মাসুমা সিদ্দিকা
প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০১:২৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

‘নিরাপদ মাতৃ স্তন্যদানের অধিকারের সুরক্ষা’

ছবি : সৌজন্য
ছবি : সৌজন্য

মাতৃদুগ্ধ পানের অধিকার নিয়েই প্রতিটা বাচ্চা জন্মায়। কিন্তু অনেক সময় মাতৃদুগ্ধদানের পানের জন্য সমাজ থেকে উৎসাহব্যঞ্জক পরিবেশ না থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই সেই নবজাতক শিশু তার জন্ম থেকেই বঞ্চিত হয় আমাদের দেশে। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, স্তন্যদানের মাধ্যমে মায়ের সঙ্গে শিশুর এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক স্থাপন হয়। বিভিন্ন ধর্মেও সন্তানকে মাতৃদুগ্ধ পান করানোকে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। বাংলাদেশে অনেক মেয়েরাই তাদের ঋতুবর্তীকালীন সময়ে যেমন এক স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া নিয়ে অকারণ অস্বস্তিতে থাকেন, লজ্জার মধ্যে থেকে নিজেদের গুটিয়ে রাখেন, তেমনি মায়েরা তাদের কোলের বাচ্চাটাকে স্তন্যদান করার ব্যাপারে অনেক লজ্জায় থাকেন যথাযথ পরিবেশের অভাবে।

আমি আমার অস্ট্রেলিয়ার প্রবাস জীবনে দেখে এসেছি প্রতিটি শপিং সেন্টারে, বিনোদনের জায়গায়, পাবলিক প্লেসে কিছুদূর পরপর ওয়াশরুমের সঙ্গে সঙ্গে ব্রেস্ট ফিডিং এর রুম থাকতে। ওখানে মহিলারা যেমন তাদের স্তন্যদানের ব্যাপারটাকে স্বাভাবিকভাবে নিয়েছেন, সে রকম তারা স্তন্যদানের ক্ষেত্রেও তারা কাজটি করে থাকেন গর্বের সঙ্গেই। নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন যেমন একটি অত্যন্ত উন্নত দেশের সরকারপ্রধান হিসেবে দেশ পরিচালনা করার সময়ও তার শিশুসন্তানকে সময় দিতে, ব্রেস্ট ফিডিং করাতে যথাযথ সময় দিয়েছেন। তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তার শিশু সন্তানকেসহ যোগ দিয়েছেন। আর তার এই কাজকে সবাই উৎসাহ দিয়েছেন, এ নিয়ে কোনো সমালোচনা হয়নি।

চাকরিজীবী নারী হোক, কিংবা গৃহিণী হোক বাইরে বেরোতেই হয় কোনো না কোনো কাজে সব নারীকেই। কিন্তু ছোট বাচ্চাকে দুগ্ধদানের উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় অনেক মহিলারাই বাইরে বেরোতে স্বচ্ছন্দবোধ করেন না; আর বের হলেও তারা বাচ্চাদের ফর্মুলা দেবার জন্য রেডি রাখেন। আর এটা তো আজকাল প্রায় সব চিকিৎসক প্রায় বলেন যে, নেহায়েত বাধ্য না হলে ছয় মাস বয়সের নিচে শিশুকে ফর্মুলা বা অন্য কোন খাবার খাওয়ানো উচিত নয়। তারা নিরুপায় হয়েই এই কাজটি করেন। কারণ আমাদের দেশে দুগ্ধদানের জন্য আলাদা ব্যবস্থা অনেকাংশেই নেই।

যদিও কিছু বড় বড় প্রতিষ্ঠানে, প্রধানের আলাদা ব্যবস্থা দেখেছি বটে কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই সীমিত। কেননা সবাই তো আর বড় বড় শপিংমলে যেতে পারেন না। একজন মা হিসেবে আমি আমার বাচ্চাদের দুগ্ধপানের সময়টা যেভাবেই হোক ব্যবস্থা করে ফেলেছিলাম, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। যদি উপযুক্ত পরিবেশ না পেতাম তবে দূরে কোথাও গিয়ে হলেও আমার বাচ্চাকে সেই পরিবেশটা দেওয়ার চেষ্টা করে গেছি। কতটা অস্বস্তিকর কষ্টদায়ক পরিবেশের মধ্য দিয়ে, ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনো অতিউৎসাহী দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে- সেই সময়টা যে পেরিয়ে এসেছি তা বলাবাহুল্য। আর তাই আজ যখন দেশের বিভিন্ন সেক্টরে অর্থনৈতিক উন্নতির ছোঁয়া লেগেছে, সবকিছু ‘ডিজিটাল’ হচ্ছে, তখন নবজাতক যে শিশুরা আজ জন্ম নিচ্ছে যারা ভবিষ্যতের কর্নধার হবে তাদের সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য এত জরুরি যে ব্যবস্থা তাদের দুগ্ধদানের ব্যবস্থা করা। আমরা কি এটুকু করতে পারি না যে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে, প্রত্যেক বড় বড় জনসমাগম হয় এমন স্থানে আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা করা হোক। একটি সত্যিকারের উন্নত সমৃদ্ধ জাতি হতে হলে শুধু রাস্তাঘাটের চাকচিক্য, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নয়, শিশু এবং মায়ের চিরন্তন অধিকারের প্রতিও অনেক বেশি সংবেদনশীলতা থাকতে হবে।

একজন মা যখন তার বাচ্চাকে ব্রেস্ট ফিডিং করানোর মতো উপযুক্ত পরিবেশ পান না তখন তিনিই বোঝেন এর কষ্টটা।২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর উমাইর বিন সাদী নামের ৯ মাস বয়সী শিশু ও তার মা অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপনের জন্য রিট দায়ের করেন। অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান যখন তার বাচ্চাকে ব্রেস্ট ফিডিং করানোর মতো উপযুক্ত পরিবেশ পাচ্ছিলেন না তখন তিনি এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে বিভিন্ন পাবলিক প্লেস যেমন কর্মস্থল, এয়ারপোর্ট, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টশন, শপিংমল, সরকার নিয়ন্ত্রিত, পরিচালিত, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপনে রিট দায়ের করেন, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে উচ্চ আদালতে নয় মাস বয়সী বাচ্চার প্রথম রিট। অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান যেন সমস্ত মায়েদেরই প্রতিচ্ছবি। রিটে বলা হয় ব্রেস্ট ফিডিং কর্নারগুলো এমন পরিবেশে স্থাপন করতে হবে যেন কোনো অস্বস্তিবোধ না করেন বা যৌন হয়রানি শিকার না হন। পরে হাইকোর্ট বিভিন্ন পাবলিক প্লেস যেমন কর্মস্থল, এয়ারপোর্ট, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, শপিংমলসহ বিভিন্ন জনসমাগমস্থলে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপন ও বেবি কেয়ার কর্নার স্থাপনের পক্ষে রায় দেন।

কিন্তু এই রায় কতটা কার্যকর হয়েছে বিগত চার বছরে সেটা আমরা সকলেই দেখতে পাচ্ছি। স্তন্যদায়ী মায়েরা তাই আজও স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের সন্তানদের নিয়ে বাইরে বেরোতে পারছেন না। আর নেহায়েত যখন বাইরে বের হচ্ছেন তখন অনেক সময় নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছেন। সামাজিক বিভিন্ন চাপের কারণে অনেক মহিলাই বাসার বাইরে গেলেই এই ব্যাপার নিয়ে নানা ধরনের অস্বস্তি ও অসুবিধায় ভোগে থাকেন। তাই সর্বস্তরে এই রায়ের কার্যকারিতা যেমনি আশা করব, তেমনি সবার উৎসাহব্যঞ্জক আচরণ প্রত্যাশা করাটা নিশ্চয়ই অমূলক হবে না।

দুগ্ধদানের ব্যাপারে কোনোরকম অযৌক্তিক লজ্জা-সংকোচ দূর করার জন্য পরিবারের মা-বাবা, ভাইবোন থেকে শুরু করে সবাই যেন দুগ্ধদানের জন্য প্রত্যেক মাকে উৎসাহিত করি। স্বতঃস্ফূর্তভাবে,গর্বের সাথেই যেন প্রতিটা নারী তাদের স্তন্যদানের জন্য আলাদা পরিবেশ পায়, আলাদা ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার পায়, তার ব্যবস্থা করা ও নৈতিক সাপোর্ট করার দায়িত্ব সরকারের সঙ্গে সঙ্গে পাঠক আপনার-আমার-সকলের।

মাসুমা সিদ্দিকা: রন্ধনশিল্পী ও ফ্রিল্যান্সার

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

২২ অক্টোবর : নামাজের সময়সূচি 

কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

ঢাকার যেসব এলাকায় আজ মার্কেট বন্ধ

চাঁদপুরে যৌতুকের দাবিতে স্ত্রী হত্যার দায়ে স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

অটোমেটেড মেশিনের দিকে ঝুঁকছে পোশাক কারখানার মালিকরা

ব্যারিস্টার সুমন গ্রেপ্তার

মধ্যরাতে ব্যারিস্টার সুমনের ভিডিও বার্তা

ব্যারিস্টার সুমন কি গ্রেপ্তার হয়েছেন?

আইটেক প্রশিক্ষণে অংশ নিতে ভারতে গেলেন ১০ কর্মকর্তা

চালককে হত্যা করে অটোরিকশা ছিনতাই, গ্রেপ্তার ৩

১০

শুরু হলো আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের ৭১ কোটি টাকার পুনর্বাসন প্রকল্প

১১

বাবা হত্যার দায়ে ছেলের মৃত্যুদণ্ড

১২

দৌলতদিয়ায় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আটক

১৩

বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে প্রাণ গেল কিশোরের

১৪

ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের দাবিতে বেরোবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

১৫

অন্তর্বর্তী সরকারের পরিধি বাড়ানোর দাবি রাশেদ খাঁনের

১৬

শেখ হাসিনা পালায় না, ভেগে যায় : আমান উল্লাহ আমান

১৭

পুলিশে নিয়োগ হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে : পুলিশ সুপার আব্দুল জলিল

১৮

ডেঙ্গুতে আরও ৩ মৃত্যু, আক্রান্ত ছাড়াল অর্ধলক্ষ

১৯

চাঁদপুরে গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন 

২০
X