গত শনিবার সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে ঢাকা রাজধানীসহ সারা দেশে ৫ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। যদিও ক্ষয়-ক্ষতি তেমন হয়নি। তবে এক্ষেত্রে সময়ের ব্যাপ্তি বেশি হলে সেটা মারাত্মক হতো বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ। এ প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস উল্লেখ করেছে যে, রামগঞ্জ উপজেলা থেকে ৮ কিলোমিটার উত্তরপূর্বে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল।
মূলত ভূমিকম্প হলো- ভূপৃষ্ঠে সংঘটিত হঠাৎ ও অস্থায়ী কম্পন, যা ভূ-অভ্যন্তরস্থ শিলারাশিতে সঞ্চিত শক্তির বহির্প্রকাশ মাত্র। এটি ওই শিলারাশির সঞ্চিত শক্তির অবমুক্তির কারণে সৃষ্ট। আর এ স্পন্দনের মাত্রা মৃদু বা প্রচণ্ড হতে পারে। এটি তরঙ্গ গতির বিশেষ ধরনের শক্তি, যা স্বল্প পরিসরে উদ্ভূত হয়ে উৎস থেকে ছড়িয়ে পড়ে এবং যা কয়েক সেকেন্ড থেকে এক মিনিট বা এর অধিক স্থায়ী হতে পারে।
যে বিন্দুতে ভূমিকম্পের তরঙ্গ সূচিত হয়, তাকে কেন্দ্র বা ফোকাস বলে এবং এর থেকে সব দিকে ছড়িয়ে পড়ে। আর এ কেন্দ্র থেকে ঠিক এর ভূ-উপরস্থ যে বিন্দুতে অনুভূত হয়, তাকে উপকেন্দ্র বলে। আর এ উপকেন্দ্রেই প্রথম ঝাঁকি অনুভব হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, কেন্দ্রের গভীরতা অনুযায়ী ভূমিকম্পকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়, যেমন- অগভীর কেন্দ্র (০-৭০ কি.মি.), মাঝারি কেন্দ্র (৭০-৩০০ কি.মি.) এবং গভীর কেন্দ্র (৩০০ কি.মি বা তার চেয়ে বেশি)। এদিকে ভূমিকম্পের আকার ও তীব্রতা মাপার জন্য প্রচলিত মাপক হচ্ছে রিখটার স্কেল। উল্লেখ্য, ১৯৩৫ সালে ক্যার্লিফোনিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির বিশেষজ্ঞ চার্লস রিখটার এমন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যেটা বিভিন্ন ভূমিকম্পের তুলনামূলক চিত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে এঁকে ফেলতে সক্ষম। আর এ গণিতনির্ভর যন্ত্রটি দিয়ে তখন থেকে ভূকম্পনের মাত্রা পরিমাপের জন্য ব্যবহার হয়ে আসছে।
তাই চার্লস রিখটারের নামের সূত্র ধরে এ যন্ত্রটির নাম হয়েছে “রিখটার ম্যাগনিচুউড স্কেল”, সংক্ষেপে “রিখটার স্কেল”। এ স্কেলে তীব্রতা নির্ধারণে সিসমোগ্রামে সর্বোচ্চ পৃষ্ঠে তরঙ্গ বিস্তার (Suface Wave Amplitude) এবং সে সূত্র ধরে প্রাথমিক (P) ও মাধ্যমিক (S) তরঙ্গ পৌঁছানোর সময়ের পার্থক্যকে ভিত্তি করে ‘ভূকম্পন মাত্রা’ নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
বিভিন্ন কারণে ভূমিকম্প হতে পারে। তবে এগুলো প্রধান দু’শ্রেণির আওতাভুক্ত। একটি ভূ-গাঠনিক, আর অন্যটি অ-ভূ-গাঠনিক। উল্লেখ্য, ভূ-গাঠনিক ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে ইলাসটিক রিবাউন্ড তত্ত্ব দিনে দিনে বেশ সমাদৃত হচ্ছে। যদিও ভূমিকম্প নিয়ে অনেক কল্প-কাহিনি আছে, যা অবাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত নয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ভূমিকম্পের বিষয়ে মানুষ পূর্বাহ্ণে পূর্বাভাস না পেলেও কিছু পশু-পাখি আগাম বুঝতে পারে। এ প্রেক্ষাপটে ভূমিকম্পের আগে পশুপাখী ব্যতিক্রমধর্মী আচরণ করে থাকে।
এই যে তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হলো। তার আগে নাকি কুকুর ও পাখিরা অদ্ভুত আচরণ করেছিল। এ সূত্র ধরে প্রকাশ থাকে যে, অতি বুদ্ধিমান হওয়া সত্বেও মানুষ এবং মনুষ্য সৃষ্ট রোবটও ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ। তবে পশুপাখির আচরণের ওপর ভিত্তি করে উন্নত বিশ্বে গবেষণা অব্যাহত আছে।ফলে পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয়। এদিকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এটিকে গজব বলে অভিহিত করা হয়।
যা হোক, শান্ত প্রকৃতি সবকিছুই ঠিক-ঠাক চলছে। বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ প্রবল ঝাঁকুনিতে প্রকৃতি ও জনপদ অশান্ত হয়ে ওঠে। ঘর-বাড়ি, দালান-কোঠা ভেঙেচুরে একাকার এবং চারদিকে আহাজারি আর করুন আর্তনাদ। এ প্রেক্ষাপটে, বিপুল পরিমাণ শক্তির আকস্মিক নির্গমন হেতু ‘সিসমিক ওয়েভ’ নামক যে তরঙ্গ সৃষ্টি হয়, তার ফলস্বরূপ বহির্প্রকাশ হিসেবে এ সর্বনাশা ভূমিকম্প হয়ে থাকে। আর এর মাত্রা মাপা হয় বর্ণিত রিখটার স্কেলে। এ স্কেল অনুযায়ী ৩ মাত্রা বা এর কমে তেমন একটা ঝুঁকি নেই। কিন্তু ৭ বা এর বেশি হলেই খুবই বিপজ্জনক হিসেবে বিবেচিত হয়। অদ্যাবধি ভূমিকম্পনের সর্বোচ্চ মাত্রা রিখটার স্কেলে ৯.০০। যদিও দূর অতীতে এ ভূমিকম্প মাত্রা ৯.০০ অতিক্রম করে ৯.৫ মাত্রা পর্যন্ত পৌঁছে ছিল। যা হোক, এতদসম্পর্কে সম্যক ধারণার জন্য নিম্নোক্ত সারণি দ্রষ্টব্য-
উল্লেখ্য, ভূমিকম্পনহেতু যে স্পন্দন সৃষ্টি হয়, তার প্রাবল্য মাপা হয় মার্কেলিং স্কেলে, যা রোমান সংখ্যা (I, II, III, IV, V, VI, VII, VIII, IX, X) দ্বারা নির্দেশিত হয়ে থাকে। এদিকে ভূমিকম্পের গভীরতা যত কম, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ততবেশি। মাটির বুকে চিড় কিম্বা খাদ এবং কখনো ভূমি ধস বা আগ্নেয়গিরির অগ্নেুাৎপাতের কারণে ঘটতে পারে। এদিকে পৃথিবীর গভীরে কিছু এলাকা আছে, সেগুলো ভূমিকম্পপ্রবণ এবং এগুলো ফল্টলাইন হিসেবে অভিহিত। এসব এলাকার ফাটল হওয়ার কারণে ভূ-কম্পন সৃষ্টি হয়ে থাকে। আর এ ফল্ট লাইন তিন প্রকারের, যেমন- ১) সাধারণ, ২) উল্টো, ৩) ঘর্ষণজনিত বিচ্যুতি।
এ প্রেক্ষাপটে ভূ-অভ্যন্তরে কঠিন দুটো স্তরের মাঝে বিচ্যুতি ঘটলে সাধারণ ফল্ট, দুটো স্তর সংকোচনের কারণে রিভার্স তথা উল্টো এবং শেষত একই সাথে সরে স্ট্রাইক স্লিপ বা ঘর্ষণজনিত বিচ্যুতি ঘটে থাকে। এতদ্ব্যতীত খনির বিস্ফোরণেও ভূমিকম্প হতে পারে। সাধারণত মাটির নিচে প্রথমে যে ফাটল সৃষ্টি হয়, সেটাকে ভূমিকম্পের কেন্দ্র বা হাইপোসেন্টার এবং এর ঠিক উপরে ভূ-পৃষ্ঠের অংশকে উপকেন্দ্র বা এপিসেন্টার বলা হয়। অনেক সময় বড় একটি ভূমিকম্প আঘাত হানার পর ছোট আকারে বেশ কত ভূমিকম্প পরপর আঘাত হানতে পারে। এক্ষেত্রে বড় আকারের ভূমিকম্পটিকে ‘মেইনশক’ এবং ছোট আকারের ভূকম্পনগুলোকে ‘আফটার শক’ বলা হয়ে থাকে। অবশ্য বড় ভূমিকম্পের আগে যে মৃদু ভূকম্পন হয়, তাকে ফোর শক বলে অভিহিত করা হয়।
এদিকে সবচেয়ে মারাত্মক হলো পৃথিবীর প্লেটের তারতম্য হেতু ভয়াবহ সুনামি। উল্লেখ্য, এ অবনী ছোট-বড় ২৭টি প্লেট নিয়ে গঠিত, এর মধ্যে ৭টি বড় এবং ২০টি ছোট। আর এ প্লেটগুলোর আয়তন কয়েক হাজার হতে কয়েক কোটি বর্গমাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। এ প্লেটগুলো সর্বদা চলমান, কখনো বিপরীতমুখী আবার কখনো সমমুখী। সাধারণত দুটি প্লেটের সংঘর্ষে ও অন্যান্য কারণবশতঃ সাগরতলে প্রচণ্ড ভূ-কম্পের সৃষ্টি হয়, যার ফলে ভয়াবহ সুনামি ঘটে থাকে।
সুনামি শব্দটি এসেছে জাপানি ভাষা থেকে, আর এর আভিধানিক আক্ষরিক অর্থ ‘পোতাশ্রয়ের ঢেউ’। আসলে সমুদ্রের তলদেশে তাপের তারতম্যহেতু ভূ-প্লেট (Geo-plate) সম্প্রসারিত হলে প্রচণ্ড কম্পনের সৃষ্টি হয়। এটিই ঢেউ তথা সুনামির সৃষ্টি করে। আর সাধারণত দুটি প্লেটের সংযোগ স্থলে বা অঞ্চলে বা কোনো এলাকায় ফাটল থাকলে সেথায় ভূমিকম্প অনিবার্য হয়ে বসে। বাংলাদেশ, ভারত প্লেটের অংশ, যা উত্তর পূর্বে অবস্থিত। তাছাড়া ভূ-তাত্তি্বক গঠন ও টেকটনিক কাঠামোর কারণে বাংলাদেশ ভূ-কম্পন প্রবণ এলাকা, বিশেষ করে সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
যা হোক, আবার সুনামিতে ফিরে আসি। সাধারণত সুনামি বা ঢেউের উৎপত্তি স্থলে এর উচ্চতা কয়েক সেন্টিমিটার। অথচ পরবর্তীতে ৩০ থেকে ৫০ মিটার উচ্চতায় বৃদ্ধি পেয়ে উপকূলের জনপদ সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ফলে ঘরবাড়ি, দালান-কোঠা ধ্বংসসহ অসংখ্য মানুষ ও প্রাণীর জীবন কেড়ে নেয়। ইতিপূর্বে জাপানে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পজনিত সুনামিহেতু বাংলাদেশে ভূমিকম্পের আশংকায় জনমনে সংশয় সৃষ্টি হয়েছিল।
যদিও বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ইতোবাচক দিক পালন করছে। কেননা বঙ্গপোসাগরের মহীসোপান অগভীর বিধায় সুনামি তেমন একটা আঘাত হানতে পারবে না বলে প্রতীয়মান হয়। এদিকে ভূ-তাত্তি্বকদের মতে, পৃথিবীকে ব্যবচ্ছেদ করলে তিনটি প্রধান অংশ পাওয়া যায়, যেমন কোর বা কেন্দ্র, ম্যান্টেল বা মাঝের অংশ এবং ক্রাস্ট বা পৃষ্ঠ। আবার পৃষ্ঠ দু’ধরনের, একটি মহাদেশী পৃষ্ঠ এবং অন্যটি সামুদ্রিক পৃষ্ঠ। পূর্বেই উল্লেখ্য করেছি যে, এ অবনীকে ঘিরে অসংখ্য ছোট-বড় প্লেট আছে, যা প্রতিনিয়ত কম্পনশীল। প্লেটগুলো লিথোস্ফেয়ারের উপরের অংশ। আর এর নিচে গলিত অ্যাসথেনোস্কেয়ার, যার উপরে প্লেটগুলো নড়াচড়া অব্যাহত রেখেছে। তবে নড়াচড়া অস্বাভাবিক হলে পরিণতি হয় মারাত্মক। বাংলাদেশে যেসব উৎস থেকে অতীতে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছে, আগামীতে সেসব উৎস থেকে আবারও মারাত্মক ভূমিকম্প হতে পারে।
বৈশিষ্ট বা চরিত্রগত দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায়, পলিমাটি দিয়ে গঠন, ব-দ্বীপ এবং তিনটি প্লেটের ওপর বাংলাদেশের অবস্থান হওয়ার কারণে ভূমিকম্পের ঝুঁকিটা অনেক বেশি। এই ঝুঁকির আরেকটি প্রাকৃতিক কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশ বৃষ্টিবহুল এলাকায় অবস্থিত। আর আশংকার বিষয় হলো, তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তের চেয়েও রাজধানী ঢাকার অবস্থান অতিবিপজ্জনক। এ প্রেক্ষাপটে ঢাকার চারপাশ নদী আর খাল-বিলে ঘেরা। এখানকার গঠন পলিমাটির ওপর। এক্ষেত্রে ঢাকাকে ভৌগোলিক অবস্থানের পাশাপাশি মাটির গঠনের কারণে বিপজ্জনক হতে পারে। অবশ্য গোটা বাংলাদেশেই বিপজ্জনক অবস্থায় আছে।
ইউরেশিয়ান, ইন্ডিয়ান এবং বার্মিজ প্লেটের সঙ্গমস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। আর তিনটি প্লেটের পারস্পরিক সংঘষের কারণে তৈরিপূর্বক ভূমিকম্প হওয়ার আশংকা অনেক বেশি। এদিকে আমাদের শহরগুলো যথাযথ পরিকল্পনাহীন ও অতি বিপজ্জনক হিসেবে গড়ে উঠেছে। তা ছাড়া এখানকার শহরগুলো তুরস্ক বা সিরিয়া শহরগুলোর তুলনায় অনেক বেশি জনঘনত্বের। কেননা সিরিয়া-তুরস্কের শহরগুলোতে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে এক হাজার মানুষও বাস করে না।
উল্লেখ্য, আমাদের দেশে চারটি বড় ধরনের চ্যুতি রয়েছে। আর সে চ্যুতি থেকে মহানগরী ঢাকা রাজধানী মাত্র ২৫ থেকে ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থান। তা ছাড়া অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ সম্প্রসারণ, জনসংখ্যার চাপ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গভীর নলকূপের দ্বারা ভূ-অভ্যন্তর থেকে পানি উত্তোলন, ইত্যাদি। তাই ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে এগুলো খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। এদিকে বিশেষজ্ঞদের অভিমত অনুযায়ী, ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানীতে বড় ধরনের ভূমিকম্প বয়ে আনতে পারে মহাবিপর্যয়।
এ প্রসঙ্গে বুয়েটে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের উক্তি অনুযায়ী জানা যায়, ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য প্রণীত বিল্ডিং কোড মানা হচ্ছে না। একের পর এক তৈরি হচ্ছে উঁচু ইমারত বা ভবন। অবশ্য যেসব ইমারত বিল্ডিং কোড না মেনে তৈরি করা হয়েছে, সেসব ভবনে এক্সটার্নাল জ্যাকেটিংয়ের মাধ্যমে খুঁটির শক্তি বাড়ানো সম্ভব। তা ছাড়া এ সময় যেসব বিল্ডিংগুলো হচ্ছে, সেগুলোকে ভূমিকম্প প্রতিরোধের জন্যে কন্ট্রোল সিস্টেম সংযোজন করা আবশ্যক। যদিও এটা ব্যয়বহুল, তথাপিও ক্ষয়ক্ষতি ও জান-মালকে বিপদ থেকে বাঁচতে হলে এ ব্যবস্থা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প আছে বলে আপাতত দৃষ্টিতে মনে হয় না।
এটা সত্য যে, প্রকৃতিগত নিয়মে সৃষ্ট ভূমিকম্প রোধ করা সম্ভব নয়, তবে ভূমিকম্পের কারণে উদ্ভূত ক্ষয়-ক্ষতি ও জীবন নাশ কমিয়ে আনা সম্ভব।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রতি ২৫০ থেকে ৩০০ বছর পর পর বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে। ১৬৬৪ সালে যে ভূমিকম্প হয়েছিল তার তীব্রতা ছিল ভয়ানক। সে হিসেবে যে কোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প বাংলাদেশে হতে পারে। এ দেশের ৪৩ ভাগ জায়গা অধিক, ৪১ ভাগ মাঝারি, আর ১৬ ভাগ কম ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকম্প স্থান হিসেবে চিহ্নিত। দেখা গেছে, রংপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ ও পাহাড়ি এলাকা অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তা ছাড়া বাংলাদেশে বেশকিছু এলাকা ফল্টি জোন, এসব স্থানে বড় ধরনের ফাটল বিরাজ করছে। এগুলো হলো আসাম ও বাংলাদেশের সীমানা বরাবর সিলেট ও ময়মনসিংহের ডাউকি জোন, মধুপুর, সীতাকুণ্ড এবং পাবর্ত্য চট্টগ্রাম।
এসব ফল্টি জোনে ভূমিকম্পের মাত্রা ৭ থেকে ৮ রিখটার স্কেলে হতে পারে, যার পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। আর অগোছালো ও অপরিকল্পিত জনবহুল ঢাকা রাজধানীর কথা পূর্বেই বলেছি যে, এর অবস্থান ফল্টি স্থান থেকে মাত্র ২৫ হতে ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে। এটা সত্য যে, শহরাঞ্চলের ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ নির্ভর করে মাটি ও ইমারতের অবকাঠামোর ওপর। এর সপক্ষে নেচার জিওসায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত (সোমবার ১১/০৭/২০১৬ইং) প্রতিবেদন দেখে আঁৎকে উঠি। সত্যিই কি ৯ রিখটার স্কেলে ভূমিকম্প বাংলাদেশে আঘাত হানতে পারে? বিপদগ্রস্ত হতে পারে প্রায় ১৮ কোটি লোক এবং লাখ লাখ লোকের জীবন হানি হতে পারে?
এ বিষয়টি মোটেই উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। কেননা এ বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা প্রতিবেদন প্রণয়ন করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর ও বাংলাদেশের একদল অভিজ্ঞ ও চৌকষ গবেষক। তারা জানিয়েছেন, ৪০০ বছর ধরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা দুটি টেকটোনিক প্লেটের ‘সাবডাকশন জোন’ টান টান (স্ট্রেইন) অবস্থা সৃষ্টি করেছে। এই শক্তি মুক্ত হলে ৮ থেকে ৯ মাত্রার রিখটার স্কেলে ভূমিকম্প হতে পারে।
আগে ভাবা হতো, এ অঞ্চলের প্লেটের বাউন্ডারি আনুভূমিকভাবে কাছের পৃষ্ঠদেশের ওপর দিয়ে পিছলে যাচ্ছে। এটি হলে বড় ধরনের তেমন কোনো ক্ষতি হতো না। তবে প্রকৃত অবস্থা এমনটি নয়। সাবডাকশন জোনের বিষয়টি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরে এ কারণে ভূমিকম্প হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, যে ভূ-গাঠনিক অবস্থানে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে, ইতোমধ্যে সেখানে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। রিখটার স্কেলে ওই ভূমিকম্পের তীব্রতা হতে পারে ভয়াবহ। আর এটি হলে পুরোপুরি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যেতে পারে রাজধানী ঢাকা।
এদিকে আমরা সচক্ষে দেখতে পাচ্ছি, বিল্ডিং কোড মানা হয় না। ৫ তলার প্লানে ৬-৭ তলা পর্যন্ত করে থাকি। রাস্তা প্রশস্ত রাখতে চাই না, খোলা মাঠ নেই বললেই চলে। এক্ষেত্রে একটি বাস্তব ঘটনা তুলে ধরতে প্রয়াসী হয়েছি-
কয়েক বছর আগে রাজাবাজারে একটি বাচ্চা ছেলে ওয়াল বেয়ে উঠতে গিয়ে পা ফসকে পড়ে মারা যায়। তখন দুঃখ করে একজন পথচারী বলেছিলেন যে, মরবে না কেন? ঢাকা শহরে বলতে গেলে কোনো খোলা জায়গা বা মাঠ নেই, যেখানে বাচ্চারা খেলতে পারে। তাই আর কি করা, খেলার আওতায় ওয়াল বাওয়া ছাড়া আর কি করবে?
এদিকে ভূমিকম্প হলে জরুরি অবস্থা মোকাবিলার জন্য ফায়ার সার্ভিস এবং সেনাবাহিনীকে এক্ষেত্রে আরও আধুনিক সাজ-সজ্জায় প্রশিক্ষিত করা আবশ্যক এবং একই সাথে সবধরনের ডিভাইসসহ লজিস্টিক সাপোর্ট আনুপাতিক হারে বাড়াতে হবে। কেননা মনে রাখতে হবে, যে কোনো সময় ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে।
ভূমিকম্পের সময় অবশ্য করণীয় জরুরি নির্দেশনা :
* প্রথম ঝাঁকুনির সাথে সাথে দ্রুত খোলা জায়গায় আশ্রয় নিন। * রুম বা ঘর থেকে বের হওয়া অথবা সিড়িঁ দিয়ে নামার সময়ে আশপাশের লোকজনকে জরুরিভিত্তিতে উচ্চ স্বরে ঘর থেকে বের হতে বলুন। * ভূমিকম্প শেষ হওয়ার পরও অন্তত ত্রিশ মিনিট খোলা জায়গা বা রাস্তায় থাকুন, কেননা ভূমিকম্পের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আধা ঘণ্টার মধ্যে পুনরায় ‘আফটার শক’ ভূমিকম্প হতে পারে। * বের না হতে পারলে, পাকা বাড়ি হলে শক্ত কলামের গোড়ায় আশ্রয় নিন অথবা শক্ত খাট বা টেবিলের নিচে বসে থাকুন। * যদি বাইরে থাকেন, ফাঁকা জায়গায় অবস্থান নিন। * গাছ-পালা, ভবন ও লাইট পোস্ট থেকে দূরে থাকুন। * ভূকম্পনের সময় বর্ণিত যে কোনো এক স্থানে বসে হাঁটুকে কোলের কাছে এনে মাথা গোড়ালির উপর রেখে হাত মাথার পিছনে দিয়ে অবস্থান করুন। * অনতিবিলম্বে বৈদ্যুতিক ও গ্যাসের সুইচ বন্ধ করে দিন। * সাথে কিছু নেওয়ার জন্য অযথা সময় নষ্ট করবেন না, মনে রাখবেন জিনিস-পত্রের চেয়ে জীবনের মূল্য অধিক। * ভূমিকম্প চলাকালে লিফট, ওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস ব্যবহার করবেন না। * গাড়িতে থাকাকালে চালককে গাড়ি থামিয়ে রাখতে বলুন এবং সে সময়ে সেতু পার হবেন না। * কোনো অবস্থায় তাড়াহুড়া করবেন না। দুর্ভাগ্যবশত ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়লে, সাহস হারাবেন না। কেননা উত্তেজনা ও ভয়ে অধিকতর ক্ষতিকর হতে পারে। মনে রাখবেন মানুষ মানুষের জন্য, তাই বিলম্ব হলেও উদ্ধারকারী দল আসবেই। আর সৌভাগ্যবান কাছে মোবাইল থাকলে, তা দিয়ে আপনার অবস্থান জানিয়ে দিন। * ভূমিকম্পে আহতদের জন্য সম্মিলিতভাবে জরুরি চিকিৎসার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। * পরিশেষে একান্ত অনুরোধ, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার আওতায় বাড়ি বানানোর প্রাক্কালে সরকারি ইমারত নির্মাণ কোড এবং ভূমিকম্প সহনশীল মার্কেলিং স্কেলে ইনটেনসিটি নং VII (৭) মাথায় রাখুন। এখনো যেসব স্থান খোলা আছে, সেসব জায়গায় আর যাতে ভবন নির্মাণ না করা হয় এবং একই সাথে রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য মহল্লায় মহল্লায় উপকমিটি গঠন করুন। প্রয়োজনে স্থানীয় সরকারের সাথে পরামর্শ করুন। কিছু আত্মকেন্দ্রিক লোক বাধা দিবেই। তাতে পিছপা হবেন না। কেননা এটি মানবতাবাদী মহত কাজ বিধায় স্বয়ং মহান স্রষ্টা আপনার সহায় থাকবেন। তা ছাড়া সরকার থেকে সবরকম সহযোগিতা পাওয়া যাবে। এ প্রেক্ষিতে আপনাদের সদয় অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, রাস্তা প্রশস্ত হলে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স ও উদ্ধারকারী টিম দ্রুত আসতে পারবে। কেননা এতটুকু সময়ের জন্য অনেক মূল্যবান জীবন বেঁচে যেতে পারে। আর এ বিপন্ন জীবন আমার কিংবা আপনার, এমনকি সব মহল্লাবাসীরই হতে পারে।
সহায়ক সূত্রাদি :
০১। দৈনিক মানবজমিন- ০৩/১২/২০২৩ইং ০২। দৈনিক সমকাল ২৩/০৩/২০১১ইং ০৩। দৈনিক কালেরকণ্ঠ - ১২/০৩/২০১১ইং ০৪। দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন- ২৭/০৪/২০১৫ইং এবং ০৯/০২/২০১৩ইং ০৫। দৈনিক আমাদের সময়- ১৩/০৭/২০১৬ইং ০৬। দৈনিক দেশ রূপান্তর- ০৯/০২/২০২৩ইং ০৭। প্রবন্ধ মালঞ্চ- মোঃ আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব। ০৮। দৈনিক সাহস- ১১/০২/২০২৩ইং ০৯। বাংলা পিডিয়া (৭) বাউ-মধু। ১০। ইউটিউব ১১। জিরো টু ইনফিনিটি, পাই, মে ২০১৫। ১২। লেখকের অভিজ্ঞতাসহ অন্যান্য টিউবিটস।
মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব : বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক
মন্তব্য করুন