জন্ম তার ১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদে জমিদার পরিবারে। তার নামের সঙ্গে প্রথম পরিচয় মা-নানিদের মুখে শুনে শুনে। খুব সম্ভবত: মধ্য পঞ্চাশ দশকে বরিশালে একটি সাহিত্য সম্মেলন হয়েছিল। সেখানে প্রয়াত আব্বাসউদ্দীন আহমেদ, কবি গোলাম মোস্তফার সঙ্গে তিনিও এসেছিলেন।
এ সন্মেলনের একটি অধিবেশন বসেছিল বরিশাল জিলা স্কুলের মাঠে। এক দুপুরে দেখি সেখানে যাওয়ার জন্য নানি, মা আর পাড়ার অন্যান্য খালা-চাচিদের মধ্যে সাজসাজ রব। কারণ সে অধিবেশনে বলবেন কবি সুফিয়া কামাল। মায়ের পোঁটলা হয়ে আমার সভাস্থানে গমন ও অধিষ্ঠান। মঞ্চে ফর্সা চশমা পরা আধা ঘোমটা টানা ছোটখাটো মানুষটিকে নিয়ে এতে হইচইয়ের কী আছে বুঝতে পারছিলাম না। আমার মনে আছে, তার ঠোঁটের ওপরে বড় মাসটা দেখে আমার শিশুমন অবাক হয়েছিল।
দ্বিতীয়বার তার দেখা পেয়েছিলাম আরেক সাহিত্য সম্মেলনে- আমি তখন অষ্টম বা নবম শ্রেণির ছাত্র। সাহিত্য সম্মেলন বসেছিল অশ্বিনী কুমার টাউন হলে- আইয়ুবী আমলে যার নামকরণ করা হয়েছিল আইয়ুব খান টাউন হল (আদ্যাক্ষরের পরিবর্তন না ঘটিয়েই)। সবিনয়ে বলি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় দুর্দান্ত বিতর্ক করে শিরোপা জিতেছিলাম। প্রধান অতিথি কবি সুফিয়া কামালকে মুগ্ধ করতে পেরেছিলাম। বিতর্ক শেষে পুরস্কার প্রদানের পরে কাছে ডেকেছিলেন, চিবুক ধরে আদর করেছিলেন, প্রশংসাবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। মোহিত হয়েছিলাম।
তার কবিতার সঙ্গে পরিচয় নবম শ্রেণিতে। ‘সাঁঝের মায়া’ বইটি হাতে এসেছিল। পাঠ্যবইতেও তার কবিতা ছিল। কেমন নরম মায়াময় ছন্দের সোজা সরল অর্থের কবিতা তার। পড়ে ভারী ভালো লাগত- উপভোগ করতাম কবি সুফিয়া কামালের কবিতা। নির্মেদ নিটোল তার ভারী মায়াময় কবিতাগুলো আমাকে টানতে।
ষাটের দশকে তার প্রতিবাদী কণ্ঠ ও কলম প্রতিফলিত হয়েছে নানাভাবে। বাংলা ভাষা আররি হরফে লেখা, রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করা থেকে শুরু করে পাকিস্তানি শাসকদের সব অপপ্রচেষ্টার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার - অবস্থান নিতেন প্রথম কাতারেই। একবার আইয়ুব খান ঢাকায় এসে বুদ্ধিজীবীদের এক সভায় উর্দুতে মন্তব্য করেছিলেন যে, বাংলাদেশের জনগণ হায়ওয়ান (পশু)। কবি সুফিয়া কামাল সঙ্গে সঙ্গে চোস্ত উর্দুতে খান সাহেবকে বলেছিলেন, ‘আপনি তো তাহলে হায়ওয়ানদের ছদর (পশুদের রাষ্ট্রপ্রধান)’। তার পিতৃগৃহে উর্দু বলার রেওয়াজ ছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কবি সুফিয়া কামালের অনন্য অবদানের কথা সর্বজনবিদিত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন। মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে যখন পাকিস্তানের স্বপক্ষে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল, তাতে কবি সুফিয়া কামাল সই করেননি। এমনই ছিল বাংলাদেশ ও বাঙালির প্রতি তার অঙ্গীকার। ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটিতে তার অনন্যসাধারণ অবদানের কথা আমরা সবাই জানি।
আশির দশকের শেষদিকে প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর সঙ্গে একবার কবি সুফিয়া কামালের ধানমন্ডির বাড়িতে গিয়েছিলাম। দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে তখন আমার ‘কড়ি-কড়চা’ নিয়মিতভাবে বেরোচ্ছে। কবি সুফিয়া কামাল সে লেখার প্রশংসা করেছিলেন, বলেছিলেন যে, সে লেখা তিনি নিয়মিত পড়েন। আপ্লুত হয়েছিলাম, মনে আছে।
আজ ২০ নভেম্বর, কবি সুফিয়া কামালের প্রয়াণ দিবস। চব্বিশ বছর আগে ১৯৯৯ সালের এই দিনে প্রয়াত হয়েছিলেন মহীয়সী এই নারী। প্রয়াণ দিবসে খুব করে মনে হচ্ছে যে, আজকের বাংলাদেশে তার মতো মানুষের বড় প্রয়োজন। জননী সাহসিকার দিকনির্দেশনা, চিন্তা-চেতনা ও কর্মযজ্ঞ থেকে আমাদের শেখার বহু কিছু রয়েছে।
ড. সেলিম জাহান : নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক
মন্তব্য করুন