদর্শ (ঘড়ৎস Norm) হয়ে উঠে।
এদিকে স্মরণকাল থেকে ধর্ম অবতারসহ অনেক মহামানবের উপদেশ বা অনুদেশ বা নির্দেশণা বা নৈতিকতা ও সমাজ সংস্কারমূলক ভাষণ যুগান্তকারী হয়ে গনমনে জায়গা করে প্রবাহমান এবং এর আবর্তে হযরত নবী করীম (সঃ), হযরত মুসা (আঃ), হযরত ঈসা (আঃ), অজুর্নের প্রতি কৃষ্ণ, বুদ্ধ, এবং সক্রেটিস, এরিস্ট্রেটল, প্লেটো, লেনিন, মাওসেতু; প্রমুখ যথাক্রমে ধর্ম অবতার বা বরেণ্য ব্যক্তিত্ব বা মহামানবের বিষয়টি সঙ্গতকারণেই এখানে টেনে আনছি না। কেবল অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে এ পর্যন্ত যতগুলো ভাষণ সারা বিশ্বের মানুষের হৃদয়ে আসন গেড়ে বসে আছে। সেই সাতটি শ্রেষ্ঠ ভাষণ শুধু নিম্নোক্ত সারণীতে কালানুসারে তুলে ধরেছি। সত্যিকারার্থে এ সকল ভাষণ অবস্থা ও যুগসন্ধিক্ষণে দেশ এবং জাতির ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের সহায়ক হিসেবে গঠনমূলক ক্রিয়া-প্রক্রিয়া করে থাকে। তবে এক্ষেত্রে ভাষণ দানকারী ব্যক্তিত্বের নিজস্বতা ও সৃজনশীল শক্তির আদলে ব্যতিক্রমধর্মী বৈশিষ্ট্য খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।
মূলত সেই ভাষণ জাগরণ সৃষ্টি করে, যা যুগের দাবীর আবর্তে সৃষ্টি হয়। আর যিনি সেই ভাষণটি দিয়ে থাকেন তাঁর ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্ব, উদারতা, সততা, নিষ্ঠা এবং ত্যাগের মহিমায় শতগুণে এটি মহিমান্বিত হয়ে থাকে। এখানে অনেক ক্ষেত্রে ভাবাবেগ বিদ্যমান থাকে, তখন ভাষা বা ব্যাকরণের ধার ধারে না। মেসেজটা পৌঁছানোই কেবল বড় কথা। তাছাড়া আরও কিছু কথা থেকে যায়, তাহলো যুগান্তরকারী ভাষণ হঠাৎ করে হয় না। নেতা বা ব্যক্তি বিশেষের দীর্ঘকালীন ত্যাগ-তিতিক্ষার বহির্প্রকাশ হিসেবে যুগের দাবী ও সাধারণ জনগোষ্ঠির বাঁচা-মরার দশর্ন তথায় বিদ্যমান থাকে। এ প্রেক্ষাপটে দীর্ঘ প্রায় চারশত বছরের মধ্যে যে ৭টি যুগান্তকারী ভাষণের অবতারণা হয়েছে, শুধু তার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী স্থান, কাল ও জনগোষ্ঠিভেদে সবাই কম-বেশী অবহিত আছেন। অনেকে এগুলোকে মাইল-ফলক বলেও অভিহিত করে থাকেন। তাছাড়া এ থেকে অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষণীয় বিষয়ের আওতায় ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য একাডেমিক পাঠ্য হিসেবে স্বমহিমায় পাঠ্যপুস্তকে অর্ন্তভুক্ত হয়ে থাকে। এছাড়াও কিছু কিছু ক্ষেত্রে নবদিগন্তের সুচনা হয়ে থাকে। যাহোক, এগুলোর সংঘটিত হওয়ায় সময় অনুসারে পর পর তুলে ধরা হলোঃ
প্রথমত পেট্রিক হেনরির কথা আসে, যাঁর ভাষণ এখনও যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার আপামর জনগণের কাছে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। মূলত তিনি ছিলেন ভার্জিনিয়া রাজ্যের প্রশাসক। যখন আমেরিকায় ব্রিটিশ আধিপত্য অসহনীয় হয়ে উঠে এবং সবকিছুতেই ব্রিটিশরা নাক গলাতে থাকে। তখন অর্থাৎ ১৭৭৫ সালের ২৩ শে মার্চে একটি চার্চের আঙ্গিনায় স্থানীয় নেতা, পরবর্তী প্রেসিডেন্ট জেফারসন ও জর্জ ওয়াশিংটনসহ স্থানীয় জনগণের উপস্থিতিতে পুরোপুরি স্বাধীনতার জন্য জ্বালাময়ী বক্তৃতা প্রদানের এক পর্যায়ে মিঃ হেনরি বলেছিলেন, “আমাকে স্বাধীনতা দেও, নয়তো মৃত্যু”। জানা যায়, তাঁর এই মূলমন্ত্র ঘিরে ব্রিটিশদের নাগপাশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পূর্ণরূপে স্বাধীনতা পাওয়ার বিষয়টি অধিকতর ত্বরান্বিত করেছিল।
তৎপর যিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন। তিনি হলেন সর্বাধুনিক গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক আব্রাহাম লিংকন। উল্লেখ্য যে, ১৮৬৩ সালে জুলাই মাসের প্রথম দিকে পেনসেলভেনিয়ার গেটিসবার্গে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে প্রায় আট হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সেই অনাহুত মৃত ব্যক্তিদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়। আর গৃহযুদ্ধের প্রায় চার মাস পরে যুক্তরাষ্ট্রের এই ষোড়শ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন উক্ত দুঃখজনক স্মৃতির স্মরণে বক্তৃতা দিতে আসেন। আর দিনটি ছিল ১৮৬৩ সালের ১৯ শে নভেম্বর। উক্ত স্মরণ সভায় মূলবক্তা বাকপটু অ্যাডওয়ার্ড এভার্ট প্রায় দুই ঘন্টা লাগাতার বক্তৃতা করেন। তৎপর প্রচলিত রীতি মোতাবেক বক্তৃতা শুরু করেন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন। কিন্তু তাঁর ভাষণ মাত্র ২৭২ শব্দ সম্বলিত, যা অনধিক তিন মিনিটেই শেষ হয়ে যায়। মজার ব্যাপার হলো যে, ফটো সাংবাদিকরা ক্যামেরা সেট করতে করতে অল্প সময়ে তিনি বক্তৃতার ইতি টানেন।
তথাপিও সেই ভাষণ এখনও সারা বিশ্বের মানুষের মনিকোঠায় বিশেষ আঙ্গিকে বিরাজ করছে। উল্লেখ্য যে, তাঁর বক্তৃতার নির্যাস ছিল মাত্র তিনটি ছোট বাক্য, যেমন- ÒThe Govt. of the People, for the People & by the PeopleÓ এই স্মরণীয় মূল্যবান কথাটি এখনও কেবল রাজনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সব পর্যায়ের লোক কমবেশী স্মরণীয় এই উক্তির সাথে পরিচিত। আর এটি এমনিই দ্রুপদী উক্তি, যা সারা বিশ্বের প্রায় সারে আটশত কোটি লোকের মধ্যে কোন না কোন লোকের মুখে প্রত্যহ কোন না কোন সময় উচ্চারিত হয়ে থাকে।
তৃতীয় যাঁর ভাষণ, তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুগান্তরকারী রূপ নেয়। যুক্তরাজ্যের সেই বরেণ্য ও প্রখ্যাত প্রধানমন্ত্রী হলেন উইনস্টন চার্চিল। আসলে তিনি অনেক গুণাবলীর আতিসয্যে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। লর্ড পরিবারের সন্তান হয়েও সাধারণ মানুষের দুঃখ কষ্টের জন্য ছিলেন সমব্যাথিত। আর এটি সমুন্নত করে রাখার জন্য প্রথম জীবনে অনেকে ঝুঁকি নিয়ে পত্রিকার রিপোর্টারের কাজে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এদ্বত্যতীত স্বনামধন্য লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন বিধায় সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পর্যন্ত পেয়েছিলেন। তাছাড়া তাঁর অভ‚তপূর্ব কর্মকান্ডের সুবাদে দু’দু বার যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। যাহোক, তাঁর চলমান বর্নাঢ্য জীবনে অনেক বক্তৃতা দিলেও ১৯৪০ সালের ১৩ই মে’র ভাষণটি ছিল যেমন সমযোপযোগী, তেমনই তাৎপর্যপূর্ণ, যা এখনও আলোকছটার বর্তিকা হয়ে উদ্ভাসিত হয়ে আছে। উল্লেখ্য যে, তিনি উক্ত সালের ১২ই মে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যখন শপথ নেন। সেই সময়ে এই গুরু দায়িত্বটা ছিল তাঁর পক্ষে বিরাট চ্যালেঞ্জ। কেননা জার্মানির আগ্রাসী ভূমিকা একের পর এক কালো ছায়া ঘিরে ফেলতে থাকে। দুরদর্শী ও বিচক্ষণ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল অবস্থার প্রেক্ষাপটে সরাসরি জার্মানির বিরুদ্ধে দীর্ঘ মেয়াদী যুদ্ধের জন্য অবস্থান নেন এবং সেই সূত্র ধরে পরের দিন অর্থাৎ ১৩ই মে একটি নাতিদীর্ঘ গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন এবং এক পর্যায়ে বলেন “এই মুহূর্তে দেওয়ার মতো কিছুই নেই আমার। আছে শুধু রক্ত, কষ্ট, অশ্রু আর ঘাম”। এ ছাড়া আরও কিছু মূল্যবান কথা বলেন, যার কারণে এখনও ইতিহাসের অম্বরে এই ভাষণটি জ্বল জ্বল করে জ্বলছে।
আর গান্ধী নামটি বললে যাঁর কথা মনে পড়ে যায়। তিনি হলেন ভারতবর্ষের কর্ণধার করমচাঁদ গান্ধী। লন্ডন থেকে ব্যারিষ্টারী পড়া শেষ করে প্রথম জীবনের দিকে অর্থাৎ মাত্র ২৪ বছর বয়সে তিনি চলে যান দক্ষিন আফ্রিকায়। সেখানের বর্নবাদ তার মোটেই ভাল লাগেনি বিধায় এ ব্যাপারে সোচ্চার হওয়ায় তাঁকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়। সেখানে কয়েক বছর থাকার পর অবস্থাভেদে ভেবে চিন্তে মাতৃভূমির টানে ১৯১৫ সালে ফিরে আসেন ভারতবর্ষে। সময়ের পরিক্রমায় এর মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী কর্মকান্ড আরও জেঁকে বসে। তখন আইনজ্ঞ গান্ধী জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার দৃষ্টিকোণ থেকে এই মর্মে উপলদ্ধি করেন যে, পরাধীন জাতির মেরুদন্ড বাঁকা থাকে, তারা কখনও কোন দিক দিয়ে মাথা উঁচু তথা ভাগ্যের উন্নতি সাধন করতে পারে না। আর সেই দর্শন সামনে রেখে ব্রিটিশদের উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষ থেকে বিদায় হয় (Quit India), এই শ্লোগানের উপর জোর দেন। আর এটাকে ঘিরে ব্রিটিশদের সবকিছু বর্জণ শুরু করতে থাকেন এবং উদহারণ হিসেবে প্রথমে নিজেই ইংল্যান্ডের সুটকোট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গায়ে পড়েন দেশী চরকায় হাতে বোনো ধুতি ও চাদর। রহস্যজনক ব্যাপার হলো, গান্ধীজির এ আন্দোলন সংহিস ছিল না। এটা ছিল অহিংস ধর্মের আদলে গ্রোথিত এবং শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি ছিলেন অবিচল। এমনি চলমান অবস্থায় ১৯৪২ সালের ৮ই আগস্ট মহাত্মা গান্ধী বোম্বের (এখন মুম্বাই) গাওলিয়া ট্যাক ময়দানে ব্রিটিশদের প্রতি অবিলম্বে “ভারতবর্ষ থেকে চলে যাও (Quit India) আহবানপূর্বক একটি অভুত্বপূর্ব ভাষণ দেন, যা ইতিহাস হয়ে এখনও পাক-বাংলা-ভারতবাসীর মনিকোঠায় চির জাগরুক হয়ে আছে।
বর্তমানে সারা বিশ্বে খুব কম লোকই আছেন, যাঁরা সফল সংগ্রামী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার নাম জানেন না। দক্ষিন আফ্রিকার সামান্য একটি উপজাতির ঘরে ১৯১৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে যেয়ে তাঁকে দীর্ঘ ২৮ বছর কারাজীবনে থাকতে হয়েছিল। তথাপিও জীবন-যৌবনসহ সবকিছু ত্যাগ স্বীকার করে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সদানিয়ত সোচ্চার ছিলেন। এ প্রেক্ষাপটে ১৯৫৩ সালের ২১ শে আগস্ট আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা ছিল বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এক অনবদ্য সৃষ্টি, যা কভু ভুলবার নয়। কেননা এর মধ্যে একটি ক্লাসিক্যাল বা শাশ্বত কথা ছিল, তা হলো, “স্বাধীনতা অর্জনের কোন সহজ পথ নেই”। তার বক্তৃতার এই উল্লেখ্যযোগ্য অংশ পরবর্তীতে আইন পাড়াসহ বিভিন্ন জনপদের মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হতে থাকে। আর এর সুবাদে বর্ণবাদসহ নিপীড়িত ও লাঞ্চিত মজলুম জনগণের মধ্যে সচেতনা শতগুণে বাড়িয়ে তুলে, যা প্রকারান্তরে বর্ণবাদের কবর রচনার পথে এগিয়ে দেয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, শুধু দক্ষিন আফ্রিকাই নয়, সারা বিশ্বের সাধারণ মানুষের কাছে যে কোন অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ক্ষেত্রে উদহারণ হিসেবে এটি একটি প্রতিক্রিয়াশীল ও অনুসরণমূলক ভাষণ। তাছাড়া এ পথ ধরে শান্তির জন্য নোবেল প্রাইজের সম্মানও পেয়েছেন। আর এতে প্রতীয়মান হয় যে, সুইডেনের নোবেল কমিটি সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন।
এতদ্ব্যতীত যাঁর ভাষণ বর্ণবাদের বিরুদ্ধে একটি মাইলফলক হিসেবে সর্বজনবিদিত। তিনি আর কেউ নন, সেই প্রিয় কৃষ্ণাঙ্গ নেতা হলেন মার্টিন লুথার কিং। ১৯৬৩ সালের ২৮ শে আগস্ট ওয়াশিংটন শহরে বিশাল জনসভায় তাঁর ভাষণ কৃষ্ণাঙ্গদের সপক্ষে এন্টিবায়োটিকের মতো কাজ করেছিল। এই ভাষণের শব্দ সংখ্যা ছিল ১৬৬৭টি এবং সময় লেগেছিল ১৭ মিনিট। আর এই মহান ব্যক্তি বক্তৃতার প্রথমে তুলে ধরেছিলেন কৃষ্ণাঙ্গদের উপর অকথ্য নির্যাতন ও বঞ্চনার কথা এবং ভাষণের এক পর্যায়ে মিঃ কিং বলেন, কৃষ্ণাঙ্গদের উপর যত ধরনের জোর জুলুম, অত্যাচার ও বাধা আসুক না কেন” আমি স্বপ্ন দেখি (ও উৎবধস ....) একদিন এই জাতি জাগ্রত হবে এবং সব মানুষের কাছে মূল্যায়িত হবে, কেননা সব মানুষ জন্মসূত্রে সমান। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, ১৯৬৫ সালের ৭ই মার্চ রোববার তাঁরই আহুত অহিংস ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের সূত্র ধরে মন্টোগোমারীর দিকে যাওয়ার পথে শেত্বাঙ্গ ও পুলিশের হামলায় রক্ত রঞ্জিত হয় রাজপথ, সৃষ্টি হয় রক্তস্নাত রোববার (Blooded Sunday)। আর সেই সময় এবং একই সাথে পরবর্তীতে তার আলোচ্য ভাষণ কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে বাঁচা-মরার মন্ত্র হিসেবে উৎসাহ যুগিয়েছিল।
শেষত যাঁর কথা বলছি, তিনি হলেন আমাদেরই প্রাণপ্রিয় অতিকাছের মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, রেসকোর্স ময়দানে ৭ই মার্চ (রবিবার) ২টায় সভা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বিকেল ৩-১৫ মিনিটের সময় (সাদা-পাজামা-পাঞ্জাবী ও কাল শর্ট কোর্ট পরিহিত) বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠেন। সাথে ছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ। এগিয়ে যান বঙ্গবন্ধু, ফরমালিটিজের ততটা বালাই ছিল না। আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান নেতা আব্দুর রাজ্জাক কে বলেন, “মাইক দে”, তৎপর শুরু হয়, সেই ঐতিহাসিক আকাশ-বাতাস বিদারী ভাষণ। একাত্তরের এই ৭ই মার্চের ভাষনে তাঁর যে অগ্নি স্ফুলিংগ ছিল, তাতে পাকিস্তানের নাগ পাশ থেকে পুড়িয়ে খাটি সোনা তৈরীপূর্বক বাংলাদেশে স্বাধীনতার পথ উম্মোচন করেছিল। মাত্র ১৮মিনিট ৩ সেকেন্ডের সারথী ধরে ১৩০৮টি শব্দের আদলে যে অমর গাথা সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনের ভাব-তরঙ্গের সূত্র ধরে নয় মাসের মাথায় অর্থাৎ ১৬ই ডিসেম্বর সূচিত হয়েছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক সবুজে ঘিরে লাল টক টকে সূর্যের আলপনা নিয়ে নতুন মানচিত্র।
এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, সত্তরের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও পাকিস্তানী স্বৈরাচার কর্তৃক ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ কথা সত্য যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সবকিছু তাঁর অঙ্গুলি হেলনে চলতে থাকে, কার্যত হয়ে উঠেন মুকুট বিহীন সম্রাট। এহেন মুহূর্তে তাঁর দিক-নির্দেশণা আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। উদ্ভুত অবস্থা ও সময়ের চাহিদা ধরে রেস কোর্স ময়দানের উত্তর পূর্ব-পার্শ্বে তৈরী মঞ্চে ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু প্রায় দশ লক্ষ লোকের অধিক সমাবেশে ঐতিহাসিক ভাষণের শেষের দিকে মিসাইল স্বরূপ বাক্যে ছেড়ে দেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম”। এমনই মাধুর্যপূর্ণ, অথচ কঠোর নির্দেশনার জাদুকরী সম্মোহনী আবেশ ছিল সেই ভাষনে, তাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষগুলো মন্ত্র মুগ্ধভাবে স্বাধীনতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ৩০ লক্ষ শহীদের প্রায় চৌদ্দ হাজার টন রক্ত ঝরে এবং ২ লক্ষের অধিক মেয়েরা মান সম্ভ্রম হারায়। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বাংলার জনগন ছিনিয়ে আনে স্বাদের স্বাধীনতা। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় হলো যে, এত বড় হৃদয়ের মানুষটিকে কিছু বিপদগামী সৈন্যরা মাত্র ৫৫ বছর বয়সে ধানমন্ডির বাড়ীতে নিমর্মভাবে সপরিবারে হত্যা করে। এক্ষেত্রে দুঃখ করে একজন লেখক বলেছিলেন যে প্রধানমন্ত্রী কিম্বা, প্রেসিডেন্ট নয়। একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে তাঁকে বাঁচতে দিল না ওরা। কি নিষ্ঠুর নিয়তি? যাহোক, এখন তাঁর সেই ভাষণ শুধু বাংলাদেশীদের কাছে নয়, সারা বিশ্বের কাছে দুনিয়া কাঁপানো ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়াশীল প্রায়োগিক ভাষণ, যা অন্য ছয়টি শ্রেষ্ঠ ভাষনে পুরোপুরি পরিলক্ষিত হয়নি।
এই শ্রেষ্ঠ সাতটি ভাষণের মধ্যে কোনটি সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ, সে নিয়ে মতভেদ আছে। তবে এটি সত্য যে, বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে দুটি ভাষণই সর্বশ্রেষ্ঠতার সোপানে পর্যবসিত হয়েছে। কেননা দুটি ভাষণের উপরই সবারই প্লাস পয়েন্ট আছে। কেউ কেউ বলেন বঙ্গবন্ধুর ১৮মিনিট ৩ সেকেন্ডের ৭ই মার্চের ভাষণ সর্বশ্রেষ্ঠ। আবার কেউ বলছেন গেটিসবার্গের, আব্রাহাম লিংকনের মাত্র ৩ মিনিটের ভাষণ, অনবদ্য ও তুলনামূলক সর্বশ্রেষ্ঠ। অবশ্য সারা বিশ্বের মানুষ এ ভাষণদ্বয় তাঁদের নিজস্বতায় এবং সেই আঙ্গিকে দেখে থাকেন। যেহেতু আব্রাহাম লিংকনের ভাষণ পশ্চিমা বিশ্ব সবার উপরে রাখার জন্যে ব্যতিব্যস্ত, সেহেতু সঙ্গতকারণেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে নিয়ে নিম্নে আমি কিছুটা বিশ্লেষণে ব্রতী হয়েছি। যদিও এটি আমার মতো স্বল্প জ্ঞানী মানুষের ক্ষেত্রে দুঃসাহস ও অনধিকার চর্চা। কিন্তু যাই মনে করুন না কেন, সঠিক চিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্য এ ছাড়া আমার কোন পথ আর খোলা দেখছি না। কেননা পশ্চিমা বিশ্ব তাঁদের মতো করে চাপিয়ে দিলে তো হয় না? তৃতীয় বিশ্বের মানুষ হলেও সঠিকতা এবং বস্তুনিষ্ঠতার নিরীক্ষে সব সময় চোখ-মুখ-কান বন্ধ রাখা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে অনেকে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা অধিকতর আবেগপূর্ণ বিপ্লবী ভাষণ বলে মনে করেন। অন্য দিকে লিংকনের বক্তৃতা ততটা আবেগপূর্ণ নয় এবং গ্রামারের দৃষ্টিকোণ থেকে তেমন কোন ভুল পরিলক্ষিত হয়নি বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। অথচ মুজিবের বক্তৃতায় ডুপ্লিকেশন আছে এবং অনেক জায়গার ক্রটি পরিলক্ষিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। তবে দুজনেরই বক্তৃতা ছোট হলেও মুজিবের বক্তৃতা তুলনামূলক প্রায় ছয় গুণ বড়। আর তাঁরা দু’জনরাই আগে লিখিত বা কোন পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না।
অবশ্য বঙ্গবন্ধুর ভাষণ তাৎক্ষনিক স্বতঃস্ফূর্তায় সৃষ্ট এবং বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক অমর ঝরণা ধারা। এটিকে বিশ্বের বিজ্ঞ ও প্রজ্ঞাশীল রাজনীতিবিদগণও প্রশংসা করেছেন। সেক্ষেত্রে অন্যগুলোর ব্যাপারে তেমনটি দেখা যায় না। এ প্রেক্ষাপটে বিশ্বখ্যাত পত্রিকা নিউজ উইক, টাইম ম্যাগাজিন, বিবিসি, এএফপি, ওয়াশিংটন পোস্ট, আনন্দ বাজার, সাংবাদিক সায়মন ড্রিং, কবি অন্নদা শংকর রায়, নেলসন ম্যান্ডেলা, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্থ হিথ, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, মার্শাল টিটো, পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, অমর্ত্য সেন, প্রমুখ প্রখ্যাত ব্যক্তিবর্গ ও পত্র-পত্রিকা না না আঙ্গিকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সামগ্রিক বৈশিষ্ট্যের উপর প্রশংসা করেছেন। তবে যে কারণে “সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ” এর বিচারে দ্বিতীয় সোপানে ধরা হয়, সেক্ষেত্রে দু-একটি উদহারণ তুলে ধরছি। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, ‘ভাইয়েরা আমার’ দিয়ে ভাষণটি শুরু করে বঙ্গবন্ধু প্রচন্ডতম আবেগে নিমজ্জিত হওয়ার কারণে বাক্য গঠনে বেশ ক’বার খেই হারিয়ে ফেলেন। যেমন “নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন”।
আসলে কথাটি হওয়া উচিত ছিল, নির্বাচনের প্রাক্কালে কিংবা নির্বাচনের সময়, কারণ নির্বাচনের পরে ভোট দেয়া সম্ভব নয়। তবে দর্শক শ্রোতারা ঠিকই বুঝেছিলেন। তাছাড়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু বেশ ক’বার “ন্যাশনাল এসেমব্লি, ‘রাউন্ড টেবিল, ‘উইথড্র, ইত্যাদি” বিদেশী শব্দ প্রয়োগের বদলে যদি ‘জাতীয় পরিষদ’ ও রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সের সংক্ষিপ্ত রূপের বদলে ‘গোল টেবিল বৈঠক’ ‘প্রত্যাহার, ইত্যাদি শব্দ প্রয়োগ করতেন, তাহলে বাক্য আরো হৃদয়গ্রাহী ও ওজস্বী হতো বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু কথাটি বোধ হয় সঠিক নয়। কেননা যে ভাষায় হোক না কেন, যেটা জনগন বুঝেন, সেটাতে কিছুটা তারতম্য হলে অসুবিধা কোথায়? এদিকে “১৯৫৪ সনে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পানি নাই” ‘গদি বিমুখ বঙ্গবন্ধু গদির পরিবর্তে ‘ক্ষমতা’ কিংবা ‘সরকার গঠন’ শব্দটি প্রয়োগ করলে বাক্যটিতে বঙ্গবন্ধুর ‘নিজস্বতা’ আরও প্রকাশ পেতো। তাছাড়া ভাষণের মাঝামাঝি অবস্থানে গিয়ে ইয়াহিয়ার কথা বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেন, “তিনি বললেন, আমি বললাম”, একই শব্দ ব্যবহার করায় জটিল হয়ে ভাষণের শ্রুতিমধুরতা তথা অলংকার কিছুটা হলেও নষ্ট হয়েছে। এতদ্ব্যতীত বাক্যের ‘প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে বর্ণিত হৃদয় নিংড়ানো ভাষণে তিনি “তৈয়ার, শুকায়, মায়না-পত্র, ইত্যাদি” আঞ্চলিকতা পরিহার করতে পারলে ভাষণের দীপ্তিমান ও বাগ্মিতা আরও বাড়তো। এদিকে “দাবাইয়া রাখতে পারবা না”, যা আঞ্চলিক শব্দ হলেও বাক্যটিতে চমৎকার কাব্যিক, নিজস্বতা ও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এছাড়াও বাক্যে রিক্সা, ঘোড়ার গাড়ি, রেল, লঞ্চ চলার কথা বলা হলেও, তখনকার গণপরিবহন হিসেবে ‘বাস’ বা প্রাইভেট কারের কথা আসেনি। এদিকে “সরকারী কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি” তা মানতে হবে’। এক্ষেত্রে সরকারী চাকুরীজীবীদের চলমান আন্দোলনে ‘সহযোগিতা ও সম্পৃক্ততার আহবান জানালে ভাষণটি উৎসাহবোধক ও প্রাণবন্ত হতো।
ভাষণে ‘হিন্দু-মুসলমান’ সম্প্রীতির কথা বলা হলেও, ভুলক্রমে ‘বৌদ্ধ খ্রিস্টান’ বাদ পড়াতে অসাম্প্রদায়িকতার দিক দিয়ে কিছুটা হলেও খন্ডিত হয়েছে। এতদ্ব্যতীত অতি আবেগের কারণে বঙ্গবন্ধু কখনো দর্শক শ্রোতাদের “আপনি”, আবার কখনো ‘তুমি’ সম্বোধন করে ৭ই মার্চের সাহিত্যিক তথা কাব্যময় ভাষণটির মহাকাব্যিক বৈশিষ্ট্য থেকে যৎসামান্য হলেও দূরে রেখেছে বলে মনে হয়। তথাপিও ভাষণের শেষ বাক্য “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম” বাক্যদ্বয়ে তেজদীপ্ত, সাহিত্য তথা মহাকাব্যিক সারথী ধরে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছেন। আর একটি কথা তিনি শেষের দিকে “ইন্-শাল্লাহ” শব্দ ব্যবহার করে, ¯্রস্টার প্রতি নির্ভরশীলতার উপর জোর দিয়েছেন, যা অন্য কোন ভাষণে তেমন পরিলক্ষিত হয়নি। যাহোক, এই সাতটি ভাষণ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয় যে, আব্রাহাম লিংকন এবং বঙ্গবন্ধুর এই দুটি ভাষণকে নিয়ে বিজ্ঞজন ও বুদ্ধিজীবীরা অধিকতর মাথা ঘামিয়ে চলেছেন। কিছুদিন আগে পত্র-পত্রিকায় দেখলাম, পশ্চিমা বিশ্বের চিন্তা ধারায় গেটিসবার্গের ভাষণ সর্বশ্রেষ্ঠ। অথচ এশিয়ানসহ অনেক দেশ রেস কোর্সের ভাষণ সর্বশ্রেষ্ঠতার দিক দিয়ে আসন পাওয়ার উপযোগী বলে মনে করেন। এ প্রেক্ষাপটে বিষয়বস্তু, ভাষা, ব্যাকরণগত রীতিনীতি, বাঁচন ভঙ্গি ও আকর্ষণীয় রাগ-রাগিনীর আদলে সুতী² কণ্ঠস্বর, শব্দের মাত্রা (ডেসিবল), উচ্চারণ, যুগসন্ধিক্ষণের চাহিদা, ঝুঁকি, দর্শকশ্রোতার সংখ্যা ও তাদের গ্রহণযোগ্য প্রতিক্রিয়া, প্রকৃতি ও ফলাফল যদি বিচার করি, তাহলে গেটিসবার্গের বক্তৃতা উপরে উঠতে পারবে কি না, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এই দুটি ভাষণেরই মধ্যে কোনটিতে প্লাস পয়েন্ট, আবার কোনটিতেও মাইনাস পয়েন্ট রয়েছে।
একটি আদর্শ ভাষণের সামগ্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো বিবেচনা ও হিসাবে আনলে কোন ক্রমেই রেস কোর্সের ভাষণের তাৎক্ষনিক গুরুত্ব অন্য কোন ভাষনে আছে কিনা আমার জানা নেই। আর যেহেতু দুটি ভাষণই দেয়ার প্রাক্কালে প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ায় সৌভাগ্য হয়নি। সেহেতু তৎকালীন পারিপাশ্বিক অবস্থা প্রসূত মূল্যবোধ (Situation Value) সম্পর্কে আমার মন্তব্য করা সম্ভব নয়। তবে এটি সত্য যে, আব্রাহাম লিংকনের সময় যেখানে আগুন নিভতে শুরু করেছিল এবং যা তাঁর মোটামুটি অনুক‚লে ছিল। সেখানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সময় আগুন জ্বলতে শুরু করছিল বিধায় সংকটাপূর্ণ ছিল। সেহেতু মানবীয় বৈশিষ্ট্যের আদলে ভাবাবেগ আসা স্বাভাবিক। যাইহোক না কেন, গেটিসর্বাগ ও রেসকোর্সের ভাষণ অনেক ক্ষেত্রে সমানে সমান। আর একটি কথা, গেটিসবার্গের ভাষণ তাত্তি¡ক, অথচ রেস কোর্সের ভাষণ পুরোপুরি প্রায়োগিক, যার ফলাফল স্বরূপ এই স্বাধীন বাংলাদেশ। সেই প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সর্বশ্রেষ্ঠ বললে অত্যুক্তি হবে না। তাছাড়া যেহেতু ৭ই মার্চের বক্তৃতা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালীদের জীবন, আর্থ-সামাজিক ও দেশের সাথে সম্পৃক্ত এবং শ্রেষ্ঠতার আদলে কাম্য মানসম্পন্ন গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান, সেহেতু সঙ্গতকারণেই সর্বশ্রেষ্ঠ না বললে বঙ্গবন্ধুর আত্মার প্রতি অবিচার করা হবে। আর একটি কথা, সাদা চামড়া বা কাল চামড়া বিচার না করলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের উপরে অন্য ভাষণ উঠতে পারবে কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
এতদ্ব্যতীত বিভিন্ন দেশী ও বিদেশী পত্র-পত্রিকায় যতদূর দেখেছি তাতে, লক্ষ্য করেছি যে রেস কোর্সের ভাষণ ব্যাকরণ ও ভাষাগত দিক দিয়ে কেবল মাইনাস পয়েন্টের আওতায় টেনে আনা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে আমি জোর দিয়ে বলতে পারি যে, অধিব্যক্তিদের ছোট খাটো ভুল অনেক সময় স্বীকৃতি লাভ করে। যেমন, কবিগুরু ভুলবশত “অজগরের” স্থলে “অজাগর” লিখেছিলেন। বাস্তবে দেখা গিয়েছে এ “অজাগর” শব্দটি স্বীকৃতি লাভ করেছিল। সেই আঙ্গিকে ৭ই মার্চের সময় যে অবস্থা বিরাজ করেছিল, তখন পূর্ব প্রস্তুতি ব্যতিরেকে এবং চারিদিকে অস্থির ও আশংকামূলক পরিবেশে অলিখিত ভাষণ দেয়ার সময় ডুপ্লিকেশন, শব্দের বিচ্যুতি ও স্থানীয় শব্দ ব্যবহারের কারণে এটিকে ক্রটিপূর্ণ ভাষণ বলা যায় না, বরং অভাবনীয় সৌন্দর্যের সুবাদে আকর্ষণীয়তা শতগুণে বাড়িয়ে তুলেছে। কেননা সেই সময়ে ব্যাকরণের সূত্র ধরে দাঁড়ি-কমার বেড়াজালে বক্তৃতা দেয়া কারও পক্ষে সম্ভব ছিল কিনা, সে ব্যাপারে যথেস্ট সন্দেহ আছে। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণ উপস্থিত জনতা সাদরে গ্রহণ করেছে। আর ব্যাকরণের দৃষ্টিকোণ থেকে আপিনিহিত বা স্বরভক্তির আদলে এই ক্রটি বা বিচ্যুতি প্রকারান্তরে সমর্থিত। কেননা উক্ত কথাগুলো প্রাঞ্জল ও গতিময়তা বাড়িয়ে তুলেছে। এতদ্ব্যতীত ৭ই মার্চে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু বলতে গেলে একক ও প্রধান বক্তা। পক্ষান্তরে গেটির্সবাগে মূল বক্তা ছিলেন বাকপটু অ্যাডওয়ার্ড এভার্ট, যিনি দু’ঘন্টা একাধারে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এরপর বিশেষ বক্তা হিসেবে প্রেসিডেন্ট লিংকন সামান্য সময় ভাষণ দিয়েছিলেন।
প্রসঙ্গক্রমে আর একটি কথা এখানে উল্লেখ না করলে কমতি থেকে যাবে, তা হলো- ইতিপূর্বে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ সভায় উপস্থিত দশ লক্ষ লোকের উচ্ছ্বাসিত সম্মতির সারথী ধরে তাঁকে “বঙ্গবন্ধু” খেতাব বা উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। যাহোক, বর্ণিত সামগ্রিক চুলচেরা বিচারের নিরীক্ষে ৭ই মার্চের ভাষণের উপরে অন্য কোন ভাষণ আসন না পাওয়ার সপক্ষে যথেষ্ট যৌক্তিক বিষয়াদি বিদ্যমান আছে। কারণ প্রধান বক্তা হিসেবে বজ্রকণ্ঠে যে ভাষণ বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন, উপস্থিত জনসমুদ্রে সেই ভাষা ও শব্দের চয়ন এত স্বীকৃতি লাভ করেছিল যে, দু’একটি বাক্যের পর-পরেই মুহূ মুহূ করতালি বাজতে থাকে। সেহেতু সবকিছু বিবেচনায় এনে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবীদার। এক্ষেত্রে বিশ্ববাসীর মধ্যে কারও কাছে বোধ হয়, কোনটি সর্বশ্রেষ্ঠ, সে ব্যাপারে সন্দেহ পোষন বা অন্য কোন যুক্তি-তর্কের অবতারণা করার সুযোগ নেই বলে প্রতীয়মান হয়।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, বর্ণিত ৭টি ভাষণই ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের আদলে ইউনোস্কো কর্তৃক ওয়েটেজ দেওয়া হয়েছে বিধায় এটি কমন বিষয় হিসেবে বিবেচনায় আনা হয়নি। আর প্রাসঙ্গিক না হলেও যে কথা না বললে কমতি থেকে যাবে, তা হলো একাত্তরের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ দিয়েছিলেন তখন ছিল পুরোপুরি প্রতিকূল পরিবেশ। সেই সময় সরাসরি রেডিও এবং টেলিভিশনে প্রচার করা সম্ভব ছিল না। এদিকে তখন তথ্যপ্রযুক্তি অতটা উন্নত ছিল না যে সহজে তাঁর ভাষণ ধারণ করা সম্ভব হবে। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, ভাষণটি সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ধারণ করা হয়েছিল পাকিস্তান সরকারের ক্যামেরাতেই। আর তা ডেভেলপ করার পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরে রক্ষা পেয়েছিল সেই অধিদপ্তরের কর্মরত কয়েকজন মুক্তিকামী ও দেশ প্রেমিক বাঙালি কর্মচারীদের সুবাদে, যাঁরা হলেন ক্যামেরাম্যান জেড এম এ মবিন ও এম এ রউফ এবং যুগপৎ ক্যামেরা সহকারী আমজাদ আলী খন্দকার, এসএম তৌহিদ, সৈয়দ মইনুল আহসান ও জোনায়েদ আলী। আরও তাঁদের সঙ্গে ছিলেন পিয়ন খলিলুর রহমান। এরা বস্তুত দু’দলে বিভক্ত হয়ে এই অসাধ্য কাজটি করেন।
এখানেই শেষ নয়, পাকিস্তান সরকার যাতে ভাষণটি বিনষ্ট না করতে পারে, সেক্ষেত্রে ক্যামেরা সহকারী আমজাদ আলী খন্দকারের ভূমিকা প্রণিধানযোগ্য। তিনি জীবন বাজি রেখে পাকসেনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সচিবালয় থেকে ঢাকার দোহারে নিয়ে যেয়ে ধানের গোলায় লুকিয়ে রাখেন। সেখানে মাস খানেক রাখার পর প্রতিকূল অবস্থা বিবেচনাপূর্বক সমমনা সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা নিয়ে ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। আর ডিসেম্বরে (১৯৭১) বিজয় অর্জন করার পর ভিডিও টেপটি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, আমজাদ আলী খন্দকারসহ উক্ত সাত/আট জন কর্মচারী যদি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ কাজটি না করতেন; তাহলে হয়তো অমূল্য সম্পদমূলক বঙ্গবন্ধুর এই সম্পূর্ণ ভাষণটি উদ্ধার করা সম্ভব হতো কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সংশয় আছে। (ভাষা ও বানানরীতি লেখকের নিজস্ব)
সহায়ক সূত্রাদিঃ ১। নির্ভীক সংবাদ- ১৬ই মার্চ এবং ১লা এপ্রিল ২০১১ইং। ২। আর রাহীকুল মখত‚ম (বাংলা অনুবাদকৃত)- আল্লামা শফিউর রহমান মোবারক পুরি। ৩। পেশ ইমাম, তেজতুরী বাজার জামে মসজিদ। ৪। এম. শামসুল হুদা, এ্যাডভাইজার, সেলস্্ এন্ড মার্কেটিং, এটিএন বাংলা লিঃ, কাওরান বাজার, ঢাকা। ৫। বাংলাদেশ প্রতিদিন- ০৭/০৩/২০১৩ইং ও ০৭/০৩/২০১৪ইং। ৬। দৈনিক যুগান্তর- ০৭/০৩/২০১৯ইং। ৭। প্রতিদিনের সংবাদ- ০৭/০৩/২০২২ইং ৮। সাহিত্য কণিকা, অষ্টম শ্রেণী। ৯। লেখকের পঞ্চদশ বর্ষ অভিজ্ঞতা। ১০। ইন্টারনেট।
মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব: বিশিষ্ট গবেষক, অথর্নীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত
মন্তব্য করুন