মিয়ানমারে জান্তা সরকার ক্ষমতায় বসে ২০২১ সালে। যদিও এর আগে সেখানে সুদীর্ঘ সামরিক শাসনের ইতিহাস রয়েছে। ১৯৬২ সালে শুরু হওয়া সেনাশাসনের অবসান ঘটিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করেছিলেন অং সান সু চি। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসা সু চির সরকার মাত্র ১০ বছর স্থায়ী হয়। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট অং সান সু চি ক্ষমতায় থাকাকালে বিশ্ব মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সৃষ্ট বিশাল এক মানবিক সংকট প্রত্যক্ষ করে।
সহিংস হামলার শিকার হয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসে, যাদের গ্রামগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হয়। এটি সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে প্রবেশ করা মানুষের নজিরবিহীন এক ঢলের সূচনা করেছিল। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই নিরাপত্তা ও আশ্রয়ের খোঁজে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
এই সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে এবং তা বাংলাদেশের জন্য একটি বিরাট এবং দীর্ঘ সংকট তৈরি করে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা আটকা পড়ে আছে। তাদের নিজ দেশে ফেরার আশা সামান্যই। এদিকে শরণার্থীশিবিরগুলো সহিংসতা, অপরাধ এবং নানা ধরনের সমস্যায় জর্জরিত।
২০২১ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং মিয়ানমারের পুনর্নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করেন। অং সান সু চিসহ সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের গৃহবন্দি করেন তারা। মিয়ানমারে সূচনা হয় গৃহযুদ্ধের। দেশটির তরুণরা, জাতিগত-সংখ্যালঘু, সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য, বেসামরিক নেতারা এবং একটি বিদ্রোহী জনগোষ্ঠী ক্ষমতাসীন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করা এসব গোষ্ঠী তাদের লড়াইকে বিপ্লব হিসেবে অভিহিত করছে। তারা অনেক জায়গায় যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয় অর্জন করেছে এবং সংঘর্ষের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।
সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের এ লড়াই বাংলাদেশের সীমান্ত পর্যন্ত গড়িয়েছে অনেক আগেই। গত দুই দিনে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতে একটি সংবাদ আমাদের সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ‘মিয়ানমার থেকে অনেক সীমান্তরক্ষী বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে’। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় কয়েক দিন ধরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সংঘাতের তীব্রতা বেড়েছে। বিদ্রোহীরা অনেক এলাকা দখল করে নিয়েছে এবং প্রাণ বাঁচাতে এসব মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে।
মিয়ানমারের এই মারাত্মক অভ্যন্তরীণ সংঘাত কয়েক মাস ধরে চলতে পারে। কারণ সেনাবাহিনী টিকে থাকার জন্য বিমান শক্তি, সাঁজোয়া যান এবং আর্টিলারি সাজিয়ে রাজধানীসহ প্রধান শহরগুলোতে অবস্থান নিয়েছে এবং শহরগুলোর চারপাশে অবস্থান নিয়েছে বিদ্রোহীরা। বিদ্রোহীরা গেরিলা কৌশলের পাশাপাশি প্রচলিত যুদ্ধ কৌশল ব্যবহার করেও শাসক বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাচ্ছে। অভ্যুত্থানের মাত্র এক বছরের মধ্যে তারা দেশব্যাপী জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণকে অচল করে দিতে সক্ষম হয়েছে।
জান্তা শাসকের বিরুদ্ধে এই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ প্রতিরোধ ক্রমবর্ধমানভাবে শক্তিশালী হচ্ছে এবং বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তারা সেনাবাহিনীকে হটিয়ে দিচ্ছে। তাদের এই সফলতার মূল কারণ- সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ বর্বরতা জান্তার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিদ্রোহকে উস্কে দিয়েছে। মিয়ানমারের বৈচিত্র্যময় জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ এই প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। সমস্ত ফ্রন্টে আক্রমণের ফলে সেনাবাহিনীর শক্তিক্ষয় হচ্ছে। নতুন নিয়োগ না পাওয়া ও সরবরাহের অভাবে জান্তা বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়েছে।
বিদ্রোহীরা সবচেয়ে বড় সফলতাটি পায় দুই মাস আগে। বিদ্রোহী গোষ্ঠী ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স, মিয়ানমারের ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি, তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি এবং আরাকান আর্মি সমন্বিতভাবে অপারেশন ১০২৭ পরিচালনা করে। এই অপারেশনের মাধ্যমে তারা মিয়ানমারের উত্তর রাজ্যে দুই ডজনেরও বেশি শহরে একযোগে আক্রমণ চালায়। চীনের সীমান্তবর্তী শান শহরসহ শত শত সামরিক ফাঁড়ি দখল করে নেয় তারা।
কায়াহ, চিন, রাখাইন এবং কাচিন রাজ্যের অন্যান্য প্রতিরোধ কলামেও অগ্রগতি অর্জন করে বিদ্রোহীরা। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের অগ্রগতি সামরিক বাহিনীর দুর্বলতাকে জোরদার করে তুলেছে এবং প্রতিরোধ শক্তির আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে। এখন মনে হচ্ছে, জান্তার পতন শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।
ঠিক যে সময় মিয়ানমারে জান্তা সরকারের পতন হতে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে সে সময় বাংলাদেশের জন্য সব থেকে বড় প্রশ্ন হলো- মিয়ানমার জান্তার পতন ঘটলে রোহিঙ্গারা কি ফিরে যেতে পারবে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, জান্তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আরাকান আর্মি ভালো করছে। তবে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাংলাদেশে থাকা ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনো প্রভাব পড়বে কিনা তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ রয়েছে। বিশেষ করে এনইউজি (বিদ্রোহীদের সমন্বিত সংগঠন) রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের জাতিগত গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই স্বীকৃতির পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি আরও গুরুত্বসহকারে নেওয়ার দাবি রাখে।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংকট এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কোনোকিছু ভাবার আগে আরও কিছু বিষয় আলোচনার দাবি রাখে। মিয়ানমারে প্রতিবেশী চীন, ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের নানা ধরনের প্রভাব এবং স্বার্থ রয়েছে। চীন একইসঙ্গে মিয়ানমার জান্তা এবং বিদ্রোহীদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রেখে চলেছে। পশ্চিমারা অস্ত্রসহ নানা ধরনের সাপোর্ট দিচ্ছে বিদ্রোহীদের।
চীন এর আগে দুইবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে এগোনোর উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার জান্তা সরকারের অনাগ্রহে সে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। চীন আবারও এ বিষয়ে আলোচনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে মিয়ানমার জান্তা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তৃতীয় কোনো পক্ষের যুক্ত হওয়ায় রাজি নয়। তারা রোহিঙ্গা ইস্যুকে শুধু বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ইস্যু হিসেবে দেখতে চায়।
এটা স্পষ্ট যে, মিয়ানমারে আরাকান আর্মির উত্থান বা অগ্রগতি বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিকভাবে জটিল পরিস্থিতি তৈরি করবে। কারণ এই সশস্ত্র সংগঠনের উত্থান বা পতন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে প্রভাব ফেলবে।
আঙঙ্কা করা হচ্ছে, মিয়ানমার জান্তার পরাজয় ঘটলেও এই সংঘাত খুব দ্রুত শেষ হবে না। জান্তা সরকার গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে অবস্থান নিয়ে দীর্ঘদিন লড়াই চালিয়ে যাবে। ফলে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতময় পরিস্থিতি এবং বহিঃশক্তি নানা পক্ষের স্বার্থসংঘাতে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়াটি অনেক দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে যাবে।
মুজাহিদুল ইসলাম : শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন