ট্রান্সজেন্ডারিজম নিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মতো পাল্টানোর ব্যাপারটি বিশ্লেষণ করলে বিষয়টা অনুধাবন করতে সহজ হতে পারে। একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০১৪ সালে আমেরিকার মাত্র ১৪% মানুষ সমলিঙ্গের বিয়েতে নৈতিক সমর্থন করত। আশ্চার্যজনক হলে সত্য, মাত্র ৮ বছরের ব্যবধানে (২০২২) তা হয়ে গেল ৬৮%। যেদিন বাইডেন সাহেব শত শত সমকামী গোষ্ঠীর নেতাদের উপস্থিতিতে সমলিঙ্গ বিয়ের বিল রাষ্ট্রীয় ভবনে সাইন করলেন।
৫০ বছর আগে যখন সিনেটর হিসেবে বাইডেন রাজনীতি শুরু করেন তখন সমকামিতা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি এটিকে দেশের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি মনে করেন! ১৯৭৩ সালের দ্য মর্নিং নিউজ (a Delware newspaper) প্রতিবেদন অনুসারে তিনি এভাবে মন্তব্য করে- ‘My gut reaction is that they (homosexuals) are security risks,’ সেই বাইডেন-ই ২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট হয়ে প্রথম দিকে একটি এক্সিকিউটিভ অর্ডার সাইন করে সমকামিতা ইস্যুকে আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম ফোকাসে পরিণত করলেন! ২০২২ সালে সমলিঙ্গের বিয়ের বিল অনুমোদন করার সময় বলেন- ‘Marriage is a simple proposition. Who do you love? And will you be loyal to that person you love?’ the president asked from the South Lawn. ‘It’s not more complicated than that.’
বাইডেনের নতুন নীতির আলোকে আমেরিকার অনুদান বা ফান্ড (যেমন USAID) পেতে সমকামিতা কমপ্লায়েন্ট (compliant) হতে হবে। প্রয়োজনে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাসহ ভবিষ্যতে সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সম্পতি এলজিবিটি তথা সমকামিতা অপরাধ আইন প্রতিষ্ঠার কারণে আমেরিকা উগান্ডার সাথে বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করেছে। বিশ্বব্যাংকও উগান্ডায় ঋণ দেওয়া স্থগিত করেছে সমকামিতা ইস্যুতে।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন সাহেবের কাছে ব্যক্তিগতভাবে এই ব্যাপারটা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে তিনি প্রয়োজনে being bullied, অর্থাৎ মন্দ কথা শুনতেও প্রস্তুত রয়েছেন। সমকামিতা মুভমেন্ট বেগবান করতে তিনি white house-এর ১৫০০ কর্মচারীর ১৪% সমকামী গোষ্ঠী থেকে নিয়োগ দিয়েছেন।
সমকামিতা মতাদর্শ প্রতিষ্ঠায় বিশ্বের একমাত্র চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মুসলিম বিশ্ব এবং এটা ধর্মীয় কারণে। উন্নত দেশের স্ট্র্যাটেজিতে আমাদের দেশের মতো সরাসরি অনেক কিছু উল্লেখ থাকে না। তারা কাজ করে মূলত একাডেমিক্যালি। এমন শব্দের প্যাঁচ থাকে যা সাধারণ মানুষ, উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকরা সহজে অনুধাবন করতে পারে না। গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের মোড়কে সমকামিতাকে প্যাকেট করা হয়েছে। অন্যভাবে বলা যায় গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার সজ্ঞা পরিবর্তন করা হয়েছে।
সময়ের পরিক্রমায় সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটলেও হোমোসেক্সুয়ালিটি প্রশ্নে আমেরিকা রাষ্ট্রীয়ভাবে রক্ষণশীল ভাবধারা ২০০০ সাল পর্যন্ত অক্ষুণ্ন ছিল। ১৯৮৬ সালে জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের এক আইনি লড়াইয়ে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট সমকামিতা অপরাধ আইন বাতিল করে। অর্থাৎ সমকামিতাসংক্রান্ত কার্যক্রম লিগ্যাল হয়ে যায় সেই রাজ্যে।
আমেরিকার লিবারেল আদর্শের ধারক ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ১৯৯৩ সালে স্পেশাল আইন (Don’t Ask, Don’t Tell) পাস করে সামরিক বাহিনীতে জনসম্মুখে সমকামিতাকে নিষিদ্ধের পলিসিগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৯৫ সালে বিয়ের সজ্ঞাকে নির্দিষ্ট করেন আইনের মাধ্যমে। ‘Defense of Marriage Act’-এর মাধ্যমে বিয়ে শুধু একজন ছেলে এবং মেয়ের মাঝেই হবে তা নির্দিষ্ট করা হয়। এই বিলে বাইডেন সাহেব পক্ষে ভোট দেন।
টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের এক আইনি লড়াইকে কেন্দ্র করে (Lawrence V Texas) আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট ২০০৩ সালের সমকামিতা অপরাধ আইনটি বাতিল ঘোষণা করে (ডি-ক্রিমিনালাইজেশন)। এর ফলে পুরো আমেরিকাসহ বিশ্বব্যাপী সমকামিতা আইডেন্টিটি আন্দোলনের নতুন দিগন্তের সূচনা হয়।
এই মুভমেন্ট বেগবান হয় বাইডেনের হাত ধরে। সবাইকে অবাক করে ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে (৬ মে ২০১২) সমলিঙ্গের বিয়ে সমর্থন দানের ঘোষণা দেন! এরপর তিনি প্রেসিডেন্ট ওবামাকে অনুপ্রাণিত করেন পাবলিক স্টেটমেন্ট দেওয়ার জন্য। যে ওবামা সমলিঙ্গের বিয়ের ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি এর পক্ষে সমর্থন করেন (৯ মে ২০১২)।
আমেরিকার নেতৃত্বে সমকামিতা মতাদর্শ (ট্রান্সজেন্ডারিজম/এলজিবিটি) বাস্তবায়নের মাধ্যমে কলোনিয়ালিজম প্রতিষ্ঠা মূল লক্ষ্য। আর এতে বাগড়া বাজিয়েছে পুতিনের রাশিয়া। আমেরিকার নীতিকে (নতুন মোড়কের মানবাধিকার) পরাস্ত করতে তারা গ্রহণ করেছে ট্রাডিশনাল মূল্যবোধ (traditional value defender) রক্ষাকারী হিসেবে। রাশিয়া নীতিগতভাবে এই অবস্থান নেওয়ার মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের সমর্থন অর্জন করবে বলে আশাবাদী।
মজার ব্যাপার হচ্ছে রাষ্ট্রীয়ভাবে নাস্তিক্য মূলনীতির দেশ চায়না কূটনৈতিক কৌশল হিসেবে যোগ দিয়েছে রাশিয়ার শিবিরে। তারাও মুসলিম বিশ্বের সমর্থন চায় নিজের আধিপত্য গড়ে তুলতে। সমকামিতা মতাদর্শ ৭০ দশকের স্নায়ুযুদ্ধের মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি রাশিয়ান সরকার এলজিবিটি মুভমেন্টকে চরমপন্থি আখ্যায়িত করতে সুপ্রিম কোর্টের দারস্থ হয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- প্রায় ২ বিলিয়ন মুসলিমদের জন্য এটি মৌলিক ধর্মীয় তথা ইমানিক ইস্যু। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- মুসলিম বিশ্বে (উন্নয়নশীল) এটা কি প্রতিষ্ঠা করার সম্ভব? হ্যা, অসচেতনতার কারনে এটা আমাদের দেশের দূর্বল আর্থসামাজিক সিস্টেমের বিরাজমান থাকার ফলে ট্রান্সজেন্ডারিজম পশ্চিমা দেশের চেয়ে কম সময়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
তার সাম্প্রতিক কিছু প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। ট্রান্সজেন্ডার নারীকে (আদতে পুরুষ) মহিলা হলে সিট বরাদ্দ করা হতো না, সুন্দরী প্রতিযোগিতায় পুরুষরা নারীর মুকুট নিত না। গণমাধ্যম এমন শিরোনাম (ইয়াছিন আহমেদ সুন্দরী প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় রানারআপ) বানিয়ে সামাজিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারত না।
মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন, পিএইচডি : সহযোগী অধ্যাপক, আইইউবি; সেক্স চেঞ্জ ফিল্ডে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর-এ ৬ বছরব্যাপী পিএইডি গবেষণা করেছেন, দেশে ১১ বছর ধরে জনস্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা করছেন। এই আর্টিকেলের রেফারেন্সের জন্য এই গবেষকের লিখিত বই- ‘সন্তান প্রতিপালনে এ যুগের চ্যালেঞ্জ’ পড়তে পারেন।
মন্তব্য করুন