হোমায়রা আহমেদ
প্রকাশ : ০৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০৫:১১ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
হোমায়রা আহমেদের নিবন্ধ

লাইব্রেরি কথন : ফকিরাপুল থেকে আগারগাঁও

ছবি : সৌজন্য
ছবি : সৌজন্য

লাইব্রেরির সাথে আমার সম্পর্ক শুরু জন্ম থেকেই, আমাদের ফকিরাপুল পানির ট্যাংকির নিচের বিশাল দোতলা বাড়ির প্রতিটি ঘরে ব্যক্তিগত পাঠাগার ছিল। আব্বুরা পাঁচ ভাই, তিন বোন। আমি জন্মাতে জন্মাতে তাদের সাতজনের লেখাপড়া শেষ, বাকি কেবল মুন্নি ফুপ্পি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিজ্ঞানে পড়ছেন তখন। তাদের প্রত্যেকের পাঠাভ্যাস আলাদা, আর তাই ব্যক্তিগত বইয়ের সংগ্রহে একেবারে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ।

ছোটবেলা থেকে ভয়ংকর চঞ্চল আমি বাসায় তখনো একমাত্র শিশু সকলের জ্যান্ত পুতুল। ১০ বছর আর ৭ বছরের বড় চাচাতো বোন আর ভাই তো বটেই- কেউই কোল থেকে নামায় না। কিন্তু খাওয়াতে পারে না কেউই বই পড়ে না শোনালে, আর তাই হাট্টিমাটিম থেকে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার হয়ে সুকুমার রায় শোনানো হয়ে গিয়েছে বয়স এক পেরোনোর আগেই।

তখন স্মার্টফোনের যুগ নয়, একটা মাত্র টিভি চ্যানেল বিটিভির অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু হয় বিকেল ৫টায়। ভাত ঘুম সেরে তখন মাত্র জেগে উঠেছেন চাচি-ফুপুরা। তবু ওই বইপড়া আর সকলের ছড়া কাটা শুনতে শুনতে মাত্র আট মাস বয়সে পূর্ণ বাক্যে কথা বলা শিখে গেলাম আমি। কোনো স্পিচ থেরাপি দিয়ে আমাদের যুগে বাচ্চাদের কথা শেখাতে হতো না, যৌথ পরিবার আর লাইব্রেরির সুবাদে। যৌথ পরিবারটা বোধ করি আর ফিরিয়ে আনবার সুযোগ নেই, কিন্তু লাইব্রেরিটা খুব সহজেই পরিবারে স্থান করে নিতে পারে আজও।

আমি ইংরেজি মাধ্যমে স্কুল জীবন শুরু করেছিলাম। তার মাত্র ৬ মাস বাদেই বাংলা মাধ্যমে শিফট করে যাই ঢাকার সবচেয়ে নামি দুটো মেয়েদের স্কুলের একটায়। বড় বোন (চাচাতো) সে স্কুলেই পড়তেন। সেবার এস এস সি দেবেন আর আমি ওয়ানে। এক সাথে স্কুলে যাই, আর আমি দৌড়ে সিনিয়র থেকে তেপান্তরের মাঠ (ভিকারুননিসা নূন স্কুলের মূল খেলার মাঠ) পেরিয়ে ঠিক সময়ে অ্যাসেম্বলি ধরার চেষ্টা করি।

মাঝে মাঝে উঁকি দেই স্কুলের মূল অডিটোরিয়ামের আগে কমনরুমের ঘরটায়, ওটা লাইব্রেরি। আমাদের শুকনো মতন মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পড়া একটু খিটখিটে লাইব্রেরি আপা তাতে অহর্নিশি কিছু না কিছু পড়ছেন।

সপ্তাহে একদিন এক ঘণ্টা করে লাইব্রেরি ক্লাস ছিল আমাদের। সম্ভবত, বৃহঃস্পতিবার শেষের দিকের টিফিনের পরের একটা বা দুটো পিরিয়ড। লাইব্রেরি আপা সেশনের প্রথম ক্লাসে জানতে চাইলেন, জাতীয় টেলিভিশন ভবন কোথায়। সবাই জানি সেটা, রামপুরায় টিভি সেন্টার। তারপরে, জিজ্ঞেস করলেন পাবলিক লাইব্রেরি কোথায়। এবার কবি নীরব টাইপ আমি ভূতপূর্ব বান্ধবী মুনমুনের দিকে তাকালাম ও উত্তর দিল, শিশুপার্কের পরে, জায়গার নাম জানি না। লাইব্রেরি আপা বলে দিলেন, শাহবাগ এবং একই সাথে প্রবল বকাঝকা করলেন এ প্রজন্ম কীরকম বখে গিয়েছে দেখে। টিভি সেন্টার সবাই চেনে, রামপুরায় আমরা বিতর্ক করতে যাই, কুইজ আর অনুষ্ঠান করতেও। আর ততদিনে বিটিভির ১৯৮৯ সালের রজতজয়ন্তী হয়ে যাওয়ার সুবাদে সবাই আরও বেশি করে সেটা চেনে।

কিন্তু সেদিনের সেই বকাটার সুবাদে শাহবাগের নাম কেবল নয়, জাতীয় গ্রন্থাগারও চেনা হয়েছিল। স্কুল থেকে নিয়ে যাওয়া হত আমাদের সেখানে পরে বিতর্ক, স্কুল-কলেজ- এমনকি আন্তর্জাতিক অনেক প্রতিযোগিতার জন্য তথ্য খুঁজতেও আমাদের যেতে হয়েছে সেখানে। যদিও স্বীকার করছি, লাইব্রেরির ভেতরের বদলে তার সিঁড়িতেই গ্রুপ স্টাডি ও আড্ডা দুটোই বেশি হয়েছে। কিন্তু পাবলিক লাইব্রেরির মিলনায়তনে যেসব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র বা নাট্য প্রদর্শনী হত- সেগুলো দেখে মনের আকাশটা বড় করবার রুচিও তৈরি করে দিয়েছিল ওই লাইব্রেরির আবহই।

আমাদের সময়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা এত বহুল প্রচলিত বা জনপ্রিয় ছিল না। মুষ্টিমেয় উচ্চবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা তাতে পড়ত, কিন্তু ইংরেজি গল্পের বই আর কমিক্স পড়বার চল ছিল খুব। বইগুলো নিউমার্কেট বা নীলক্ষেতে আর প্রেস ক্লাবের উল্টোদিকে অথবা বায়তুল মোকাররমের পুরোনো বইয়ের দোকানে পাওয়া যেত বটে, কিন্তু নতুন বইগুলোর দাম ছিল অনেক। মধ্যবিত্ত একক আয়ের সংসারে সেগুলো কিনে পড়বার বিলাসিতা করতে পারত কম মানুষ। তাই আমরাও আমাদের মা-বাবার মতোই ব্রিটিশ কাউন্সিল আর আমেরিকান সেন্টার (তৎকালীন ইউসিস) লাইব্রেরির মেম্বার ছিলাম। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তখনো অত বিপুল কলেবরে তৈরি হয়নি, ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরিগুলোর পরিসরও তখন কম, এলাকাভিত্তিক বই বিলি হয়। কী যে সব বই- দেখলে জিভে পানি চলে আসে। আমার বই প্রীতি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বলে আম্মু-আব্বুর কাছ থেকে বকা খাবার প্রশ্নই ওঠে না।

চারটে করে বই আনতে দিত ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে - পরে ৬টা এক সপ্তাহের মাঝে পড়া শেষ হয়ে যেত সেগুলো। পরের সপ্তাহে আবার চারটে। আমি মিলস অ্যান্ড বুনস পড়িনি ছেলেবেলায় কখনো, পড়েছি বড় হয়ে পিএইচডি করছি যখন নর্দান আয়ারল্যান্ডে তখন; কিন্তু এনিড ব্লাইটন অ্যাডভেঞ্চার সিরিজ আর সব রহস্য রোমাঞ্চ পড়ে শেষ করে ফেলেছি স্কুল জীবনেই।

আশির দশকে বা নব্বইয়ের শুরুতে অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং বা কমপ্লেক্স কোনোটাই চালু হয়নি তেমন ঢাকায়, কিন্তু কলোনি ছিল অনেক। ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের উল্টোদিকে ইস্টার্ন হাউজিংয়ের যে কমপ্লেক্স ছিল আর তার প্রায় পাশে যে বোম্বে কলোনি ছিল তার প্রথমটাতে চাচারা বাসা নিলেন আর পরেরটাতে ছিল বেশ কয়েকজন বান্ধবীর বাসা। তখন কলোনিগুলোতেও একটা করে লাইব্রেরি থাকত আর তাতে থাকত লোভনীয় সব দামি দামি গল্পের বই, যেগুলো সব কিনে পড়া আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। খুব চাহিদা ছিল সেসব বইয়ের। পছন্দের বইটা কে আগে নিয়েছে জানতে পারলে আর সে দিতে দেরি করলে রীতিমতো ঝগড়াঝাঁটি লেগে যেত। আমার এমনিতে অতি দুষ্টু আর চঞ্চল চাচাতো বোন, যে কি না আবার আমার এক বছর পাঁচ মাসের ছোট আর পড়ে দুক্লাস নিচে, সে হঠাৎ দেখি আমার চাইতে বেশি বই পড়ে ফেলেছে। পরে দেখি সেগুলো ওই লাইব্রেরির। এদিকে নিজের বই না হলে আমি ঠিক পড়ে জুত পাই না, কিন্তু ও আমার থেকে বেশি মজার মজার গল্প পড়ে ফেলেছে বলে আমার তো মন নিশপিশ করছে। তখন আম্মু আমাকে বোঝালো, সব বই তো কিনে পড়া সম্ভব নয়। সেই প্রথম আসলে আমার মাথায় ঢুকেছিল, লাইব্রেরির বই কেন এত গুরুত্বপূর্ণ।

আনাতোল ফ্রাঁসের মতো মধুমক্ষিকা এবং মক্ষিকার মতো পুঞ্জাক্ষি পাবার আর কোনো উপায় নেই আসলে ঠিক যেমনটা সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন। আর বইয়ের গুরুত্ব বোধ করি যাদের কিনবার ইচ্ছে আছে, কিন্তু সামর্থ্য নেই তারা বাদে আর কেউ তেমন করে বোঝে না আর তারা যদি আমার মতো ভিক্ষেজীবী (আমি এ বছর বই ভিক্ষে করেছি কারণ কিনবার টাকা নেই) না হয়ে আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মানুষ হয়ে থাকে, তবে লাইব্রেরি তার দ্বিতীয় ঠিকানা হতে বাধ্য। কাজেই আমার জীবনে লাইব্রেরি প্রায় প্রথম প্রেমের মতো সুন্দর হয়ে উঠল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময় যেহেতু বাড়িতে অর্থনীতিবিদ আরও ছিলেন এবং যেহেতু স্কুল-কলেজের সিনিয়র আপু-ভাইয়ারাও তাদের পুরোনো বই দিয়ে দিতে আগ্রহী ছিলেন, হলে বা বাসায় স্থান সংকুলানের অভাবে- তাই আমি নিজেই একটা বিষয়ভিত্তিক ব্যক্তিগত লাইব্রেরি গড়ে তুলবার সুযোগ পেয়েছিলাম। আর এশিয়া ফাউন্ডেশনে পাওয়া যেত অরিজিনাল পাঠ্যবই। সেখান থেকেও অনেক বই সংগ্রহ করেছি। নীলক্ষেতে শিক্ষকরা বাদে একমাত্র আমিই যে ফটোকপির পাশাপাশি মূল বই কিনি, তা মোটামুটি প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল। তবে যখন পুরোনো এডিশন বা কোনো দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থের প্রয়োজন পড়ত, তখন লাইব্রেরি ছাড়া কোনো গতি ছিল না। আর এ লাইব্রেরির সুবাদেই আমার বর্তমান কর্মস্থলে আমার আগমন আর আমার গবেষক হিসেবে আগ্রহের সূচনা।

আগেই বলেছি, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরকৌশল বিভাগের নিয়মিত ক্লাস শুরু করার আগেই যেহেতু স্কুলের বন্ধুদের সাথে ঢাবির অর্থনীতি বিভাগের ক্লাস করতে শুরু করেছি এবং বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী হওয়ায় নিজেকে বকলম মনে হচ্ছে, তাই তখন কাজে এল খালাতো ভাইদের তাত্ত্বিক অর্থনীতি আর সমাজতত্ত্বের ওপরের বিশাল সংগ্রহ। অধ্যাপক আবুল বারকাতের রাজনৈতিক অর্থনীতির ক্লাসে তাই শহীদ জননী জাহানারা ইমামের জ্যেষ্ঠ পুত্র রুমীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ‘দাস ক্যাপিটাল’ আর আস্ত মার্কস-অ্যাঙ্গেলস পড়ে ফেললাম। ফ্রাঙ্কো মডিগ্লিয়েনি ১৯৯৯ সালে আমাদের ক্লাস শুরু আগে সদ্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। অধ্যাপক হারুনুর রশীদ পড়ানো শুরু করেছেন তার ফাইন্যান্সিয়াল ইকোনমিকস। আমাদের স্কুলের বড় বোন নাইমা নুসরাত চৌধুরী ডিপার্টমেন্ট থেকে অনার্স-মাস্টার্সে ফার্স্ট হয়ে তখন মাত্র ঢুকলেন শিক্ষক হিসেবে এবং গাণিতিক অর্থনীতি পড়ানো শুরু করলেন। অধ্যাপক ফরিদ উদ্দীন আহমেদের পরিসংখ্যান আমার হায়ার সেকেন্ডারিতে জীববিজ্ঞান থাকবার কারণে হিব্রু ভাষা মনে হতো। কিন্তু জীবনে প্রথম অঙ্ক ক্লাসে মনে হলো, ধড়ে প্রাণ ফিরে পেলাম- কিছু ভাষা বুঝি তার।

আমাদের ব্যাচের সৌভাগ্য যে ১৩ বছর অস্ট্রেলিয়ায় কীভাবে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের কাছে অর্থনীতিকে পাঠ্য বিষয় হিসেবে আকর্ষণীয় করে তোলা যায়, তা নিয়ে গবেষণা করে অধ্যাপক কামরুন নাহার তাসলিম এবং অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী তাসলিম তখন মাত্র দেশে ফিরেছেন। এই দম্পতি আমাদের বিভাগে যোগদান করে যেন ডিপার্টমেন্টকেই দত্তক নিলেন। ঢেলে সাজালেন কিছু নীতি। যাতে অন্তর্ভুক্ত হলো একটি কম্পিউটার ল্যাব আর ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতি তারা আমাদের যত্ন নিয়ে পড়ালেন। লাইব্রেরি কখন লিখতে গিয়ে সবিস্তারে আমাদের শিক্ষকদের কথা লেখা এজন্য যে তাদের নিজেদের ক্রমান্বয়ে নিজেদের ও শিক্ষার্থীদের পড়বার, জানবার ও গড়বার অনুসন্ধিৎসা এবং নিষ্ঠা না থাকলে অন্তত: আমার কখনো অর্থশাস্ত্র পড়ার নেশা তৈরি হতো না। যে বিষয়টিকে শৈশব থেকে আমার কেবল দুর্বোধ্য নিষ্ফল বাক্যালাপ মনে হতো, তাকেই এবং তারও একেবারে কাঠখোট্টা তাত্ত্বিক (গাণিতিক নয়) অর্থনীতির দিকটির প্রতি আমার ব্যক্তিগত আকর্ষণ তৈরি করার পেছনে আমাদের ঢাবি অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষকরা এবং তাদের রেফার করা বিআইডিএস লাইব্রেরির সরাসরি অবদান রয়েছে।

বিআইডিএস তখন আগারগাঁওয়ের যে জায়গায় আছে, তার নাম বিএনপি বাজার নয়- বিএনপি বস্তি ছিল। কলাভবন থেকে বিশ টাকা (সেটা ২০০০ সালে অনেক টাকা। উদাহরণ দেওয়ার জন্য বলছি, সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরের পেছনে থাকা আমার বাসা থেকে ঢাকা ভার্সিটির কলাভবনের রিকশাভাড়া তখন ১০ টাকা মাত্র) রিকশা ভাড়া দিয়ে আসা যায় সেখানে। আমার মোশন সিকনেস থাকায় পাবলিক ট্রান্সপোর্ট কোনোকালেই ব্যবহার করতে পারি না আমি। আর তাই রিকশাই ভরসা।

যারা চেনেন না বা নতুন চেনেন, তারা চিন্তাও করতে পারবেন না কী পরিমাণ সুন্দর ছিল বিআইডিএস ক্যাম্পাস আর কীরকম রূপকথার রাজন্যদের মতো ক্যারিশম্যাটিক ছিলেন তার গবেষকরা। নারনিয়ার জঙ্গলের মতো সবুজ, ক্রীসমাস স্ত্রী ঘেরা চারতলা বিল্ডিং, রাবার স্ত্রী আর চন্দনে সাজানো লন আর অ্যামাজন লিলি, গোলাপ, গাঁদায় শোভিত বাগান। কলাবতীর সুগন্ধ, রঙ্গন আর জবার লাল আর মর্নিং গ্লোরি-মোরগফুল-চন্দ্রমল্লিকার উদ্যানসজ্জার মাঝে হেঁটে বেড়াতেন রহস্যমানব-মানবীরা- যারা আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন, অথচ মাটির মানুষ। যাদের দিকে তাকালে আপনি আনত হয় দৃষ্টি, কিন্তু প্রাণ খুলে একাডেমিক তর্ক করতে বাধে না। যারা নিজেরা বিপুল বলেই জানেন – কেউ বা কোনো নতুনই তুচ্ছ নয়। যারা আপনার ভাবনার সীমানা ছড়িয়ে দেন মহাবিশ্বে - যাতে মহাকাল এসে মেশে তার কালোত্তীর্ণ রহস্য নিয়ে, যে রহস্য সমাজ ও সংসারের দর্শন বা নীতিশাস্ত্র ছাপিয়ে এমন এক সত্যে উত্তরণ ঘটায়, যাতে প্রতিটি বালুকণাই মণিমাণিক্য - অমূল্য।

আমাদের সত্যানুসন্ধানের যে মহাযাত্রার করণ মূলত অর্থনীতি এবং যাতে রয়েছে সমাজবিজ্ঞান, পরিসংখ্যান, গণিত বা নৃতত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা – তাতে নতুন পালক যুক্ত করেছে আমাদের মাস্টার্স প্রোগ্রাম, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সম্পৃক্ত থেকেই একটি বিশ্বমানের ডিগ্রি দেয়। আমাদের দীর্ঘ ৭০ বছরের প্রাথমিক উপাত্ত নির্ভর এবং সেকেন্ডারি উপাত্ত বিশ্লেষণকারী সামাজিক ও নীতি গবেষণার উত্তরাধিকার আমাদের শিক্ষার্থীরা পেয়ে যান বিদগ্ধ ইন-হাউস এবং এক্সটার্নাল ফ্যাকাল্টির মাধ্যমে যারা প্রত্যেকে স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্বনামধন্য কেবল নন, স্বীকৃত এবং সম্ভাবনাময়। মাত্র ৩০টি সিট আছে আমাদের আর এখনো পর্যন্ত মাত্র একটি ব্যাচ বেরিয়েছে (প্রায়)। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ব্যাচ ক্লাস করছে এখন, যারা পাচ্ছেন দেশের বরেণ্য শিক্ষকদের সাথে ক্লাস করবার বিরল সুযোগ।

ঠিক যেমন বলছিলাম, বিআইডিএসের আদি গবেষকদের উপস্থিতিতে আপনিতেই চোখ আনত হয়, কিন্তু ঘাড় বা মাথা নিচু হয় না। যারা আপনাকে আকাশ ছাড়িয়ে মহাশূন্য চিনতে শেখান, কিন্তু শেকড় ভুলতে দেন না। আমাদের দুর্ভাগ্য যে কালের বিবর্তনে সকলের ধারণা, খুব বিরল কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বিআইডিএসে এসে আর গবেষক (Researchers) নেই, আছে কেবল পরামর্শক (Consultant)।

লাইব্রেরিটা এখনো আছে। আর সেখানে আজও নবীন ও প্রবীণ গবেষকরা, পাঁড় পাঠক আর অনুসন্ধিৎসু সমাজবেত্তারা অধ্যয়ন করতে আসেন নিয়মিত। উন্নয়ন অর্থনীতির হাল নাগাদ এবং ক্লাসিক পাঠ্যবই, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তথ্য ও জার্নালের উপাত্ত ছাড়াও আছে সাহিত্য ও সংস্কৃতির সুলিখিত গ্রন্থের এক বিরল সমাহার। আছে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের ইতিহাসবিষয়ক গবেষণা কর্নার, যাতে আপনি পাবেন বঙ্গবন্ধুর লেখা এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা যাবতীয় উল্লেখযোগ্য প্রকাশনার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় এবং জাতীয় ইতিহাসের ওপর রচিত গ্রন্থের সম্ভার। আমাদের দৈনিক পত্রিকার আর্কাইভ ঈর্ষণীয়। তার সাথে রয়েছে আমাদের সব গবেষণা রিপোর্টের এবং মাস্টার্স ও পিএইচডি অভিসন্দর্ভের ঈর্ষণীয় সংগ্রহ।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ঠিক কী কাজ করে আর তার গবেষকরা আসলে কারা, তা নিয়ে অনেকের মনেই রয়েছে এক বহু যুগ ধরে লালিত অস্পষ্টতার কুয়াশা। ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক উম্মা আর বিরূপভাবাপন্ন অনপনীয় অতৃপ্তিজাত বিবমিষা থাকলেও এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে সমগ্র বাংলাদেশে কেবল নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়াতেই একমাত্র বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি আর নীতি গবেষণায় নিঃশর্ত নৈর্ব্যক্তিকতা ধরে রাখতে পেরেছে বিগত সাত দশক ধরে। আর এর অবিমিশ্র অংশ, অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী আর সহায়ক ছিল, আছে এবং থাকবে আমাদের বিআইডিএস লাইব্রেরি।

বর্তমানে অধিকাংশেরও বেশি রিসোর্স ডিজিটাইজ (অটোমেশন) করে ফেলছি আমরা, যার ফলে দেশ-বিদেশের যে কোনো স্থান থেকে আপনি অ্যাক্সেস পাবেন আমাদের রিসোর্সের। আমাদের নিজস্ব ক্যান্টিন এবং উপাসনালয় রয়েছে, যার ফলে দীর্ঘসময় এখানকার রিডাররা স্বাচ্ছন্দ্যে নিজেদের গবেষণা এবং অধ্যয়ন চালিয়ে যেতে পারেন।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নের সাক্ষী বা নীরব দর্শকমাত্র নয়– নীতি গবেষণা, পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন, নির্ণয় আর নতুন নতুন সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, এমনকি সাহিত্য ও সাংস্কৃতি বিবর্তনের গবেষণা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আজও নিরলস আর নিয়মিত পরিশ্রম করে চলেছে। আমাদের লাইব্রেরি আমাদের এ প্রয়াসে আমাদের নিজেদের এবং অনুসন্ধিৎসু পাঠক ও গবেষকদের জন্য একইসাথে বিশ্বস্ত তথ্যভাণ্ডার এবং দিকনির্ণায়ক বাতিঘর। আমাদের এ বাতিঘরে আপনাদের স্বাগতম।

সম্ভবত: আমরা আজ যেমন : আগামীতেও একাডেমিশিয়ান হিসেবে, প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে, নীতি নির্ধারক, পরামর্শক, শিক্ষক বা গবেষক হিসেবে ততটাই দুর্বোধ্য রয়ে যাব সকলের কাছে, যতটা আগেও ছিলাম। তবে আমাদের শ্রম, মেধা, আর কর্মঘণ্টা বিনিয়োগের ফলে ব্যাপ্তির খানিকটার আভাস আপনারা পাবেন আমাদের গ্রন্থাগারে। যারা আজও তাতে খানিকটা অগ্রহ রাখেন, তাদের বিআইডিএসে স্বাগতম।

হোমায়রা আহমেদ : গবেষক, জনসংখ্যা অধ্যয়ন বিভাগ, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান

**কৃতজ্ঞতা স্বীকার : এ লেখাটি লিখতে এবং একটু দেরি হলেও শেষ করতে উৎসাহ দেওয়ার জন্য প্রাবন্ধিক বিআইডিএস লাইব্রেরির বর্তমান চিফ লাইব্রেরিয়ান ড. দিলরুবা মাহবুবার কাছে কৃতজ্ঞ। একই সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যয়নরত অবস্থায় এ লাইব্রেরিতে অধ্যয়ন ও গবেষণার সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করবার জন্য তৎকালীন চিফ লাইব্রেরিয়ান নীলুফার ইয়াসমিন আপা এবং তাদের নিজস্ব কার্ডে নিয়মিত বই ধার দেওয়ার জন্য বিআইডিএসের জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো ড. চৌধুরী আনোয়ারুজ্জামান এবং ড. সালমা চৌধুরী জহিরের কাছে সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

প্রধান উপদেষ্টার / সহকারী প্রেস সচিব হলেন দুই তরুণ সাংবাদিক

শিক্ষকদের দ্বন্দ্ব, শিক্ষাব্যবস্থায় অচলাবস্তা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে ধুম্রজাল

গণপিটুনির ঘটনায় / জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার

জন্মাষ্টমীর শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন তারেক রহমান

বিশেষ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিচার দাবি লায়ন ফারুকের

জাবিতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে হত্যা, এক সমন্বয়ককে অব্যাহতি

ড. ইউনূসকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের

মাদারীপুরে কৃষককে পিটিয়ে হত্যায় মানববন্ধন

জাতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন গ্রিডের টাওয়ার পদ্মায় বিলীন

১০

দীঘিনালায় দুপক্ষের সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ

১১

তিন মাস ধরে ১৪০০ চা শ্রমিকের মজুরি বন্ধ

১২

নীতিমালার খসড়া অনুমোদন / সম্পদের হিসাব দিতে হবে উপদেষ্টাদেরও

১৩

জাতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন গ্রিডের টাওয়ার পদ্মায় বিলীন

১৪

বিটকয়েনে বার্গারের দাম পরিশোধ করলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প

১৫

ডেঙ্গুতে আরও ৩ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৮৮৭

১৬

চর দখলের মতো সাংবাদিক সংগঠনগুলো নিয়ন্ত্রণের অপচেষ্টা চলছে : শওকত মাহমুদ

১৭

নেতাকর্মীদের জরুরি নির্দেশনা দিল আ.লীগ

১৮

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের নির্মাণসামগ্রী ও গবাদিপশু দিল বিএনপি

১৯

ছেলে নিহতের চার ঘণ্টা পর মারা গেলেন বাবা

২০
X