আমার এখানে টেলিভিশন নাই। টেলিভিশন থাকলেও সেখানে বিশ্বকাপের ম্যাচ দেখা যেতো কিনা সন্দেহ। কারণ বেলিজিয়ামে ক্রিকেট জনপ্রিয় কোনো খেলা নয়। তাই ম্যাচ দেখার জন্য ইন্টারনেটই ভরসা।
ম্যাচ দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা লিংক আসল। দেখি বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে লাইভ দেখাচ্ছে। হাজার হাজার ছেলেমেয়ে এই সন্ধ্যায় বিশ্বকাপের ফাইনাল দেখছে সেখানে। এর আগে ফুটবল বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের খেলার দিন এই দৃশ্য দেখা গেছে। সেসব দৃশ্য সারা পৃথিবীর মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। কিন্তু তাই বলে ক্রিকেটের একটা ম্যাচ? তাও বাংলাদেশ সেখানে খেলছেনা? তাও দেশের এরকম একটা দুর্যোগপূর্ণ সময়ে? তাও বিরোধী দলের ডাকা হরতালের দিনে? টিএসসির মতো একটা জায়গায়?
হুম! সম্ভব। একমাত্র ক্রিকেটের পক্ষেই সম্ভব!
ভারত পরিষ্কার ফেবারিট হয়ে ফাইনালে ওঠেছে। ধরে নেওয়া হয়েছিল যে ফাইনালে ভারত জিতবে। তাই ফেসবুক কমিউনিটি মোটামুটি চুপচাপ ছিল। সকাল থেকে ভারতের বিপক্ষে তেমন কোনো স্ট্যাটাস চোখে পড়েনি। তাই বলে এটা ভেবে নেওয়া যাবে না যে, ভারতের সাপোর্টার এখন বেড়েছে। বরং উল্টোটা সত্য! তার প্রমাণ পাওয়া গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই।
যখনই ভারত একটু একটু করে হারের দিকে যাচ্ছিল, খেয়াল করেছেন কিনা জানি না, ভারতের বিরুদ্ধে স্ট্যাটাসের যেন বন্যা বয়ে গেল। সেসব পড়তে পড়তে হাসছিলাম আমি। কারণ গত ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে খুব মনোযোগ দিয়ে ক্রিকেট খেলাটা দেখে অন্তত এ বিষয়ে মানুষের মনোভাব বোঝার মতো সামর্থ্য তৈরি হয়েছে।
ব্যাপারটা এমন না যে, এরা সবাই অস্ট্রেলিয়ার সাপোর্টার। আর বাংলাদেশের ৮০ ভাগ মানুষ এখন অস্ট্রেলিয়াকে সাপোর্ট করে। তাহলে কারণ কি?
প্রথম কারণ হলো- এদের অনেকেই ভারতকে অপছন্দ করে। কেউ রাজনৈতিক কারণে, কেউ ক্রিকেটে ভারতের ‘অযথা’ মাতব্বরির কারণে। ক্রিকেট দুনিয়ায় এই কথাটা ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে যে, ভারত ক্রিকেট থেকে অবৈধ সুবিধা নেয়।
দ্বিতীয় কারণটা হল, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের ব্যাপক প্রভাব। এই প্রভাবকে উপেক্ষা করা যায় না। যেহেতু মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এখন খুবই সীমাবদ্ধ, ফলে মানুষ ক্রিকেটে ভারতকে অপছন্দ করার মধ্য দিয়ে তার ঘৃণা বা অপছন্দ প্রকাশ করে।
তৃতীয় কারণ হল, ভারত বিরোধী একটা সমর্থন গ্রুপ সবসময় ছিল। ক্রিকেটে পাকিস্তানের বিরাট এক ফ্যান-বেইজ আছে বাংলাদেশে। পাকিস্তানি সাপোর্টাররা কখনোই ভারতকে সমর্থন করবে না। ভারত যত ভাল খেলুক কিংবা বিরাট কোহলি ওয়ানডেতে ১০০টা সেঞ্চুরি করলেও!
বিশ্বকাপে ব্যর্থতার কারণে শ্রীলংকার ক্রিকেট টালমাটাল। বহিষ্কার-পূন:বহিস্কারের খেলা চলছে। আইসিসি শ্রীলংকার সদস্য পদ স্থগিত করে বসে আছে। সে নিয়ে ওদের এখন সংসদ উত্তাল। রানাতুঙ্গা বলেছেন, শ্রীলংকার ক্রিকেটকে ভারতের ক্রিকেট বোর্ডের সদস্যসচিব জয় শাহ ধ্বংস করে দিয়েছে। এই জয় শাহ হলো ক্ষমতাসীন বিজেপির সেকেন্ড ম্যান, স্বরাষ্টমন্ত্রী অমিত শাহর পুত্র। শুধু রাজনৈতিক লেনদেনে বনিবনা হল না বলে গাঙ্গুলিকে ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি থেকে সরতে হল। অথচ জয় শাহ গাঙ্গুলিরই রানিংমেট ছিল। নিজেদের পিঠ বাঁচাতে তাড়াহুড়ো করে দুইজন সংসদ সদস্য সংসদে দাঁড়িয়ে সরকারের পক্ষ থেকে জয় শাহ’র কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।
পাকিস্তানের অবস্থা তো আরও করুণ। বিশ্বকাপে ব্যর্থতার কারণে অধিনায়ককে বহিষ্কার করে বোর্ড আপাতত গা বাঁচিয়েছে। ইমরান খান নামের যে রাজনৈতিক ফিনিক্স, যাকে ঘিরে এখন পাকিস্তানের রাজনীতি আবর্তিত; ওনিতো ক্রিকেটারই। পাকিস্তানের ক্রিকেট, সেখানকার বোর্ডের কাজকাম আর টকশো’তে চোখ রাখলে জানা যাবে, ওখানকার সাবেক ক্রিকেটারদের ক্ষমতা কতটুকু! বলা হয় যে, পাকিস্তান চালায় দুই গ্রুপ, এক ক্রিকেট আর দুই, জেনারেল।
শুধু রাজনীতি না, অর্থনীতিতেও দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রিকেট মহা শক্তিশালী এক বস্তু। বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের শেয়ারবাজার চাঙা হতে শুরু করেছে। বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার তিন মাস আগেই ভারতের শেয়ারবাজারের সূচক ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
ভারতের যে শহরগুলোতে খেলার ভেন্যু পড়েছে, সেখানে বিমানের ভাড়া দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আহমেদাবাদগামী বিমানের টিকিটের দাম ৪১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এই বিশ্বকাপ ভারতের অর্থনীতিতে প্রায় ২৬০ কোটি ডলার যোগ করেছে। উৎপল শুভ্রের এক কলামে পড়লাম, যেখানে বিশ্বকাপের ম্যাচ হচ্ছে, সেখানে হোটেলে থাকার জায়গা নেই। ভাড়া বেড়েছে কয়েক গুণ। হোটেলের ম্যানেজার একটা টিকেটের জন্য সাংবাদিকদের কাছে ধর্না দিচ্ছেন।
দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রিকেট কোনও ফেলনা বস্তু না।
ভারতে খেলা হলে শুধু টেলিভিশনে ম্যাচ সম্প্রচারণের স্বত্ব বিক্রি করে ভারত যে টাকা আয় করে সেটা ধারণার বাইরে। ক্রিকেট থেকে সারা দুনিয়া যে পরিমাণ টাকা আয় করে, তার ৯০ ভাগ দখলে থাকে ভারতীয়দের। ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারতের ক্রিকেট বোর্ড কত টাকা আয় করেছে জানেন? ৭৭ কোটি ডলারের বেশি! আইপিএলে গত পাঁচ বছরে বিসিসিআইয়ের খেলোয়াড়দের সঙ্গে চুক্তি করা অর্থের পরিমাণ ছিল ৬২০ কোটি ডলার।
বাংলাদেশের মতো নিচু স্তরের ক্রিকেট খেলা দলেরও ব্যাংকে নাকি ১০০০ কোটি টাকার বেশি জমা আছে। অথচ এই দল আজ পর্যন্ত একটা ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টের ট্রফিও জিততে পারে নাই। তাহলে এত টাকা হলো কী করে? এর মূল কারণ জনসমর্থন। চাহিদা আর জোগানের থিউরি। এই দেশের শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই এখন ক্রিকেট বোঝে। খেলা থাকলে টেলিভিশনের সামনে গিয়ে বসে থাকে। সারা দেশ প্রায় অচল হয়ে যায়। বিজ্ঞ মতামত দেয়। মাহমুদুল্লাহকে বাদ দিলে ফেসবুক ক্ষোভে উত্তাল হয়। ক্রেতা থাকলে পণ্যের উৎপাদনতো থাকবেই। তাই না?
অথচ মেয়েরা গত ১০ ম্যাচে ৮ টা খেলায় জিতেছে। পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ জিতেছে। সেই মেয়েদেরই গত ৬ মাস ধরে বেতন হয় না। কেন হয় না জানেন? কারণ ওই খেলার চাহিদা নাই। এক বছর বেতন না হলেও সেটা কেউ জানবে না। জানলে ভ্রুক্ষেপ করবে না। প্রধানমন্ত্রী জানেন, তামিম রাগ করে অবসর নেয়ার পর তার পোস্ট করা ভিডিও দেখে কত কোটি মানুষ বিক্ষুব্ধ হতে পারে। তামিমের রাগকে সরকারের ব্যর্থতার সমার্থক ধরা হয়। তাই তাড়াহুড়ো করে তামিমের ডাক পড়ে রাজালয়ে। ‘হ্যাপি ফ্যামিলি’র ছবি পোস্ট করার দরকার হয়।
তাই সামি কিংবা রিয়াসাদ আজিমদের একেকটা ভিডিওতে লাখো ভিউ। একটা ম্যাচের সামারি দিয়ে ৩/৪টা ভিডিও বানায়। সেসব ভিডিওর নিচে লাখ লাখ ভিউ। ভিউ মানে টাকা। এই ভিউ ভূতপ্রেত বা অদৃশ্য কোনও বস্তু নয়, রক্ত-মাংসের মানুষের ভিউ। ক্লিল করছে এদিকে, ওদিকে রিয়াসাদ আজিমের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফুলে উঠছে।
ক্রিকেট যেখানে, তাই এখন মিডিয়া সেখানে। তাই, সাকিব আল হাসানের সাবেক প্রেমিকা যখন সেলিব্রেটি ক্রিকেট লীগে খেলেন, সেখানে ধারাভাষ্যকার খুবই নগ্নভাবে তাকে দুনিয়ার মানুষের সামনে পরিচয় করিয়ে দেয়। তিন মিনিট ধরে একজন মানুষের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কচলাকচলি চলে। কারণ এটাই স্ক্রিপ্ট, এই অংশটুকুর ভিউ বেশি আসবে, স্পন্সর বেশি পাওয়া যাবে।
যারা দেখছে, তাদের অধিকাংশই তরুণ। বাংলাদেশের তরুণদের ৯৯ ভাগ শ্রীলংকার রাজনীতি নিয়ে একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারবে কি না সন্দেহ! ওরা বলতে পারবে না, এই মুহূর্তে ওখানকার প্রেসিডেন্টের নাম কি? কিন্তু অন্তত ৭০ ভাগ তরুণ বলতে পারবে এ্যাঞ্জেলা ম্যাথিউজের ভাইয়ের নাম কি? কারণ সে সাকিব আল হাসানের দিকে পাথর ছুড়ে মারার হুমকি দিয়েছিল।
খেয়াল করে দেখেছেন, মুম্বাই, ব্যাঙ্গালুরুর, দিল্লি বা কলকাতাকে বাদ দিয়ে এবারের ফাইনাল হল আহমেদাবাদে? কেন হল? কারণ এই স্টেডিয়াম নরেন্দ্র মোদির নামে। এখানে এ রকম এক আসরের ফাইনাল হওয়া মানে, সারা দুনিয়াব্যাপী মোদি নাম আরও আরও বেশি করে জপতে থাকা। মোদি ব্র্যান্ড আরও দূর বহুদূরে ছড়িয়ে পড়ে...
ভারত হারার পর কি হবে জানি না, কিন্তু জিতলে কি হত সেটা শশী থারুরের এক লেখা থেকে তুলে দেওয়া যায়। ‘‘বিশ্বকাপে যদি ভারত চ্যাম্পিয়ন হয়, তাহলে সন্দেহাতীতভাবে প্রধানমন্ত্রী মোদির মুকুটে আরও একটি বিজয়-পালক যুক্ত হবে। এটিকে ভারতের উত্থানের একটি ধাপ হিসেবেও প্রচার করা হবে। আর ভারতের পরাজয় হলে ভারতীয় দলে ১৫ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে যে দুজন মুসলমান আছেন, তাদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠা ও দেশপ্রেমের অভাব থাকার অভিযোগ নেমে আসবে।’
তাই দক্ষিণ এশিয়ায়, ক্রিকেটকে আমার কাছে আফিম মনে হয়। মনে হয় এক ভয়ানক নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা ২০০ কোটির জনপদ। যাদের দিয়ে সবকিছু করে ফেলা সম্ভব। মনে হয়, কোনও এক মহাবিপ্লবের মাঝপথে যদি একটা স্ক্রিন জোগাড় করে সেখানে একটা ক্রিকেট ম্যাচ চালিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে সবাই বিপ্লব থামিয়ে ক্রিকেট দেখবে। আর প্রতিপক্ষ এসে সেই বিপ্লবীদের কচুকাটা করবে।
তাই ক্রিকেট বোধহয় এখন আর শুধু ক্রিকেটারদের খেলা নয়..বরং অনেক বেশি সমর্থকদের খেলা। মাঠে কি আর খেলা হয়, তারচেয়ে ঢের বেশি খেলা হয় মাঠের বাইরে। আবেগে, জুয়ায়, ভালোবাসায়। তাই আজ ভারতে হওয়া ফাইনালের গ্যালারি দেখেছেন? নায়িকাদের ভিড়ে বেশ উষ্ণ গ্যালারি। কে ছিল না সেখানে? আসতেই যে হবে। কারণ, নাম-যশ-খ্যাতি সব এখন এখানে। সেঞ্চুরির অর্ধশতক করে বিরাট যতটা আলোচনায় থাকেন, তারচেয়ে বেশি থাকেন বিরাট পত্নী আনুশকা। স্বামীর সাফল্যে সেলিব্রিটি স্ত্রীর কতটা অবদানন সেটা দাম্পত্যের অন্দরে এখন অবশ্যপাঠ। বছর পাঁচেক আগেও এসব ভাবা যেত?
তাই ওয়েস্ট ইন্ডিজের এক বিখ্যাত বিশ্লেষকের একটা লাইন মনে পড়ে গেল। এটা দিয়ে এই লেখাটা আপাতত শেষ করি। তবে এই ক্রিকেট নামের আফিম নিয়ে বড়সড় গবেষণা হওয়া দরকার। কেউ হয়তো করবেনও কোনওদিন।
লাইনটা হল, ‘যে শুধু ক্রিকেট বুঝে, সে ক্রিকেটের কি বুঝে?’
রাজু নুরুল : উন্নয়ন সংগঠক, বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে ‘উন্নয়ন নীতিপরামর্শ’ বিষয়ে অধ্যয়নরত
মন্তব্য করুন