বাজেট হলো সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের যৌথভাবে প্রণীত একটি রাজনৈতিক দলিল, যেখানে পরবর্তী অর্থবছরের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের অনুমিত হিসাব লিপিবদ্ধ হয়। প্রতিবছর বাজেট প্রণয়ন একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাও বটে। সংবিধানের ৮৭(১) অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, ‘প্রত্যেক অর্থবছর সম্পর্কে ওই বছরের জন্য সরকারের অনুমিত আয় ও ব্যয় সম্পর্কিত একটি বিবৃতি (বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি) সংসদে উপস্থাপিত হইবে।’ এই বার্ষিক আর্থিক বিবৃতিই হলো বাজেট। সংবিধানের ৮৩ অনুচ্ছেদে নির্দেশ রয়েছে, ‘সংসদের কোনো আইনের দ্বারা বা কর্তৃত্ব ব্যতীত কোনো কর আরোপ বা সংগ্রহ করা যাইবে না।’
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ বাজেটের আর্থিক বরাদ্দের বিষয়টি অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনাক্রমে নির্ধারণ করে, আর শুল্ককর নির্ধারণসংক্রান্ত কাজটি সম্পাদন করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের অধীন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
গত ১ জুন তারিখে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করা হয়। এটি বর্তমান সরকারের তৃতীয় মেয়াদের শেষ বাজেট। এ বাজেট বাস্তবায়নকালেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রাক নির্বাচনী বাজেট বিধায় বাজেট প্রণয়ন ও ঘোষণার পূর্বেই সবার মধ্যে এক ধরনের উৎকণ্ঠা ও কৌতূহল লক্ষ্য করা গেছে। অর্থনীতিবিদ, সুশীলবোদ্ধা ও জনগণের পরামর্শ ও প্রত্যাশাও ছিল অনেক।
এবারের বাজেট এমন এক সময় প্রণীত হয়েছে যখন নানামুখী চ্যালেঞ্জ ও সমস্যায় বিশ্ব অর্থনীতি জর্জরিত। প্রায় দুবছরব্যাপী নোভেল করোনা ভাইরাসের উপস্থিতির পর বিশ্ব অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পর্যায়ে ২০২২-এর ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ধাবিত করেছে। আমেরিকা ও ইউরোপসহ সারা বিশ্বে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে তা গত ৪০ বছরেও দেখা যায়নি।
ঊর্ধ্বমুখী আন্তর্জাতিক বাজার, জ্বালানি তেলের স্বল্পতা, বিভিন্ন দ্রব্যের সরবরাহ চেইনে বিপর্যয়, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি, দেশীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও সহনীয় পর্যায়ে রাখা, বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধি, ব্যবসা-বাণিজ্য গতিশীল রাখা, সর্বোপরি অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ বৃদ্ধি করে সরকারের কোষাগার সমৃদ্ধ করার প্রচেষ্টা গ্রহণের ক্ষেত্রে আগত বাজেটের ভূমিকা অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করছেন।
এখন দেখা যাক, প্রস্তাবিত বাজেট কতটা স্বস্তিদায়ক, বাস্তবায়নযোগ্য ও জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সহায়ক হয়েছে।
প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ছিল ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। সম্প্রতি সংশোধিত হওয়ার পর বাজেট দাঁড়ায় ৬ লাখ ৬০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকায়। সে হিসেবে বর্তমান অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় আগামী অর্থবছরের বাজেট আকারে ১ লাখ ১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা বেশি অর্থাৎ শতকরা হিসেবে ১৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেশি। সে বিবেচনায় এ বাজেটকে সম্প্রসারণমূলকও বলা যায়।
প্রস্তাবিত বাজেটের রাজস্ব আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। এরমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সংগ্রহ করবে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর বহির্ভূত কর রাজস্ব আদায়ে প্রাক্কলন করা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা এবং নন ট্যাক্স রেভিনিউ প্রাককলন করা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা।
বাজেটে মোট ঘাটতি নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এ ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎস অর্থাৎ ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রয় থেকে সংগ্রহ করা হবে ২৩ হাজার কোটি টাকা। বৈদেশিক উৎস (অনুদান ও ঋণ) থেকে আসবে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। বাজেটে জিডিপি প্রবৃত্তির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭.৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে আগামী অর্থবছরের জন্য সরকার পরিচালনা ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। উন্নয়ন ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকার বিপরীতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা যা জিডিপির ৫ দশমিক ৩ শতাংশ।
প্রস্তাবিত বাজেটে যেহেতু চলতি অর্থবর্ষের বাজেটের তুলনায় প্রায় এক লাখ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ রয়েছে সেহেতু প্রায় সকল মন্ত্রণালয়েই পূর্বের তুলনায় টাকার অঙ্ক অধিক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ খাতের বরাদ্দ নিয়ে কিছু কথা উঠেছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ খাতে এবার ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে বিদায়ী বাজেটের তুলনায় বরাদ্দ বেড়েছে ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা। তবে মোট বাজেটের খাতওয়ারী বরাদ্দের নিরিখে এবার স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমেছে। গত বছর মোট বাজেটের বিপরীতে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ ছিল ৫ দশমিক ৪ শতাংশ, এবার সেটা হয়েছে ৫ শতাংশ। গত বছরের বরাদ্দের তুলনায় উন্নয়ন ব্যয় ১৭ শতাংশ কম প্রস্তাব করা হয়েছে। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ৩৫ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা, বর্তমান অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৩৩ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা, অর্থাৎ প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি খাতে ১ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। টাকার অঙ্ক বাড়লেও খাতওয়ারী বরাদ্দ কমেছে। প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ মোট বাজেট বরাদ্দের শতকরা ৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ, চলতি অর্থবছরে যা ছিল ৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ। অনুরূপভাবে শিক্ষা খাতেও বরাদ্দ কমেছে। শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে যা মোট বাজেট বরাদ্দের ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের বরাদ্দ ছিল ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা, যা ছিল মোট বরাদ্দের ১২ দশমিক ০১ শতাংশ। জিডিপির হিসাবেও শিক্ষা খাতের বরাদ্দ কমেছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ তিন শতাংশ। ইউনেস্কোর পরামর্শ মতে, একটি দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত।
সামাজিক সুরক্ষা খাতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিগত বছরের তুলনায় ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি বাড়ানো হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে এ খাতে ১ লাখ ২৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে বয়স্ক ভাতা ৫০০ টাকা থেকে বেড়ে ৬০০ টাকা হবে। ভাতাভোগীর সংখ্যাও ১ লাখ বাড়ানো হবে। বিধবাদের মাসিক ভাতা ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৫০ টাকা করা হবে। এই কর্মসূচিতেও উপকারভোগীর সংখ্যা এক লাখ বাড়বে। অন্যান্য চালু কর্মসূচিতেও উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়বে। তবে সামাজিক সুরক্ষা খাতের কর্মসূচিতে ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় ৮ লাখের কাছাকাছি অবসর ভোগী সরকারি কর্মচারী রয়েছে। তাছাড়া ১০০ কোটি টাকার জলবায়ু পরিবর্তন তহবিল, ১২৫ কোটি টাকার নারী উন্নয়ন ও নারী উদ্যোক্তা তহবিল, শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র, জয়িতা ফাউন্ডেশনের মতো আরও কর্মসূচিতে বরাদ্দ দেখিয়ে সামাজিক সুরক্ষা খাতের বরাদ্দ ও উপকারভোগীদের সংখ্যা বেশি দেখানো হচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন। এগুলোর মধ্যে এমন কিছু কর্মসূচি রয়েছে যা আসলে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় পড়ে না বলে অনেকের ধারণা।
এবারের বাজেটে ভর্তুকি এবং বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের জন্যও বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। আগামী বছরের ভর্তুকির জন্য ধরা হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩৩ হাজার কোটি টাকা থাকবে বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকিতে। কৃষি খাতে ভর্তুকি থাকবে ১৭ হাজার কোটি টাকা। দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিষদের জন্য রাখা হচ্ছে ৯৪ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা ।
তবে এ নিবন্ধের লেখক মনে করেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বিপরীতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা সঠিকভাবে ব্যয় করার মধ্যেই রয়েছে বাজেটের সার্থকতা । বরাদ্দ কম বেশি যাই হোক প্রতিবছর অধিকাংশ মন্ত্রণালয়েই অব্যবহৃত অর্থ থেকে যায়, যার ফলে সংশোধিত বাজেট আকারে ছোট হয়। এবার এনবিআর এর রাজস্ব বাজেট তথা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও আদায় পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা যাক। এনবিআর এর রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা (৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা) চলতি বছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৬ শতাংশ বেশি। চলতি বছরের রাজস্ব আদায়ের অবস্থা সন্তোষজনক নয়। অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসের রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৪ হাজার কোটি টাকা কম হয়েছে। বছর শেষে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আদায় প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা কম হওয়ার সম্ভাবনা। সে হিসাবে প্রকৃত আদায়ের চেয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি হতে পারে। এত বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে না বলে অনেকের ধারণা। বিগত ১০ বছরের রাজস্ব প্রবৃদ্ধি পর্যালোচনায় দেখা যায় স্বাভাবিকভাবে কোনো বছরই রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ১৫-১৬ শতাংশের বেশি হয়নি। বর্তমান সময়ে দেশের অর্থনীতি কিছুটা চাপের মধ্যে রয়েছে। এ প্রেক্ষিতে রাজস্ব সংগ্রহ প্রবৃদ্ধি ১০-১২ শতাংশের উপরে আশা করা যায় না। রাজস্ব সংগ্রহ আশানুরূপ না হলে বাজেটে ঘাটতি আরও বেড়ে যাবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা ৫০ হাজার টাকা বাড়ানোর ফলে জনমনে কিছুটা স্বস্তি এসেছে। কিন্তু কর আদায় বাড়াতে এবার করমুক্ত আয়সীমার মধ্যে অবস্থানকারী ব্যক্তিকেও রিটার্ন জমা দিয়ে রশিদ সংগ্রহের জন্য দুই হাজার টাকা কর ধার্য করা হয়েছে। রশিদ না দেখালে প্রায় ৪০ প্রকার প্রয়োজনীয় সরকারি সেবা থেকে বঞ্চিত হতে হবে। এরূপ কর ধার্যকরণ করমুক্ত আয়সীমার নীতির সঙ্গে পরস্পর বিরোধী। মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক ধার্য অথবা বৃদ্ধির ফলে বলপেন, মোবাইল ফোন, প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্র, টিস্যু পেপার, দামি গাড়ি, বাইসাইকেল, সিমেন্ট, রডসহ নির্মাণসামগ্রী, বাসমতি চাল, কাজুবাদাম, খেজুর, বিদেশি ফ্রিজ, ফ্যান, এক্সিলেটর, কোমল পানীয়, ওভেন, চশমা ও এলপিজি সিলিন্ডারের দাম বাড়তে পারে। তাছাড়া জমি ও ফ্লাট রেজিস্ট্রেশন কর ও ভ্রমণ কর বাড়ানো হয়েছে। অন্যদিকে দেশীয় শিল্প সুরক্ষার জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে বিভিন্ন ধরনের পণ্যে শুল্ক কর ও ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে । এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে মাংস, এলইডি বাল্ব ও সুইচ সকেট, মিস্টি, কীটনাশক স্প্রেয়ার মেশিন, হাতে তৈরি বিস্কুট ও কেক, ম্যালেরিয়া ও যক্ষার ওষুধ, পশু খাদ্য, অপটিক্যাল ফাইবার, উড়োজাহাজ ইজারা, কন্টেইনার, ইত্যাদি। দেশীয় ইলেক্ট্রনিক্স যেমন—ব্লেন্ডার, জুসার, প্রেসার কুকার, ওয়াশিং মেশিন, ওভেন প্রভৃতি গৃহস্থালি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা আরও দুবছর বাড়ানো হয়েছে। অনুরূপভাবে রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজার উৎপাদনে ৫ শতাংশের অধিক ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা আরও এক বছর বাড়বে। সাবান ও শ্যাম্পুর কাঁচামাল আমদানিতে ৫ শতাংশের অধিক ভ্যাট অব্যহতির সুবিধা আরও এক বছর বহাল রাখা হয়েছে। দেশীয় ইলেক্ট্রনিক্স প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘকাল ধরে বিভিন্ন শুল্ককর অব্যাহতি সুবিধা পেয়ে আসছে। পর্যায়ক্রমে এসব অব্যাহতি তুলে দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানকে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতাসক্ষম করে তুলতে হবে। প্লাস্টিক দ্রব্যাদি, কলম, খেজুর, টিস্যু পেপার, এলপিজি সিলিন্ডারের মতো দ্রব্যাদির মূল্যবৃদ্ধি বর্তমান সময়ের মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিবে। মিস্টির মতো দ্রব্যের ভ্যাট কমানো নিষ্প্রয়োজন ছিল। সিগারেটের মূল্য যে পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে, এখানে আরও মূল্য বৃদ্ধি করে কর সংগ্রহের সুযোগ ছিল। ধনীদের সম্পদের ওপর সারচার্জ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগে ৩ কোটি টাকার ওপরে পরিসম্পদ থাকলে সারচার্জ দিতে হতো। এবার এ সীমা বাড়িয়ে ৪ কোটি টাকা করা হয়েছে। নিম্ন আয়ের লোকদের ২ হাজার টাকা কর ধার্যকরণ ও বিত্তশালীদের সারচারজ মওকুফ আয় বৈষম্য আরও বাড়াবে বলে অনেকে মনে করছেন। আগামী অর্থবছরে ১৩ ধরনের জ্বালানি পণ্যের ওপর বিদ্যমান ৫-১০ শতাংশ আমদানি শুল্ক, ১৫ শতাংশ মূসক ও ৫ শতাংশ অগ্রিম কর প্রত্যাহার করে প্রতি লিটার ১৩.৭৫ টাকা সুনির্দিষ্ট শুল্ক আরোপ করা হবে। ফলে জ্বালানি তেলের মূল্য কমানো যাবে বলে আশা করা যায়।
বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পাশাপাশি ডব্লিওটিও এর বিধিবিধানের সঙ্গে সংগতি রক্ষার জন্য কিছু পণ্যের ট্যারিফ যৌক্তিকীকরণ করা হবে। সেজন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ২৩৪টি পণ্যের সম্পূরক শুল্ক (এসডি) এবং ১৯১ টাকা পণ্যের নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের কিংবা শিল্প উৎপাদনের ওপর খুব একটা বাড়তি কর চাপানো হয়নি বলে বাজেটকে অনেকটা ব্যবসাবান্ধব বলা যায়।
দেশের কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি, সম্প্রসারণমূলক বাজেটের অর্থ জোগান তথা বাজেট ঘাটতি কমানোর লক্ষ্যে এনবিআর রাজস্ব অবশ্যই বাড়াতে হবে। তবে জনগণের ওপর করের বোঝা বাড়ানোর চেয়েও করের আওতাবৃদ্ধি এবং কর ফাঁকি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ অধিক ফলপ্রসূ হবে। সে লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রশাসনিক সংস্কার তথা জনবল ও কর অফিস সম্প্রসারণ জরুরি ভিত্তিতে সম্পাদন করতে হবে। প্রকাশ থাকে, ১৯৯১-৯২, ২০০১-০২ এবং ২০১১-১২ সালে প্রশাসনিক সংস্কার বাস্তবায়নের পর রাজস্ব সংগ্রহে বড় রকমের উল্লম্ফন লক্ষ্য করা গেছে। এ ছাড়া মূসক আদায়ের জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ইএফডি মেশিন স্থাপন এবং কর আহরণ ব্যবস্থার অটোমেশন জরুরি। এসব কাজ সম্পন্ন করা গেলে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় করা সম্ভব বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা।
প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়ন করে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার আশা করা হচ্ছে। কিন্তু কী প্রক্রিয়ায় তা করা হবে তার সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মপন্থা বাজেট বক্তব্যে নির্দেশ করা হয়নি। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আমদানি পণ্যের শুল্কে কোনো ছাড় দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া বাজেট ঘাটতি পূরণে বাণিজ্যিক ব্যাংক কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ছাপানোর মাধ্যমে যদি লক্ষাধিক হাজার টাকা ঋণ নেওয়া হয়, তা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিতে পারে। ব্যাংকঋণ প্রদানের সুদের হার ৯ শতাংশ সীমা উঠিয়ে দেখার বিষয়টি এখনো কার্যকর হয়নি বিধায় মূল্যস্ফীতিরোধে মুদ্রা সংকোচন নীতিও গ্রহণ করা হচ্ছে না। তাছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, রপ্তানি বৃদ্ধি ও রপ্তানি মূল্য দেশে আনার বিষয়ে বাজেটে কোন সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা দেখা যাচ্ছে না। বাজেট বাস্তবায়িত হলে সরকারি ব্যয় বাড়বে। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ জিডিপির ২৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা (যা বর্তমানে ২১ দশমিক ৮৫ শতাংশ) কীভাবে বাস্তবায়িত হবে তার দিক নির্দেশনা অনুপস্থিত। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণখেলাপিরা বিপুল পরিমাণ অর্থ সরিয়ে নিয়েছে। তার ওপর লক্ষাধিক হাজার কোটি টাকা সরকারি ঋণ দেওয়া হলে ব্যক্তি ঋণ সংকুচিত হবে—এতে কোনো সন্দেহ নেই। সার্বিক মূল্যস্ফীতির মধ্যে নতুন বিনিয়োগের জন্য অতিরিক্ত ভোগচাহিদা সৃষ্টি করা দুরূহ হবে। চলতি বছর মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ৫০ শতাংশ কমেছে। কাঁচামালের আমদানিও কমেছে। তাছাড়া বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ জ্বালানি সংকটে শিল্পখাতের উৎপাদন দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থার আশু উন্নয়নের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। খেলাপি ঋণ কমানো কিংবা বিদেশে পাচারকৃত অর্থ চিহ্নিতকরণ ও ফেরত আনার ব্যাপারে বাজেটে কোনো দিক নির্দেশনা নেই।
বাজেট বাস্তবায়ন করে আগামী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সে লক্ষ্য অনুযায়ী আগামী বছরের জিডিপির আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ লাখ ৬ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বাজেট বাস্তবায়নের অবস্থা ভালো নয়। অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে উন্নয়ন বাজেটের ৬০ শতাংশও বাস্তবায়িত হয়নি। রাজস্ব বাজেট বাস্তবায়ন, রাজস্ব সংগ্রহ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা গ্রহণ, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতি প্রভৃতিও আশানুরূপ নয়। এ পরিস্থিতিতে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন কঠিন হবে। তবে জিডিপি প্রবৃদ্ধির দিকে জোর না দিয়ে অর্থনীতির অন্যান্য সূচকের প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, জ্বালানি তেল ও কয়লা সংগ্রহ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো, শিল্প ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং রপ্তানি বহুমুখীকরণ ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনার ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ সময়ের দাবি।
সাধারণত নির্বাচনী বছরের বাজেটে জনতুষ্টির অনেক কর্মসূচি থাকে, কম গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রকল্পে ব্যয় বরাদ্দ, কিংবা রাজনৈতিক কর্মীদের হাতে টাকা দেওয়ার জন্য থোক বরাদ্দ থাকে, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষকে খুশী করার জন্য থাকে নানা শুল্ক কর ছাড়। কিন্তু এবারের বাজেটে তেমন কিছু নেই বললেই চলে। সে বিবেচনায় এ বাজেট প্রণয়ন প্রশংসাযোগ্য। প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সংসদ এবং সংসদের বাইরে নানা আলোচনা হবে। এসব বিবেচনায় নিয়ে কিছু জায়গায় কাট-ছাট করে বাজেটটি বাস্তবায়নযোগ্য করে পাস করা হবে—এটাই প্রত্যাশা। সর্বোপরি অর্থবছরের প্রথম মাস থেকেই বাজেটের সঠিক বাস্তবায়নের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে বছর শেষে কাঙ্খিত ফল লাভ করা যায়।
[লেখক : সাবেক সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত]
মন্তব্য করুন