আমলাতন্ত্র এখন আর জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারছে না এমন একটা হাওয়া ইতোমধ্যেই সত্য-মিথ্যার বাতাবরণে চাউর হয়ে গেছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগে এখন সব কিছুই মোবাইলের ভয়েস রেকর্ডারে বা ভিডিও ক্লিকে চাক্ষুষ হচ্ছে। আবার কিছু কিছু ঘটনা ফেনিয়ে তোলাও হচ্ছে। বলাচলে আমলাতন্ত্র এখন সর্বসময়ের মধ্যে ক্রান্তিকাল অতিবাহিত করছে। মিডিয়াজুড়েও এখন হট টপিক হিসেবে দুর্দশাগ্রস্ত আমলাতন্ত্রের বেসুরো কোরাস নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে সেবা প্রদানের করুণ চিত্র দেখে সকলের মানসপটে আমলাতন্ত্র সম্মন্ধে যে একটা নেতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠেছে- এটা অনস্বীকার্য বাস্তব। এর সঙ্গে অন্তঃ, আন্তঃ ও বহির্গত অনেক ফ্যাক্টর সংশ্লিষ্ট।
আমলাতন্ত্রের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে জনগণের কাছে সেবা-সুবিধাকে আয়াসলব্ধ করতে না পারা। দুর্নীতি এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। এর সাথে রয়েছে অভ্যন্তরীণ সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারা। রয়েছে স্বজনপ্রীতি, দুর্জন তোষণ, শিষ্টের দমন ও ‘কিছুই হয় না’ জাতীয় বেপরোয়া সংস্কৃতির বিস্তার ও পৃষ্ঠপোষকতা। রয়েছে মেধা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন না হওয়া জনিত হতাশা।
পক্ষান্তরে অযোগ্যদের পদোন্নতি ও চিত্তাকর্ষক পদে পদায়ন ও তাদের আস্ফালনে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের মতো গুরুতর অপরাধমূলক কর্ম। আরও রয়েছে নিজ দায় অন্যের ঘাড়ে চাপানোর প্রবণতা, যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে তার লেজুড়বৃত্তি ও প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক সিন্ডিকেটের খায়েস পূরণ। যার ফলে আমলাতন্ত্র ইমেজ সৃষ্টিকারী কোনো উদাহরণ হয়ে উঠতে পারেনি। আমাদের খোদ পরিকল্পনামন্ত্রীও বেশ কিছুদিন আগেই প্রকাশ্যে বলেছেন ক্যাডার সার্ভিসের কোনো প্রয়োজন নেই। অথচ তিনি নিজেও আমলাতন্ত্রের মধ্যে ছিলেন যুগের পর যুগ। ছিলেন প্রশাসনের বড় বড় আসনে। তার এই কথনে অপরাপর জনগোষ্ঠী ওম পেয়েছে। আমলাতন্ত্র পড়েছে এতিমের মতো অসহায় অবস্থায়।
সরকারি দপ্তরে সেবা প্রদানই যদি হয় শেষ কথা তাহলে এর জন্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীই দায়ী এরকম সরল অঙ্ক সমাজ মানসে আজ বদ্ধমূল হয়ে আছে। আর এটাই মোটা দাগে সত্য। এর নেপথ্যে কত শত কারণ, কত ধ্যান-ধান্ধা, অঙ্ক আর-টঙ্ক জড়িয়ে আছে জনগণ তা জানতে চায় না। তারা চায় ‘সেবা’। সেটা অবশ্যই তাদের ন্যায্যপ্রত্যাশা। কিন্তু তাই বলে মাথাব্যথা হওয়ায় মাথা কেটে ফেলে নিষ্কৃতি লাভের উপায় খোঁজা কি যৌক্তিক না কি বাস্তব?
এদেশের প্রশাসনকে শেষ করে দেওয়ার খায়েস অনেক আগে থেকেই এক শ্রেণির লোকের মাঝে ক্রিয়াশীল ছিল। ব্রিটিশ উত্তরকাল থেকেই এদেশের ‘প্রগতিশীল’ নামধারী এক শ্রেণির শিক্ষিত মানুষ ইনিয়ে-বিনিয়ে-ফেনিয়ে প্রশাসনকে চিত্রিত করতে সচেষ্ট ছিলেন কখনো খল নায়ক হিসেবে, কখনো প্রগতির প্রতিবন্ধক হিসেবে, কখনো বুর্জোয়া শ্রেণির দাসানুদাস হিসেবে আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জনবিরোধী শাসক হিসেবে।
ব্রিটিশ উত্তর প্রশাসন গড়ে উঠে মূলত- আইসিএস ও তাদের অধীনে কর্মরত কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে। ব্রিটিশবিরোধী প্রচারণার আদলে এইসব কর্মকর্তাদেরও ব্রিটিশ রাজের প্রতিভূ হিসেবে ধরে নিয়ে এর কপালে ‘আমলা’ তকমা সেঁটে দিয়ে প্রকারান্তরে ‘কামলা’, ‘ঝামেলা’ হিসেবে পৌনঃপুনিক প্রচারে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়েছে। সাতচল্লিশ উত্তর সদ্যস্নাত সিএসপিরাও এই শ্রেণির কাছ থেকে পৃষ্ঠপোষকতা পায় নি বরং পেয়েছে ঘৃণা ও মশকরা। এদের অবদানকে কখনোই গ্লোরিফাই করা হয় নি। অথচ এদের কৃপা ও অর্থানুকূল্যে তেলে-মেদে স্থুলকায় ও চকচকে সোহাগ চান বদন রূপ পরিগ্রহ করেছে অনেকেই।
এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ছিল বুদ্ধিজীবী শ্রেণি। যুগ পরম্পরায় শিক্ষা-সভ্যতার শ্রী বৃদ্ধি হয়েছে, শহুরে সমাজ জমাট বাঁধতে শুরু করেছে, বিজ্ঞানের অগ্রযাাত্রায় আধুনিক জীবনোপকরণের স্বাদ আস্বাদন করা শুরু হয়েছে। কিন্তু আধুনিক মনষ্ক নাগরিক সমাজ গড়ে ওঠেনি।
ব্রিটিশ এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী-পরবর্তী প্রজন্মকে যথাযথ দীক্ষা দান করতে পারে নি। ফলত- এস্টাবলিশমেন্টবিরোধী সেন্টিমেন্টকে পুঁজি করে এক শ্রেণির শিক্ষিত, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, তথাকথিত প্রতিবাদী ও উন্নাসিক শ্রেণির উত্থান হয়। যাদের নাসিকা সমাজের ও রাষ্ট্রের তাবত কুঠুরিতে উঁকি দিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে আর ছিদ্রান্বেষণই তাদের কাছে একমাত্র অর্জন বলে আত্মতৃপ্তির উপকরণ হয়ে ওঠে। মজার বিষয় হলো সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রকেও এরা আপন করে নিতে পারেনি। ব্র্রিটিশ রাজের উত্তরাধিকার হিসেবে ও পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর দোসর হিসেবে চিহ্নিত করা ছাড়া তারা একে অন্য কোনো অভিধায় অভিষিক্ত করতে পারেনি। অন্য অর্থে চায়নি। অথচ অনগ্রসর আমাদের এই গাঙ্গেয় অববাহিকায় না ছিল শিক্ষা, না ছিল সভ্যতা, না ছিল উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা।
এরকম এক ব-দ্বীপে একটা শিক্ষিত সমাজ বিনির্মাণে এর অবকাঠামো তৈরি করাই ছিল বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ। দেশ ভাগের পর শিক্ষিত উচ্চবর্ণের হিন্দুরা ওপারে চলে গেলে এই ভূ-ভাগের উন্নয়নের দায়িত্ব পড়ে তখনকার রাজনীতিবিদ, সমাজপতি আর মুষ্টিমেয় শিক্ষিত সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর। আমলা বলে যাকে হেয় জ্ঞান করা হয়, অচ্ছ্যুত জ্ঞানে যাদের উপেক্ষা করা হয় তারাই কিন্তু অক্লেশ পরিশ্রমে এর অবকাঠামো নির্মাণসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বস্ত্র ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠায় ও তার উন্নয়নে কাজ করেছে। দেশের এমন কোনো স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, এতিমখানা, ধর্মীয় উপাসনালয়, ক্লাব, পাঠাগার, খেলার মাঠ, দিঘি, উন্মুক্ত জলাশয়, রাস্তা-ঘাট নেই যেখানে এই আমলাদের (!) পৃষ্ঠপোষকতা এবং ব্যক্তিগত আবেগ ও উদ্যোগ ছিল না। এখনো শতবর্ষী সেসব প্রতিষ্ঠান কালের সাক্ষী হয়ে আছে।
সদ্য স্বাধীন দেশেও আমলাতন্ত্রকে সমহিমায় দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। এক্ষেত্রে সামরিক, বেসামরিক উভয় তরফের একক ও যৌথ প্রয়াস ছিল লক্ষ্যণীয়। এর পেছনে আরও কাজ করেছে বাম ঘরানার বুদ্ধিজীবী আর কৌলিণ্যের আত্মগরিমায় বুঁদ হয়ে থাকা কিছু আঞ্চলিক প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এই শ্রেণিই নানা ভাবে এই আমলাদের কৃপা ধন্য হয়েছে। পদ-পদবিতে, আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি, খেতাব ইত্যাদি প্রাপ্তির মাধমে। আর যে যার মতো করে বৈষয়িক সুবিধা তো নিয়েছেনই। অথচ প্রচার-প্রচারণায় এরাই উত্তর প্রজন্মের কাছে যুগে যুগে ভুল ম্যাসেজ দিয়ে গেছেন।
আমলাদের পিন্ডি চটকিয়ে এক ধরনের আত্মতৃপ্তিতে মশগুল এই শ্রেণি আমলাদের দাঁড় করিয়েছে আপামর জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে। উন্নয়নের অংশী হিসেবে তাদের প্রাপ্য হিস্যাটুকু দিতেও তাদের প্রবল কুণ্ঠা ছিল। আজও সে চিত্রের হেরফের হয়নি। শিক্ষায়তনগুলোতে এন্টি এস্টাবলিশমেন্ট হিসেবে আমলাতন্ত্রকে আজও চিহ্নিত করা হয় খুব নগ্নভাবে। তরুণ প্রজন্মকে এর মাধ্যমে ভুল ম্যাসেজ দেওয়া হচ্ছে। আজকের যে শিক্ষিত তরুণ তারাই কালকের সরকারি কর্মকর্তা। অথচ তাদের আধুনিক মনষ্ক হিসেবে গড়ে তোলার ছবক দেওয়া হচ্ছে না। যে ছাত্রটি সরকারি চাকরির চেষ্টা করছে তাকে দেখা হচ্ছে ভবিষ্যতের দাস হিসেবে। স্বাধীন দেশে এরুপ মানসিকতা নিয়ে আমলাতন্ত্র আর কতদূর এগোবে? অথচ এই আমলাতন্ত্রে ভার্সিটির শিক্ষকরাও এসেছেন, আবার আমলাতন্ত্র ছেড়ে ভার্সিটির শিক্ষকতায় ফিরে গেছেন এমন নজিরও কম না। তাহলে কেন এই অসুস্থ চিন্তা?
যুগোপযোগী একটা স্থায়ী উন্নতমনষ্ক প্রশাসন কাঠামো তৈরি করাতে সুশীল সমাজ, শিক্ষিত শ্রেণি ও বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর অতি অবশ্য করণীয় ছিল অনেক। রাজনীতিবিদদের কথা আলাদা। আগে তবু রাজনীতিকদের কিছু অংশ লেখাপড়ায়, কৌলিণ্যে, আচার-ব্যবহারে, পরিশীলিত জীবনবোধে ও প্রভাব-প্রতিপত্তিতে উজ্জীবিত ছিলেন। নৈতিকতা ছিল তাদের পক্ষে ক্ষুরধার মারণাস্ত্র। রাজনীতিবিদদের মানের পতন আমলাতন্ত্রের আজকের এই অবস্থার জন্য অন্যতম কারণ। শিক্ষা-দীক্ষায় দুর্বল ও নীতি-নৈতিকতায় ক্ষীণ এই সব রাজনীতিবিদরা আমলাতন্ত্রকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে দেয়নি। অসুস্থ সম্পর্ক বজায় রেখে কেবলই দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। আর এমন একটা চিত্র অঙ্কনে চেষ্টা করেছে যাতে করে আপামর জনমানসে ‘আমলাতন্ত্র’ সম্মন্ধে একটা নেগেটিভ তকমা সেঁটে থাকে। বলাবাহুল্য, সেক্ষেত্রে তারা প্রায় শতভাগ সফল হয়েছে। আর এখন তো আদেশানুগ একদল কর্মকর্তা চাহিবামাত্র প্রভুর সেবা প্রদানে ঢেঁড়া পেটাতে মুখিয়ে থাকে। আমলাতন্ত্রের আজকের চিত্র চার পায়া টেবিলের তিন পা ভাঙা সদৃশ। যে পা-টা অক্ষত আছে সেটাও বড্ড নড়বড়ে।
ব্রিটিশ উত্তর বেসামরিক প্রশাসনে সামরিক কর্তৃপক্ষের বারবার হস্তক্ষেপও এই চিত্রটিকে বিবর্ণ করে তুলতে ক্যাটালিস্টের মতো কাজ করেছে। এতে করে রাজনীতি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তেমনি আমলাতন্ত্রও নড়বড়ে অবস্থা থেকে আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি। সর্বত্র আমলাতন্ত্রের অসারতা, দুর্নীতি, লাল ফিতার দৌরাত্ম্য, স্বেচ্ছাচারিতা আর উন্নাসিকতা নিয়ে আলোচনা এখন ছোট-বড় সবারই খাদ্য হয়ে উঠেছে। এখন প্রশ্ন উঠবে আমলারা কী তবে ধোয়া তুলশী পাতা? কক্ষনো না।
আমলাতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এর অসীম ক্ষমতা। আর বহুমুখী সুযোগ। শিক্ষিত আমলাতন্ত্রের লাগাম ধরে রাখার মতো উপযুক্ত রাজনৈতিক নেতার অপর্যাপ্ততাও একটি বড় সমস্যা। অপর্যাপ্ততা ও অদক্ষতার এই মনস্ত¡কে কাজে লাগিয়ে আমলাতন্ত্র কখনো কখনো বেপোরোয়া রূপ পরিগ্রহ করেছে সত্য। আমরাই সেরা, আমরাই সরকার, ক্ষমতা আমাদের কলমে আর মেধার ডগায় - এই ধরনের উন্নাসিকতা তাদের আগেও ছিল আর এখন তো জেঁকেই বসেছে। এ কাজটি সিএসপিরা বেশ দক্ষতা আর দাপটের সাথেই করে গেছেন। এর পরেও ধ্যানে-জ্ঞানে, কীর্তিতে-গাঁথায়, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায়, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তাদের অবদান আজো স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে আছে। সিএসপি উত্তর সেই মানসিকতা আজও স্বল্প মাত্রায় হলেও চলমান রয়েছে। সেই সাথে প্রশাসনে নতুন কর্কট রোগ হিসেবে যুক্ত হয়েছে অন্ধ দলবাজি ও ব্যাক্তি আনুকূল্য। যার ফলে আমলাতন্ত্র হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রের নয়, শাসক গোষ্ঠীর একান্ত বশংবদ।
আমলাতন্ত্রের আগের নিজস্ব মেকানিজম এখন বাইরের শক্তি বলয়ের অনুগামী হয়ে পড়েছে। স্তরভিত্তিক প্রশাসনিক কর্তৃত্ব তাদেরকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারছে না। লেজুড়বৃত্তির কারণে জুনিয়র আর সিনিয়রের মধ্যে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে কে কার ওপর প্রভাবক সেটাই অনেক সময় যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। সরকারি চাকরিতে সিনিয়র কর্তৃক জুনিয়রকে প্রটেকশন দেওয়ার একটি অলিখিত রেওয়াজ সেইফ গার্ড হিসেবে কাজ করত। সেটা গর্হিত কোন কর্মের জন্য নয়। কর্মকর্তার মনোবল দৃঢ় করার জন্য। অধীনস্থদের কর্ম সম্পাদনে সাহস জোগানোর জন্য। এখন প্রটেকশন মানে অধীনস্থর অপকর্মকে আড়াল করে গ্লোরিফাই করা।
বেশ কয়েক বছর ধরে সরকারি দপ্তরগুলোতে বার্ষিক কর্ম সম্পাদন চুক্তি সংক্ষেপে এপিএ চালু রয়েছে। স্বল্প সময়ে কাঙ্ক্ষিত সেবা প্রদান, সেবা প্রদানকারী দপ্তরের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সেবা হস্তান্তরকারী ব্যক্তির নিজের সক্ষমতা বৃদ্ধিও এর উদ্দেশ্য। স্বক্রিয় রয়েছে উদ্ভাবনী কমিটি, নৈতিকতা কমিটি। এগুলোর সুফল যে পাওয়া যাচ্ছে না এমনও না। কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ে এখনো সেবা সহজলভ্য হচ্ছেনা। কী সময়ক্ষেপণে, কী অর্থ অপচয়ে- এ যেন অনেকটা বেশি করে লেবু চিপে তৈরি করা তিতা শরবতের মতো হয়ে পড়েছে। দেশে-বিদেশে কর্মকর্তাদের এখন পর্যাপ্ত প্রক্ষিণ প্রদান করা হচ্ছে। কর্মচারীদেরও আগের তুলনায় অনেক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু জনমানসে তাদের কর্মতৎপরতা ‘সন্তুষ্টি’ অর্জন করতে পারছে না। যার যেখানে থাকার কথা সে সেখানে নেই।
ঘুরে ফিরে গুটিকয়েক ব্যক্তিই প্রতিটি দপ্তরের সব কাজের নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করছে। তারাই এখন একচেটিয়া সুবিধা ভোগ করছে। তাই সার্বিকভাবে প্রতিষ্ঠানকে কেউ নিজের বলে মনে করতে পারছে না বা করছে না। তাই আমলাতন্ত্রের বেসুরো ও অসুর চিত্র প্রায়ই দৃশ্যমান হচ্ছে। প্রাপ্য অধিকার যদি মেধা, যোগ্যতা ও সমতাভিত্তিক না হয় তাহলে এরূপই হওয়ার কথা।
প্রতিষ্ঠানগুলোতে ‘ক্যারিয়ার পাথ’ আছে কিন্তু সেটা কাগজেই। তদারকি ব্যবস্থাও নামকাওয়াস্তে বা দুর্বল। সবাই যেন নিজ নিজ বলয় সৃষ্টি করে কিসের নেশায় কিসের আশায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এ থেকে অতি আবশ্যিকভাবে ফিরে আসতে হবে। অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা কঠোরভাবে প্রতিপালন করতে হবে। যার যে কাজ তাকে দিয়েই করাতে হবে। মেধা ও যোগ্যতাকে অগ্রগণ্য করতে হবে। তবে দক্ষতাকেও সম গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই দেখা যায় কাজের কাজী দু’তিনজন থাকে। বাকিরা সময়মতো এসে সরটুকু তুলে নিয়ে যায়। মূলত- এ থেকেই হতাশার সৃষ্টি। রাজনৈতিক প্রভাব আমাদের প্রশাসন কাঠামোর সাথে অনুঘটক হিসেবে যেন যুক্ত হয়ে গেছে অনেক আগে থেকেই। গণতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোতে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক এজেন্ডা সামষ্টিকভাবে বাস্তবায়নে সরকারি প্রশাসন যন্ত্র বাধ্য। কিন্তু তাই বলে দৈনন্দিন কাজ-কর্মে, পদ-পদবি নির্ধারণে, পদোন্নতি আর পদায়নে এর প্রভাব নেতিবাচক ভূমিকা রাখে। যার শিকার এখনকার আমলাতন্ত্র। কিছু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মনীতি ও শৃঙ্খলার তোয়াক্কা না করে রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে আমন্ত্রণ করে আনে বা তাদের সাথে গাঁটছড়া বাঁধে। রাজনৈতিক নেতারাও এই সুযোগটি ষোল আনা উসুল করে থাকে।
সরকারি কর্মচারীদের জন্য সরকারি কর্মচারী চাকরি বিধি ১৯৭৯ নামে একটি বিধি তথা গাইড লাইন চালু ছিল। সরকারি আইন ২০১৮ প্রণীত হওয়ার পরেও তা বহাল আছে। এতে একজন সরকারি কর্মচারী মূলত- কী কী করতে পারবেন না তা-ই বলা হয়েছে। এই বিধির অনেক ধারারই বাস্তবে প্রয়োগ নেই। আর এই বিধি নিয়ে খোদ সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে হাসাহাসি চলে। এতে বলা হয়েছে কোনো সরকারি কর্মচারী তার চাকরির কোনো বিষয়ে রাজনীতকদের কাছে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের ওপর হস্তক্ষেপের উদ্দেশ্যে দ্বারস্থ হতে পারবে না।
বিধিতে আরও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, কোনো মাননীয় জাতীয় সংসদ সদস্যের কাছেও যেতে পারবে না। অথচ বাস্তবে হচ্ছে কি? কর্মকর্তা -কর্মচারী নির্বিশেষে অনেকেই দ্বারস্থ হচ্ছেন, প্রভাব খাটাচ্ছেন, সুপারিশপত্র সংগ্রহ করছেন। এর মাধ্যমে সুবিধাজনক স্থানে বদলি ও পদোন্নতিও হচ্ছে। অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ এই বিধির নিষেধাজ্ঞা সম্মন্ধে ওয়াকিবহাল হওয়া সত্ত্বেও এগুলো আমলে নিচ্ছেন, অনুমোদন করছেন। ক্ষেত্র বিষেষে উৎসাহিত করছেন। ক্যাডার সার্ভিসের উচ্চতর পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রেও অনুরূপ চর্চা হয়ে থাকে। সুপিরিওর সিলেকশন বোর্ডের রাশভারি কর্তারা এটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনাও করছেন। ফলত- আমলাতন্ত্র কর্মমুখী না হয়ে রাজনৈতিক প্রভুর মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে। আর সে কারণেই সেবা মনষ্ক পেশাভিত্তিক কোনো তাড়না কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে কাজ করে না। আর এভাবেই আমলাতন্ত্র নখ-দন্তহীন কাগুজে বাঘে পরিণত হয়েছে।
আমরা কথায় কথায় ভারতের উদাহরণ টানি। ভারত বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ। সেখানেও আমলাতন্ত্র আছে। বলাবাহুল্য সেখানকার আমলাতন্ত্র ‘স্টেনলেস স্টিলে’র মতো শক্ত অবস্থান বজায় রেখেছে। এতে করে সেখানে রাজনৈতিক শক্তি বলয়ের সাথে তাদের লড়াইয়ের মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। আমাদের বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত শ্রেণি ‘আমলা’ বলে আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের যে তাচ্ছিল্য বা ব্যাঙ্গ করে থাকেন তারা কী ভারতের ব্রিটিশ রাজের যথার্থ উত্তরাধিকার আইসিএসদের দাপটের কথা শুনেননি? কার্যনির্বাহকের কাজে বাধা দিলে, তাকে অবমাননা করা হলে, তার অবস্থানকে অবমূল্যায়ন করলে এবং সর্বোপরি ক্রীতদাস বলে গণ্য করলে উন্নয়ন প্রতি পদে পদে বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য। এতে করে প্রশাসনিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়বে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে হতাশাজনিত কর্মবিমুখতা সৃষ্টি হবে। এই সুযোগের অপেক্ষাতেই থাকে বিশেষ শ্রেণি ও গোষ্ঠী। দুর্জনের আঁতাত বড় শক্তিশালী। আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা এখন এই দুর্জন আর দুর্বৃত্তদের খপ্পরে পড়েছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে হবে, বহিরাঙ্গণের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। দুর্নীতি প্রশমনে কঠোর অবস্থান নিতে হবে এবং তা দৃষ্টান্তমূলক হতে হবে।
বুদ্ধিজীবী শ্রেণি ও শিক্ষিত সমাজকেও বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিপক্ষ হিসেবে নয় আমলাতন্ত্র ও এতে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেখতে হবে পরিপূরক সহকর্মী হিসেবে। রাজনৈতিক নেতৃত্বকেও এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে। না হলে বেপোরোয়া, দুর্বল ও অযোগ্য আমলাতন্ত্র কখন কার ওপর চড়াও হয়ে কোনো আচরণ করে বসবে তা অনুমান করাও দুরূহ হয়ে পড়বে। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমলাতন্ত্রের হিস্যা যথাযথ মূল্যায়নে এনে একে যথোপযুক্ত প্রতিপালনের দিকে আরও বেশি মনযোগী হতে হবে। রাজনীতি আর আমলাতন্ত্রকে পরস্পরের গ্ল্যাডিয়েটর ভাবলে চলবে না। বরং উভয়ই উন্নয়ন অভিলাষী শেরপা। আর তা না হলে সব বাদ দিয়ে আসুন সবাই মিলে আমলাতন্ত্রকে শেষ করে দেই।
আনোয়ার হাকিম : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
মন্তব্য করুন