সুইডেনের মাঠেও শাকসবজির চাষ করতে কীটপতঙ্গের খুব সাহায্যের দরকার পড়ে পরাগায়ণের জন্য। আমরা জানি, পশুপাখি, মানুষসহ সব জীবজন্তুর মধ্যে যেমন পুরুষ, নারী ও উভয় লিঙ্গ রয়েছে, গাছপালারও একই অবস্থা। আমাদের দেশে মূলত নারী-পুরুষের যৌনতাকে নরমাল বলে মনে করি, বাকি সব যেমন সমকামীদের যৌনতাকে অসুস্থ মস্তিষ্কের বিকাশ বলে থাকি। সুইডেনেও এমনটি ধারণা করা হতো আজ থেকে ৫০-৬০ বছর আগে।
এখন এখানে এমনকি বিশ্বের অনেক দেশে এটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছর সুইডেনের রাজপথে সমকামী প্যারেড অনুষ্ঠিত হয় যার নাম ‘প্রাইড সেলিব্রেশন’। এ প্রোগ্রাম সপ্তাহ ধরে চলে। বিশ্বের নানা দেশের সমকামীরা স্টকহোমে একত্রিত হয়।
সপ্তাহব্যাপী আনন্দ-ফুর্তির সঙ্গে এরা এদের অস্তিত্ব বা অধিকারে যাতে কেউ হস্তক্ষেপ না করে তার জন্য মূলত এখানে অনুষ্ঠানটি হয়ে থাকে। ইদানীং জেনেছি কিছু সাধারণ ছেলে, মেয়ে সেজে এ দলে যোগদান করে মেয়েদের তাঁবুতে রাতযাপন করে, পরে রাতের আঁধারে দেখা গেছে মেয়েদের ধর্ষণের চেষ্টা করে। কিছু পুরুষ এবং মেয়ে আছে যারা মেয়ে এবং ছেলে উভয়ের সাথে মিলিত হয়, এদের সংখ্যাও কিন্তু দেশে-বিদেশে কম নয়।
কী কারণে মানুষ সমকামী, উভকামী বা বিষমকামী হয়? অনেক ফ্যাক্টর এর পেছনে কাজ করে থাকতে পারে। কেউ হয়তো জৈবিক কারণে সমকামী হয়, কেউবা মনস্তাত্ত্বিক কারণে। হোমোসেপুয়ালিটি, যার বাংলা হচ্ছে সমকামী। সমকামীরা এ সমাজেরই একটি বড় অংশ। তারা এ সমাজেই বাস করে। ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী সমকামিতা বহু দেশে বৈধ নয়, কিন্তু অনেক দেশে সমকামী বিয়ে আইন চালু আছে এবং অন্যান্য নাগরিক অধিকার রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। সেক্ষেত্রে সবাই এখন নিজ অস্তিত্ব নিয়ে ভাবছে, যেমন: হিজড়া, লিঙ্গগত অস্পষ্টতা ও অসম্পূর্ণতা নিয়ে জন্ম নেয়। এরা না পুরুষ না মহিলা। মহিলা ও পুরুষ উভয় বৈশিষ্ট্যের কিছু কিছু এরা ধারণ করে।
ট্রান্সজেন্ডার, যারা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তন করে ছেলে থেকে মেয়ে অথবা মেয়ে থেকে ছেলেতে রূপান্তরিত হয় এবং সমকামী, যারা বিপরিত লিঙ্গের পরিবর্তে সমলিঙ্গে আকৃষ্ট হয়ে সমলিঙ্গের সাথে সংসার করে বা মিলিত হয়।
আমরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ জীব বলে দাবি করি, কিন্তু শ্রেষ্ঠ নৈতিকতা বা মানবতার পরিচয় দিতে পারছি বলে মনে হচ্ছে না। এ যুগে সবকিছু যে স্কুলের বই পড়লে শেখা যাবে এমনটি ধারণা করাও বোকামি। প্রযুক্তি প্রতিক্ষণের কথা তুলে ধরছে নানাভাবে। তারপরও যখন পুঁথিগত বিদ্যায় একটি গল্প তুলে ধরা হলো সঙ্গে সঙ্গে সেটা নিয়ে তুমুল কাণ্ড। কারণ কী জানেন? কারণ হচ্ছে একটি অজুহাত খুঁজতে হবে তাই। সারাবিশ্বে এমনকি বাংলাদেশেও সকল সময় তৃতীয় লিঙ্গ অর্থাৎ হিজড়া ছিল, আছে। হঠাৎ পাঠ্যপুস্তকে সেটা তুলে ধরা হয়েছে, কাম সারছে! এখানে সমকামিতাকে উৎসাহিত করা হয়েছে, এটাই সমস্যার কারণ।
মহান সৃষ্টিকর্তাই আমাদেরকে নারী-পুরুষ-হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গ রূপে তৈরি করেছেন। কারো জন্মগত লিঙ্গের ওপর তার নিজের তো কোনো হাত নেই। হিজড়ারা না ছেলে না মেয়ে। তাদের কিছু বৈশিষ্ট ছেলেদের মতো কিছু মেয়েদের মতো। কেউ তাদের ভুল করে মেয়ে মনে করে, কেউ ছেলে মনে করে। ওরা পুরুষের পোশাক পরলে মনে হয় মেয়েলি স্বভাবের পুরুষ। আবার মেয়েদের পোশাক পরলে মনে হয় পুরুষালী স্বভাবের নারী। হিজড়াদের কেউ নিজেকে মেয়ে কেউ নিজেকে ছেলে ভাবতে পছন্দ করে।
আমাদের দেশে হিজড়া শিশুকে বিরূপদৃষ্টিতে দেখা হয়। যে কারণে হিজড়াদের তার নিজ পরিবার সমাজ-লোকলজ্জার ভয়ে সাধারণত ছেলে হিসেবে পরিচয় দিয়ে ছেলের পোশাক পরিধান করায়। এদের মধ্যে কোনো হিজড়া মনে করে সে মেয়ে, কোনো হিজড়া মনে করে সে ছেলে।
এখন সমাজের অতি আবেগী বা অনুভূতিশীল ব্যক্তিবর্গ যদি মর্মাহত হন বা মনে করেন হিজড়াদের কথা পাঠ্যবইয়ে লেখা যাবে না, বাচ্চাদের হিজড়ার কথা বলা ঠিক নয় কারণ হিজড়ার গল্প বাচ্চাদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে। আমার কথা হলো শুধু পাঠ্যবই কেন, পারলে পুরো প্রযুক্তির উপস্থাপনার স্টাইল চেঞ্জ করুন। সেটা কি করা সম্ভব বা পারবেন?
দেখুন কী হচ্ছে বিশ্বে, জ্বালানি তেলের দামসহ আন্তর্জাতিক বাজারে কী দুঃসহ একটা সময় এখন! নিজেসহ চেনা-পরিচিত বিপুল মানুষের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। অনেক দেশের মানুষ সন্তান-পরিজনের মুখে খাবার তুলে দেওয়া, লেখাপড়ার খরচ চালানোসহ কোনো কিছুই কুলিয়ে উঠতে পারছে না। মানুষ ভয়ানক কষ্টে আছে। অন্যদিকে, বন্যার পানির মতো লুটপাটের টাকা জমেছে বড় একটা গোষ্ঠীর পকেটে। তারা সারাদিন চারদিকে শুধু নিজেদের মতো মানুষদেরই দেখে। ফলে এদের ধারণা, চারপাশে শুধু সুখ আর প্রাচুর্যের বন্যা বয়ে যাচ্ছে, যা অনেক মন্ত্রী ও তার পরিষদের বক্তব্য-বিবৃতির মধ্যে আপনি এই গোষ্ঠীর চিন্তার প্রতিফলনই পাবেন।
যুদ্ধ বেধেছে কবে, আর এখন বিশ্বের অনেকের টনক নড়েছে। কারণ অনেক দেশের সরকার একটু একটু করে জ্বালানি খাতকে পরনির্ভরশীল করেছে শুধু একদল ব্যবসায়ী নামে ডাকাতের স্বার্থের কথা চিন্তা করে। পরিস্থিতি যখন শোচনীয় হয়ে উঠেছে, জ্বালানি তেলের দাম একলাফে প্রায় দ্বিগুণ করে দিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ এদের জন্য খুব ভালো একটা ঢালের কাজ করছে। এই তেলের দাম বাড়ানোর ফল হবে- অনেক মানুষ বেঁচেই থাকতে পারবে না। ম্যাক্রো-ইকোনমি হয়তো রক্ষা পাবে; বলা হবে, রিজার্ভ আছে, মাথাপিছু আয় ভালো। আর এটার দায় দিতে হবে সাধারণ মানুষকে। তাদের চামড়া, রক্ত, মাংস চুষে শেষ করে দেওয়া হবে।
এতসব সমস্যার মধ্যেও সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে সপ্তাহ ধরে হয়ে গেল প্রাইড সেলিব্রেশন! অথচ বিশ্বে যুদ্ধ চলছে, মানুষ মরছে, তাতে কার কী যায় আসে! এখন আর আগের মতো কেউ রাস্তায় নামে না; বলে না যে যুদ্ধ বন্ধ করো। অথচ প্রাইড সেলিব্রেশনে শত শত মানুষ। চেয়ে চেয়ে দেখলাম, আমার বলার কিছু ছিল না!
রহমান মৃধা: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। [email protected]
মন্তব্য করুন