বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র এবং কল্যাণ রাষ্ট্রের জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ। আর একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রথম অঙ্গীকার থাকে জনস্বার্থ রক্ষা করা। মানুষের জীবনমান উন্নয়নে এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে রাষ্ট্র বিভিন্ন ধরনের নীতি-পলিসি গ্রহণ করে। আর এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় সবকিছুর পেছনে নিয়ামক হল শক্তি অর্থাৎ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি। ফলে দেশের জনগণের জ্বালানির প্রাপ্যতা এবং জ্বালানি অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি।
বাংলাদেশ একটি অপ্রতুল প্রাকৃতিক সম্পদের দেশ। এ দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে যতটা সম্ভব সাশ্রয়ী মূল্যে নাগরিকদের কাছে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা আবশ্যক। দরকারে জ্বালানিতে ভর্তুকি দিয়ে জ্বালানি মূল্য ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতার নাগালে রাখা প্রয়োজন। কিন্তু জ্বালানি সনদ চুক্তি “ইসিটি” এর অন্তরায়।
বাংলাদেশ যদি ‘ইসিটি’-তে স্বাক্ষর করে তাহলে সরকার চাইলেও আর জ্বালানির মূল্য কমাতে পারবে না। জনগণের স্বার্থে প্রয়োজনে জ্বালানির মূল্য কমাতে হবে সেই সুযোগ হারিয়ে ফেলবে সরকার। কারণ জ্বালানির মূল্য কমালে এবং এতে যদি বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে বিনিয়োগকারী মামলা করতে পারবে চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশের বিরুদ্ধে। হাঙ্গেরি এবং বুলগেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ এ ধরনের মামলার শিকার হয়েছে। এ থেকে স্পষ্ট যে, জ্বালানি সনদ যুক্তিতে স্বাক্ষর বাংলাদেশে জ্বালানি খাতের জনস্বার্থকে হুমকির মুখে ফেলবে।
জ্বালানি খাতের বিনিয়োগ ও বিনিয়োগকারীর নিরাপত্তা ও স্বার্থ রক্ষায় ১৯৯১ সালে আবির্ভূত হয় ইউরোপীয় জ্বালানি সনদ বা ইউরোপিয়ান এনার্জি চার্টার। তবে এই সনদের আইনগত প্রয়োগ তখন স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল না, ছিল ঐচ্ছিক। পরবর্তীতে চুক্তিটি ১৯৯৮ সালে আন্তর্জাতিক জ্বালানি সনদ নামে কার্যকর হয় এবং আইনগুলো বাধ্যতামূলক করা হয়। বর্তমানে ৫৪টি দেশ ও অর্থনৈতিক জোট চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু জ্বালানি সনদ চুক্তির মূল উদ্যোক্তা নেদারল্যান্ডসসহ অনেক দেশ এখন এই চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহারের চেষ্টা করছে।
মোট আট ভাগে বিভক্ত জ্বালানি সনদ চুক্তিতে ৫০টি ধারা রয়েছে। সনদের ধারা ৫, ১১ ও ১৪ অনুযায়ী জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বাগতিক রাষ্ট্র স্থানীয় কোনো পণ্য ব্যবহারে বিনিয়োগকারীকে বাধ্য করতে পারবে না। এমনকি জনবলও নিতেও বাধ্য করা যাবে না। ভোক্তার জন্য জ্বালানি মূল্য কমালে এবং এতে যদি বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে বিনিয়োগকারী মামলা করতে পারবে। এই সনদে সই করলে বিদেশি কোম্পানি বিনা বাধায় তাদের পুঁজি, মুনাফা ফেরত নিয়ে যেতে পারবে। সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে, বিনিয়োগসংক্রান্ত দ্বন্দ্ব নিরসনে অতি ব্যয়বহুল আন্তর্জাতিক সালিশের দারস্থ হতে বাধ্য করা হয়েছে। এই সনদ আইনি কাঠামো অনেকটাই একপেশে এবং ভারসাম্যহীন। এটা স্বাগতিক রাষ্ট্রের জন্য এক রকমের আইনি ফাঁদ। বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের জন্য জ্বালানি সনদ চুক্তি দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি।
একটি দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার অন্যতম প্রধান শর্ত হলো জ্বালানির মূল্য স্থিতিশীল থাকা। সাম্প্রতি আমরা বাংলাদেশে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি দেখেছি। জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি করায় এই মূল্যস্ফীতির কবলে পড়েছে অর্থনীতি। ছোবল হেনেছে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রার ওপর। ভোগ কমেছে, জীবনযাত্রার মান কমেছে, ছোট হয়েছে দৈনন্দিন খাদ্য তালিকাও।
কার্বন নিঃসরণ, দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক প্রভাব দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ একটি দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ২০৩০ সাল নাগাদ কার্বন নিঃসরণ বর্তমান পর্যায় থেকে ২১.৮৫% কমিয়ে আনবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জলবায়ু সম্মেলনে। বর্তমান দেশে জ্বালানি খাতই কার্বন নিঃসরণের ৫৫% এর জন্য দায়ী।
যেখানে বাংলাদেশের জন্য জরুরি হলো কার্বনযুক্ত জ্বালানির ব্যবহার কমানো। সেখানে ইসিটিতে স্বাক্ষর বাংলাদেশকে বাঁধাগ্রস্ত করবে। ইসিটিতে স্বাক্ষর করলে বাংলাদেশ চাইলেও আর জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসতে পারবে না। ইসিটিতে স্বাক্ষরকারী কোনো রাষ্ট্র নবায়নযোগ্য জ্বালানি রূপান্তরের ব্যাপারে সচেষ্ট হলে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগকারীর জন্য তা ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই এসব ক্ষেত্রে জ্বালানি সনদ চুক্তিকে আইনগতভাবে ব্যবহার করে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা জ্বালানি রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
বাংলাদেশ ২০১৫ সালে জ্বালানি সনদ চুক্তির প্রাথমিক ধাপে স্বাক্ষর করেছে এবং এখন একটি পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র। ২০১৯ সালে এই সচিবালয়ের এক কর্মকর্তার বাংলাদেশ সফরের বরাতে জানা যায়, বাংলাদেশ আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক জ্বালানি সনদ চুক্তি বা বাংলাদেশ এনার্জি চার্টার ট্রিটি চূড়ান্ত পর্বে স্বাক্ষরের প্রায় সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে ফেলেছে।
জ্বালানি সনদ চুক্তি বাংলাদেশের জন্য পরিষ্কারভাবে জনস্বার্থবিরোধী এবং এটি বাংলাদেশকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। একই সঙ্গে এটি বাংলাদেশের জ্বালানি রূপান্তরকে বাধাগ্রস্ত করবে।
মুজাহিদুল ইসলাম : শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন