রহমান মৃধা
প্রকাশ : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৩:১৩ পিএম
আপডেট : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৩:১৫ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
রহমান মৃধার নিবন্ধ

প্রযুক্তি নির্ভরতায় স্বাভাবিক জীবন হারাচ্ছে বিশ্বের তরুণ প্রজন্ম

ছবি : সৌজন্য
ছবি : সৌজন্য

A holistic journey of life — জীবনের একটি সামগ্রিক যাত্রা। যদি বলি আমি আমার ভেতর এবং বাইরের সবকিছু সম্পর্কে বর্ণনা করব। বর্ণনা করব আগমন থেকে শুরু করে আমার প্রত্যাবর্তন, তবে আগমনের শুরু থেকে বোধগম্য হওয়া পর্যন্ত সময়টির গল্প আমার নিজের নয় তবুও এ সময়টুকুর সত্যতা ডুকুমেন্টেড, কারণ বাবা-মার সক্রিয়তা জড়িত রয়েছে সেখানে। কিন্তু আমার প্রত্যাবর্তনের পর কী হবে, কেমন যাবে, সেটার সত্যতা আমি বা অন্য কেউ বলতে পারবে না বিধায় আমার যাওয়ার সময় হবে এবং আমি চলে যাব, তারপর? তার আর পর নেই।

আমার জন্মের পর যে প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয় তা ছিল বাইস্কোপ, রেডিও পরে টেলিভিশন, সিনেমা এবং টেলিফোন। আজকের দিনে এর সব কিছুরই ধারাবাহিকতা বিরাজমান সাথে যুক্ত হয়েছে নানা ধরনের অ্যাপস (এপ্লিকেশন)। যেমন : ইউটিউব, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার‌ ইত্যাদ ইত্যাদি এবং এর সবকিছু সংযুক্ত ইন্টারনেটের মাধ্যমে।

ইন্টারনেট কী?

ইন্টারনেট হলো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা একটি নেটওয়ার্ক। এটি বিশ্বজুড়ে ছোট এবং বড় নেটওয়ার্কগুলোর আন্তঃসংযোগ, যার মাধ্যমে আমরা বর্তমানে সবাই কানেক্টেড। সহজ কথায়, ইন্টারনেট হলো এমন একটি নেটওয়ার্ক যা বিশ্বের সমস্ত টেকনোলজিকে সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। এই বিষয়টি অস্বীকার করা যাবে না যে ইন্টারনেট একটি বিপ্লব হয়ে আমাদের জীবনধারাকে সম্পূর্ণরূপে বদলে দিয়েছে। এটি আমাদের যোগাযোগ, ব্যবসা, তথ্য পাওয়ার পাশাপাশি বিনোদনের উপায়কে সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করেছে। অতীতে এসব তথ্যগুলোর অংশ বিশেষ গ্রন্থাগারে পাওয়া যেত।

গ্রন্থাগার কী?

গ্রন্থাগার একটি জীবন্ত উপকরণ, যা অতীতের সমস্ত তথ্য সংরক্ষণ করে রেখেছে আজীবনের নবীন এবং প্রবীণের ব্যবহারের জন্য। ইহা এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা অতীত এবং বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে চলছে এবং তাদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করাসহ সমস্ত তথ্যের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎকে নতুন প্রজন্মের ব্যবহারোপযোগী হিসেবে কাজ করে চলছে। পরে সেই গ্রন্থাগার আজকের প্রযুক্তির যুগে ডোমেইন নাম গুগলে নিবন্ধিত করা হয় ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৭ সালে যা ১৯৯৬ সালে গবেষণা প্রকল্প হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন পিএইচডি কোর্সের ছাত্র ল্যারি পেইজ ও সের্গেই ব্রিন শুরু করেছিলেন। সেই যে যাত্রা শুরু হয়েছে, সেই থেকে তার ধারাবাহিকতা চলমান বিশ্বের সর্বত্র।

এখন এই প্রযুক্তি মানব জাতির জীবনের পরিবর্তন করছে বিপুল আকারে। এখন মানুষের পাশাপাশি এই প্রযুক্তি মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাশক্তিকে কৃত্রিম উপায়ে যন্ত্রের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হিসেবে মানুষের মতো ভাবতে শুরু করেছে। যেমন শিক্ষাগ্রহণ এবং সমস্যার সমাধান। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) হলো প্রযুক্তি দ্বারা প্রদর্শিত বুদ্ধি, যে বৃদ্ধি সত্তর মানব জাতির জীবনকে অতীতের তুলনায় দ্রুতগতিতে একটি সামগ্রিক যাত্রায় অগ্রসর করতে শুরু করেছে। এখন এই যাত্রায় টিকে থাকা বা মানিয়ে চলা নতুন প্রজন্মের জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমি সুইডেনের একজন টিনএজ মেয়ের মায়ের বর্তমান জীবনের গল্প শোনাব, গল্পটি তার জীবন থেকে নেওয়া। সেদিন ছিল ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবস। দিনটি আমার জন্য ছিল এক মিশ্র অনুভূতি। কারণ প্রতি বছর এই বিজয়ের মাসে আমি সেই ’৭১-এর প্রতিধ্বনি শুনি। তারপরও আমার বর্তমান সুইডেনের গ্রামে এ দিনটির পুরো সময়টুকু কেটেছে আনন্দ-ফুর্তির মধ্য দিয়ে। পরে সন্ধ্যায় প্রায় একশর বেশি বন্ধু-বান্ধবী জড়ো হই একটি অতি পুরোনো কৃষকের বাগানবাড়িতে। সেই ১৭৯৩ সালের গুদামঘর যা এখন হয়েছে অতীত এবং বর্তমানের মিলন ঘর। চমৎকার পরিবেশে নানা ধরনের বিনোদনে ভরা, সেখানে জমেছিল সুইডিশ পার্টি। যাদের সাথে রাতের আড্ডায় সময় কাটিয়েছি তারা সবাই এখানকার, চেনা জানা মুখ। কারিনার সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা হলো। কারিনা বয়সে আমার ছোট হবে। তার একটি মেয়ে বয়স ১৪ বছর।

কথা প্রসঙ্গে মেয়ের এবং পারিবারিক কিছু সমস্যা তুলে ধরল। ঘটনা প্রসঙ্গে যে বিষয়টি ফুটে উঠেছে সেটা ছিল নতুন প্রজন্ম কীভাবে প্রযুক্তির কারণে অতি অল্প বয়সে ঝরে পড়ছে ঝরা পাতার মতো। অর্থ, সম্পদ, বিলাসিতাসহ কোনো কিছুর অভাব নেই কারিনার তারপরও তার মেয়েটির জীবন প্রযুক্তি গ্রাস করে চলছে। সারাক্ষণ টেলিফোন আর নেটের জগৎ কারিনার মেয়েকে পৃথিবীর রিয়েল জগৎ থেকে দূর থেকে বহু দূরে নিয়ে চলছে। সে এখন মানবের জীবন ছেড়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জীবনে ধায়িত। তাকে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনতে শুধু কারিনা এবং তার পরিবার নয় সুইডিশ রাষ্ট্র পর্যন্ত হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে।

আমি সুইডেনে বসবাস করি এবং এ সমাজের ছোটখাটো বিষয় থেকে শুরু করে বড় ধরনের সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি সমস্যাগুলো সম্পর্কেও সচেতন। সুইডিশ টিনএজ ছেলেমেয়েদের মধ্যে অন্ধকার বাসা বেঁধেছে অতীতের তুলনায় বেশি। এযুগের প্রজন্ম অনলাইনে কেনাকাটা থেকে শুরু করে যোগাযোগও সেইভাবে করতে অভ্যস্ত এখন। যার ফলে তাদের মাঝে ন্যাচারাল মেলামেশা খুব একটা হয় না। হলেও কথা নেই পরস্পরের মধ্যে। দেখা যাচ্ছে এক জায়গায় বসে আছে ঠিকই কিন্তু টেলিফোনে ব্যস্ত। সামাজিকতা না করার কারণে একা হয়ে পড়ছে এবং শেষে মানসিক অসুস্থায় ভুগে ভুগে বাবা-মাকে অশান্তিতে ফেলছে।

আমি নিজেও কোনো এক সময় ছোট ছিলাম, টিনএজ আমারও এসেছিল জীবনে একবার। যুদ্ধের সময় শেষ না হতেই এসেছিল টিন এজের সময়। কোনো এক সময় বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকা শহরে চলে গেছি, কারণ পরিবার, গ্রাম আমাকে ধরে রাখতে পারেনি, পারেনি শিক্ষা ব্যবস্থাও। কোনো কিছুতে মনোযোগী হওয়া খুবই কঠিন কাজ ছিল। তবে সবার ক্ষেত্রেই যে এমনটি হয়েছে তা নয় ব্যতিক্রম ছিল। এযুগের টিনএজদের ক্ষেত্রেও তেমনটি।

এখন প্রযুক্তি যেভাবে নতুন নতুন বিনোদন নিয়ে হাজির হচ্ছে সেখানে পুঁথিগত বিদ্যা বা ক্লাসের শিক্ষক ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে শিক্ষার্থীর মোটিভেশন শ্রেণিকক্ষে বা পুঁথিগত বিদ্যার মাঝে। কারণ কী জানেন? বেশির ভাগ শিক্ষক নিজেই এখন গুগলে হাবুডুবু খাচ্ছে তার শিক্ষার্থীদের মতো। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী সারা দিন স্কুলের নির্জনতার বন্ধ ঘরে থাকাকে জেল হাজতের সাথে তুলনা করছে। অন্যদিকে গুগল এবং প্রযুক্তি দিচ্ছে তাদের নিজ নিজ চাওয়া পাওয়ার প্রাধান্য এবং সেখানে নেই কোনো রুটিনমাফিক নিয়ম কানুন। এমতবস্থায় কী হবে পরবর্তী জেনারেশনের যদি বিশ্ব এখন নতুন করে না ভাবে? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে যখন নতুন প্রজন্ম দেখছে কীভাবে মানুষ মানুষকে নিজ হাতে খুন করছে, দেখছে কীভাবে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং বাসস্থানের অভাবে তরুণ প্রজন্ম পৃথিবীর এক প্রান্তে মরছে, ঠিক একই সময় দেখছে দুর্নীতি-অনীতি এবং কালো পাহাড়ের টাকায় একদল দুবাই বা অন্য রাজ্যে বিলাসিতায় হাবুডুবু খাচ্ছে। কীভাবে এই তরুণ সমাজ নতুন পৃথিবী গড়ার মোটিভেশন খুঁজে পাবে? কী মনে হয় আপনাদের?

আজ যারা রাষ্ট্র তথা জাতির জীবনের দায়ভার নিয়েছে তারা যদি এ বিষয়গুলো নিয়ে না ভাবে সম্ভব কি শুধু বাবা-মায়ের পক্ষে এতবড় চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করা?

শুধু রীতিমতো শিক্ষার মান বাড়ালে হবে না, সমাজের তথা সমাজের অবকাঠামো থেকে শুরু করে প্রযুক্তিরও মান বাড়াতে হবে। আমি মনে করি তরুণ সমাজ যাতে প্রযুক্তির এডাল্ট সাইট ভ্রমণ করতে না পারে সে ব্যবস্থা করা সময়ের দাবি। এর জন্য প্রত্যেক তরুণের প্রযুক্তির একসেসে বয়সভিত্তিক ফিঙ্গার প্রিন্ট যুক্ত করা আশু প্রয়োজন যাতে করে অশ্লীল বা অবৈধ কোনো সাইট তাদের গ্রাস না করে। মানব জাতির জীবনের একটি সামগ্রিক যাত্রা হোক মধুময় এবং আনন্দময়, এমনটি কামনা আমি করি, আপনি?

রহমান মৃধা : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বদরুদ্দোজা চৌধুরীর প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত

ইয়েমেনের ১৫ নিশানায় মার্কিন হামলা

‘বিরল’ এক সফরে পাকিস্তান যাচ্ছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

গাজীপুরে বাসচাপায় যুবক নিহত

দুর্গাপূজায় নিরাপত্তা নিশ্চিতে মাঠে থাকবে বিএনপি : আজাদ

সাড়ে ৩ কোটি টাকার চাল নিয়ে লাপাত্তা খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা

সাতক্ষীরায় ৯ মাস বেতন পাচ্ছেন না ৪২০ শিক্ষক

সিরাজগঞ্জে হত্যা মামলার আসামি গ্রেপ্তার

গাজীপুরে শান্তিপূর্ণভাবে চলছে পোশাক কারখানার উৎপাদন

বৃষ্টি আর কত দিন থাকবে, জানাল আবহাওয়া অফিস

১০

ইসরায়েলি হামলায় সিরিয়া-লেবানন সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন

১১

দুপুরের মধ্যে ঝড় হতে পারে যেসব অঞ্চলে

১২

আরেক দেশ থেকে ইসরায়েলে হামলায় ২ সেনা নিহত, আহত ২৪

১৩

বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে জবির স্লোগান ‘বিপ্লবে বলীয়ান নির্ভীক জবিয়ান’

১৪

শিক্ষক দিবসে যেসব কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে

১৫

হত্যা মামলায় রসিকের সাবেক কাউন্সিলর মিলন গ্রেপ্তার

১৬

বৈরুত বিমানবন্দরের পাশেই ইসরায়েলি তাণ্ডব

১৭

সিলেটে রায়হান হত্যা মামলায় ২ যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

১৮

৫ অক্টোবর : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৯

রোহিঙ্গা সংকট একটি তাজা টাইম বোমা : ড. ইউনূস

২০
X