বাংলাদেশে উৎসবে একটা সময় পশ্চিমা সংস্কৃতি বলে আমাদের পরিবার ও সমাজে থার্টিফার্স্ট নাইটসহ নানা উদযাপনে আতশবাজি ও ফানুস নিরুৎসাহিত করা হলেও সেই বাস্তবতা এখন আর নেই। সেই বাস্তবতা এখন বিস্মৃতিতে ম্লান হয়ে গেছে, এমন একটি সময়ের জন্য পথ তৈরি করেছে যখন উদযাপনটি সাংস্কৃতিক সীমানা অতিক্রম করে, একটি ধ্বংসাত্মক প্রভাব তৈরি করেছে।
আতশবাজি শুধু মানুষের জন্যই নয়, এটি পশুপাখির জন্যও ভয়ংকর ক্ষতির কারণ। ২০২১ সালে থার্টিফার্স্ট নাইটে আতশবাজি ফোটানোর কারণে ইতালির রোম শহরে কয়েক হাজার পাখি মরে রাস্তায় পড়ে ছিল। এই পাখিগুলো হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছিল আতশবাজির বিকট শব্দের কারণে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা গেছে, ভয়ে বাসাবাড়িতে ঢুকে পড়েছে অনেক পাখি। এতে পাখিদের স্বাভাবিক জীবনক্রিয়া ব্যাহত হয়।
আমাদের দেশের থার্টিফার্স্ট নাইটসহ বিভিন্ন উৎসবে পশুপাখিদের এই আত্মচিৎকার আমরা দেখি। পাখিরা প্রচণ্ড আওয়াজের কারণে ওড়াউড়ি করে এবং গাছে বা ভবনের দেয়ালে আঘাত পেয়ে নিচে পড়ে যায়, ফলে আহত হয় এবং মারাও যায়। রাস্তার কুকুর-বিড়াল, গৃহস্থালি প্রাণী এমনকি বন্যপ্রাণীরাও শব্দের কারণে ভয়ে বিভ্রান্ত হয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে গিয়ে মারা যাচ্ছে।
আতশবাজির ব্যবহার পরিবেশের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলছে তা চিন্তা করা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আতশবাজি সাধারণভাবেই পরিবেশের জন্য বেশ ক্ষতিকর। এর ফলে অধিক পরিমাণে বায়ু ও শব্দ দূষণ ঘটে। বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর গবেষণা দল গত ৭ বছরব্যাপী (৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ থেকে ১ জানুয়ারি ২০২৪) ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে বায়ু ও শব্দদূষণের তীব্রতা পর্যবেক্ষণ করে আসছে। গবেষণায় দেখা যায়, ডিসেম্বরের শেষদিনের তুলনায় জানুয়ারি মাসের প্রথম দিনের বায়ুমান অনেক বেশি খারাপ থাকে। উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৩১ ডিসেম্বরের থেকে ১ জানুয়ারি বায়ুমান সূচক সর্বনিম্ন ৬ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৬৬ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল। গবেষণায় আরও দেখা যায়, পটকা-আতশবাজি ইত্যাদি ফুটানোর ফলে শব্দের তীব্রতা সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, বর্ষবরণের পটকা-আতশবাজি থেকে উৎপন্ন শব্দের মাত্রা পূর্বের দিনের তুলনায় সর্বনিম্ন ৪৬ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১১৩ শতাংশ পর্যন্ত বেশি হয়ে থাকে।
আতশবাজির শব্দের জন্য প্রাণী ছাড়াও শিশু, বয়স্ক, গর্ভবতী মা এবং রোগীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়। আমাদের দেশেই বর্ষবরণের বাজির শব্দে ২০২২ সালে শিশুর প্রাণহানি ঘটেছে। এ ছাড়াও উচ্চশব্দের কারণে অনেকেই হার্ট অ্যাটাক করেন এবং অসুস্থ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। এছাড়াও আতশবাজি ও ফানুস উড়িয়ে পুরোনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করতে গিয়ে ২০২৩ সালের শুরুতেই সারা দেশ থেকে ২০০ স্থান থেকে আগুনের সংবাদ পেয়েছিল জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ ও ফায়ার সার্ভিস।
এ ছাড়াও আতশবাজিতে ব্যবহৃত সালফার পুড়ে (অক্সিজেনের সঙ্গে দহন বিক্রিয়া করে) সালফার ডাই-অক্সাইড তৈরি করে যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং অ্যাসিড বৃষ্টির জন্য দায়ী। জার্মান সংবাদ সংস্থা ডয়েচে ভেলের প্রতিবেদন অনুসারে, নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে একরাতে আতশবাজি পোড়ানোর ফলে যে পরিমাণ ধোঁয়া উৎপন্ন হয়, তা এক বছরে যানবাহন কর্তৃক উৎপন্ন ধোঁয়ার সমান। আতশবাজির রঙিন আলো আর শব্দের আড়ালে পড়ে গেছে বিপন্ন এক পরিবেশের ছবি। কিন্তু আলো আর শব্দ হারিয়ে গেলেও পরিবেশের যে বিপর্যয় সাধন হয় তা চিরস্থায়ী।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্দেশনা আর সমাজের বিভিন্ন অংশের অনুরোধ উপেক্ষা করে এবছরও খ্রিষ্টীয় নববর্ষ উদযাপনে ঢাকা শহর ভেসেছে পটকা, আতশবাজি আর ফানুসে। তবে কারও বিরুদ্ধেই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি; কেবল নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দায় সেরেছে পুলিশ। ২০২৪ সালেও উচ্চস্বরে লাউডস্পিকারে গান-বাজনা ও শব্দদূষণসংক্রান্ত সারাদেশে ৯৭১টি অভিযোগ পেয়েছে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯। যার মধ্যে ঢাকা মহানগর এলাকায় ২৩৭টি অভিযোগ পেয়েছে। আতশবাজির যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে যারা অভিযোগ জানিয়েছিলেন তাদের তথ্য মতে পুলিশ সেখানে গেলেও, পেনাল কোডের পাবলিক নুইসন্স বা উৎপাতসংক্রান্ত ধারার আলোকে সেখানে হয়তো অনুষ্ঠান বন্ধ করেছেন কিন্তু আইনে শাস্তি এবং জরিমানার বিধান থাকা সত্ত্বেও কাউকে আইনের আওতায় আনা হয়নি। সে জায়গা থেকেই মানুষ নিষেধাজ্ঞাকে হালকাভাবে নিতে শুরু করেছে বলে ধারণা করা যায়।
সম্প্রীতি বাংলাদেশের পরিবেশবাদী ও প্রাণী অধিকারবিষয়ক কয়েকটি সংগঠন, সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর যথাযথ আইনি পদক্ষেপ ও কার্যকর ভূমিকা চেয়ে রিট আবেদনের করে। গত ২১ জানুয়ারী আতশবাজি ও ফানুস নিয়ন্ত্রণে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর আইনি পদক্ষেপ ও কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণে কর্তৃপক্ষের নিস্ক্রিয়তা কেনো বেআইনি ও আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।
নানা সমস্যা ও ক্ষতির মধ্যেও আতশবাজির ব্যাবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে। সকলের সচেতনতা এবং টেকসই উৎসব উদযাপন পরিকল্পনা করার মাধ্যমে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওা সম্ভব। আমরা চাইব আমাদের উৎসবের সময় চিরকাল স্থায়ী এবং পরিবেশের সংরক্ষণে প্রযুক্তিগত ব্যবহার হোক। একইসাথে, আমরা উৎসবের মাধ্যমে আনন্দ এবং আমাদের পরিবেশের জন্য দায়িত্বশীলভাবে আচরণ করতে চাই। এতে একটি উজ্জ্বল এবং সমৃদ্ধশীল ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হবে এবং পরিবেশ দূষণ মুক্ত হবে।
অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার ও অ্যাডভোকেট রাশেদুজ্জামান মজুমদার : লেখকদ্বয় যথাক্রমে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
মন্তব্য করুন