বাংলাদেশ সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি, কোভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচি এবং কালাজ্বর নির্মূলসহ বিভিন্ন ভার্টিকাল স্বাস্থ্য কর্মসূচিগুলোতে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করলেও সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্য অর্জন, গ্লোবাল হেলথ সিকিউরিটি ইনডেক্স এবং হেলথ ইনক্লুসিভিটি ইনডেক্স-এ অনেক পিছিয়ে আছে। যেমন সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্য অর্জনের সার্ভিস কাভারেজ ইনডেক্স-এ ১০০-এর মধ্যে বর্তমান স্কোর ৫২ যা ২০৩০ সাল নাগাদ কমপক্ষে ৮০ তে উন্নীত করতে হবে; স্বাস্থ্যের মোট ব্যয়-এ ব্যক্তির নিজস্ব অংশ বর্তমান ৬৮.৫ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে।
২০২১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গ্লোবাল হেলথ সিকিউরিটি ইনডেক্স-এ বাংলাদেশের স্কোর ১০০-এর মধ্যে ৩৫.৫ এবং ১৯৫ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৫তম। উল্লেখ্য, স্থানীয় এবং বৈশ্বিক প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধ; প্রাদুর্ভাবজনিত রোগ শনাক্ত করা এবং বিবরণী পেশ করা; প্রাদুর্ভাবজনিত রোগ মোকাবিলায় সাড়া দেওয়া; সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য জনবলের সুরক্ষার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা; স্বাস্থ্যখাতের সক্ষমতা এবং অর্থায়ন বাড়ানোর অঙ্গীকার ও প্রাদুর্ভাব মোকাবিলার বৈশ্বিক নিয়ম মেনে চলা এবং সামগ্রিক ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ ও জৈবিক হুমকি মোকাবিলায় অরক্ষণীয়তা - এই ৬টি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে গ্লোবাল হেলথ সিকিউরিটি ইনডেক্স-এর স্কোর তৈরি করা হয়। এগুলোর মধ্যে স্থানীয় এবং বৈশ্বিক প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধ এবং সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য জনবলের সুরক্ষার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর সবচেয়ে কম।
অন্যদিকে হেলথ ইনক্লুসিভিটি ইনডেক্স -এ ৪০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর সর্বনিম্ন (৩০.৮) এবং এই ইনডেক্সের ৩টি উপাদানের প্রত্যেকটিতে বাংলাদেশের স্কোর সর্বনিম্ন। উপাদানগুলো হলো- একটি জাতির নিকট জনগণের স্বাস্থ্যের গুরুত্ব কতটুকু এবং রাষ্ট্রের সব নীতিতে স্বাস্থ্য কতটুকু স্থান পায়; অন্তর্ভুক্তিমূলক স্বাস্থ্যব্যবস্থা যেখানে আর্থিক সামর্থ্য স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের পথে যেন বাধা হয়ে না দাঁড়ায়; এবং জনগণ ও কমিউনিটিকে ক্ষমতায়িত করা যেন কেউ স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত না হয়।
বিভিন্ন স্বাস্থ্য সূচকে আমাদের বর্তমান অবস্থান নিশ্চয়ই আমাদের উন্নয়ন, উন্নয়ন চিন্তা এবং উন্নয়ন স্বপ্নের সঙ্গে মানানসই নয়। অন্যদিকে, এই সূচকগুলোর বৈশিষ্টসমূহ যে বার্তা দেয় তা হলো স্বাস্থ্য গঠন, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি শুধু স্বাস্থ্যখাতের ওপর নির্ভর করে না। একটি দেশের স্বাস্থ্যনীতি ছাড়াও সে দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি, ঔষধ নীতি, বিচারব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থা ইত্যাদি স্বাস্থ্যখাতের পারফরমেন্স দারুণভাবে প্রভাবিত করে।
২০০০ সালে প্রথম স্বাস্থ্যনীতি এবং ২০১১ সালে দ্বিতীয় স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করা হলেও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তেমনি উদ্যোগ নেওয়া হয়নি ২০১২ সালে প্রণীত ‘হেলথ কেয়ার ফাইন্যান্সিং স্ট্রাটেজি’ বাস্তবায়নে। ১৯৯৮ সালে স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন বাজেট ব্যয় করার পদ্ধতি হিসাবে ‘অপারেশনাল প্ল্যান’ পদ্ধতি তখনকার প্রেক্ষিতে যুক্তিসংগত থাকলেও বর্তমান প্রেক্ষিতে তা গ্রহণযোগ্য নয়। উপযুক্ত ও দক্ষ জনবলের অভাব এবং পারস্পরিক সহযোগিতার অভাব ও সমন্বয়হীনতাসহ নানাবিধ কারণে ‘অপারেশনাল প্ল্যান’ পদ্ধতি থেকে সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে, গত দুই দশকে স্বাস্থ্যখাতে কোনো কার্যকরী সংস্কার করতে পারি নাই; বরং সংস্কারের নামে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দুইভাগে বিভাজিত করে আলাদা আলাদা জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেছি। কোভিড-১৯ পরবর্তী প্রথম সেক্টর প্রোগ্রামেও পরিবর্তনের তেমন কোনো রূপ রেখা দেখা যায়নি।
তাই সরকারি স্বাস্থ্য খাত থেকে আপাতত ভালো কিছু পাওয়ার আশা কম। এর প্রধান কারণ হলো আমাদের নীতি-নির্ধারণী মহলের স্বাস্থ্যখাত এবং এই খাতের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে নিখাঁদ এবং সামগ্রিক ধারণার অভাব। স্বাস্থ্যখাতের অবয়ব, কলেবর, কাঠামোগত জটিলতা এবং ক্রমাগত পরিবর্তনশীলতাসহ বহুমুখী বৈশিষ্ট আমাদের নীতি-নির্ধারণী মহলের নিকট সমন্বিতভাবে বোধগম্য নয়। ফলে, তারা স্বাস্থ্যখাতকে অন্যান্য খাত থেকে আলাদা হিসেবে ভাবতে পারেন না।
এই না বুঝার পিছনে একদিকে রয়েছে তাদের অজ্ঞতা, অন্যদিকে রয়েছে তাদের স্বার্থপরতা এবং দুর্নীতি পরায়ণতা। আবার ক্রমাগতভাবে স্বাস্থ্যখাত বিভাজিত হতে হতে এক একজনের নিজস্ব তালুকে পরিণত হয়েছে। ফলে মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হোক কিংবা স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান হোক কোনো প্রতিষ্ঠানকেই জনবল, ইকুইপমেন্ট এবং অর্থায়নের ভিত্তিতে আমরা পূর্ণাঙ্গ এবং সক্ষম করে গড়ে তুলতে পারিনি। এ সব প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত কর্ম পরিবেশও তৈরি করতে পারিনি। তাছাড়া রয়েছে নানা অযাচিত নিয়ম-কানুনের বেড়াজালে আবদ্ধতা। এসব কিছু থেকে বেরিয়ে আনার জন্য যে স্বার্থহীন, দূরদর্শী এবং গতিময় নেতৃত্ব প্রয়োজন তার আজ প্রচণ্ড অভাব।
অন্যদিকে, বেসরকারি খাতের ওপর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপযুক্ত পর্যবেক্ষণ, পরিদর্শন ও নিয়ন্ত্রণ না থাকায় জনগণ অর্থ খরচ করে বেসরকারি খাত থেকেও গুণগত স্বাস্থসেবা পাচ্ছে না। তাই জনগণ বিদেশমুখী হচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এ বিদেশ মুখিতা সামনে আরও বাড়বে, এমনকি সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা নিতেও জনগণ বিদেশে যাবে। এই সুযোগে বিদেশি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের দেশে তাদের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলবে যার লক্ষণ স্পষ্ট। উল্লেখ্য, কিছু বিদেশি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে বাংলাদেশে তাদের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। এই নেটওয়ার্কগুলো সাধারণ সেবা এখানে দিবে এবং পরবর্তী সেবার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশে তাদের নেটওয়ার্কের উন্নত হাসপাতালে রেফার করবে। স্বাস্থ্যসেবার জন্য এই বিদেশ নির্ভরতা কোনোভাবেই জনগণের স্বাস্থ্য, দেশের অর্থনীতি কিংবা দেশের নিরাপত্তার জন্য শুভ নয়।
পরিস্থিতির উন্নতির জন্য আমাদের সামনে কিছু পথ এখনও খোলা আছে। যেহেতু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বি এস এম এম ইউ)-এর স্বাস্থ্যসেবার প্রতি মানুষের আস্থা আছে এবং এটি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে ত্রাতার ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসতে পারে। যদিও রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট এবং খুলনায় মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালসহ পূর্ণাঙ্গ সেবা চালু হতে বেশ কিছু বছর লাগবে। এ ক্ষেত্রে তাই বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় রেফারাল সুবিধাসহ একটি শক্তিশালী টেলিমেডিসিন সেবা চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।
প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিটি জেলা শহরে বেসিক ডায়াগনস্টিক সুবিধাসহ একটি টেলিমেডিসিন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এই টেলিমেডিসিন সেন্টার দুই শিফট-এ খোলা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতি শিফট-এ চুক্তি ভিত্তিতে দুজন ডাক্তার (একজন পুরুষ এবং একজন মহিলা), একজন নার্স, একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, একজন আয়া, একজন ক্লিনার ও একজন সিকিউরিটি গার্ড বিশিষ্ট একটি প্রশিক্ষিত টীম থাকতে হবে।
অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উচ্চপ্রযুক্তি বিশিষ্ট একটি টেলিমেডিসিন সেবা ইউনিট প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই ইউনিট জেলা টেলিমেডিসিন সেন্টার-এ আগত রোগীদের অডিও-ভিজ্যুয়াল টেকনোলজির মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করবে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে জেলা টেলিমেডিসিন সেন্টার থেকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রেফারাল-এর ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রাথমিক ভাবে কিছু জেলায় পাইলট আকারে এই কাযর্ক্রম শুরু করা যেতে পারে। পরে পাইলট-এর ফলাফলের ভিত্তিতে অন্যান্য জেলায় এই সেবা প্রসারিত করা যেতে পারে।
পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে দেশে সরকারি এবং বেসরকারি খাতের একটি শক্তিশালী কনসোর্টিয়াম গড়ে তোলা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রথম দিকে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল, বাংলাদেশ ডায়াবেটিস এসোসিয়েশন, আদ্ দ্বীন, গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র, টিএমএসএস এবং হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালসহ নট-ফর-প্রফিট হাসপাতালসমূহকে কনসোর্টিয়াম-এর সদস্য হতে আহবান করা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এর নেতৃত্বে এ কনসোর্টিয়াম এর সদস্যরা একটি কমন স্টান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিজার এর মাধ্যমে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে গুণগতমানের সেবা প্রদানের পাশাপাশি একটি রেফারাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলবে।
এটি ঠিকঠাক মতো করতে পারলে এই কনসোর্টিয়াম জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। ফলে ফর-প্রফিট প্রাইভেট হাসপাতালগুলো একই স্টান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিজার অনুসরণ করে এই কনসোর্টিয়াম এ যোগদান করতে উদ্বুদ্ধ হবে। এই পদ্ধতি কার্যকর হলে স্বাস্থ্যবিমা চালু করাও সহজ হবে। উল্লেখ্য, স্ট্যান্ডার্ড প্রোটোকলভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা না দিলে স্বাস্থ্য বিমা চালু করলে তা আর্থিকভাবে টেকসই হবে না।
উল্লিখিত পরামর্শগুলো প্রয়োগ করতে না পারলে সর্বশেষ পরামর্শ হলো বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে দেশি এবং বিদেশি যৌথ মালিকানায় রেফারাল সুবিধাসহ একটি হাসপাতাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা যা একটি স্টান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিজার অনুসরণ করে পরিচালিত হবে। তবে এ ক্ষেত্রে কম পক্ষে ৫০ ভাগ মালিকানা দেশীয় প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকতে হবে। তবে এসব ক্ষেত্রে সরকারের বিশেষ সহযোগিতা এবং আনুকূল্যতা প্রয়োজন। আশাকরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্যবিদ্যালয় কর্তপক্ষ এবং সরকার বিষয়টি ভেবে দেখবেন।
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক
মন্তব্য করুন