ড. মইনুল ইসলাম
প্রকাশ : ৩১ জানুয়ারি ২০২৪, ১১:৩৬ এএম
অনলাইন সংস্করণ
ড. মইনুল ইসলামের নিবন্ধ

খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ কেন খাদ্য আমদানিতে তৃতীয়?

অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম। ছবি : সংগৃহীত
অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম। ছবি : সংগৃহীত

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফুড এন্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন বা এফএও) গত ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে ঘোষণা করেছে যে বিশ্বের মধ্যে খাদ্য আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে চীন ও ফিলিপাইনের পর বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। এই খবরের মধ্যে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মাত্র এক লাখ আটচল্লিশ হাজার পাঁচ শত সত্তর বর্গ-কিলোমিটার আয়তনের একটি দেশে ২০২২ সালে ষোল কোটি আটান্নব্বই লাখের বেশি জনসংখ্যা রয়েছে বলে সর্বশেষ জনশুমারিতে নির্ণয় করা হয়েছে। সন্দেহ রয়েছে, প্রকৃত জনসংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে।

২০২৩ সালের জুলাইয়ে প্রকাশিত সরকারী সংস্থা ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার এমপ্লয়মেন্ট এন্ড ট্রেনিং (বিএমইটি) এর হিসেব মোতাবেক দেশের এক কোটি পঞ্চান্ন লাখেরও বেশি মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হিসেবে বসবাসরত ও কর্মরত রয়েছে, যাদের জনশুমারির জনসংখ্যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় বিশ্বের অষ্টম-বৃহৎ জনসংখ্যার এই দেশটি বড় জনসংখ্যার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়, লুক্সেমবুর্গ ও সিঙ্গাপুরের মতো কয়েকটি সিটি-স্টেটকে বাদ দিলে। অতএব এই ঘনবসতিপূর্ণ ও ভূমি-দরিদ্র দেশে খাদ্য আমদানি করতে হবে, ব্যাপারটা স্বাভাবিক। বক্ষমাণ কলামে বিষয়টি ব্যাখ্যা করছি।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বিজয়লগ্নে এই নব্য-স্বাধীন দেশটি অর্থনৈতিকভাবে আদৌ টিকে থাকতে পারবে কি না তা নিয়ে বিশ্বের অনেক উন্নয়ন-অর্থনীতিবিদ ও ওয়াকিবহাল মহলের গভীর হতাশা ছিল। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে জনসন নামের যুক্তরাষ্ট্রের একজন কূটনীতিক যখন স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ‘ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস’ হবে বলে মন্তব্য করেছিলেন তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সনের তদানীন্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত সেক্রেটারি অব স্টেট ড. হেননি কিসিঞ্জার তাতে সায় দিয়েছিলেন।

এসব সমালোচকদের দোষ দেওয়া যাবে না ওই অপমানজনক অভিধা প্রদানের জন্য, কারণ তখন বাংলাদেশে প্রায় চল্লিশ লাখ টন খাদ্যশস্যের ঘাটতি ছিল। ওই সময় আমাদের চাল লাগত এক কোটি পঞ্চাশ লাখ টন, কিন্তু আমরা উৎপাদন করতে পারতাম মাত্র এক কোটি দশ লাখ টন। বাকি চল্লিশ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা না থাকায় ঘাটতি পূরণের জন্য বিশ্বের দাতাদেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে খাদ্য সাহায্যের জন্য ভিক্ষার হাত পাতা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।

এই খাদ্য-সাহায্যের বিষয়টি পুরো সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশের জনগণের জীবন-মরণের সমস্যা সৃষ্টি করত। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ কিউবার বিরুদ্ধে আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কিউবায় পাটের বস্তা রফতানি করায় মার্কিন সরকার বাংলাদেশ সরকারের কাছে কৈফিয়ত তলব করেছিল। প্রাথমিকভাবে কৈফিয়তের সন্তোষজনক জবাব না পাওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য খাদ্য-বহনকারী ৫টি মার্কিন জাহাজকে মাঝ-দরিয়া থেকে যাত্রাপথ ঘুরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বন্দরে নোঙর ফেলে যাত্রা বিলম্ব করতে বাধ্য করেছিল। এর ফলে ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে বাংলাদেশে খাদ্যশস্য-মজুত বিপজ্জনকভাবে প্রায় নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল।

একইসাথে, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত থাকায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে খাদ্যশস্য পরিবহন ভীষণ কষ্টকর ছিল। এর পাশাপাশি ওই বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে মারাত্মক বন্যার কারণে আউশ ও আমন ফসল ভীষণভাবে মার খেয়ে গিয়েছিল। এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে বর্ষাকালে দেশের উত্তরাঞ্চলে ‘মঙ্গা’ সমস্যার কারণে মৌসুমি-বেকার মানুষের হাতে খাদ্য কেনার ক্রয়ক্ষমতা সংকুচিত হয়ে যেত। (২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ‘মঙ্গা’ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়েছে)। এর সাথে যখন খাদ্য সাহায্যের পাইপলাইন নিঃশেষিত হওয়ার গুজবের ব্যাপারটি যুক্ত হয়েছিল তখন বাজারে খাদ্যের জোগানে বিপর্যয় সৃষ্টি হওয়ায় মজুতদাররা ষড়যন্ত্র করে বাজারে কৃত্রিম খাদ্য-ঘাটতি সৃষ্টি করেছিল, যার ফলে অতি দ্রুত এক সের চালের দাম কয়েকদিনের মধ্যে লাফ মেরে দেড় টাকা থেকে দশ টাকায় উন্নীত হয়েছিল। অতএব, ওই বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে দেশের উত্তরাঞ্চলের রংপুর ও মধ্যাঞ্চলের ফরিদপুরে প্রাণঘাতী দুর্ভিক্ষে প্রায় এক লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল।

পরে বঙ্গবন্ধু সরকার কূটনৈতিক চ্যানেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে করে খাদ্য-সাহায্য পুনরায় চালু করলেও দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে পারেনি, যা তার শাসনামলের একটি দুঃখজনক ও অনপনেয় ব্যর্থতার অধ্যায় হিসেবে আজও ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। বিংশ শতাব্দীর সত্তর দশক থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের এহেন খাদ্য-সাহায্য-নির্ভরতা মারাত্মক পর্যায়ে অবস্থান করছিল। এখন বাংলাদেশ আর খাদ্য-সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল নয়। আমাদের প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য হয় নিজেরা উৎপাদন করার সক্ষমতা কিংবা যেসব খাদ্যদ্রব্য আমরা উৎপাদন করতে পারি না সেগুলো আমদানি করার সক্ষমতা আমাদের এহেন ‘ব্লাকমেইল’ থেকে মুক্তি দিয়েছে।

১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে আমরা ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিলাম প্রথমবারের মতো, কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আওয়ামী লীগের কৃষিনীতি পরিত্যাগের মতো ভুল নীতি নিয়ে আবার দেশকে খাদ্য-ঘাটতির গহ্বরে নিক্ষেপ করেছিল। ২০০১-০৬ মেয়াদের বিএনপি-জামায়াত সরকারের খাদ্য-মজুত মারাত্মকভাবে কমিয়ে ফেলার ভুল নীতির কারণে ২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেশ মারাত্মক খাদ্য-ঘাটতির ঝুঁকিতে পড়ে গিয়েছিল।

ওই সংকটের সময় বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে খাদ্যশস্য আমদানি করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার মরিয়া প্রয়াস চালালে দেশ খাদ্যশস্য রপ্তানি করতে রাজি হয়নি। কারণ, সারা বিশ্বে ওই সময়ে খাদ্য-ঘাটতি সৃষ্টির শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল। ‘প্যানিক বায়িং’ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও কোনমতে দেশ আরেকটা দুর্ভিক্ষ এড়াতে সক্ষম হয়েছিল। এরপর ২০০৯ সালে মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর আবার শেখ হাসিনা ও মতিয়া চৌধুরীর দক্ষ ও নিষ্ঠাবান নেতৃত্বে দুই বছরের মধ্যে দেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছিল ২০১১ সালে। এরপর গত ১২ বছরের মধ্যে দু’বছর ছাড়া দশ বছর দেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করে চলেছে কিংবা উদ্বৃত্ত ধান উৎপাদনে সক্ষম হচ্ছে।

কৃষিখাতের এই সাফল্য বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুবাতাস বইয়ে দিচ্ছে। বলতে গেলে দেশে একটি কৃষি বিপ্লব চলমান। ইতোমধ্যেই বলেছি, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ধান উৎপাদিত হতো মাত্র এক কোটি দশ লাখ টন। গত পঞ্চাশ বছরে ধান উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন কোটি বিরান্নব্বই লাখ টনে, ভুট্টার উৎপাদন এবং গম উৎপাদন যোগ করলে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে প্রায় চার কোটি ষাট লাখ টন। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে পৌঁছে গেছে। তরি-তরকারি, শাকসবজি, আলু, হাঁস-মুরগীর মাংস ও ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে।

আমরা গর্বের সাথে বলতে পারি, প্রায় সতের কোটি মানুষের খাদ্যশস্য জোগান দিয়েও এখন প্রায় প্রতি বছর মোটা ধান উদ্বৃত্ত হচ্ছে আমাদের। (অবশ্য প্রতি বছর আমরা ৬০/৬৫ লাখ টন গম আমদানি করি)। দুধ উৎপাদনে দেশে এখনো ঘাটতি রয়ে গেলেও গরু-মহিষের মাংস উৎপাদনে আমরা স্বয়ম্ভরতার দ্বারপ্রান্তে। ঈদুল আজহার সময় অতীতে চোরাচালানে আসা ভারতীয় গরু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এখন তার প্রয়োজন হয় না, বরং ২০২৩ সালের ঈদুল আজহার সময় কোরবানির গরু উদ্বৃত্ত ছিল। আম, আনারস, কলা, পেয়ারা ও কাঁঠালের মতো কয়েকটি প্রধান ফল উৎপাদনেও বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ।

বৈদেশিক ঋণ/অনুদান এখন জিডিপির এক শতাংশের নিচে নেমে এসেছে, আর এই বৈদেশিক ঋণ/অনুদানের অতি ক্ষুদ্র অংশ খাদ্য-সহায়তা। উচ্চফলনশীল প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার, সেচ ব্যবস্থার আওতায় আসায় দেশের অধিকাংশ জমিতে বোরো চাষের সম্প্রসারণ, যথাযথ ভর্তুকি প্রদান, কৃষিঋণ পদ্ধতির সহজীকরণ, ফসলের বহুধাকরণ, কৃষির লাগসই যান্ত্রিকীকরণ, উচ্চফলনশীল ফসল, তরি-তরকারি, মাছ, হাঁস-মুরগি ও ফলমূল চাষের ব্যাপক প্রচলন, রাসায়নিক সার, বীজ ও কীটনাশকের সহজলভ্যতা, ইত্যাদি কৃষিখাতের উল্লেখযোগ্য সাফল্য।

উপরে উল্লিখিত সাফল্যগুলোকে খাটো না করেও স্বীকার করতে হবে যে খাদ্য আমদানিতে বিশ্বের তৃতীয়-বৃহৎ আমদানিকারক হওয়া বাংলাদেশের জন্য একান্তই স্বাভাবিক। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা জানাচ্ছে, বাংলাদেশে মোট ৯ কোটি তেত্রিশ লাখ টন কৃষিজাত দ্রব্য উৎপাদিত হচ্ছে, আর বাংলাদেশ এক কোটি পঁচিশ লাখ টন খাদ্য আমদানি করছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত খাদ্যের মোট চাহিদার ৯.৩ শতাংশ আমদানি করা হতো, ২০২২ সালে খাদ্য আমদানি চাহিদার ১১.২ শতাংশে পৌঁছে গেছে। এই ব্যাপারটির দুটো দিক্ রয়েছে। জনগণের মাথাপিছু জিএনআই বাড়ার কারণে বাজার থেকে খাদ্য কেনার সক্ষমতা যেমনি এই তিন বছরে বেড়েছে, তেমনি দেশের খাদ্যদ্রব্য আমদানির আর্থিক সক্ষমতাও বেড়েছে।

খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে আমরা গম, ভোজ্যতেল এবং গুঁড়াদুধ আমদানির জন্য সর্বোচ্চ ব্যয় করে থাকি। আমাদের গম উৎপাদন খুব বেশি বাড়ানোর সুযোগ নেই, কিন্তু মানুষের আয় বাড়ার কারণে ময়দা থেকে উৎপাদিত বাজারের নানা খাদ্যপণ্য ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে। অতএব, ৬০-৬৫ লাখ টন গম আমদানি করতে হচ্ছে আমাদের। বোরো ধান এখন আমাদের ধান উৎপাদনের প্রায় ৬০ শতাংশে পৌঁছে গেছে, যা শুষ্ক মৌসুমের ধান। এই কারণে, শরিষার মতো ভোজ্য তেলবীজ উৎপাদনের জমি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে বোরো ধান উৎপাদনের জন্য।

আমাদের শৈশবে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান শরিষা উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল, কিন্তু উচ্চফলনশীল বোরো ধান উৎপাদন ক্রমশ বিস্তৃত হওয়ায় ষাটের দশক থেকে ভোজ্যতেল আমদানির ওপর আমাদের নির্ভরতা বাড়তে শুরু করেছিল। এখন আমাদের ভোজ্যতেলের চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ সোয়াবিন ও পাম অয়েল আমদানি-নির্ভর হয়ে পড়েছে। মানুষের আয় বাড়ার কারণে ভোজ্যতেলের ব্যবহারও বেড়ে যাচ্ছে দিনদিন। কিন্তু আমি মনে করি, সরকার অগ্রাধিকার দিয়ে প্রণোদনা দিলে আবার সরিষা উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন অসম্ভব হবে না।

কুমিল্লা, বগুড়া, দিনাজপুর এবং যশোরে আমন ধান কাটার পর বোরো ধান লাগানোর আগে সরিষা চাষের ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। এজন্য বোরো ধান লাগানো পনেরো দিনের মতো পিছিয়ে দিতে হলেও তাতে বোরো ধানের উৎপাদনশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। এসব জেলায় যদি সরিষা উৎপাদন কারিগরিভাবে সম্ভবপর হয় তাহলে অন্যান্য জেলায় সরিষা উৎপাদনের জন্য সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মসূচি গ্রহণ করছে না কেন? সরকার ব্যাপারটিকে যথাযথ গুরুত্ব দিলে একই জমিতে প্রতি বছর আমন ধান, সরিষা এবং বোরো ধান উৎপাদন খুবই সম্ভব মনে করি। এর ফলে কয়েক বছরের মধ্যে ভোজ্য তেল আমদানি অনেকখানি কমানো সম্ভব হবে।

অনেকে মনে করেন, গুঁড়াদুধের ওপর নির্ভরতাও অদূর ভবিষ্যতে কমানো যাবে না। গুঁড়াদুধকে শিশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহারের সংস্কৃতি এখনো দেশে গেড়ে বসে আছে, মায়ের দুধ না খাওয়ানো মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে ‘ফ্যাশনে’ পরিণত হয়েছে। বিশেষত, আতিথেয়তার খাতিরে মিষ্টি আদান-প্রদানের যে সংস্কৃতি সারা দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে তার ফলে চিনি ও গুঁড়াদুধের আমদানিও কমানো যাচ্ছে না। স্বাস্থ্যের বিবেচনায় মিষ্টি একটি অস্বাস্থ্যকর খাদ্য। এজন্য ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মিষ্টি উৎপাদন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, কিন্তু কয়েক লাখ মানুষ বেকার হয়ে যাওয়ার যুক্তি মেনে নিয়ে কয়েকদিনের মধ্যে ওই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। ‘মিষ্টি সংস্কৃতি’ একটি অপসংস্কৃতি।

অতীতে যখন দেশ দুধ উৎপাদনে উদ্বৃত্ত অবস্থানে ছিল তখন উদ্বৃত্ত দুধ সংরক্ষণের প্রযুক্তি হিসেবে মিষ্টি উৎপাদন ও ব্যবসার প্রয়োজনীয়তা ছিল। কিন্তু এখন আধুনিক বিদ্যুৎনির্ভর প্রযুক্তি ফ্রোজেন অবস্থায় দুধ সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে সহজলভ্য করে দিয়েছে, তাই এখন মিষ্টি-সংস্কৃতিকে নিরুৎসাহিত করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সর্বোপরি, দেশের গরুর উন্নত জাত চালু করাকে অগ্রাধিকার দিলে যে দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সম্ভব সেটা সফলভাবে দেখিয়েছে ভারত। আমরা ভারতের ‘আমূল’ মডেলকে গ্রহণ করছি না কেন? মসলাপাতি, ডাল ও ফল আমদানি বাংলাদেশে অপরিহার্য, তবে আতিথেয়তার সংস্কৃতি হিসেবে বিদেশি ফল আদান-প্রদান নিরুৎসাহিত করাই সমীচীন।

ড. মইনুল ইসলাম : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আজকের নামাজের সময়সূচি

প্রথম দিনে উইন্ডিজ তুলল ২৫০ রান

গাঁজা-জাল নোটসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের শীতবস্ত্র বিতরণ

উইন্ডিজের প্রতিরোধ ভেঙে বাংলাদেশের স্বস্তি

টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস / ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়িক অংশীদার চাই

২০২৪ সালের হাইয়েস্ট কালেকশন দরদের : শাকিব 

নায়িকা পরীমনির প্রথম স্বামী নিহত

রাজনীতিতে আ.লীগের পুনর্বাসন ঠেকাতে হবে: নুর

নির্বাচন যত দ্রুত হবে, সমস্যা তত কমে আসবে : মির্জা ফখরুল

১০

খাসজমির দখল নিয়ে সংঘর্ষে দুজন নিহত

১১

মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ক্রীড়াঙ্গন অন্যতম একটি মাধ্যম : আমিনুল হক 

১২

তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল

১৩

আহত রানার পাশে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’

১৪

ফেসবুকে দাবি ‘মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ একই ব্যক্তি’, যা বলছে ফ্যাক্ট চেক

১৫

একদিকে প্রশান্তি, অশান্তিও বিরাজ করছে: শামা ওবায়েদ

১৬

চোর সন্দেহে খুঁটিতে বেঁধে যুবককে নির্যাতন

১৭

র‍্যানকন মটরসের সঙ্গে ক্র্যাক প্লাটুন চার্জিং সলুশনের চুক্তি

১৮

জনকল্যাণে কাজ করাই বিএনপির মূল লক্ষ্য : নয়ন

১৯

‘এক ফ্যাসিস্টকে হটিয়ে আরেক ফ্যাসিস্টকে ক্ষমতায় দেখতে চাই না’

২০
X