জ্বালানি ও বিদ্যুৎ অর্থাৎ শক্তি মানুষের মৌলিক অধিকার। খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় সবকিছুর পেছনে নিয়ামক এই শক্তি। ফলে জ্বালানির প্রাপ্তি ও জ্বালানির মূল্য এই দুইয়ের ওপর নির্ভর করে আমাদের জীবনমানের অনেক কিছু। একটি দেশের জনগণের জ্বালানির প্রাপ্যতা এবং জ্বালানি অধিকার যত বেশি সুরক্ষিত সেই দেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি, কাম্য আয়ুষ্কাল, শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস এবং শিক্ষার হার বৃদ্ধি ততটাই ঊর্ধ্বমুখী। ফলে জ্বালানি নিরাপত্তা একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রথম ও আবশ্যিক অগ্রাধিকার।
দারিদ্র্য বিমোচন ও জনগণের জীবনমান উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রের সামর্থ্য বা সক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। এই সক্ষমতা মূলত নির্ভর করে বিদ্যুৎ ও প্রাথমিক জ্বালানির ওপর জনগণের কতটা স্বত্বাধিকারের ওপর। যদি সেই স্বত্বাধিকার প্রকৃতই থেকে থাকে তাহলে টেকসই জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। যার ফলে মাথাপিছু জ্বালানি চাহিদা অব্যাহত থাকে এবং জ্বালানি প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। এর ফলে জনগণের আর্থিক উন্নতি ও অগ্রগতি অব্যাহত থাকে। এ জন্যই একটি জাতীয় জ্বালানি-নীতি অপরিহার্য।
বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৫ সালে জাতীয় জ্বালানি-নীতি গ্রহণ করে। ২০০৪ সালে তা সংশোধিত হলেও অনুমোদিত হয়নি। জাতীয় জ্বালানি-নীতির মৌলিক উদ্দেশ্য ছিল, জাতীয়ভাবে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। জ্বালানি খাত উন্নয়নে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রয়োজনে এই খাতের সংস্কার ও রূপান্তর চললেও তা বিভ্রান্তির শিকার। ফলে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তায় অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। জ্বালানি খাত উন্নয়ন ও পরিচালনায় সরকারের নীতিগত অবস্থান সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্যহীন এবং ক্ষেত্রবিশেষে পরিপন্থি বলেও প্রতীয়মান।
নিজস্ব মালিকানায়, নিজস্ব জ্বালানি উৎপাদন ও ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সবচেয়ে সাশ্রয়ী পন্থা। এই কৌশল অবলম্বনে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ভোক্তাদের পক্ষে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ২০১১ সালে জাতীয় সমন্বিত জ্বালানি-নীতি শীর্ষক প্রস্তাবনা তৈরি করে।
জ্বালানি দক্ষতা ও সংরক্ষণে উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নয়ন হয়নি। নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন ও বাজার সৃষ্টি করা যায়নি। আবার অন্যায়, অযৌক্তিকভাবে সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধির কারণে একদিকে ভর্তুকি অন্যদিকে ভোক্তাপর্যায়ে জ্বালানির মূল্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে জ্বালানির ওপর ভোক্তার স্বত্বাধিকার অর্জন করা এবং স্বত্বাধিকার টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। সঠিক দামে, সঠিক মাপে ও সঠিক মানে জ্বালানি না পাওয়ায় ভোক্তা একদিকে যেমন অধিকারবঞ্চিত, অন্যদিকে আয় অপেক্ষা জ্বালানি ব্যয় অধিক হওয়ায় অধিকাংশ ভোক্তার জ্বালানি নিরাপত্তাও বিপন্ন। জ্বালানি নিরাপত্তার সুরক্ষা নিশ্চিত না হলে নাগরিকদের জীবন রক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা কঠিন।
চলমান জ্বালানি রূপান্তর কার্যক্রম পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাংলাদেশের মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহারের অব্যাহত বৃদ্ধিতে জিডিপির ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি অব্যাহত আছে। জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে। এখানে কৃষিতে ব্যবহৃত জ্বালানি ভর্তুকি পায়। ফলে খাদ্যের ওপর ভোক্তার স্বত্বাধিকার বহাল রয়েছে এবং খাদ্য নিরাপত্তা অনেকাংশে সুরক্ষিত হয়েছে। কিন্তু খাদ্যের তুলনায় জ্বালানিতে অধিক পরিমাণে ভর্তুকি থাকা সত্ত্বেও খাদ্যের মতো জ্বালানির ওপর ভোক্তার স্বত্বাধিকার নিশ্চিত হয়নি এবং জ্বালানি নিরাপত্তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত থেকেছে। অন্যদিকে জ্বালানি সরবরাহে অন্যায়, অযৌক্তিকভাবে ব্যয়বৃদ্ধি তথা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ না হওয়ায় সরকারি ভর্তুকি ও ভোক্তা পর্যায়ে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত আছে। যার ফলে জ্বালানির ওপর ভোক্তার স্বত্বাধিকার সংকটে পড়েছে এবং ভোক্তার জ্বালানি অধিকার সংরক্ষণ অনিশ্চিতই থেকেছে।
গত ১০ বছরে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ১০০ শতাংশেরও বেশি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০ এর কারণে জ্বালানির বাজার প্রতিযোগিতাহীন হয়ে পড়ল। যেকারণে ভোক্তা জ্বালানি অধিকার থেকে বঞ্চিত। জ্বালানি সংকট মোকাবিলার অজুহাতে দুই বছর মেয়াদে এই আইন করা হলেও মেয়াদ বারংবার বৃদ্ধি করে দেড় দশকের পর আজও সেই আইন বলবৎ রাখা হয়েছে। তাতে চলমান রূপান্তরে জ্বালানি উন্নয়ন ব্যয় অন্যায়, অযৌক্তিক ও সামঞ্জস্যহীন ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভোক্তা লুণ্ঠনমূলক মূল্যে বিদ্যুৎ ও প্রাথমিক জ্বালানি ক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছে।
বিইআরসির আইন অনুযায়ী জ্বালানির মূল্যহার রাজস্ব চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। কিন্তু রাজস্ব চাহিদা একদিকে যৌক্তিক চাহিদার তুলনায় বেশি দেখানো হয়, অন্যদিকে জ্বালানি মূল্য ওই বর্ধিত রাজস্ব চাহিদা অপেক্ষা বেশি নির্ধারণ করা হয়।
মূল্যহার লুণ্ঠনমূলক হওয়ায় জ্বালানি ইউটিলিটি ও সংস্থায় প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা বাড়তি সঞ্চয় হয়। আবার জ্বালানি বিভাগ কর্তৃক এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে নির্ধারিত মূল্যহার সাত বছরের বেশি সময় ধরে বলবৎ রেখে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ৪৩ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা মুনাফা করে। জ্বালানি বিভাগ এক যুগের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে ( বিইআরসি) এলপিজির মূল্যহার নির্ধারণে বিরত রেখে লাইসেন্সধারীদের ইচ্ছামাফিক মূল্যহারে এলপিজি বিক্রির সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
ভোক্তাদের নিকট থেকে পেট্রোবাংলা লুণ্ঠনমূলক সম্পদ আহরণ করেছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। গ্যাস উন্নয়ন তহবিল, বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল এবং জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিলের অর্থ ইউটিলিটিসমূহের রাজস্ব চাহিদা হ্রাসে অনুদান হিসেবে বিনিয়োগের পরিবর্তে ঋণ হিসেবে দেখানো হয়। তাতে জ্বালানির সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধি পায় এবং মূল্যহার বৃদ্ধি হয়। জ্বালানি সরবরাহ ব্যয়বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে অনুদান হিসেবে বিনিয়োগের জন্য ভোক্তাদের অর্থে ওইসব তহবিল গঠিত হয়। অথচ সেসব তহবিল এখন মূল্য ও ভর্তুকি বৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক। এভাবেই ভোক্তার অধিকার লুণ্ঠিত হয়েছে। ভোক্তা জ্বালানি অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, উৎপাদনে দেশীয় জ্বালানির অনুপাত হ্রাস, আমদানিকৃত জ্বালানির অনুপাত বৃদ্ধি অব্যাহত থাকা, প্রকৃত ব্যয়ের তুলনায় জ্বালানি অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়া, সেইসাথে অব্যবহৃত উৎপাদন ক্ষমতার অনুপাত বৃদ্ধির কারণে আর্থিক ঘাটতি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবং সে ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে মূল্যহার ও ভর্তুকি উভয়ই বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। ফলে অব্যাহতভাবে ঘাটতি বৃদ্ধির অভিঘাতের শিকার একদিকে দেশের অর্থনীতি, অন্যদিকে ভোক্তাঅধিকার।
চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ ক্ষমতা বৃদ্ধি না হওয়ায় সে ক্ষমতা অনেকাংশে অব্যবহৃত থাকে। ক্ষমতা যতটুকু ব্যবহার হয় ততটুকু ধরে যদি রাজস্ব চাহিদা নির্ধারণ করা হতো তাহলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যয়বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে থাকত। অসাধু ব্যবসা বা দুর্নীতি রোধ করা সহজ হতো। ধারণা করা হয় ২০২৪ সালে প্রায় ৬৭ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অব্যবহৃত থাকবে।
বিদ্যুতের চাহিদার থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্যাপাসিটি অত্যধিক বৃদ্ধি করা হয়েছে বিদ্যুতের রেন্টাল এবং কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে। এখানে কোনো প্রতিযোগিতা নেই। বিদ্যুতের উৎপাদন নেই এবং অপ্রয়োজনীয় এই ক্যাপাসিটির বৃদ্ধিকে উন্নয়ন বলা যায় না। এই ক্যাপাসিটির প্রায় সম্পূর্ণটাই অব্যবহৃত থেকে যায়।
বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অকার্যকর হওয়ায় জ্বালানি খাতে প্রতিযোগিতা নয়, অলিগপলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সরকার উদ্যোক্তা, সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি মনোপলির শিকার। মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা সরকারের পক্ষে ওই কোম্পানিগুলোর মালিক, পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও পরিচালক। ফলে জ্বালানি খাতের আপস্ট্রিম রেগুলেটর হিসেবে মন্ত্রণালয় স্বার্থ সংঘাতযুক্ত এবং অকার্যকর। এমন পরিস্থিতিতে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের লাইসেন্সিরাই বেশি বেশি লুণ্ঠনমূলক মুনাফা লাভের সুযোগ পাচ্ছে। যার কারণে ভোক্তা জ্বালানি অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
চাহিদার তুলনায় উৎপাদন স্বল্পতার কারণে জ্বালানি সরবরাহ বিঘ্নিত ও অনিশ্চিত। মধ্যম আয়ের দেশে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বছরে জনপ্রতি দুই টন অয়েল ইকুইভ্যালেন্ট জ্বালানি খরচ হয়। আমেরিকায় সেখানে খরচ হয় ৮ টন। বাংলাদেশে ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা ছিল ০.৫২ টন। সিটি স্টেট দেশগুলো বিবেচনা না নিলে প্রতি বর্গকিলোমিটারে এক হাজার জনের অধিক জনবসতির কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ঘনবসতির দেশ। এদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ অত্যন্ত সীমিত। চাহিদার তুলনায় জ্বালানি সম্পদও খুব কম। তাই দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জ্বালানি চাহিদা মেটানোর ব্যাপারে এমন অবস্থা মোটেও অনুকূল নয়। (তথ্যসূত্র: কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ‘ক্যাব’ প্রস্তাবিত “বাংলাদেশ জ্বালানি রূপান্তর নীতি ২০২২”)
মুজাহিদুল ইসলাম : শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন