বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী শেখ ফরিদ। তিনি বর্তমানে পিএইচডি গবেষণা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কানেক্টিকাটে। শেখ ফরিদ এর ফেসবুক পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
‘আমি মাস্টার্স শেষ করেছি ২০১৬ সালে। বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় ২৭ বার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে আবেদন করেছি, ওই প্রক্রিয়ায় গিয়েছি, ভাইভা দিয়েছি। আমি নিজের চোখে দেখেছি কীভাবে এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তা ব্যক্তিরা নিয়োগ বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছে, সেই টাকা দিয়ে সন্তানদের বিদেশে পড়াচ্ছে। আমি দেখেছি কীভাবে নিজের প্রগতিশীল আইডেন্টিটি আর ধর্মবিরোধী অবস্থানকে পুঁজি করে নিয়োগ বাণিজ্য করে এদেশের উচ্চশিক্ষাকে ধ্বংস করে দিয়েছে একটা শ্রেণি। আমি দেখেছি কীভাবে ক্লাসের ৬২তম সিরিয়ালের একজনকে ৩০ লাখ টাকার বিনিময়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে ওই বোর্ডের সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী আখ্যা দিয়ে সেই ৩০ লাখ টাকা হালাল করেছে।
আমি দেখেছি নকল করে পাস করা একজনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে বিকালে এসে এক সেমিনারে শিক্ষকদের আরও নীতিবান হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন এক মহান শিক্ষক। আমি এর আদ্যোপান্ত জানি, ভিতরের এবং অনেক ভিতরের খবর জানি। এগুলো সব আমার অভিজ্ঞতা, স্বচক্ষে দেখা। এগুলো কোনো অপিনিয়ন বা এজাম্পশান না।
তাই আমার দেখার চোখ, বেড়ে ওঠা, আর পর্যবেক্ষণ আপনার সাথে মিলবে না। আমার এই ফেইসবুক আইডি থেকে আমি অভিজ্ঞতাগুলো লিখব। আপনার যদি মনে হয় এগুলো পড়লে আপনার ইমেজ নষ্ট হবে, আপনার ব্যথা অনুভব হবে, বুক চিনচিন করবে, তাহলে আমাকে আনফ্রেন্ড করেন। আপনার যদি মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে মেরিটোক্রেসির বাইরে আর কোনো ফ্যাক্টর কনসিডার করা উচিত, তাহলে আমার কাছে আপনি একটা ৩য় শ্রেণির বলদ। আমাকে আনফ্রেন্ড করেন। উই আর নট সেম, ব্রো।
আমার সাথে যা হয়েছে সেটার কম্পেন্সেশন কোনো কিছু দিয়েই দেওয়া যাবে না। আমি চাই না আপনারা আমাকে সান্ত্বনা দেন, আমি চাই আপনারা এদের হাত থেকে এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষাকে বাঁচাবেন। এদের মন থেকে ঘৃণা করবেন। এদের একমাত্র নেশা টাকা, দুনিয়ার কোনো কিছু দিয়ে আপনি এদের ভয় দেখাতে পারবেন না। এদের বিচারের ভার কেবল আল্লাহর কাছেই রাখতে হবে আপনাকে। এরা অল্প কয়জন, কিন্তু এদের শক্তি এদের অমানবিকতা, এদের শক্তি এদের চেতনার বাক্স।
এরা কেমন ছিল সেটা আমি এদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে জানাতে চাই। এদের কারণে কত মানুষ দেশ ছেড়েছে, নিজের স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিয়েছে সেটা তাদের সন্তান ও এদেশের পরবর্তী প্রজন্মকে জানাতে চাই।আমি শুধু এদের ঘৃণা করি তা না, এদের যত সাঙ্গপাঙ্গ আছে সবাইকে একই কাতারে দেখি। জালিমের হাতকে যারা শক্তিশালী করে তারাও জালিম। এদের অট্টহাসির সাথে যে বহু মানুষের কান্নার আওয়াজ ভাসে, সেটা আপনারা শুনতে না পান, কিন্তু আমি পাই।
আমাকে সান্ত্বনা দিতে আসবেন না, আমি একা না। আমি এদেশের হাজার তরুণের প্রতিনিধি, যারা এদের আর্থিক চাহিদা মেটাতে না পেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারেনি। দেশ ছেড়েছে। আমি চাই এদের মৃত্যুর পর আপনি এদের কবরে থুথু দিয়ে আসবেন। ঘৃণা প্রকাশ করবেন, যাতে অন্যরাও ভয় পায়। অনেকের কাছে এরা সফল ব্যক্তি। কিন্তু আমার কাছে এরা পৃথিবীর নিকৃষ্টতম কীট।
এদের হাত এত শক্তিশালী, সবাই এদের বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পায়। সবাই ভাবে তাহলে আর কখনো শিক্ষক হতে পারবে না। এটা তাদের ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গদেরকে শক্তি দেয়, আবার নতুন করে নিয়োগ বাণিজ্যে নামার সাহস দেয়। কাউকে না কাউকে তো কথা বলতে হবে। দেশের উচ্চশিক্ষাকে বাঁচানোর জন্য লড়তে হবে।
কাউকে না কাউকে নামতেই হবে, কথা বলতেই হবে।
(আমার ব্যাপারে একটু লিখি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স দুটোতেই ফার্স্ট হয়েছি। চাকরি করেছি ব্র্যাকের ইয়াং প্রফেশনাল হিসেবে, প্রকাশনা ৭ টি, IELTS speaking score 7.5, writing score: 7, এছাড়া ৪টি কনফারেন্স প্রেজেন্টেশন আছে। এখন পিএইচডি করছি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কানেক্টিকাট-এ। এখানে ৩টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েট এসিস্ট্যান্টশিপ ছাড়াও আলাদা ৫ বছরের ৩টা ফেলোশিপ অফার পেয়েছি। আমার ব্যাপারে লিখলাম যাতে আপনারা আমার লেখার ব্যাকগ্রাউন্ড বুঝতে পারেন। আর এই যোগ্যতাগুলো একাডেমিয়ার সাথে যায় বিধায় উল্লেখ করলাম)।
শেখ ফরিদ : পিএইচডি ক্যান্ডিডেট ও গবেষণা সহকারী, কানকেটিকাট ইউনিভার্সিটি
মন্তব্য করুন