ডেমোক্র্যাসি বা গণতন্ত্র অর্থাৎ মানুষের মধ্য সমতা এবং সাম্যের বিশ্বাস এবং এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে সরকার ব্যবস্থা পরিচালনা হয় যাতে ক্ষমতা থাকে বাস্তবিক অর্থে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে। এ ব্যবস্থায় কোনো জাতি বা রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিক বা সদস্যের সমান ভোটাধিকার থাকে। এর দ্বারা বোঝা যায়, এটি এমন একটি ব্যবস্থা যার মাধ্যমে জনগণের শাসন প্রবর্তিত হয়। পৃথিবীব্যপী তাই এটি এত জনপ্রিয়। বাংলাদেশও একটি গণতন্ত্রকামী দেশ। আমরা আমাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে কতটা আগ্রহী বা অনাগ্রহী, জনগণকে ভোটদানে আগ্রহী করার জন্য কি করা দরকার তার জন্য সরকারের দায়িত্ব রয়েছে কিনা, কেনইবা তা দরকার- এসব নিয়ে নানা প্রশ্ন, যুক্তি তর্ক আছে এবং চলছে এবং এটা চলতেই থাকবে। তবে সমাধান সাধারণ মানুষের হাতে নেই। বর্তমানে আমরা একটি জাতীয় নির্বাচনের সামনে দাঁড়িয়ে। এ সময় অস্ট্রেলিয়ার গণতন্ত্রের উদাহরণটি আমাদের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে।
গণতন্ত্রকামী দেশগুলোর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে নরওয়ে, আইসল্যান্ড, সুইডেন, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি দেশ। আরও দেশ রয়েছে যেখানে গণতন্ত্রের চর্চা রয়েছে। সম্প্রতি আমার সুযোগ হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার, যদিও আমি সে দেশের নাগরিক নই, কিন্তু তার পরও কেউই আমাকে জিজ্ঞাসা করেনি আপনি কেন এখানে এসেছেন,বা কোনো পুলিশ দেখতে পেলাম না পোলিং কেন্দ্রে, নেই কোনো পোস্টার বা পোলিং এজেন্ট বা অন্য কোনো আয়োজন। আমি কিছুটা অবাক হলাম, তাকিয়ে দেখছিলাম তাদের কাণ্ডকারখানা। না বলে দিলে বোঝাই যাবে না যে, দেশব্যাপী একটি নির্বাচন হচ্ছে, যেখানে বিপুল ভোটার ভোট দিচ্ছে। এত সহজে এত বড় একটা কাণ্ড তারা ম্যানেজ করছে কীভাবে। নিজের দেশের তুলনা সংগত কারণেই বার বার মনে আসছিল। যদিও এ প্রক্রিয়াটি ছিল একটু ভিন্ন, এখানে কোনো প্রতিনিধি নির্বাচন নয়, তবে জনগণের একটি রায় এ ভোটের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়া একটি প্রতিনিধিত্বমূলক ডেমোক্র্যাটিক দেশ যেখানে ভোটদাতারাই তাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করে থাকে যার মধ্য দিয়ে সরকার পরিচালিত হয়।
অস্ট্রেলিয়াতে ১৮ বছরের উপরে সবাইকে ভোট দিতে হয়। এখানে গণতন্ত্রের মূল বিষয় হলো, কথা বলার স্বাধীনতা, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, অন্তর্ভুক্তি এবং আইনের শাসন। অস্ট্রেলিয়ায় শতভাগ মানুষ ভোট দেয়। ভোট না দেওয়া এখানে একটি অপরাধ হিসেবে পরিগণিত হয়।
অস্ট্রেলিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে একটি কমনওয়েলথভুক্ত সার্বভৌম দেশ, যার মধ্যে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ, আইল্যান্ড তাসমানিয়া এবং রয়েছে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আইল্যান্ড যার সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার ২২২। অস্ট্রেলিয়া ওসানিয়ার বৃহত্তম এবং পৃথিবীর ষষ্ঠ বৃহৎ দেশ। প্রায় ১.৬ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি (২০২১) যার রাজনৈতিক অবস্থান অত্যন্ত ভালো তাদের প্রতিনিধিত্বমূলক ডেমোক্র্যাটিক পার্লামেন্টারি সিস্টেমে পরিচালিত হয়।
অস্ট্রেলিয়ার গণতন্ত্রের পদ্ধতি ১৯-এর দশক থেকে পরিচালিত হচ্ছে, কমনওয়েলথ অব অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিপ্রস্তর হয় জানুয়ারি ১৯০১ সালে যখন থেকে ফেডারেশনভুক্ত ছয়টি কলোনির ভোট পরিচালিত হচ্ছে। ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাডাপশন অ্যাক্ট ১৯৪২-এর মাধ্যমে ইউকে থেকে তাদের স্বায়ত্তশাসন প্রাপ্তির প্রক্রিয়া চূড়ান্ত রূপ পায় ১৯৮৬ সালে।
প্রতিনিধিত্বমূলক ডেমোক্র্যাটিক এ দেশটিতে ১৪ অক্টোবর একটি রেফারেন্ডাম অনুষ্ঠিত হলো যেখানে জনগণ হাঁ বা না ভোট নিয়েছে। এ ভোটের মাধ্যমে তাদের ফার্স্ট পিপল বা প্রথম মানুষ অনুমোদনে তারা রাজি হয় কিনা সেটা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এটা ছিল তাদের ২০২১ সালের প্রথম রেফারেন্ডাম। কিন্তু রেফারেন্ডামটি পাশ হয়নি। অস্ট্রেলিয়ান ইলেকট্রোরাল কমিশন (এইসি) জনগণের জন্য একটি স্বাধীন ইলেকট্রোরাল সেবা দিতে বাধ্য, যেটা তাদের সাংবিধানিক অধিকার। এইসি তাদের কর্মকাণ্ড সঠিকভাবে সম্পাদন করেছিল। তবে জনগণ এটা চায়নি।
বিষয়টি ছিল ভোটের মাধ্যমে সংবিধানে পরিবর্তন নিয়ে আসা, যার দ্বারা এবরজিনালদের প্রথম মানুষ হিসেবে টোরিস স্ট্রেইট আইল্যান্ডে স্বীকৃতি দেওয়া যায়। তাদের সংসদ রাজি হয়েছিল সংবিধানে একটি নতুন চ্যাপটার অন্তর্ভুক্তির জন্য,যার মাধ্যমে এবরজিনালদের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। সেটা কী রকম হবে তার একটি রূপরেখাও তৈরি হয়েছিল এবং তা বিতরণ করা হয় যার না করণ হয় ১২৯ এবরজিনাল এবং টোরেস স্ট্রেইট আইল্যান্ড-এর কণ্ঠ এবং এর দ্বারা তাদের এ দেশের প্রথম মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া।
হ্যাঁ এবং না ভোট কীভাবে দিতে হবে সে ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার, লিফলেট বিতরণ, টিভি অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়। জনগণ নির্ভয়ে তাদের রেফারেন্ডাম প্রদান করেছিল শতভাগ ভোটের মাধ্যমে। কীভাবে শতভাগ ভোটারকে নিয়ে আসা সম্ভব, সেটি ছিল আমার জন্য একটি চমকপ্রদ বিষয়।
একটি ফেডারেল নির্বাচনের মতোই এইসি সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছিল। দিনটি শনিবার রাখা হয়েছিল ইচ্ছা করেই যাতে ছুটির দিনে হওয়ায় সবাই নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে যেতে এবং ভোট দিতে পারে। ভোটের দিন সময় নির্দিষ্ট ছিল সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত । যদি আপনি নিজের জায়গায় না থেকে ওইদিন অন্য কোনো আন্তঃরাজ্যে থাকেন তাহলে ভোটারকে সংশ্লিষ্ট জায়গার ভোটিং কেন্দ্রে যেতে হবে ভোট দেওয়ার জন্য।
এছাড়া আগাম ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা আছে যেটা শুরু হয়েছিল অক্টোবরের ২ তারিখে। জায়গাগুলো ছিল নর্দান টেরিটরি, তাসমানিয়া, ভিক্টোরিয়া এবং ওয়ের্স্টোন অস্ট্রেলিয়া। তেমনিভাবে অক্টোবরের ৩ তারিখে কিছু জায়গা নির্দিষ্ট করা ছিল যাতে সকলেই ভোট দেওয়ার সুযোগ পান। ব্যাপকসংখ্যক ভোটিং কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল যা সপ্তাহজুড়ে কাজ করেছে। সকলেই কোনো কোনোভাবে ভোট দিয়েছে।
যে যেখানে অবস্থান করছেন তার আট কিলোমিটারের মধ্য যে কোনো কেন্দ্রে ভোট দেওয়া যাবে। যাদের পক্ষে ফিজিক্যালি উপস্থিত হওয়া সম্ভব নয়, তারা পোস্ট করেও ভোট দিতে পারে। কেউ অসুস্থ থাকলে, কর্মস্থল থেকে কোনোভাবে বের হতে না পারলে, কেউ অল্প সময়ের মধ্য সন্তান জন্ম দিতে যাচ্ছেন, কেউ হাসপাতালে আছেন অথবা কারও খেয়াল রাখছেন তাই বের হতে পারছেন না। কেউ হয়তো জেলে রয়েছেন, কারও হয়তো এমন বিশ্বাস রয়েছে যার থেকে তিনি পোলিং কেন্দ্রে যেতে চান না। কারও হয়তো কোনো ভয় আছে সে কারণে তিনি পোলিং স্টেশনে যেতে চান না, কেঊ হয়তো কোনো কারণে কোনো জায়গায় আটক আছেন কিংবা কেউ হয়তো কথা বলতে পারেন না। এসব ক্ষেত্রে রিমোট পোলিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।
মনে হয়েছিল বাংলাদেশের নির্বাচনের কথা। কতটা পার্থক্য আমাদের ভোটের সঙ্গে। বাংলাদেশে কতখানি মর্যাদা পায় একজন ভোটদাতা। একজন সচেতন নাগরিক হয়েও আমি হয়তো মনে করছি ভোট কেন্দ্রের যে পরিবেশ কি দরকার ঝুঁকি নিয়ে ভোট দিতে যাওয়ার। একটি শ্লোগান বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে চলে আসছে, ‘আমার ভোট আমি দেব’, তা হলে কী এটা হতে পারে যে আমার ভোট অন্য কারও দিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা আছে! প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশে এটা কীভাবে হতে পারে।
আশা করি, বাংলাদেশের মানুষ স্বতঃর্স্ফূতভাবে নিজের ভোট নিজে দিতে পারবে এবং সরকার গঠনে ভূমিকা রাখবে।
ফেরদাউস আরা বেগম: সিইও, বিল্ড-একটি পাবলিক প্রাইভেট ডায়ালগ প্ল্যাটফর্ম, যা বেসরকারি খাতের জন্য কাজ করে
[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
মন্তব্য করুন