ড. কামরুল হাসান মামুন
প্রকাশ : ০২ জুলাই ২০২৩, ০২:৫৮ পিএম
আপডেট : ০২ জুলাই ২০২৩, ০৪:০১ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
ড. কামরুল হাসান মামুন

শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরিতে বৈচিত্র্য জরুরি

ড. কামরুল হাসান মামুন
ড. কামরুল হাসান মামুন

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট একটি রায় দিয়েছেন। সত্যি বলতে কী গত দুই দিনে বেশ কয়েকটা রায় এসেছে যা যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের কাছে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করবে। প্রথম এবং যুগান্তকারী যে রায়টি সুপ্রিম কোর্ট দিয়েছেন সেটি যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনবে। আমেরিকায় কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও চাকরির ক্ষেত্রে ‘অ্যাফারমেন্টিভ অ্যাকশন প্রোগ্রাম’ নামে একটি প্রোগ্রাম অনেক বছর ধরে চালু রয়েছে, যার মাধ্যমে সমতা বা ইকুয়ালিটির পরিবর্তে ন্যায্যতা বা ইকুইটিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এটিও এক ধরনের কোটা ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের জাতিগত সংখ্যালঘুদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া হয়। তবে তা অবশ্যই গুণগত মানকে অবহেলা করে নয়। যুক্তরাষ্ট্রে শেতাঙ্গ সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর চেয়ে কৃষাঙ্গ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী অনেক পিছিয়ে। পিছিয়ে পড়াদেরও এগিয়ে নিতে এবং বাড়তি সুযোগ দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাফারমেন্টিভ অ্যাকশন প্রোগ্রাম চালু আছে। গরিব পরিবারে জন্ম ও বেড়ে উঠে ছেলেমেয়েদের উচ্চবিত্তের সন্তানদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দিলে সেটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হয় না। উচ্চবিত্তের সন্তানরা ভালো স্কুলে পড়ার সুযোগ পায়, ভর্তির প্রস্তুতির জন্য স্যাট, টোফেল, জিআরই ইত্যাদি পরীক্ষা প্রদান ও কোচিং করার বেশি সুযোগ পায়। অ্যাফারমেন্টিভ অ্যাকশন প্রোগ্রামে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতিটা শিক্ষার্থীর নিজস্ব গল্প শোনা হয়। কে কতটা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে বন্ধুর পথ সফলভাবে পারি দিতে পেরেছে ইত্যাদি বিষয় ভর্তির যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের আইভি লিগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইহুদি শিক্ষার্থীদের ভর্তির ক্ষেত্রে কোটা ব‍্যবহার করা হয়। না হলে ইহুদি শিক্ষার্থী দিয়ে এসব বিশ্ববিদ্যালয় ভরে যেত। এ অ্যাফারমেন্টিভ অ্যাকশন প্রোগ্রাম না থাকলে ডাইভার্সিটি ক্ষতিগ্রস্ত হতো

যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট যেই রায় দিয়েছেন তাতে এখন ন্যায্যতার বদলে সমতার ভিত্তিতে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি হবে। এর ফলে ধনী, গরিব, পিছিয়ে পড়া আর এগিয়ে থাকাদের একই নিক্তিতে বিবেচনা করা হবে। এই রায়ে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্পের রিপাবলিকান দল খুব খুশি। ট্রাম্প নিজেও অনেক খুশি হয়েছেন। অন্যদিকে ডেমোক্রাটরা এর বিরুদ্ধাচারণ করছে। রায়ের পর পরই সাবেক ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন ‘So often, we just accept that money, power and privilege are perfectly justifiable forms of affirmative action, while kids growing up like I did are expected to compete when the ground is anything but level’. ‘So today, my heart breaks for any young person out there who’s wondering what their future holds—and what kinds of chances will be open to them.’ এই রায় বাস্তবায়ন হলে ডাইভারসিটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রকৃতি সুন্দর। এই সুন্দরের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো এর বৈচিত্র্যতা। পানিতে হাজার রকমের মাছ ও জলজ প্রাণী আছে। স্থলে হাজার রকমের প্রাণী আছে। আকাশে উড়ার জন্য হাজার রকমের পাখি ছাড়াও নানারকম পোকামাকড় আছে। মানুষের মধ্যে শরীরের চামড়ার রং, চোখের রং, চুলের রং ইত্যাদিতে রকমফের বা ভিন্নতা আছে। শুধু তাই নয়; মানুষের বৈচিত্র্যতা আছে ধর্মে, জাতীয়তায়, সংস্কৃতিতে। মানুষের এসব বৈচিত্র্যতার সঙ্গে অর্থনৈতিক বৈষম্য যোগ হয়ে আরও বৈচিত্র্যতা তৈরি করতে পারে। পৃথিবী টিকে আছে বৈচিত্র্যতার মধ্যে ফুড ওয়েব তৈরি করার মাধ্যমে। বিশ্বে যতগুলো দেশ আছে তার মধ্যে বৈচিত্র্যতার দিক থেকে সেরা উদাহরণ হিসেবে ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা এবং তারপরেই আছে ইউনাইটেড কিংডম বা গ্রেট ব্রিটেন। নিউইয়র্ক কিংবা লন্ডনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে নানা ধর্মের, নানা গোত্রের, নানা বর্ণের মানুষের দেখা পাওয়া যায়। পৃথিবীর এমন দেশ নেই, দেশের মানুষ এই দুই শহরে পাওয়া যাবে না। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞান গবেষণা ও উদ্ভাবনেও এই দুই দেশ বিশ্বসেরাদের শীর্ষে। যুক্তরাষ্ট্র এখনো সব দিক দিয়ে শীর্ষে—কারণ দেশটিতে আছে বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয় যেমন হার্ভার্ড, এমআইটি, স্ট্যানফোর্ড, ইয়েল, প্রিন্সটন ইত্যাদি। অন্যদিকে ইংল্যান্ডের শীর্ষে থাকার পেছনের কারিগর হলো কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড, ইম্পেরিয়াল, ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন প্রভৃতি। আর এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সফলতার পেছনের সূত্র হলো ডাইভারসিটি। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাস দিয়ে হেঁটে গেলে নানা দেশের, নানা ধর্মের, নানা বর্ণের, নানা রংয়ের বিজ্ঞানী ও দার্শনিক ও শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে। বৈচিত্র্যের নানা মাত্রা আছে যেমন জাতীয়তা, জাতিতত্ত্ব, ধর্ম, লিঙ্গ, প্রতিষ্ঠান, বয়স, লেখাপড়ার ব্যাকগ্রাউন্ড ইত্যাদি।

সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোয় ধারাবাহিকভাবে প্রমাণ পাওয়া গেছে, একটি নির্দিষ্ট গবেষণা দলে যত বেশি বৈচিত্র্যতা থাকে গবেষণার কার্যকারিতা ও গবেষণায় উৎপাদনশীলতা তত বাড়ে। এমনকি ইম্পেক্টফুল কাজও বাড়ে। বিশেষ করে নৃতাত্ত্বিক, আন্তর্জাতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক বৈচিত্র্যতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের এই রায় এসব ক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।

বাংলাদেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে আমরা কি এসব বিষয় নিয়ে ভাবি? আমার দৃষ্টিতে একটুও না। সামান্যতমও না। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কি দেশের বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম, মাদ্রাসা মাধ্যমের সমান প্রতিনিধিত্ব আছে? শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক বৈচিত্র্যতা আছে? ধনী, গরিব, মধ্যবিত্ত পরিবারের সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব আছে? হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ খ্রিষ্টানের সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব আছে? আন্তর্জাতিক বৈচিত্র্যতা আছে? একটি সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব রাখার ভালো একটি পদ্ধতি তৈরির চেষ্টা কি আমাদের কখনো ছিল? তাছাড়া আছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, আছে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া।

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত এসব নিয়ে ভাবা। নানা ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের প্রতিনিধিত্ব না থাকলে লেখাপড়া ও গবেষণার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি হয় না। এই পরিবেশ যতদিন তৈরি না হবে ততদিন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয় হবে না। আমাদের এমন একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করতে হবে যাতে সমাজের সকল শ্রেণীর সেরাদের নিয়ে একটি বৈচিত্রপূর্ণ শ্রেণীকক্ষ তৈরি করতে পারি। আর এটি করতে পারলেই প্রতিটি শ্রেণীকক্ষ পঠন পাঠনের জন্য আদর্শ পরিবেশ হবে।

যুক্তরাষ্ট্রে মেধার চেয়ে বৈচিত্র্য বেশি গুরুত্ব দেয় কারণ তারা এর সুফল পেয়েছে। রাশিয়ার এত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আমেরিকা থেকে পিছিয়ে থাকার একটি কারণ বৈচিত্র্যের অভাব। বাংলাদেশেরও উচিত যুক্তরাষ্ট্রের মতো অ্যাফারমেন্টিভ অ্যাকশন প্রোগ্রামের মতো ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে বৈচিত্র্যতা আনয়নে দৃষ্টি দেয়া।

ড. কামরুল হাসান মামুন: অধ্যাপক, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাকার যেসব এলাকায় আজ মার্কেট বন্ধ

আজকের নামাজের সময়সূচি

প্রথম দিনে উইন্ডিজ তুলল ২৫০ রান

গাঁজা-জাল নোটসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের শীতবস্ত্র বিতরণ

উইন্ডিজের প্রতিরোধ ভেঙে বাংলাদেশের স্বস্তি

টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস / ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়িক অংশীদার চাই

২০২৪ সালের হাইয়েস্ট কালেকশন দরদের : শাকিব 

নায়িকা পরীমনির প্রথম স্বামী নিহত

রাজনীতিতে আ.লীগের পুনর্বাসন ঠেকাতে হবে: নুর

১০

নির্বাচন যত দ্রুত হবে, সমস্যা তত কমে আসবে : মির্জা ফখরুল

১১

খাসজমির দখল নিয়ে সংঘর্ষে দুজন নিহত

১২

মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ক্রীড়াঙ্গন অন্যতম একটি মাধ্যম : আমিনুল হক 

১৩

তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল

১৪

আহত রানার পাশে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’

১৫

ফেসবুকে দাবি ‘মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ একই ব্যক্তি’, যা বলছে ফ্যাক্ট চেক

১৬

একদিকে প্রশান্তি, অশান্তিও বিরাজ করছে: শামা ওবায়েদ

১৭

চোর সন্দেহে খুঁটিতে বেঁধে যুবককে নির্যাতন

১৮

র‍্যানকন মটরসের সঙ্গে ক্র্যাক প্লাটুন চার্জিং সলুশনের চুক্তি

১৯

জনকল্যাণে কাজ করাই বিএনপির মূল লক্ষ্য : নয়ন

২০
X